সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং দুই হাজারের বেশি শ্রমিকের আহত হওয়ার ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি করপোরেট অপরাধ, এই অপরাধের কারণ করপোরেট লোভ আর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এ রকম ঘটনা যে এবারই প্রথম ঘটল, তা-ও নয়। ১৯৯০ সালে সারাকা গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডে ১৭ জন নারীসহ ৩২ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যুর পর থেকে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেসবের জন্য শিল্প খাত ও রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলা দায়ী।
অতি নিম্ন মজুরিতে শ্রম দিয়ে যাঁরা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতকে লাভজনক করেছেন, সেই শ্রমিকদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা যখন শোক করছি, তখন প্রশ্ন তোলা জরুরি যে রাষ্ট্র কেন বারবার এই ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করেছে, কেন রাষ্ট্রের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা পোশাকশিল্পের ব্যবস্থাগত ব্যর্থতাগুলোর ওপর নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়েছে, কেন এই খাতের করপোরেট অপরাধগুলোকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শাস্তির ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে।
আজ আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, যে পোশাকশিল্প মালিকদের কোটি কোটি টাকার মুনাফা এনে দিয়েছে এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বড় করেছে, সেই শিল্পের শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকে কেন এত কম দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, শ্রমিকদের জীবন যখন ঝুঁকির সম্মুখীন, তখনো কেন তাঁদের সম্মিলিতভাবে দাবি আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয় না। আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আমাদের দেশ থেকে তৈরি পোশাক কেনার সময় অর্থ-সাশ্রয় করতে চাইলে তার ফলে এই দেশের শ্রমিকেরা শোষিত হন, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে কীভাবে আইনি বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে বাধ্য করা যায়? ২৫ এপ্রিল হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে রুল জারি করেছেন, তার ফলে এই শিল্পের ব্যবস্থাগত ত্রুটি ও অপরাধমূলক ঘটনাবলির কারণগুলো নিঃসন্দেহে নির্ণয় করা যাবে। রানা প্লাজার মালিক ও ওই ভবনের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর মালিকেরা কেন আইন মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁদেরকে আদালতে হাজির করার জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।
শ্রমিকদের মৃত্যু, আহত হওয়া, তাঁদের ক্ষতিপূরণ ও বকেয়া বেতন বিষয়ে কয়েকটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
আদালতের এবারের নির্দেশনাগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে, যদিও তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যাপারে আদালত ইতিপূর্বে যেসব আদেশ দিয়েছেন, সরকার বা এই শিল্পের মালিকেরা সেগুলোর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেননি। ২০০৬ সালে আশুলিয়ার পলাশবাড়ীতে স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রির ভবনধসে প্রাণ হারিয়েছিল ৬৪ জন। ওই ভবনের জমির মালিকানা ও ভবনটি নির্মাণের আইনি বৈধতা এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা-পরিস্থিতি সম্পর্কে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে দমকল বিভাগ, শ্রম অধিদপ্তর ও বিজিএমইএর প্রতি আদেশ জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু প্রতিবেদন দিয়েছিল একা বিজিএমইএ।
সে সময় কারখানাগুলোর নিরাপত্তা-পরিস্থিতি তদারকির দায়িত্ব নিয়েছিল বিজিএমইএ। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কারখানা পরিদর্শনের কাজ দুই সপ্তাহের বেশি এগোয়নি। অনেক কারখানাই পরিদর্শন করা হয়নি। তেজগাঁও এলাকায় ফিনিক্স ভবন ধসের ঘটনায় হাইকোর্ট গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মাথাপিছু তিন লাখ ও সামান্য জখম ব্যক্তিদের মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে কেটিএস গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগে; গত বছরের নভেম্বরে সাভারের তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে আগুন লেগে ১১২ জনের মৃত্যু ঘটে।
