ইসলামের কোন কিছুতেই নাকি কোন ভুল নেই- একথাটি ছোট বেলা থেকে শুনে এসেছি - যদিও আশেপাশের মানুষগুলোকে কখনোই সেভাবে মেনে চলতে দেখিনি।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে খুব কম-ই এমন দেখার সুযোগ ভাগ্যে জুটেছে যারা সত্যিকার নিষ্ঠাবান মুসলমান। আমার সারা স্কুলের মাত্র হাতে গোনা কয়েক জন মেয়ে পরত বোরখা, তাও তাদের নিয়ে পিছনে আলোচনা হত - সেইসব আলোচনার বিষয়বস্তু যে ভালো নয় তা তো বলাই বাহুল্য। বোরখার পিছনেই নাকি সব খারাপ জঘন্য মেয়েগুলা লুকিয়ে থাকে, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে কমেন্ট ছোঁড়ায় আমিও তখন পিছিয়ে থাকতাম নাহ।
হঠাৎ ইংল্যান্ডে এলাম।
লন্ডনের স্কুলে লেখাপড়া করতে গিয়ে দেখি অনেক মুসলিম মেয়েই স্কার্ফ পরে - তবে পর্দার সীমানা ব্যাস ওই পর্যন্তই, মা-বাপের জোরাজুরিতে পরা, বেশিরভাগের-ই জামা-কাপড়ের ঠিক নেই - টাইট ফিটিং পোশাকের সাথে উগ্র আচরণের মেয়েদের আংশিক পর্দা করা দেখে ঠিক করলামঃ 'জীবনে আর যাই-ই করি, স্কার্ফ আমি অন্তত পরব না'।
তবে মানুষ যা বলে তা সবসময় করতে পারে না, আমিও খুব সহজেই ধরা খেলাম। আমার বন্ধু নির্বাচনে কোনকালেই বাছ-বিচার ছিল না - ''ধর্ম'' বিচারের তো প্রশ্নই আসেনা - আস্তিক, নাস্তিক, এ্যাগনস্টিক, খৃস্টান, মুসলমান সব ধরনের বন্ধু জুটে গেল। কিন্তু সমস্যাটা হল সেখানেই; কথায় আছে 'খালি কলসি বাজে বেশি', ধর্ম নিয়ে যেই আমি কোনকালেও সেরকম ভাবি নাই, সেই আমি কিনা মুখভরে গর্ব করে আমার বিধর্মী বন্ধুদের বলতে লাগলাম ইসলামের শ্রেষ্ঠতার কথা! যদি বা কোনভাবে কাউকে মুসলিম বানানো যায় - এই সুযোগ তো হাতছাড়া করা যায় না! তবে ওদের প্রশ্নগুলো খুব-ই অদ্ভুত- অনেকে আবার এও জিজ্ঞেস করত - 'তুমি নিজেই যদি জান ইসলাম এত ভাল তাহলে তুমি কেন অন্য মুসলমান মেয়েদের মত স্কার্ফ পর না?' মূলত পোশাকগত তফাৎটাই ওদের চোখে বেশি ধরা পড়ত।
সেবার-ই প্রথমবারের মত টের পেলাম আমি আমার ধর্ম বিশ্বাসে কতখানি দুর্বল - অবিশ্বাসী মানুষের প্রশ্ন আমাকে নাজেহাল করে দিল, আমার এক মামাতো 'practising' কাজিনের সাথেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম অতি উৎসাহের সাথে।
নেট থেকে ইসলাম বিষয়ক নানা আর্টিকেল, বই পড়ার ধুম পড়ল - হঠাৎ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আসলেই ইসলাম যা বলছে তা যুক্তিসঙ্গত, শালীন এবং মার্জিত। সেখানে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। এবং মেনে চলতে পারলে অবশ্যই ভাল বৈ মন্দ নয়।
সামার হলিডে চলছিল, অতি আগ্রহে রাতারাতি স্কার্ফ ধরলাম, হাতাঅলা পোশাক - খারাপ লাগছিল না, জেনেবুঝে কিছু ভাল করার আনন্দটাই আলাদা। বাবা-মা কে বিতর্কের মত করে জবাব দিচ্ছিলাম 'যদি জানো ইসলামের সবটাই ভাল, তাহলে করব না কেন?' আমার আগ্রহের জোয়ারে তারা তখন কিছুই বলতে পারেননি, যদিও মনে করছিলেন যে বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে।
তবে আমার কাছে ব্যাপারটি তাড়াহুড়ো মোটেও ছিল না, ইসলামের দৃষ্টিতে দেখলে আমার বয়সী মেয়ের উপর পর্দা ফরয।
বেশ কন্টিনিউ করতে লাগলাম, স্কুল খুললো, আমাকে দেখে এখানকার মানুষের রিঅ্যাকশন ছিল - হয় 'নির্বিকার' অথবা 'বাহ তোমাকে তো খুব অন্যরকম লাগছে'। বছর ঘুরল, পর্দা করতে আমার কক্ষনোই অসুবিধা হয়নি। রাস্তার বোরখা পরা নিকাব পরা মেয়েদের(যারা সত্যিকার-ই ইসলামের পথে আন্তরিকভাবে চলেন/ চলার চেষ্টা করেন) দেখে সম্মানে এবং প্রশংসায় আমার অন্তর ভরে যেত! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম আমিও কি কখনও পারব এরকম সুন্দরভাবে পারফেক্ট পর্দা করতে!? তবে হ্যাঁ, আল্লাহ পাক আবারও আমাকে তোঔফিক দিলেন! অতি শীঘ্রই আমি বোরখা পরা শুরু করলাম, এবারে স্কুলে যেয়ে সুন্দর সুন্দর কম্পলিমেন্ট- 'মাশাআল্লাহ, তোমাকে তো বুরকায় খুব মানাচ্ছে', আমার নিজেরই নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হল যেন আমাকে পর্দা করার মত করেই তৈরি করা হয়েছে!
