জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই পাঁচ
মার্কেটে ঢুকতেই ভদ্র মহিলার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমার চমকে ওঠার কথা, অথচ তীব্র কোন অনুভূতি তৈরি হচ্ছে না। বুকের কাছটায় প্রচন্ড আলোড়ন হওয়া উচিত। কিছুই হচ্ছে না। এ বড়ো অন্যায়।
ভদ্র মহিলার চেহারা দেখে বুঝলাম, আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া কাকে বলে। একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা এত সহজে বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেন না।
ভদ্র মহিলা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার স্বামী বার দুয়েক আমার দিকে তাকালেন। তারপর ভদ্র মহিলার কাঁধে মৃদু টোকা দিলেন।
ভদ্র মহিলা যেন বৈদ্যুতিক স্পর্শ পেলেন।
আমি ফটোস্ট্যাটের দোকানে চলে এলাম। দোকানদারকে নোটগুলো দিয়ে মার্কেটের ভেতরের দিকে তাকালাম। না, এখান থেকে উনাকে দেখা যাচ্ছে না। যাক, বাঁচা গেল।
দোকানদার ফটোকপি করার আগে জিজ্ঞেস করল, ‘কয় সেট হবে ?’
‘দুই সেট। ’
দোকানদার তার কাজে লেগে পড়ল। চট করে মনে পড়ে গেল অনেক দিন আগের কথা। আমার বয়স তখন ছয় বা সাত বছর হবে। ভয়াবহ জ্বর হয়েছিল।
আব্বা আমাকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাঝপথে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পাশের রিক্সাটাকে আটকালেন। ওই রিক্সায় এক ফর্সা ভদ্রলোক এবং ভদ্র মহিলা বসা। ভদ্রলোককে দেখলেই বোঝা যায়, খুব উচ্চ শিক্ষিত এবং ধনী ঘরের সন্তান। বংশানুক্রমিক ধনী হলে চেহারায় যেই রকম আভিজাত্য চলে আসে, ভদ্র লোকের চেহারায় সেই রকম লালিত্য আছে।
আব্বা চিৎকার করে বললেন, ‘আমার ট্যাকা কই ? ’
ভদ্রলোক নিচু কণ্ঠে কী যেন বোঝাতে চাইলেন। আব্বা ততোধিক চিৎকার করে বললেন, ‘আমার ট্যাকা না দিলে ছাড়মু না। আমার এক লাখ ট্যাকা। ’
আমার সারা শরীর জ্বরে কাঁপছিল। চিৎকার করে আব্বাকে ডাকতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল, আমি জোরে চিৎকার দিলে রিক্সা থেকে উবু হয়ে পড়ে যাব।
কিছুক্ষণের মধ্যে মানুষজনের জটলা পাকিয়ে গেল। লোকজন তামাসা দেখে মজা নিচ্ছে। আব্বার পক্ষে সমর্থন বাড়তে লাগল।
রিক্সায় বসা ভদ্রলোক হঠাৎ করে মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা আব্বার হাতে গুঁজে দিলেন। আব্বা রিক্সা ছেড়ে দিলেন।
জ্বরের ঘোরে চিনি নি, কিন্তু পরে ছবি দেখে চিনতে পেরেছি, রিক্সায় বসা ভদ্রমহিলাটি ছিল আমার মা। আমার গর্ভধারিনী মা।
অনেক পরে নুরীর মার কাছে জানতে পেরেছি, আব্বা যে বলেন, মা যাওয়ার সময়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন, সে দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা।
মাকে বিপদে ফেলার কৌশল মাত্র। আমাদের ঘরে নগদ এক লাখ টাকা থাকলে মা কখনই চলে যেতেন না।
আসলে মায়ের চলে যাওয়ার জন্য টাকা কোন বিষয়ই ছিল না। তখন নাকি বাবার নেশা বেড়ে গিয়েছিল। প্রতি রাতে নেশা করে এসে মাকে পেটাত।
একবার এমন চড় দিয়েছিল যে, মায়ের কানের পর্দা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। সেই থেকে মা একটা কানে শুনতেন না। এক কান নষ্ট হওয়ার পর মায়ের বড় ভাই তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে চলে যান। আব্বা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, তাকে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু মা আর ফিরে আসেন নি।
ফটোস্ট্যাট চলছে এমন সময় দেখলাম, ভদ্রমহিলা বেরিয়ে যাচ্ছেন। স্মার্ট মহিলা। ঘিয়ে রঙের শাড়িতে উনাকে খুবই অভিজাত লাগছে। তিনি হঠাৎ পেছনে তাকালেন। চোখাচুখি হয়ে গেল।
আমার মাথার ভেতর একটা তীব্র গতির রকেট ছুটে গেল।
সোমা কোত্থেকে এল কে জানে। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ কী রে, হা করে কী দেখছিস ?
