তৈরি পোশাকশ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকার প্রস্তাব মেনে নেননি মালিকেরা। তাঁদের অনড় অবস্থান হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি এক টাকাও তাঁরা শ্রমিকদের দেবেন না।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত নবম সভায় তৈরি পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকার খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। তবে বোর্ডে উপস্থিত মালিকপক্ষের প্রতিনিধি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সভা শেষ হওয়ার আগেই বের হয়ে যান।
এদিকে, সরকার মালিকদের এ প্রস্তাবে অনেকটা সহমত বলে জানিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সূত্র।
মজুরি বোর্ডের বৈঠক থেকে বেরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যায় শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিজিএমইএর নেতারা। সেই বৈঠকে সাড়ে চার হাজার টাকা নিম্নতম মজুরির বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়। মন্ত্রী নেতাদের জানান, আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব তাঁদের কাছে পাঠানোর পর মালিকদের দাবি বিবেচনা করা হবে।
মজুরি বোর্ডের প্রস্তাব অনুযায়ী, পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা মোট মজুরির মধ্যে মূল মজুরি তিন হাজার ২০০, বাড়িভাড়া এক হাজার ২৮০ (মূল মজুরির ৪০ শতাংশ), চিকিৎসা ভাতা ৩২০ টাকা (মূল মজুরির ১০ শতাংশ), যাতায়াত ও খাদ্য ভাতা বা ভর্তুকি যথাক্রমে ২০০ ও ৩০০ টাকা। এটি পোশাকশিল্পের মজুরি কাঠামোর ৭ নম্বর গ্রেডের নিম্নতম মজুরি।
বাকি ছয় গ্রেডেও আনুপাতিক হারে মজুরি বাড়বে।
রাজধানীর তোপখানা রোডে বোর্ডের কার্যালয়ে পৌনে চার ঘণ্টার সভা শেষে বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। দীর্ঘ আলোচনা করেও নিম্নতম মজুরি নিয়ে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ একমত হতে পারেননি। ফলে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ১৯৬১ অর্ডিন্যান্সের রুলস ৭ অনুযায়ী সদস্যদের ভোট নেওয়া হয়েছে। ’
এ কে রায় বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটেই খসড়া প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
মালিকপক্ষ একটি অনড় অবস্থান নিয়ে বসে ছিলেন। প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তাঁরা চলে গেছেন। খসড়া প্রস্তাবেও স্বাক্ষর করেননি। ’ তিনি বলেন, সম্ভব হলে আজই বিজি প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে বিজ্ঞপ্তি আকারে খসড়া প্রস্তাবটি সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশিত হবে।
বোর্ডের চেয়ারম্যান জানান, খসড়া প্রস্তাবটি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৪ দিন যেকোনো পক্ষ লিখিত আকারে মতামত দিতে পারবে। তারপর মজুরি বোর্ডের সদস্যরা বৈঠক করে চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরি করে শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
যোগাযোগ করলে বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিল্পের সামর্থ্য বিবেচনা না করেই পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরির খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। বোর্ড এককভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভালো কিছু হয়নি। ’ শিল্পসংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে আজ মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিজিএমইএ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে বলে জানান তিনি।
চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে গতকালের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ও জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, শ্রমিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএর পরিচালক আরশাদ জামাল, মালিকপক্ষের স্থায়ী প্রতিনিধি এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের উপদেষ্টা সাইফউদ্দিন আহমেদ ও নিরপেক্ষ সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. কামাল উদ্দিন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
বৈঠক সূত্র জানায়, সভায় শ্রমিকপক্ষ তাদের আট হাজার ১১৪ টাকার দাবি থেকে সরে এসে ছয় হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি দাবি করে। তবে গত সভায় দেওয়া চার হাজার ২৫০ টাকার লিখিত প্রস্তাবের চেয়ে মাত্র ২০০ টাকা বৃদ্ধি করতে পারবে বলে জানায় মালিকপক্ষ। এ সময় মালিকপক্ষ যুক্তি হিসেবে শিল্পের সামর্থ্যের কথা বলে।
মালিকপক্ষ জানায়, অল্প কিছু বড় কারখানা এই পরিমাণ মজুরি দিতে পারলেও বেশির ভাগই পারবে না।
আলোচনার একপর্যায়ে শ্রমিকপক্ষ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় নেমে আসে। এবার মালিকপক্ষ আগের প্রস্তাবের (৪,৪৫০) সঙ্গে ৫০ টাকা বাড়াতে রাজি হয়। এটি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি আগের সভায় দেওয়া নিরপেক্ষ সদস্যের পাঁচ হাজার টাকার প্রস্তাবের সঙ্গে ৩০০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে নিরপেক্ষ সদস্য তখন আগের প্রস্তাবেই নিজের অবস্থানের কথা জানান।
অবশ্য আলোচনার একপর্যায়ে তিনি শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তবে মালিকপক্ষ তখনো আগের অবস্থানেই অনড় থাকে।
শেষ পর্যন্ত মালিক ও শ্রমিকপক্ষ একমত না হলে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকার প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে সদস্যদের ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। প্রস্তাবের পক্ষে সিরাজুল ইসলাম, ফজলুল হক ও কামাল উদ্দিন ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন। অন্যদিকে আরশাদ জামাল ও সাইফউদ্দিন আহমেদ ‘না’ ভোট দেন।
এর পরপরই সফিউল ইসলাম ও আরশাদ জামাল বৈঠক শেষ না করেই বের হয়ে যান।
সভা শেষে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পোশাকশিল্পের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমঝোতায় পৌঁছতেই আমরা ছাড় দিতে রাজি হয়েছি। তবে বর্তমান বাজারদরে শ্রমিকদের জীবনযাপনে আরও টাকার দরকার।
ভোট না দেওয়া প্রসঙ্গে সাইফউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মালিকপক্ষের প্রতিনিধি প্রস্তাবে সম্মত হননি, তাই আমি ভোট দিতে পারি না। কারণ, আমি সরাসরি শ্রমিকদের বেতন দেই না।
’
সন্ধ্যায় মন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক: বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পোশাকশিল্পের মালিকেরা শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকদের বেতন মজুরি বোর্ড দেবে না, সরকার বা মন্ত্রীরাও দেবেন না, বেতন দিব আমরা। এ কারণে মজুরি বোর্ডের এমন অযৌক্তিক প্রস্তাব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা মন্ত্রীকে পরিষ্কার বলেছি, সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি একটি পয়সাও দিতে পারব না। ’
মালিকদের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমসচিব মিকাইল শিপার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বেসরকারি খাত, তাঁরা এভাবে বলতেই পারেন।
আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে। প্রস্তাব এলে পর্যালোচনা করে দেখব। ’
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি চার হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণেই একমত হবে শ্রম মন্ত্রণালয়। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময় আরও ৫০০ টাকা বাড়ানো হতে পারে।
বোর্ডের কার্যালয় ঘেরাও: বোর্ডের সভা চলাকালে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয় ঘেরাও করে আট হাজার টাকা মজুরি দাবি করে বিক্ষোভ করেন তিনটি শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
তবে পুলিশি বাধার মুখে তাঁরা প্রধান ফটকের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। তখন সামনের সড়কে বসে তাঁরা বিক্ষোভ করেন।
দুপুর পৌনে ১২টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী এই বিক্ষোভে অংশ নেন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীরা।
এ ছাড়া মজুরি বোর্ডের পাঁচ হাজার ৩০০ টাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আট হাজার টাকা নিম্নতম মজুরির দাবি করে ১২টি শ্রমিক সংগঠন যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।