এপর্যন্ত তো সব ভালোই ছিল, তবে এ তো গেল 'মডার্ন পাশ্চাত্য সমাজ'-এর কথা, চলুন এবার বাংলাদেশে ফিরে যাই...।
দু-তিন বছর বাংলাদেশে যাই না, আমার পুরোন বন্ধু সমাজ 'নতুন আমাকে' দেখতে অভ্যস্ত নয়, এমনকি তারা ইসলামের কথা শুনতেও প্রস্তুত না।
ফেইসবুক, প্রেম-পীরিতি, আধুনিক গান-বাজনা, নিজেদের ব্যান্ডের উদ্বোধন, গিটার এ কে কোন বিদেশী গানের সুর তুলতে পারে, wcg গেমসের খবর, কার গার্ল ফ্রেন্ড- বয় ফ্রেন্ড আছে, কে ট্রীট দিবে - এইসব নিয়ে তারা সারাদিন ব্যাস্ত থাকে... আমি খুলব না খুলব না করেও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে তথাকথিত 'মুসলিম সমাজ'-এর বাসিন্দাদের ছবি দেখে এবং কিছু কমেন্ট পড়ে হতবাক হয়ে যাই! কী ছিল এরা আর এখন কী হয়েছে! বুঝতে পারি না এদেরকে কি বলব আমার কথা নাকি বলবা না? শেষ পর্যন্ত না বলার সিদ্ধান্ত নেই। দুই-একজন খুব-ই ক্লোজ সমমন-মানসিকতার মানুষ পেলে কিছু হয়তো বলি - বেশি বলতেও ভয় হয়- যদি ফ্রেন্ডশিপ হারাই! তারপর-ও কিছু মানুষ যখন জেনে যায়--- তাদের আক্রমনাত্মক ভঙ্গি, মুখে ব্যাঙ্গের প্রকাশ্য চিহ্ন। যাদের সাথে আমি এতদিন ফ্রি ভাবে কথা বলে আসছি, আজ হঠাৎ তারাই আমার পরিবর্তনের কথার ইঙ্গিত পেয়ে সাপের ফনার মত কথা দিয়ে ছোবল মারে।
সমবয়সী আত্মীয় ভাই-বোনদের মধ্যেও লক্ষ করলাম তারা আমার ব্যাপারটা জেনে আমাকে 'হুজুর' বলে ডাকা আরম্ভ করেছে!! আশ্চর্য, আমি বুঝি না ওদের কাছে 'হুজুর' শব্দটার ডেফিনিশন কী?
আমি কি হঠাৎ করেই আলাদা হয়ে গেলাম? যখন তারা আমাকে না দেখে কথা বলত তখন তো আমাকে আলাদা বলে মনে হয়নি? আমি তাই এখন খুব ভয়ে ভয়ে আছি বাংলাদেশে গেলে কী হবে?? আমি কি সহজভাবে ওদের সাথে মিশতে পারব? কত স্বপ্নমাখা প্ল্যান নিয়ে ফিরছি - বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারব, হয়ত দূরে কোথাও বেড়াতে যাব... কিন্তু ওরা কি আমাকে মেনে নিবে?
তাই বোরখা পরার কথা বাংলাদেশে - ভাবতেও এখন ভয় হয়! 'শুনলাম তুই নাকি নিজেরে চেঞ্জ কইরা ফালাইতেসস' ফ্রেন্ডের এধরনের উপহাস উক্তি শুনে অভিমানভরে ভাবি - কোনটা চেঞ্জ? বোরখা তো আমি তখনও পরতাম যখন এই বন্ধুর সাথে চ্যাটে কথা হত, শুধু আগে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম না- আর এখন পরি, এইটাই কি তাহলে চেঞ্জ?
এখন ঢাকার রাস্তায় একটা টিন এজ মেয়ে চুল খুলে, গা দেখানো কাপড়-চোপড় পরে বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে ঘুরে বেড়ালে অস্বাভাবিক দৃশ্য বলে মনে হয় না, তবে বিলাতফেরত টিন এজ মেয়ে বোরখা পরলে সেটা হয় খুব-ই ভয়ংকর – ভীষণ অসামাজিক- মেনে নেয়া যায় না, দুঃখে মাঝে মাঝে চোখে জল আসে... তবে আল্লাহর কাছে এই বলেই শুকরিয়া- 'ভাগ্যিস ঐ সময় আমার বাংলাদেশী শুভাকাংক্ষীদের স্মরণ ছিল না, তা নাহলে কোনদিন-ই বোরখা পরতে পারতাম না। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।