এসব ঘটনায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের দোষ এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে বিরাট ফাঁকি ও গাফিলতি নজরদারিতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটেছে অনেক, কিন্তু সব ঘটনাতেই মালিক ও ব্যবস্থাপকেরা দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে গেছেন।
শ্রম অধিদপ্তর স্বীকার করেছে, প্রায় পাঁচ হাজার গার্মেন্ট কারখানা নিয়মিত নজরদারি করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল তাদের নেই। দমকল বিভাগ বলেছে, তাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই।
গত দুই দশকে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
অথচ বাংলাদেশের শ্রম আইন (২০০৬) অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। বিল্ডিং কোডও ব্যাপকভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদান ও ভবন ব্যবহারসংক্রান্ত বিধিবিধানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করা উচিত; যোগ্য লোকের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করা উচিত। কারখানার জন্য নির্মিত ইমারতের ভিত বসবাসের জন্য নির্মিত ইমারতের চেয়ে বেশি মজবুত হওয়া প্রয়োজন। তৈরি পোশাক কারখানার লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া এমন কঠোর হওয়া উচিত, যেন বসবাসের লক্ষ্যে নির্মিত ভবনকে কেউ পোশাক কারখানা হিসেবে ব্যবহার করতে না পারেন।
রাজউকের স্পষ্টতই প্রকৌশলগত পেশাদারির অভাব রয়েছে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী যেমনটি বলেছেন, বিল্ডিং কোড অনুসরণ তদারকির জন্য একটি উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন বিল্ডিং মনিটরিং অথরিটি বা ইমারত তদারকি কর্তৃপক্ষ গঠন করা প্রয়োজন। এই সংস্থার সদস্য হিসেবে বিজিএমইএকে নেওয়া যেতে পারে নিরাপত্তার মানদণ্ডগুলো নিশ্চিত করার শর্ত সাপেক্ষে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যোগ্যতার ঘাটতি থেকে থাকলে অথবা এ ধরনের কঠিন দায়িত্ব পালনে তারা সক্ষম না হলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, শ্রমিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রতিটি কারখানার জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
রানা প্লাজার উদ্ধারকার্যে যে দুর্যোগ-দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া লক্ষ করা গেছে, তাতে এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের সহযোগিতা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা প্রমাণিত হয়েছে।
স্পেকট্রাম সোয়েটার কারখানা ধসের সময় উদ্ধারকাজ প্রায় অসম্ভব হয়েছিল প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কার্যকর সহযোগিতা-সমন্বয়ের অভাবে। স্পেকট্রাম ধসের পর গঠিত একটি টাস্কফোর্স সুপারিশ করেছিল, বিশেষভাবে উদ্ধারকাজ পরিচালনার উপযোগী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হোক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে তা করা হয়নি এবং রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজের সময় উদ্ধার-সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে উদ্ধারকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের খুন্তি-শাবল ইত্যাদি দিয়ে দেয়াল, বিম, পিলার খুঁড়তে ও ভাঙতে হয়েছে। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধারকর্মী উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন খালি হাতে, কাঁচি-খুন্তি ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা নানা ধরনের ধাতব তার কেটেছেন, মানুষের জীবনরক্ষার ক্ষেত্রে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু উদ্ধারকাজের ব্যবস্থাপনায় যদি আরও বেশি সমন্বয়-শৃঙ্খলা থাকত এবং যথাসময়ে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি যদি আরও বেশি থাকত, তাহলে তাঁরা আরও অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হতেন।
শিল্প খাতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমাদের শিল্প পুলিশ রয়েছে, কিন্তু বিস্ময়ের কথা, এই শিল্পে দুর্যোগ-দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নেই!
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি অত্যন্ত শক্তিশালী এক জেগে ওঠার ডাক। এই দুর্ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, তা সহ্য করার মতো নয়। মানুষের প্রাণের এত চড়া মাশুল সহ্যাতীত রকমের ভারী। এখন দায়িত্ব এড়ানোর, পলায়নপরতার সময় নয়। আমাদের রাষ্ট্র ও পোশাকশিল্প, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে, শ্রমিকদের জীবন মূল্যহীন নয়।
তাদের আরও নিশ্চিত করতে হবে, এই শ্রমিকদের শ্রম এত সস্তা নয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদা হোসেন: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।