আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলমানের দর্শন ও বিজ্ঞান তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চা (পর্ব-১১)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র

আট শতকে আব্বাসিয়দের হাতে পতন ঘটে উমাইয়া খেলাফতের। আর এই আব্বাসিয়দের সময়েই এবং তাদের সরাসরি পৃষ্ঠপোশকতাতেই সূচিত হয় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের উত্থান। কিন্তু আব্বাসিয়দের হাতে উমাইয়াদের এই পতনের আগেই ৭১১ খ্রীস্টাব্দে ১ম আল ওয়ালিদের সময় তারিক ইবনে জায়াদের নেতৃত্বে সুচিত হয় স্পেন অভিযান, গোড়াপত্তন ঘটে মুসলিম স্পেনের। ইতিহাসে আল-আন্দালুস বা আন্দালুসিয়া নামেই বেশি বিখ্যাত হয়ে আছে মুসলিম শাসিত স্পেন। মূল আরব ভূখন্ডে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় উৎকর্ষ শুরু হওয়ার বেশকিছুকাল পরে স্পেনে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার শুরু হলেও এগারো শতকের পরও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে এই আল-আন্দালুসেই।

সিরিয়া এবং মিশরে রক্ষিত গ্রিক বিজ্ঞানীদের রচনা মুসলিমদের হাতে আসার পর গ্রিকদের উত্তরসূরী হিসাবে মানবজ্ঞানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছিল মুসলিমরা, আর স্পেনিয় মুসলিমদের রচনা থেকেই আরবদের উৎকৃষ্ট জ্ঞান ছড়িয়ে পরেছিল ইউরোপে, যেই জ্ঞানের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল পাশ্চাত্যের আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন। আল আন্দালুসঃ স্পেনে মুসলিম শাসনের সময়কাল ৭১১ থেকে ১৪৯২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। অবশ্য শেষের প্রায় দুইশ বছর মুসলিমদের শাসন ছিল স্পেনের অল্প কিছু যায়গায় এবং তাও আবার স্পেনের খ্রীস্টান শাসকদের শ্রষ্ঠত্ব স্বিকার করে। খলিফা ওয়ালিদের নির্দেশে তারিক ইবনে জায়াদ ৭১১ খ্রীস্টাব্দে ছোট আকারের এক সেনাবাহিনী নিয়ে জিব্রাল্টারে অবতরণ করেন, শুরু হয় সাত বছর মেয়াদি অভিযান। এ দীর্ঘ অভিযানে মুসলমানরা দখল করে নেয় পর্তুগাল, স্পেন এবং দক্ষিন ফ্রান্স।

তবে ৭৩২ খ্রীস্টাব্দে বিখ্যাত পয়টিয়ার্সএর যুদ্ধে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রুখে দেন ফরাসী চার্লস মার্টেল, ফ্রান্স থেকে পিছু হটে মুসলমানরা। এরপর আর ফ্রান্সে অভিযান না চালালেও বিজিত পর্তুগাল এবং স্পেন নিয়েই গঠিত হয় আল-আন্দালুস। শুধুমাত্র উত্তর স্পেনের রাজ্য ক্যাস্টিল এবং লিওন স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। শুরুতে আল-আন্দালুস উমাইয়া খলিফার নির্ধারিত গভর্ণর দ্বারা শাসিত হলেও ৭৪০ খ্রীস্টাব্দে শুরু হওয়া একের পর এক গৃহযুদ্ধে এই পদ্ধতি ভেঙে পরে ইউসুফ আল ফিহরি স্বাধীন আমির হিসাবে আবির্ভুত হন। ৭৫০ খ্রীস্টাব্দে বাগদাদে আব্বাসিয়দের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয় উমাইয়া খেলাফত।

বেশিরভাগ উমাইয়া রাজপুত্রকেই হত্যা করা হয় অথবা নির্বাসিত করা হয়। এমনি এক নির্বাসিত রাজপুত্র আবদ-আর-রহমান স্পেনে নিজের অবস্থান গড়ে নেন এবং ৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে ফিহরি'কে পরাজিত করে কর্ডোবার আমির হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আবদ-আর-রহমান তার তিরিশ বছরের শাসনকালে প্রায় পুরো আল-আন্দালুসকেই নিজের অধিনে আনতে সমর্থ হন। এই উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে প্রায় আড়াইশ বছর। ৯২৯ খ্রীস্টাব্দে তৃতীয় আবদ-আর-রহমান নিজেকে খলিফা ঘোষনা করেন এবং উত্তর পশ্চিমা আফ্রিকাও নিজের খেলাফতের অধিনে আনেন।

আল আন্দালুসের এই খেলাফতের সময়টাতেই সূচনা হয় মুসলিম স্পেনের স্বর্ণযুগ। এই যুগেই জ্ঞান বিজ্ঞান এবং সাহিত্য চর্চার নতুন অধ্যায় সূচিত হয় যা টিকে ছিল তিনশ বছরের বেশি সময়কাল। ১০০৯ থেকে ১০১৩ খ্রীস্টাব্দের মধ্যবর্তি সময়ে একের পর এক গৃহযুদ্ধে ভেঙে পরে কর্ডোভার খেলাফত। ১০৩১ খ্রীস্টাব্দে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও আল-আন্দালুস পরিণত হয় অনেকগুলো টুকরো টুকরো স্বাধীন রাজ্যে। এসময়টাকে বলা হয় "তায়ফা আমল"।

