আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপন্যাস - নিষিদ্ধ জ্যোৎস্না - পর্ব -০১

জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই দুই চুপচাপ শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না। পাশে মেজ ভাইয়া নাক ডাকছে। নাক ডাকার শব্দটা খুব বিশ্রি - ফুরুৎ ভোস, ফুরুৎ ভোস। রাত কমপক্ষে দেড়টা হবে।

চারপাশ নির্জন। ঘড়ি দেখব সে উপায় নেই। এক সপ্তাহ আগে হাত ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। হাতে অতিরিক্ত টাকা না থাকায় ঠিক করাতে পারছি না। এই দুরবস্থার মধ্যে পিকনিকের ঝামেলায় না-যাওয়াই ভালো।

মুন্না যেভাবে গোঁ ধরেছে, তাতে পাশ কাটানো মুশকিল। আচ্ছা, মুন্না কি লুনাকে দেখে ফেলেছে নাকি ? ও যদি ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে বলে বেড়ায়, তবে সর্বনাশ। কিন্তু ও যা বলে বেড়াবে, তা তো মিথ্যে নয়। লুনা যখন জানালায় এসে দাঁড়ায়, আমার ভীষণ অন্য রকম লাগে। বুকের মধ্যে হাজার মৌমাছি গুনগুনিয়ে ওঠে।

মাথার মধ্যে অজ¯্র স্বপ্ন সজ্জিত হয়। লুনা চমৎকার মেয়ে। ছিমছাম গড়নের ফর্সা কিশোরী। ক্লাশ এইটে পড়–য়া মেধাবী ছাত্রী। বছরখানেক আগে এক বিকেলে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে জানালা খুলে দেখি, গলির বিপরীত দিকের দোতলার জানালায় একটি ফর্সা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি চট করে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যেন এই মেয়ে এবং জানালা একটি চমৎকার চিত্রকর্ম। মেয়েটির ছোঁয়ায় জানালাটি পেয়েছে জীবন। যে জীবন সুন্দরের ভাষায় কথা বলে। সেই থেকে শুরু।

প্রতিদিন লুনাকে দেখি। ওকে না দেখলে মনে হয় দিনটা বৃথা। সব কাজের শেষে মনে হয়, কী যেন করা হল না। লুনাও নিশ্চয়ই আমাকে দেখে। মাঝে মাঝে ওকে বন্দী রাজকন্যা মনে হয়।

আর আমি ভীন দেশী এক রাজপুত্র। কিন্তু এ রাজপুত্র খুবই ভীতু। রাজকন্যাকে উদ্ধার করার সাহস তার নেই। আচ্ছা, একবার সাহস করে কি কিছু বলব ? না, থাক। কাজ নেই ঝামেলা বাড়িয়ে।

আমরা একতলার মানুষ। দোতলার মানুষের সহচার্যের আকাঙ্খা আমাদের জন্য এক প্রকার বেয়াদবি। কিন্তু পনিরকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। কারণে অকারণে লুনাদের বাসায় যায়। লুনার ছোট বোনটিকে কোলে করে নিয়ে আসে।

বাচ্চাদের মতো ঐ বাচ্চার সাথে খেলে। আর মাঝে মাঝে বক বক করে - লুনারা তিন বোন। বাবা এডভোকেট। এক চাচা থাকে আমেরিকায় ইত্যাদি। পনিরও ক্লাস এইটের ছাত্রী।

কাজেই লুনার সাথে বন্ধুত্ব হওয়াটা স্বাভাবিক। খাটের তলায় খুটখুট শব্দ হচ্ছে। নিশ্চয়ই ইঁদুর। উঠে আলো জ্বাললাম। সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দ উধাও।

পনির ঘুমিয়েছে পাশের খাটে। মাথার কাছে একটা সস্তা লাভ স্টোরি। পড়তে পড়তে বোধ হয় ঘুমিয়েছে। কোথায় যে পায় এসব ? একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে। ইদানিং পনির বদলে যাচ্ছে।

কিছু দিন আগেও আমার সাথে কত গল্প করত। বিকেলে এক সাথে ঘুমাত। আজকাল ঘুমায় না। তেমন গল্পও হয় না। ও বড় হচ্ছে তো।

বড় হলে মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। মাঝে মাঝে রাত দুপুরে আমার কবিতা লেখার তৃষ্ণা হয়। তখন অকারণেই কবিতা লিখি। আচ্ছা, আজ পনিরকে নিয়ে একটা কবিতা লিখলে কেমন হয় ? হ্যা, লিখব। ওকে নিয়ে একটা কবিতা লিখব এক্ষুণি।

আমি কবিতার খাতা খুললাম। প্রথম কবিতাটা খুব চমকপ্রদ। ‘এই যে শোন সুমী হৃদয়ের মাঝে তুমি। ’ রবীন্দ্রনাথের ‘প্রার্থনা’ কবিতা পড়ে তখন মনের মধ্যে অদম্য ইচ্ছা কবিতা লেখার। সে সময় একটা ঘটনা ঘটল।

