আস সালাম - আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক
[লেখাটি ইভন রিডলীর একটি লেখার অনুবাদ। মূল লেখাটি থেকে অনুবাদ অনেকটাই সংক্ষেপিত। ]
পশ্চিমে রাজনীতিবিদ কিংবা সাংবাদিক, উভয় পক্ষই ইসলামকে নারী নির্যাতনের প্রতীক হিসেবে গন্য করতে ভালবাসেন। অথচ তারা কি জানেন মুসলিম নারীরা তাদের ১৪০০ বছর আগের কাঠামোতে কতটা মর্যাদা সম্পন্ন এবং সুরক্ষিত?
প্রথাগত কিছু বিষয়, যেমন বাল্য বিবাহ, কন্যা শিশু খাৎনা, অনার কিলিং কিংবা জোরপূর্বক বিয়ে নিয়ে লিখতে লিখতে তারা ভেবে বসে আছেন এসব ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। সৌদি আরবকে সবার আগে টেনে আনা হয় নারী নির্যাতনের প্রতীক দেশ হিসেবে যেখানে নারীদের ড্রাইভিং পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
কিন্তু এসবের সাথে তো ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, যদিও বার বার ইসলামকেই তারা দোষারোপ করে থাকেন এই কুপ্রথার জন্য।
আমাকে বলা হয়েছিল ইসলামে কি করে স্ত্রী প্রহারের মত একটি বিষয়কে অনুমোদন দেয় তা নিয়ে লেখার জন্য। কিন্তু এ ধারনা তো মোটেও সত্য নয়। আমি জানি, ইসলামের সমালোচকরা এটাকে কোরান হাদীস টেনে বিভিন্ন ভাবে প্রমান করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু এসব রেফারেন্স তো বিচ্ছিন্ন ভাবে টেনে আনা।
বউ পেটানোর এই কঠোর আয়াত তো বরং বউ পেটানোকে নিন্দা করে!
এখন কিছু বাস্তবের কিছু ইন্টারেস্টিং পরিসংখ্যান দেখা যাক। ন্যাশনাল ডমেস্টিক ভায়োলেন্স হটলাইনের তথ্য অনুযায়ী, ১২ মাসে আনুমানিক ৪ মিলিয়ন নারী তাদের সংগী কতৃক নির্যাতিত হয়। আনুমনিক, তিন জন নারী স্বামী কিংবা বয়ফ্রেন্ড দ্বারা প্রতিদিন নিহত হয় - ৯/১১ এর পরে থেকে হিসেব করলে যা দাড়ায় ৫৫০০ জন!!!
নারীর প্রতি সহিংসতা বিশ্ব জুড়ে একটি সমস্যা। সহিংস পুরুষ কোন নির্দিষ্ট ধর্ম কিংবা কালচার থেকে আসে না। বাস্তবতা হল, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন প্রহৃত হচ্ছে, র্ধ্ষনের মুখোমুখি হচ্ছে, কিংবা অন্যভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতার ছড়াছড়ি রয়েছে সমস্ত ধর্ম, বিত্ত, শ্রেনী, বর্ন, সংস্কৃতিতে।
ইসলাম পৃথিবীতে আসার পূর্বে নারীদের নীচু চোখে দেখা হত। সত্যি বলতে কি আজকের যুগেও পশ্চিমে নারীদেরকে পুরুষরা নীচু চোখে দেখে থাকে। ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে উপর তলার নারীরা পর্যন্ত বেতন ভাতা এবং প্রমোশনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়ে রয়েছে আজো।
পশ্চিমা নারীরা এখনও পন্য বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে, যেখানে বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন কৌশলে যৌন দাসত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আগেই বলা হয়েছে এটা এমন এক সমাজ যেখানে ধর্ষন, যৌন নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা খুব বেশী সাধারন, যেখানে নারী পুরুষের সমতা শুধু কল্পনা বিলাস মাত্র, যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রভাব নির্ধারিত হয় তার শারীরীক সৌন্দর্যের দ্বারা।
বোরখায় আচ্ছাদিত নারীদের প্রতি এক সময় আমার স্বভাবতই ছিল মমতা বশত একটি দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে থাকত নির্যাতনের প্রতীক এসব নারীদের প্রতি সহানুভূতি। কিন্তু আজকে আমার সে দৃষ্টিতে ফুটে উঠে অতিদক্ষ, মেধাবী, আর আত্মবিশ্বাসী নারীর প্রতিচ্ছবি, যার কাছে পাশ্চাত্য নারীবাদ গুরুত্বহীন হয়েছে, হয়েছে মলিন। আমার দৃষ্টির পরিবর্তন হয়েছে সেদিন থেকে যেদিন আমি নিজে বোরখা পরিহিত অবস্থায় ধরা পড়লাম তালিবানদের দ্বারা - যে সময়টি ছিল ২০০১ এর সেপ্টেম্বর।
