আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলুপ্তির পথে হেরিটেজ সুন্দরবন

গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রধানতম উপকরণ বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডে ছেয়েছে গোটা বিশ্ব (৬১%)। এর প্রভাবে গোটা পৃথিবী ফুটছে আগুনের মতো। একেই বলা হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন। এরই প্রভাবে মেরুপ্রদেশের জমাট বরফও গলতে শুরু করেছে। আশঙ্কা, সমুদ্রের জলস্তর উঁচু হওয়ায় এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের প্রান্তে থাকা হেরিটেজ সুন্দরবন আগামী তিন-চার দশকের মধ্যে জলের তলায় নিশ্চিহ্ন হতে পারে।

কয়েকদিন আগে দরকারি কাজে সুন্দরবন আসতে হয়েছিল আমাকে। বিকেলের অবসরে গোসাবা ব্লকের পাখিরালা গ্রামে বাবুরামের চায়ের দোকানে এটা সেটা আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎই ‘ইউনিসেফ’-এর উপরোক্ত আশঙ্কার কথাটা মুখ ফসকে বলেই ফেললেন দমদম থেকে বেড়াতে আসা এক শিক্ষক। ব্যাস বাবুরাম তো সুন্দরবন জলের তলায় চলে যাবে শুনেই ভয়ে কাঁটা। পাশেই ছিলেন পাখিরালা ফিশারিজ অ্যান্ড এগ্রিকালচার ওয়েলফেয়ার সোসাইটির গোপাল বর্মন।

এখানে কলকারখানাই নেই, দূষণ হচ্ছে কি করে? প্রশ্ন তাঁর। দূষণ বলতে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে দ্বীপের হোটেলগুলিতে সারারাত জেনারেটরের ভটভট শব্দ। তাঁকে বোঝাতেই হল যে, জঙ্গলের গাছ কেটে বনের আয়তন কমিয়ে দেওয়া, বাদাবনের গাছ কেটে ৫৪টি দ্বীপে জনবসতি গড়ে তোলায় কম দূষিত হয়নি সুন্দরবন। তার উপর পর্যটকদের সেবায় সারা বছর ধরে ২৪ ঘন্টা ধরে চলছে কাটা তেলের জেনারেটর। সেটা যে কত দূষণ ছড়ায়! আসলে দোষটা সুন্দরবনবাসীর একার নয়।

ক্ষতিকারক জীবাশ্ম জ্বালানি ও গ্রিন হাউস গ্যাসের ৯৭ শতাংশই তো বিশ্বের উন্নত বড় দেশগুলির দান। এর জেরে বাড়তে বাড়তে গত দুই দশক থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রভাবে সুন্দরবনের সামুদ্রিক জলস্তর বছরে ৩.১৪ মিমি করে বেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৪টি দ্বীপ – সুপারিডাঙা, কাবাসগাছি, বেডফোর্ড, লোহাচারা তো উপগ্রহের ছবি থেকেই মুছে গেছে। নতুন করে আয়লা না এলেও, উষ্ণায়নের কারণে সেদিন জলস্তর প্রতি বছরে ১ মিটার বাড়তে শুরু করবে সেদিন এমনই জলের তলায় চলে যাবে আমাদের গর্বের সুন্দরবন।

গোসাবা দ্বীপের যে গ্রামেই গেছি, শুধু ধু ধু করছে ফাঁকা মাঠ। ২০০৯ সালের ২৫ মে-র আয়লার তাণ্ডবের পর থেকেই মাঠে ধানচাষ বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, মাঠে সাদা হয়ে ফুটে উঠেছে আয়লার নুন। উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গোসাবা, ক্যানিংয়ের প্রতিটি পুকুর ও খালের জলেও এতটাই নুন বেড়ে গেছে যা চাষের কাজে ব্যবহারের অযোগ্য। ফলে, আয়লা পরবর্তী সুন্দরবনে চাষ যেমন মার খেয়েছে তেমনই বিপন্ন হয়ে পড়েছে মিষ্টি জলের মাছ চাষ।