‘আরে তুই !’, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গি করলাম। এর প্রয়োজন ছিল না, এই মেয়ে এমনিতেই সবাইকে পাত্তা দেয়। আমাকে একটু বেশি দেয় মনে হয়।
আমার বন্ধুরা আড়ালে বলে, ও নাকি আমার ক্লাশ মেট না, আসলে গার্ল ফ্রেন্ড। আমি নাকি সত্য কথাটা এখন স্বীকার করছি না, এক সময় প্রমাণসহ ধরা পড়ে যাব।
সোমা নোটগুলো হাতড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ফটোস্ট্যাট করছিস রে ?’
আমি নোটগুলো গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, ‘বিশেষ কিছু না। ছাত্রীর জন্য কয়েকটা নোট। ’
সোমা চোখ বাঁকা করে উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসি দিল।
বলল, ‘তলে তলে এত দূর ! ছাত্রী থেকে আবার পাত্রী বানিয়ে ফেলেছিস নাকি ?’
আমি লজ্জিত চোখে চারদিকে তাকালাম। অনেকেই কথাটা শুনেছে এবং বেশ উপভোগ করেছে। এই মেয়ের সম্মানবোধ কম। এত লোকের মাঝখানে এই রকম কথা কিভাবে বলে ?
ফটোস্ট্যাট সেরে সোমাকে নিয়ে বেরুলাম। সোমা জিজ্ঞেস করল,‘রিক্সা নিবি নাকি ?’
‘রিক্সার কী দরকার ? এইটুকু পথ।
’
‘হোক এইটুকু পথ। এই রোদে আমি হেঁটে যাব না। ’
মুখ ফসকে বলে ফেললাম,‘হু, কী আমার রূপবতী !’
সোমা মুখ কালো করে ফেলল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,‘দ্যাখ, এই রকম করে বলবি না। সবাই তো আর তোর মতো সুন্দর হয় না।
সুন্দর হয়েছিস বলে সবাইকে ঘৃণা করবি ?
ওর কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে বলা উচিত হয় নি। মেয়েটা দুঃখ পেয়েছে। ওকে প্রবোধ দেয়ার জন্য বললাম,‘ঘৃণার কিছু নেই। এই এগারোটায় কী এমন রোদ ?’
সোমা কোন কথা বলল না।
চট করে রিক্সা ডেকে উঠে বসল। আমাকেও হাত ধরে টেনে ওঠাল। বাধ্য হয়ে উঠতে হল। নইলে ও রাস্তার মধ্যে হাত ধরে টানাটানি করতে থাকবে। এই জনবহুল রাস্তায় ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হবে।
বন্ধু-বান্ধবের কেউ দেখতে পেলে পরে আমাকে পঁচাবে।
রিক্সায় উঠে বুঝলাম, ভুল রিক্সায় উঠে পড়েছি। সিট কেবল ছোট না, ঢালুও। বসে থাকতে পারছি না, পিছলে পড়ে যাচ্ছি। সোমা কি মোটা হচ্ছে ? আমি ওর দিকে তাকালাম।
বেচারা মন খারাপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
সোমা হঠাৎ আমার দিকে ঘাড় ঘোরাল। বলল,‘রিক্সায় যেতে খারাপ লাগছে ?’