সেবার আমার দশ দিনের বন্দী জীবনে আমি বিপক্ষের সাথে একটি সমঝোতায় পৌছি।
তা হল - আমাকে যদি মুক্তি দেয়া হয়, তবে আমি কোরান পড়ব এবং ইসলাম নিয়ে চিন্তা করব। আমি আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলাম। আমি অধ্যয়ন করি তবে সাংবাদিকতার জন্য আমাকে ইসলাম নিয়ে আরো অনেক অনেক বেশী পড়াশোনা করতে হয়।
আমার বন্দী জীবন কি আমার জন্য বেশী বিভীষিকাময় ছিল, নাকি আমার বিপক্ষের জন্য বেশী বিভীষিকাময় ছিল? - তার জবাব আমার জানা নেই। সে সময়টায় আমি তাদের দিকে থুতু দিয়েছিলাম, অভিশাপ দিতাম, তাদের দেয়া খাবার ফিরিয়ে দিতাম।
ফিরে আসার পরে কোরান অধ্যয়নকে আমি ভেবেছিলাম, খুব সহজ একটি একাডেমিক অনুশীলন। তখন আমি অবাক হয়ে খেয়াল করি ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা আর সম্মানে নারীকে পরিষ্কার ভাবে সমমর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। সন্তান জন্ম ও প্রতিপালনকে অত্যন্ত মর্যাদাকর হিসেবে গন্য করা হয়েছে। মুসলিম নারীরা গর্বের সাথেই বলতে পারেন তারা গৃহিনী এবং গৃহ পরিচালিকা। আল্লাহর রাসুল (সা) খুব স্পষ্ট ভাবে বলেছেন ঘরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন মানুষ হলেন "মা"।
স্বর্গ রয়েছে মায়ের সাথে। শুধুমাত্র মাতৃত্বের দ্বারা কতজন নারী এরকম সম্মানিতা হতে পারে?
তাই যেসব নারীরা ঘরে অবস্থান করে সন্তান লালন করে থাকেন, তারা আমার চোখে সেসব নারীদের মতই সম্মানিত, যারা বাইরে গিয়ে কাজ করেন এবং প্রফেশনকে বেছে নেন।
এরপরে আমি তাকাই উত্তরাধিকার, ট্যাক্স, সম্পদ আর ডিভোর্স আইনের দিকে। এখান থেকেই সম্ভবত হলিউড আইনজীবীরা তাদের প্রেরনা পেয়েছেন। মুসলিম নারীরা পেশা বেছে নেবার ব্যপারে স্বাধীন এবং তাদের উপার্জন তাদের নিজস্ব।
অন্যদিকে তাদের স্বামীরা গৃহের বিল সহ যাবতীয় খরচের দায়িত্বপ্রাপ্ত। ৭০ দশকে নারীবাদীরা যে অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে, ১৪০০ বছর আগে ইসলামই সেটা নারীদের প্রদান করে গেছে।
আগেই বলেছি ইসলাম নারীকে স্ত্রী এবং মা হিসেবে মহিমান্বিত করে। ঘরে থাকতে চাইলে সে ঘরে থাকতে পারে। সন্তানের শিক্ষক এবং গৃহ পরিচালিকা হিসেবে সে মর্যাদার অধিকারী।
সাথে সাথে, কোরান এটাও শেখায় যে নারী বাইরে কাজ করতে চাইলে সে সেটাও করতে পারে। সুতরাং পেশা বেছে নেবার ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ন স্বাধীন।
পশ্চিমে সবচাইতে বেশী যে ব্যপারটিতে মুসলিম নারীদের ফোকাস করা হয় তা হল নারীর পোশাক। মুসলিম নারীদের অবশ্যই মার্জিত পোশাক পরিধান করতে হয়। সবাই যে ব্যপারটা নিয়ে সমালোচনা করতে ভালবাসেন, তা হল হেড স্কার্ফ।
দেখুন, আজকে স্কার্ফ আমার পেশাগত জীবনের অংশ। এটা বলে দেয় আমি একজন মুসলিম এবং আমি ভদ্র ব্যবহার প্রত্যাশা করি। আপনারা কি কেউ চিন্তা করতে পারেন ওয়াল স্ট্রীট এক্সিকিউটিভদের কাউকে কিংবা কোন ওয়াশিংটন ব্যংকারকে যদি টি-শার্ট এবং জিনস পড়তে বলা হয়? সে তো জবাব দেবে "আমার বিসনেস স্যুট বলে দেয় আমি এখন অফিসিয়াল দায়িত্বে এবং আমাকে গুরুত্ব দিয়ে চলতে হবে। "
