ইইসমাইল “আজকাল সবাই উন্নতি করেছে- যেদিকে তাকাই কেবল দেখি উন্নতি আর উন্নতি। কেবল আমি অথর্ব্ব বুড়ো অচল হয়ে বসে আছি। তাই ভাবি আর বেশি করে ভাত খাই, আর ভাবি যে কি করে আমার উন্নতি হবে।
চশমাটা ভালো করে মুছে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলুম। হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপনে নজর পড়লো- ‘ক্রুশেন সল্ট’ খেলে সত্তর বছরের বুড়ো কুড়ি বছরের তরুণ হয়ে যায়।
ব্যস- এক শিশি কিনে খাওয়া আরম্ভ করলুম।
ভাই! কি বলবো- এক হপ্তা ‘ক্রুশেন সল্ট’ খেতে না খেতে এক্কেবারে আঠারো বছরের তরুণের মতো গায়ে স্ফূর্তি হলো! তখন ভাবলুম, আর এ বুড়োদের সঙ্গে অথর্ব্ব হয়ে থাকা নয়- যাই তরুণদের সাথে মিশতে।
লাঠি ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দেখি- মেলা তরুণ এক জায়গায় জড় হয়ে গান করছে-
‘নগ্ন শির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে,
কাছা কোঁচা শত বার খসে খসে পড়ে-’
বাঃ! আমার বড় ভালো লাগলো- বিশেষত আমি বাষট্টি বছর এগিয়ে এসেছি কি না- অর্থাৎ আমার বয়স আশি বছর, কিন্তু এক হপ্তা ওষুধ খেয়ে যে এক্কেবারে আঠারো বছরের তরুণ হয়ে গেছি- তাই প্রাণে আর স্ফূর্তি ধরে না!
তরুণকে বললুম, ভাই আমি দাড়ি গোঁফ চেচে ফেলে তোমাদের সঙ্গে মিশতে এসেছি। আমায় তোমার সঙ্গে উন্নতির পথে নিয়ে চলো।
সে বললো, ‘বেশ এসো।
’
পরদিন আমি একটা মোটর নিয়ে তরুণের কাছে গেলুম। সে হেসে বললো, ‘এখন আর মোটর নয়। আমার এরোপ্লেনে চলো। এরোপ্লেনটা ঘণ্টায় ৬০,০০০ মাইল চলে?’
আমি অবাক হয়ে বললুম, ‘ভায়া! পৃথিবীর গতি ঘণ্টায় ৭২০ মাইল, আর তোমার এরোপ্লেনের গতি ঘণ্টায় ৬০,০০০ মাইল?’
তরুণ বললো, ‘কি জান দাদা। পৃথিবী বুড়ো হয়ে গেছে- সে আর আমাদের উন্নতির গতির সঙ্গে পেরে উঠছে না।
’
যাক, আমাদের প্লেন বোঁ বোঁ করে রওয়ানা হলো। তাতে আরো অনেক যাত্রী ছিল, ইরানী, তুরানী, তুর্কী, আলবানিয়ান, ইরাকী, কাবুলী ইত্যাদি ইত্যাদি। কেবল তরুণ নয়, তরুণীরাও ছিল। সবাই নওজোয়ান, বুড়ো (আমি ছাড়া আর) একটাও না। আমার মাথার ভিতর কেবলই গুঞ্জন করছিলো-
‘নগ্ন শির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে,
কাছা কোঁচা শত বার খসে খসে পড়ে-’
ও বাবা! কতক্ষণ পরে দেখি কি, সত্য সত্যই তরুণদের কাছা কোঁচা একেবারে খসে পড়ে গেছে, আর
‘রোদ বৃষ্টি হিম হতে বাঁচাইতে কায়
একমাত্র হ্যাট তার রয়েছে মাথায়।
’
শেষে দেখি, তরুণীরাও অর্ধ দিগম্বরী-
যাক, হ্যাট দিয়ে লজ্জা যদি নাও নিবারণ হয়, তবু রোদ বৃষ্টি হিম হতে মাথাটা বাঁচাবে। কিন্তু তরুণীদের মাথায় যে হ্যাটও নাই। আর চেপে থাকতে না পেরে বলে ফেললুম, ‘ভাই তরুণ, উন্নতির পথে চলেছ তা উলঙ্গ হয়ে কেন?’
সে বললে, ‘আমরা এখন দেশোদ্ধার করতে চলেছি- আমাদের কি কাছা-কোঁচা জ্ঞান আছে? তুচ্ছ বেশভূষা, তুচ্ছ বাস- সব বিসর্জন দাও স্বাধীনতা পাবার আশায়। আমরা চাই কেবল উন্নতি আর উন্নতি। ’
চুপ করে থাকা আমার জাতে নেই, আমি মরণকালে যমের সঙ্গেও গল্প করবো।
তুরানী তরুণকে বললুম, ‘তোমরা তো ভাই নিজের দেশেই আছ, তোমরা স্বাধীন, তবে কাপড় ছাড়লে কেন?’
সে বললে, ‘এ কোথাকার ওল্ড ফুল! পৃথিবী যে চক্রাকার পথে ভ্রমণ করে, অর্থাৎ যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছে, ঘুরে আবার সেইখানে পৌঁছবে- এ তাও জানে না!’
পরে আমি কাবুলী তরুণকে বললুম, ‘ভাই! তোমরা তো চির স্বাধীন, তবে কাপড় ছাড়লে কেন?’
সে আমাকে বুঝিয়ে বললো যে, তাদের দেশ আবর্জনায় ভরে গেছে, এখন তারা দেশের পঙ্কোদ্ধার করছে। পাগড়ি ও প্রকা- কাবুলী পায়জামা, আর চুল, দাড়ি- এসব নিয়ে কাজ করতে গেলে, কাদার ছিটায় সব বিদিকিচ্ছি হয়ে যাবে যে! তাই কেবল হ্যাট ছাড়া দেশে আর কোনো আবরণই থাকবে না।
বোঁ বোঁ করে প্লেন উন্নতির পথে ছুটছে। এখন দেখি কি, সেই তরুণী তরুণের কথাই সত্য, অর্থাৎ প্লেনটা চক্রাকার পথে ঘুরে ক্রমে কালিদাসের বর্ণিত শকুন্তলার যুগে- যখন মুনি-কন্যারা গাছের বাকল পরতো, তাও আবার সব সময় লম্বায় চওড়ায় যথেষ্ট হতো না বলে টেনে টুনে পরতে হতো, সেই যুগে এসে পড়েছে। তরুণীদের দিকে আর চাওয়া যায় না।
আমি মিনতি করে বললুম, ভায়া তরুণ, দয়া করে তোমার প্লেনটা থামাও। আমি এইখানে নেমে পড়ি।
ইরানী তরুণ হাসতে হাসতে বললো, ‘দাদা! এখনই কি হয়েছে, কোল ভীলের যুগ দেখেই ভয় পাচ্ছ? এখনো গায়ে রঙ মাখার যুগ এসে পৌঁছায়নি!’
আমি কাকুতি করে বললুম, দোহাই ভায়া তরুণ! আর না। আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা এখন আদি মাতা হযরত হাবার যুগে এসে পড়বে। ...আদি মাতা উনার লম্বা চুল খুলে সমস্ত গা ঢেকেছিলেন।
কিন্তু এখনকার তরুণীদের মাথায় তো চুলও নেই- এরা কি দিয়ে গা ঢাকবে?”
----------------------------------------------------------------------------
লেখক: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
'বেগম রোকেয়া রচনাবলী'র 'উন্নতির পথে' প্রবন্ধ থেকে সংকলিত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।