বাদাবনের প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী, গরান গাছও মাটিতে নুন বেশি হয়ে যাওয়ায় শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। শুধু, সুন্দরীই নয়, অনেক ম্যানগ্রোভ প্রজাতিই ক্রমবিলুপ্তির পথে। মাটির এই নুন দূর না হলে কিভাবে বাঁচবে আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবন, এটাই এখন বাবুরাম-দের প্রশ্ন। একদিকে উষ্ণায়নের থাবা, অন্যদিকে আয়লার নুন – দুয়ের সাঁড়াশি চাপে ভেঙে পড়েছে গোটা সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র। গোপাল বর্মন যতই বলুন যে, দূষণ কমাতে সুন্দরবনকে ‘নো প্লাস্টিক জোন’ করে তোলার প্রকল্প অনেকটাই হয়তো সফল কিন্তু পরিস্থিতির বিপন্নতা আরও গভীরে।

সমুদ্রে জলের তাপ বেড়ে যাওয়ায় কমতে শুরু করেছে সবথেকে নিচের স্তরে বসবাসকারী প্ল্যাঙ্কটনের পরিমান। জু প্ল্যাঙ্কটন ও ফাইটো প্ল্যাঙ্কটন বিপন্ন। আয়লা, ভারত মহাসাগরে সুনামির পর খাবারের অভাবে বিলুপ্তির পথে সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছেদের বহু প্রজাতি। অনেক জলজ প্রাণী আবার অন্যত্র চলেও গেছে। বনের গাছ অবাধে কেটে ফেলায় একদিকে তৃণভোজীদের খাবারে ঘাটতি ঘটছে।

অন্যদিকে, বিচরণভূমি কমে যাওয়া ও খাদ্যের অভাবে বাঘ প্রায়ই হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও খাদকের এক অদ্ভূত সঙ্ঘাত। একইসঙ্গে, বনজ ও জলজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকাও হয়ে পড়েছে বিপন্ন। ফলে, জনবসতির বিরাট অংশ জীবিকার টানে অন্যত্র চলে যাওয়ায় সুন্দরবন হয়ে পড়ছে জনশূন্য। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবন।

গত ৩০ বছরে সুন্দরবন হারিয়েছে ১৬৪ বর্গকিমি জমি। নতুন চর জেগেছে ৮৬ বর্গকিমি। দূষণের প্রভাবেই প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০টি প্রাণী ও গাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন থেকে। সবথেকে বড় কথা, সুন্দরবনের টিকে থাকার বিষয়টি মূলত নদীবাঁধের ওপর নির্ভরশীল। অতীতে, ব-দ্বীপ গঠনের প্রক্রিয়া চলার ফাঁকেই এখানকার ৫৪টি দ্বীপের বাদাবন কেটে গড়ে তোলা হয়েছে জনবসতি।

ফলে, দ্বীপগুলিকে রক্ষার জন্য যে ‘ঘের’ বা বাঁধ (৩৫০০ কিমি) দেওয়া হয়েছে তাতেও থেকে গেছে গলদ। সমুদ্রের জলতলের বছর বছর বৃদ্ধি, নদীর বুকে পলি জমে নাব্যতা কমে যাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আয়লায় নদীবাঁধ ভেঙে যাওয়ার বিষম পরিস্থিতি। আয়লার ধাক্কায় ৪০০ কিমি নদীবাঁধ ভেঙেছে। ৫০০ কিমি নদীবাঁধের উপরিভাগ নিশ্চিহ্ন। গোসাবা ব্লকের বাসিন্দা স্বপন চ্যাটার্জি নদীবাঁধ এত ভাঙনপ্রবণ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

জমিদারি আমলে অবৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত নিয়ম না মেনেই গড়ে উঠেছিল বাঁধ। নদীবাঁধ তৈরিতে যে মাটি ব্যবহৃত হয় তা বাঁধ তৈরির উপযুক্ত নয়। নদীবাঁধের সামনের বাদাবন ধ্বংস হয়ে গেছে বলে বাঁধে ঢেউয়ের ধাক্কা সরাসরি এসে লাগছে। নদীবাঁধের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে সেচ দফতরের গাফিলতির কথা‍ও স্বীকার করলেন তিনি। অতএব, ইউনিসেফের মতোই এখন আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে সুন্দরবনের মানুষ।

পাখিরালা গ্রামের গোপাল বর্মন বলেই দিলেন, আগামী ভাদ্র মাসের ষাঁড়াষাঁড়ি কোটালের বানের আগে যদি নদীবাঁধ মেরামত না হয় সেক্ষেত্রে নতুন বিপদ ঘটতেই পারে। দু' দশক বাদে হয়তো পরবর্তী প্রজন্মকে গল্প শোনাতে হবে, বঙ্গোপসাগরের কাছে ছিল সুন্দরবন নামে এক বিরাট অরণ্য, জল-জঙ্গল। সেখানে থাকত ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখতে ডোরা কাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.