তারপরেও ব্রিটিনে আমাদের প্রাক্তন ফরেন সেক্রেটারী জ্যাক স্ট্র নেকাবকে বর্ননা করেছেন আলাপচারিতার ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধা হিসেবে - মাত্র চোখ শুধু খোলা!! কখন তারা মেয়েদের ওয়ার্ডরোব নিয়ে যে কথা বন্ধ করবে কে জানে!!! আমাদের মন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং জন রেইডও নেকাব নিয়ে এরকম কটু মন্তব্য করেছেন। এরা এসেছেন স্কটিশ বর্ডার থেকে যেখানে পুরুষেরা স্কার্ট পড়ে বেড়ায়!!! আরো প্রচুর সাংসদ রয়েছেন যারা নেকাবকে সাধারন আলাপচারিতার বাধা হিসেবে গন্য করেছেন।
কি আশ্চর্য কথা!! তাহলে সেল ফোন, ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ, ফ্যাক্স মেশিনের কি হবে? কেউ সেল অফ করে রাখেনা এটা বলে যে মুখ দেখতে পাই না।
আমার জানামতে যারা নেকাব পড়েন তাদের অধিকাংশই সাদা। পশ্চিমে যারা ইসলাম গ্রহন করেছেন তাদের নেকাবের মূল কারন সেসব পুরুষদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া যারা মেয়েদের দুপুরের খাবারে আমন্ত্রন জানান এবং আপত্তিকর আচরন করেন। লন্ডনে কয়েকজন আমাকে বলেছেন তারা এন্টি ওয়ার ক্যাম্পেইনে নেকাব পড়েছেন সিগেরেটের গন্ধের জন্য।
বলতে বাধ্য হচ্ছি এইসব বর্নবাদীদের সর্বশেষ হাতিয়ার হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া।
এই কাপুরুষোচিত আক্রমন মুসলিম নারীদের পাশাপাশি সেক্যুলার নারীদের কাছেও অগ্রহনযোগ্য। আমি আগে ছিলাম নারীবাদী, আর এখন ইসলামী নারীবাদী, এখনও নারী অধিকারের পক্ষে রয়েছি। পার্থ্ক্য এই যে মুসলিম নারীবাদীরা অনেক বেশী গোড়া। আমি হাসি চেপে রাখি যখন দেখি বিকিনি পরিহিতা মিস আফগানিস্তানকে সামনে টেনে আনা হয় মুক্তির মূর্ত প্রতীক হিসেবে।
আমি অনেকবারই আফগানিস্তানে ফিরে গেছি এবং আমি বলতে পারি সেখানকার ধ্বংস স্তুপ থেকে কোন ক্যারিয়ার নারী বের হয় নি।
বরং সেখানকার নারীরা আমাকে বলেছে বোরখা নিয়ে পশ্চিমের অযথা উদ্বেগ বাদ দিতে। "আমাকে ক্যারিয়ার নারী বানানোর চেষ্টা বাদ দাও। বরং আমার স্বামীকে কাজ দাও। দেখাও আমি কি করে নির্ভয়ে আমার সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারি। আমাকে নিরাপত্তা দাও।
আমার টেবিলে পাউরুটি দাও। " - এই ছিল একজনের বক্তব্য।
তরুন মুসলিম মেয়েরা হিজাব এবং নেকাবকে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের অংশ মনে করে। কেউ কেউ বলেছে এর মাধ্যমে তারা পৃথিবীকে দেখাতে চায় তারা ড্রিংক, ড্রাগ সহ পশ্চিমা লাইফ স্টাইলকে পরিত্যাগ করেছে। ইসলামে সুপিরিয়রিটি অর্জিত হয় গুনের মাধ্যমে - সৌন্দর্য, সম্পদ, ক্ষমতা, অবস্থান কিংবা লিংগ দিয়ে নয়।
এখন বলুন, কোনটা বেশী কাম্য? আপনাকে কেউ স্কার্টের দৈর্ঘ দিয়ে বিচার করবে, - নাকি ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিচার করবে?
চকচকে ম্যাগাজিন গুলো আমাদের বলে যতক্ষন না আমরা লম্বা, স্লিম, সুন্দর না হব, ততক্ষন পর্যন্ত আমরা মূল্যহীন। টিনএজ ম্যাগাজিনের কিশোরী পাঠিকারা তাই সারাক্ষনই বয়ফ্রেন্ডের খোজে ব্যস্ত। অন্যদিকে ইসলাম আমাকে বলে আমার এডুকেশনের অধিকার রয়েছে পুরোমাত্রায়, তা বিবাহিতই হই, আর অবিবাহিতই। ইসলামে কোথাও নেই নারীকে ওয়াশিং, ক্লিনিং আর কুকিং এর কাজ করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে প্যাট রবার্টসনের ১৯৯২ এ দেয়া বক্তব্য পড়ে বলুন, কে বেশী সভ্য আর কে কম সভ্য।
তিনি বলেছিলেন, "নারীবাদ নারীকে ডিভোর্সে উৎসাহিত করে, সন্তানদের হত্যা করতে উৎসাহিত করে, ডাইনীবাদ শেখায়, পুজিবাদ ধ্বংস করে এবং লেসবিয়ান বানায়। "
এদের মত পুরুষেরা যে অন্ধত্বের নেকাব পড়ে আছে তা প্রথমে ছেড়া দরকার যাতে মানুষ সত্যিকার ইসলামের সন্ধান পায়।
[মূল লেখা থেকে কিছুটা সংক্ষেপিত।
Click This Link
]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।