আমাদের একটা নতুন ভাড়াটে এল। ওরা দু’ ভাইবোন। সুন্দর সুখী সংসার। মেয়েটি চটপটে। আমার এক বছরের জুনিয়র।

স্বভাবতই আমার মনে রং ধরল। আমার অবেলার প্রেম আর কি । এক দিন বিকেলে আদাজল খেয়ে কাব্যচর্চায় লেগেছি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বেরুল কেবল মাত্র দু’টি লাইন। কখন যে সুমী এসেছে টেরও পাই নি।

ছোঁ মেরে খাতাটা নিয়ে বলল, ‘কী করছেন, রঞ্জু ভাই ?’ ‘আহ, খাতাটা দাও তো। ’ সুমী কি আর আমার কথা শোনে ? এক দৌড়ে ওদের ঘর। আমি মনে মনে খুশি। সুমীকে কিভাবে কবিতাটা দেব, তা-ই ভেবে পাচ্ছিলাম না। এত সহজে ব্যাপারটা ঘটে যাবে ভাবতেই পারি নি।

পরম তৃপ্তিতে বিকেলের হাওয়া খেতে বেরুলাম। সন্ধে বেলা আব্বা এলেন আমার ঘরে। হাতে খাতাটা। ‘এটা কী ?’ আমি তো থ। আব্বা হুংকার দিলেন, ‘এটা কী ? লিখেছে কে ?’ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি’।

আশা ছিল, সত্য কথা বললে আব্বা সদয় হবেন। কিন্তু না, শুরু হল আব্বার ভয়ংকর মার। মা দৌড়ে এলেন আমাকে বাঁচাতে। কিন্তু তিনিও খেয়ে গেলের দু’চার ঘা। রাগলে আব্বার মাথার ঠিক থাকে না।

সেই মারে সাত দিন বিছানায়। গা কাঁপিয়ে জ্বর এল। মা অনবরত বকে যাচ্ছেন, ‘নিষ্ঠুর, পাষাণ। হাটের চোরকেও মানুষ এভাবে মারে না। আর নিজের ছেলেকে কী করে এত মারে ? খোদা চোখেও দেখে না।

কেন আমাকে তুলে নেয় না ?’ চুপচাপ শুয়ে মার বকবক শুনি। হাসি পায়। একে বোধহয় মাতৃ¯েœহ বলে। মাতৃ¯েœহ অন্ধ। ভীষণভাবে অন্ধ।

দু’তিন দিন পর একটা আজব ব্যাপার ঘটল। বোধ হয় রাত সাড়ে আটটা হবে। মা ও পনির নুরীদের বাসায় টিভি দেখতে গেছে। আমি বাড়িতে একা। এমন সময় সুমী এল আমার ঘরে।

রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলতে লাগল। আমি পাশ ফিরে শুলাম। বদমাশ মেয়ে একটা। নাম্বার ওয়ান ইতর। কোন সাড়া শব্দ নেই।

চলে গেল নাকি মেয়েটা ? না, যায় নি। আমার বিছানায় বসল বোধ হয়। ‘রঞ্জু ভাই, আমাকে মাফ করে দেন। আমি বুঝতে পারি নাই। ’ আমার রাগ গলে জল।

রাগের জায়গায় ভর করল লজ্জা এবং তীব্র ভয়। ‘তুমি এখন যাও। ’ ‘আগে আপনে বলেন, আমাকে মাফ করেছেন। ’ ‘তুমি যাও। যাও তো।

’ সুমী থতমত খেয়ে চলে গেল। ও কি কাঁদছিল ? ধ্যাৎ, ফাজলেমি ছাড়া ও আর কী করতে পারে ? জ্বর ছেড়ে গেল আট দিনের মাথায়। দেখি, ওদের ঘর খালি। ওরা কি চলে গেছে ? নাকি আব্বাই তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস পাই নি।

মারের চোটে আমার কাব্য প্রতিভা উধাও। সেই সাথে আমার খাতাটা চুলোর আগুনে। তারপর বহু দিন আর কাব্য চর্চা করা হয় নি। কলেজে ওঠার পর এক রাতে ‘কাব্য-তৃষ্ণা’ পেয়ে গেল। সে দিন একটা নতুন খাতার মধ্যে লিখলাম - ‘এই যে শোন সুমী হৃদয়ের মাঝে তুমি।

’ পনিরকে নিয়ে কী যে কবিতা লিখব। আমার বেশির ভাগ কবিতা প্রেম বিষয়ক। যদি কোন দিন সত্যি সত্যিই কবি হই, সবাই বলবে, ‘প্রেমিক কবি’। নাহ, শুধু প্রেম নিয়ে লিখলে হবে না। অন্য কিছু লিখতে হবে।