‘না। ’
‘তাহলে উঠতে চাইলি না কেন ?
‘এমনি। ’
সোমা আমার চোখে দিকে তাকিয়ে বলল,‘দ্যাখ, মিথ্যে বলবি না।
খুব খারাপ লাগে। হ্যান্ডসাম ছেলেরা কি সব সময় মিথ্যে বলে ?’
চালাক মেয়ে। বুঝে গেছে। বললাম, ‘ঠিক আছে, মিথ্যে বলব না। ’
‘তাহলে বল উঠতে চাইলি না কেন ?’
আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম,‘মেয়েদের সাথে রিক্সায় উঠতে আমার অস্বস্তি লাগে ?’
সোমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
বলল,‘তুই খুবই অহংকারী। আমি এখনও তোর কাছে কেবল একটা মেয়ে রয়ে গেলাম ?’
সোমার কথার কী জবাব দেব ? ওকে আমি কেবল মেয়ে ভাবি না। ওকে আমি মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ওর হ্যাংলামি আমার ভালো লাগে না। গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েদের সবাই সহজলভ্য ভাবে।
আমি সোমার দিকে তাকালাম। সোমা এখন কিছু ভাবছে। ওর চোখে মুখে একটা পোংটামি খেলা করে যাচ্ছে। ও এমননিই। বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকে না।
হুটহাট করে বদলে যায়। হয়তো কিছুক্ষণ পর সহজ গলায় প্রশ্ন করবে, ‘আচ্ছা, তুই কি আমাকে বিয়ে করবি?’
সে এক মজার ব্যাপার। ও বন্ধুদের ভড়কে দেয়ার জন্য এই প্রশ্নটা করে। এমনভাবে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে যে, সবাই বিভ্রান্ত হয়। আমিও প্রথমে হয়েছিলাম।
পরে জেনেছি, এটা ওর একটা প্রিয় রসিকতা।
কোন কারণ নেই। তবু হঠাৎ করে মনে হল, আমার পাশে বসে আছে লুনা। সোনালি গহনায় ঝলমলে পোশাকে লুনাকে পরীর মতো লাগছে। এমন পবিত্র সৌন্দর্য ক’জনেরই বা আছে ? আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
যেন আমি এক মহাচোর এবং কোন রাজকোষ চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছি।
‘আমি বুঝি খুব কুৎসিত মেয়ে, তাই না ?’
শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। সোমা বুঝতে পারল। জিজ্ঞেস করল,‘কি রে ওই রকম করে কেঁপে উঠলি কেন ?’
আমি প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বললাম, ‘আচ্ছা, তুই ওই ভদ্র মহিলাকে দেখেছিস ?’
‘কোন ভদ্র মহিলা ?’
‘ওই যে ফর্সা সুন্দর। ঘিরে রঙের শাড়ি পরা, চোখে চশমা।
মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ’
‘হ্যা, হ্যা, মনে পড়েছে। ভদ্র মহিলাটি কে রে ?’
‘আমার মা’, সহজ গলায় বললাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
‘হ্যা, মনে পড়েছে।
তুই বলেছিলি। তোর আপন মা আরেক জন। উনি কি তোর আপন মা? ’
আমি নীরবে সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম।
‘এত দিনে বুঝলাম, তুই কার মতো হয়েছিস। তোর মা তো দেখতে খুবই সুন্দরী।
’
রিক্সা প্রায় কলেজের কাছাকাছি এসে পড়েছে। আরেকটা মোড় ঘুরলেই কলেজ রোডে ঢুকে যাব। আমি চারদিকে খেয়াল করছি বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে দেখা যায় কি না।
‘এই রঞ্জু, এই ...’
