নাজমুল ইসলাম মকবুল
নাজমুল ইসলাম মকবুল
বর্তমান যান্ত্রিক যুগ। প্রগতি ও আধুনিকতার যুগ। কর্মব্যস্থ মানুষের ব্যস্থতা যেমন বেড়েছে তেমনি যে কোন কাজ স্বল্প সময়ে স্বল্প শ্রমে দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে। আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ অতীতের ঐতিহ্যবাহী অনেক অনেক জিনিসপত্রের ব্যবহার বা কর্মকান্ড যা তাদের জীবনাচারের সাথে ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা পরিত্যাগ করেছে কিংবা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। এজন্য কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই বরং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং সময় বাচাতে অতীতের অনেক কিছুই পরিত্যাগ করতে হয়।
তখন অতীত হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ। কিন্তু আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবেনা। জানা এবং পরবর্তী প্রজন্মকেও জানানো প্রয়োজন। অতীতকে জেনেই ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সুফল লাভ হয় সহজ। আমাদের অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য সমাজ সংস্কৃতি ইত্যাদি যাতে ভুলে না যাই এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে জানতে পারেন সেজন্য ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেছি ‘‘চিরায়ত বাংলা’’।
চিরায়ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ হচ্ছে আমাদের অতীতের বহুল ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় সমাজ সংস্কৃতির অংশ অধুনালুপ্ত ‘‘ঢেকি’’ শিল্প।
আগেকার যুগে প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই ধান বানার জন্য ডেকি থাকত এবং গাইল ছিয়াতো থাকতই। বর্তমানে নিতান্ত অজো পাড়া গায়ের কোথাও কোথাও হয়ত ঢেকী থাকতেও পারে এবং গাইল ছিয়া এখনও প্রায় ঘরে থাকলেও এসবের ব্যবহার প্রায় বিলুপ্তই বলা চলে। ঢেকিছাটা চাউলের কদর এখনও কমেনি কারন এ চাউলের ভাতের মজাই আলাদা। ঢেকী ছাটা চাউলের উপরের আবরন বা খোসা অুন্ন থাকে যাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন রয়েছে।
তাই ঢাকার ও বিভিন্ন শহরের অভিজাত দোকান গুলোতে এখনও ঢেকীছাটা চাল পাওয়া যায় এবং এর দামও অন্যান্য চালের চেয়ে তুলনামুলকভাবে বেশি।
ঢেকি শিল্প গ্রাম বাংলার প্রাচীন গ্রামীন ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ। এক সময় গ্রাম গঞ্জসহ সর্বত্র ধান ভাঙ্গা, চাল তৈরি, গুড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙ্গানো সহ বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী ঢেকি। তখন এটা গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ছিল ওতপ্রোতভাবে। অনেকে কুটির শিল্প তথা পেশা হিসেবেও ঢেকিতে ধান বানতেন।
ঢেকি চালাতে সাধারনত দুজন লোকের প্রয়োজন হয়। এেেত্র সাধারনত মহিলারাই চালাতেন তাদের সাধের ঢেকি। একজন ছিয়া সংযুক্ত যা বড় কাটের সাথে লাগানো থাকে তার এক প্রান্তে উঠে যার পাশে হাত দিয়ে ধরার নির্দিষ্ট খুটি ও লটকন থাকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পা দিয়ে চাপ দিতে হয় আবার ছাড়তে হয়। অপরজন নির্দিষ্ট গর্তে যেখানে ছিয়ার আঘাতে চাল থেকে ধান বের হয় সেখানে সতর্কতার সাথে ধান দিতে হয় আবার প্রতি আঘাতের পর পর ধান নড়াচড়া করে উল্টে পাল্টে দিতে হয় যাতে সবগুলোতে আঘাত লাগে। শেষ হলে বা গর্ত পরিপূর্ণ হয়ে গেলে এগুলো তুলে আবার নতুন ধান দিতে হয়।