হঠাৎ মাথার ভেতর দু’টো লাইন চলে এল, ‘কেউ প্রতীক্ষায় দীর্ঘ দিন নির্ঘুম, চোখে লাগামহীন স্বপ্ন ; স্বপ্নের ধুম। ’ ব্যাস, মাত্র দু’টি লাইন। আর কিছুই মাথায় আসছে না। এই রকম হয়। দু’টি লাইন লেখার পর আর কিছুই মাথায় আসে না।

কবিরা কিভাবে যে লাইনের পর লাইন লিখে যায়, কে জানে। ‘এই শুয়োরের বাচ্চারা, দরজা খোল। ’ চমকে উঠলাম। আব্বা এসেছে। পুরোপুরি মাতাল হয়ে এসেছে নাকি ? আমি তাড়াতাড়ি খাতা বন্ধ করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।

আব্বা বাড়ির দরজার বাইরে গালাগালি করেই যাচ্ছেন। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলতেই আব্বা এক চড় লাগিয়ে দিলেন। মাথাটা বো করে উঠল। ‘হারামজাদা, কোথায় থাকিস ?’ ধ্বক করে আমার নাকে এসে লাগল তীব্র পচাইয়ের গন্ধ।

আব্বা পুরো মাতাল, টলছেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠোন পেরিয়ে হেঁটে চলে গেলেন মার ঘরের দরজায়। হাঁটু পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি। থরথর করে কাঁপছেন। ‘কলমী, দরজা খোল।

’ আব্বার ডাক শুরু হল। তাঁর এই এক অভ্যাস। খুব কোমল গলায় মাকে ডাকতে শুরু করবেন। আস্তে আস্তে গলা চড়তে থাকবে। ‘কলমী, দরজা খোল।

’ মেজাজ খারাপ করে আমি ঘরে ফিরে এলাম। পনির জেগেছে। ভয় পাওয়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে পাত্তা না দিয়ে আমি এসে চেয়ারে বসলাম। ‘ঐ হারামজাদী, দরজা খোল।

’ আব্বার গলা চড়ছে। সেই সঙ্গে চলছে দরজায় লাথি। দরজা খোলার শব্দ হল। আমি এখানে বসেই বুঝতে পারছি মা ভয়ে কাঁপছেন। আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী - যাকে মেরে তিনি প্রায়ই হাতের সুখ মেটান।

আজও বোধ হয়, তার হাত নিশপিশ করছে। মদ খেয়ে স্ত্রীকে না পেটালে মদ খাওয়াই বৃথা। ‘মরার মতো ঘুমাস কেন রে, মাগী ?’ মার কোন জবাব পেলাম না। ‘ছিনাল মাগী, খাড়ায়া রইলি ক্যান ? ভাত দে। ’ কিছুক্ষণ চুপচাপ।

পনির বলল, ‘ভাইয়া, তুমি যাও। ’ আমি জেদ চেপে বসে রইলাম। পনিরের হাত পা কাঁপছে। ‘কি রে হারামজাদী, কথা কানে যায় না ?’ আব্বা বোধ হয় লাগালেন চড়। তখনই শুরু হল ধস্তাধস্তি।

‘পাইছিস কী ! ডেইলি নেশা করে আমারে মারবি ? আজ তোরে মাইরাই ফেলমু। ’ মা অবশ্য মারতে পারবেন না। উল্টো দু’চার লাথি খেয়ে আধ-মরা হবেন। হ্যা, মা বোধ হয় একটা লাথি খেলেন। ‘ভাইয়া, তুমি যে একটা কী !’ বিরক্ত পনির খাট থেকে নামল।

দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। মেজ ভাইয়া পাশ ফিরে শুল। আমি জানি, মেজ ভাইয়া জেগে আছে। কিন্তু মটকা মেরে পড়ে আছে। সুনসান সব।

ব্যাপারটা কী ? বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখি, বারান্দার চৌকিতে আব্বা পা ঝুলিয়ে ঘুমাচ্ছেন। ঘরের মেঝেতে মা পড়ে আছেন। পনির মার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। ‘মা, চোখ খোল।

চোখ খোল, মা। মা, ও মা ...’ আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। পনির মাকে নিয়ে ব্যস্ত। দাঁতের ফাঁকে চামচ ঢুকিয়ে সংজ্ঞা ফেরানোর চেষ্টা করছে। গলি পেরিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বড় রাস্তায় আসতেই মৃদু বাতাসের আভাস। অথচ ঘরে গুমোট গরম। মাঝে মাঝে হাত পাখা ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ডুবন্ত মানুষ খড়কুঁটোও ধরে। আকাশটা চমৎকার ঝকঝকে।

একটা তারা বেশ জ্বলজ্বলে। একে বোধ হয় শুকতারা বলে। ঐ তারাটা কত সুখী। ওর মতো যদি সুখী হতে পারতাম। পর্ব -০১।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২০ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.