পেছনে চেয়ে দেখি, মুন্না দৌড়ে আসছে। রিক্সা থামালাম।
‘এই ব্যাটা নেমে আয়। ’
‘কেন নেমে আসবে ? আমরা কলেজে যাব’, সোমার কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর।
মুন্না সোমাকে তোয়াক্কা না করে আমাকে জোর করে নামাল। সোমা বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাতেই মুন্না বলল,‘আরে ছেমড়ি, তুই যা। ওরে নিয়ে টানাটানি করিস কেন ?’
‘তুই আজ কলেজে আয়, তোর সবগুলো চুল ছিঁড়ব।
’
মুন্না একটা বিশ্রী ভঙ্গি করে বলল,‘তুই আমার কিছুই ছিঁড়তে পারবি না। ওই রিক্সাওয়ালা ভাই, এই ছেমড়িরে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আস। ’
সোমা রাগ করে চলে গেল। আমি পেছন থেকে বললাম, ‘আসছি। ’
মুন্না আমার কাঁধে একটা রামচড় মেরে বলল,‘শালা, মেয়েলোকের আঁচলের তলের রোমিও।
’
মেজাজটা চড়ে গেল। কিন্তু কী বলব ? হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছি। সোমাটা যে কী !
‘চুপসে গেলি যে ? ভাষাহীন নির্বাক’, মুন্না টিপ্পনী কাটল।
আমি গলা চড়িয়ে বললাম,‘ফাজলেমি করবি না। তুই তো সবই জানিস।
ওর সাথে অনেক ছেলেই রিক্সায় করে ঘুরে বেড়ায়। এটা কোন ব্যাপার না। ’
‘অন্যের বেলায় ব্যাপার না। কিন্তু তোর বেলায় অনেক কিছু। ’
‘ইচ্ছে হলে কাল থেকে তুইও ওর সাথে রিক্সায় ঘুরতে পারিস।
’
‘ওই কালি ভুটকির সাথে আমি ঘুরি না। দেশে কি মেয়ের অভাব পড়ল নাকি ?’
‘এটা কি বললি ? সোমা শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে। ’
‘করুক। আমার তাতে কী ? আমি কি ওর বয় ফ্রেন্ড নাকি ? আচ্ছা, চল কোথাও একটু বসি। ’
আমরা দু’জন পাশের একটা চায়ের দোকানে বসলাম।
লোকজনের হাউকাউ। মুন্না চা সিঙ্গারার অর্ডার দিল। দোকানের ছোকড়াটি ছো মেরে কয়েকটা সিঙ্গারা নিয়ে আমাদের সামনে রেখে গেল। আমি একটা সিঙ্গারায় কামড় বসালাম।
সিঙ্গারা নিতে নিতে মুন্না বলল, ‘শোন, তোর কি তুলির কথা মনে আছে ?’
‘তুলি ! কোন তুলি ?’
‘আমার বান্ধবী।
ওই যে ব্যাচে পড়তে গিয়ে যে পরিচয় হল ? মহিলা কলেজে পড়ে। ’
‘চিনেছি। কী হয়েছে তুলির ?’
‘কিছু হয় নি। ও আমাদের সঙ্গে পিকনিকে যাচ্ছে। ’
‘তো আমি কী করব ?’
‘তোর কিছু করতে হবে না।
করব তো আমি। তুই কেবল ফাক বুঝে বলে দিবি। ’
‘কী বলে দেব ?’
‘আমার পক্ষ হয়ে বলবি। আমি যে ওকে কতটা পছন্দ করি সেটা বলবি। ’
আমি মুন্নার দিকে হা করে চেয়ে রইলাম।
পনিরের কথা মনে পড়ে গেল। পনির কি মুন্নাকে ভালোবাসে ? তাহলে আমার বোনটি অনেক দুঃখ পাবে। কিছু মানুষকে জীবনে কেবল দুঃখ পেয়েই যেতে হয়। আমার বোনটির ভাগ্য যেন তেমন না হয়।
চলবে ...
পর্ব -০১ ।
পর্ব - ০২ । পর্ব - ০৩ । পর্ব - ০৪ ।
আমার অন্যান্য ধারাবাহিক উপন্যাস :
কুষ্ঠ নিবাস
নাটকের মেয়ে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।