মহিলারা ধান বানার ফাকে ফাকে আঞ্চলিক গীত পরিবেশন করতেন মনের আনন্দে একক বা যৌথ কন্ঠে। যেমন ‘‘ও ধান বানরে....... ঢেকিতে পাড় দিয়া, পিংকী নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া ও ধান বা..........নরে, ধান বেচিয়া কিনমু শাড়ী পিন্দিয়া যাইমু বাপর বাড়ী, স্বামী যাইয়া লইয়া আইব গরুর গাড়ী দিয়া ও ধান বা.........নরে ’’। আবার ধান ভাঙ্গা ও চিরাকুটার বিভিন্ন প্রবচনও বিভিন্ন জায়গায় শুনা যেত যেমন ‘‘চিরা কুটি, বারা বানি, হতিনে করইন কানাকানি, জামাই আইলে ধরইন বেশ, হড়ির জ্বালায় পরান শেষ’’।
আমাদের দেশে সত্তরের দশকে সর্বপ্রথম রাইসমিল বা যান্ত্রিক ধান থেকে চাল বের করার কল বা মেশিন এর আবির্ভাব হয়। তখন থেকেই ঢেকির প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে।
এক সময় সারা দেশে বার মাসে তের পার্বণ পালিত হত। গ্রামে গঞ্জে একটার পর একটা উৎসব লেগেই থাকত। হেমন্ত উৎসব, পৌষ পার্বণ, বসন্ত উৎসব, নববর্ষ, বিবাহ উৎসব, কনের বাড়ীতে আম কাঠলী প্রদানের সময় হাতের তৈরী রুটি পিঠা তৈরির উৎসব, হিন্দুদের পূজা, মেলা সহ হরেক রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন হত বা এখনও হচ্ছে। এসব উৎসবে পিঠা পায়েস সন্দেস ইত্যাদি তৈরির ধুম পড়ে যেত। আর এসব তৈরীর মূল উপকরন হচ্ছে চালের গুড়ি।
চালের গুড়ি তৈরীর জন্য অতীতে ঢেকী বা গাইল ছিয়ার আশ্রয় নেয়া হত। ঈদ বা উৎসবের সময় ঘনীভুত হয়ে এলে প্রত্যেক বাড়ীতেই ঢেকি ও গাইল ছিয়ার ছন্দময় শব্দ শুনেই আন্দাজ করা যেত ঈদ বা উৎসব এসেছে। গ্রাম বাংলার শৌখিন মহিলারা চালের গুড়ি দিয়ে চই পিঠা, চিতল পিঠা, ঢুপি পিঠা, রুটি পিঠা, ঝুরি পিঠা, চুঙ্গা পিঠা, তালের পিঠা, পাড়া পিঠা, পাটি বলা, হান্দেস, নুনগরা সহ তৈরী করতেন হরেক রকমের পিঠা। কিন্তু বর্তমান আধুনিক এ যান্ত্রিক যুগে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উৎসবে আর অতীতের মতো জৌলুস নেই। উৎসবগুলো আজকাল একমাত্র প্রথা বা রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছে।
একটা সময় ছিল বড় গৃহস্থ বা কৃষকের ঘরে অবসর সময়ে বা রাতের অধিকাংশ সময়ই ঢেকিতে বা গাইল ছিয়ার মাধ্যমে ধান বানার কাজ করতে হতো। ধান বানতে বানতে অনেক মহিলার হাতে ফুসকা পড়ে যেত। এভাবে ফুসকা পড়তে পড়তে হাতে কড় পড়েও যেত। গরীব মহিলারা বা গৃহ পরিচারিকারা এক আধসের চাল বা ধান পারিশ্রমিকের মাধ্যমে কেহবা শুধু পেটপুরে খাবার বিনিময়ে ধনীদের ঘরে চাল কুটার কাজে নিয়োজিত থাকতো। যে গৃহস্থ যতো বেশি ধান বা চাল উৎপাদন করে বিক্রয় করতে পারতেন তিনিই এলাকায় ততো বড়ো ধনী হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করতেন।
তাই বড়ো বড়ো গৃহস্থের বাড়ীতে ঢেকিতে চালা বানার আওয়াজ তথা ঢেকুর ঢেকুর শবন্দ শুনা যেত হরদম।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢেকির ছন্দময় শব্দ। এখন শুধু চাল নয় মশলাপাতিও মেশিনের মাধ্যমে কুটানো হয়। পাটা পুতাইলের (শিল-পাটা) ঘষায় যে মরিছ পিষা হতো তাও এখন বিলুপ্ত প্রায়। তাইতো ‘‘পাটাখান বিছাইয়া, মরিছও পিসাইলিগো সই, যেই পিসানি মোরে পিসাইলি’’ এ ধরনের গানও তেমন একটা শুনা যায়না।
মহিলাদের আরামের পরিধি বেড়েছে, বেড়েছে আধুনিকতা ও আধুনিক যান্ত্রিক জীবন যাপন। গ্রামের দু এক বাড়ীতে ঢেকি ও গাইল ছিয়ার অস্তিত্ব থাকলেও এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। অমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো যাদুঘরে গিয়ে জানতে হবে ঢেকি কী এবং এর মাধ্যমে কোন ধরনের কাজ করা হতো।
লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।
ঊসধরষ: হধুসঁষংুষযবঃ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল নং ০১৭১৮৫০৮১২২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।