এই তায়ফা পিরিয়ডেও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় উৎকর্ষ অব্যাহত থাকে। এসময়টায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আল-আন্দালুসের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঠাগারে অধ্যায়ন করতে আসত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জ্ঞানানুসন্ধানী শিক্ষার্থীরা। এরপরও আরো প্রায় দুইশ বছর অন্ধকার ইউরোপের একমাত্র দ্বিপশিখা হিসাবে টিকে থাকে আল-আন্দালুস, জন্ম দেয় ইবন বাজা, ইবন তুফায়েল এবং ইবন রুশদের মতো মহামানবের। তবে তায়ফা আমলের স্বাধীন রাজ্যগুলো ছিল রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল, প্রাক গৃহযুদ্ধের কারণেই। এসময় খ্রীস্টানদের আক্রমন ঠেকাতে উত্তর আফ্রিকার "আলমোরাভিদ"দের কাছে সাহায্য পার্থনা করে তায়ফা শাসকরা।

কিন্তু রক্ষক হিসাবে এসে আল-মোরাভিদরা নিজেরাই শাসক হয়ে বসে, সময়টা ১০৮৬ খ্রীস্টাব্দ। পরবর্তিতে ১২ শতকে আল-মোরাভিদদের যায়গায় আল-মোহাদরা ক্ষমতায় আসে। আল মোহাদদের সময়কালেই মিলিত খ্রীস্টান আক্রমনে একের পর এক রাজ্য হারাতে থাকে মুসলমানরা। শেষ পর্যন্ত একমাত্র "গ্রানাডা"ই নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৪ শতকের দিকে মারিনিদদের হাত ধরে নতুন করে মুসলিম অভিযান শুরু হলেও এবারো স্পেন এবং পর্তুগালের সম্মিলিত প্রতিরোধে তা ধ্বংস হয়।

১৪৯২ সালে পতন হয় গ্রানাডার। স্পেনে মুসলিম শাসনের এই দীর্ঘ সময়টা বিখ্যাত হয়ে আছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান আর ধর্মীয় সহনশীলতার এক উদার এবং প্রগতিশীল সমাজের উদাহরণ হিসাবে। মুসলিম স্পেনে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চাঃ তৃতীয় আবদ-আর-রহমান শুধুমাত্র নিজেকে খলিফা ঘোষনা করেই ক্ষান্ত হন নাই, বরং তিনি পাল্লা দিতে চেয়েছিলেন বাগদাদের খেলাফতের সূনামের সাথে। আর তা করতে গিয়ে বাগদাদের খলিফার বিখ্যাত দরবারের মতোই তার দরবারও তিনি পরিপূর্ণ করতে চেয়েছেন কবি, বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের মতো গুনি মনিষিদের সমাগমে। আব্বাসিয় আর উমাইয়া খেলাফতের মধ্যে রেষারেষি থাকলেও গুনি মনিষিরা সহজেই এক সাম্রাজ্য থেকে আরেক সাম্রাজ্যে যেতে পারতেন।

আর আবদ-আর-রহমানের উৎসাহে এসময় বহু গুনি ব্যাক্তির সমাগম ঘটে কর্ডোভার দরবারে। এছাড়াও খলিফা মুসলিম প্রাচ্য থেকে দর্শন ও বিজ্ঞানের বহু বই জোগার করে মুসলিম পাশ্চাত্যে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। এসব বই এবং গুনি মানুষদের পেছনে তিনি অকাতরে অর্থ খরচ করেন। মূলত তার পৃষ্ঠপোশকতাতেই মুসলিম স্পেনে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় স্বর্ণযুগের শুরু হয়। খেলাফতের অধিনে গড়ে ওঠে ৭০টি পাঠাগার যেগুলোর সংগ্রহে ছিল ৬ লক্ষ বই।

আল-আন্দালুসের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার প্রথম পর্বটা মূলত গনিত আর য্যোতির্বিদ্যার। পরবর্তিতে এর সাথে যুক্ত হয় চিকিৎসাবিদ্যা, বোটানি, ভূ-বিদ্যা প্রভৃত বিষয়। খাটি দর্শনের চর্চা দেরি করে শুরু হলেও শেষের দিকে অনেক ক্ষেত্রেই তা অতিক্রম করে প্রাচ্যের দার্শনিকদের সাফল্য। দর্শন ও বিজ্ঞানে আল-আন্দালুসের যেসব মহামানব অবদান রেখেছেন তাদের তালিকা বিশাল। এদের প্রত্যেকের অবদান আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করা এই প্রবন্ধে সম্ভব না, প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তুর কারণেই।

আন্দালুসের মহা মানবদের মধ্যে প্রথম যার নাম পাওয়া যায় তিনি হলে ইবনে ফিরনাস (৮১০খ্রীঃ-৮৮৭খ্রীঃ)। ইবনে ফিরনাস আন্দালুসের স্বর্ণযুগের আগের ব্যক্তিত্ব। আধুনিক যুগে নিবেদিত প্রাণ পাগল বিজ্ঞানী বলতে আমরা যা বুঝি ফিরনাস ছিলেন তারই মধ্যযুগীয় প্রতিরূপ। এই বিজ্ঞানী ও আবিস্কারক অনেকদিক থেকেই ছিলেন আরব দুনিয়ার “লিওনার্দো দা ভিঞ্চী”। অদ্ভুত সব আবিষ্কার করে নিজের সময়ের মানুষদের তাক লাগিয়েছেন এই বিজ্ঞানী।

তিনি ছিলেন একাধারে আবিস্কারক, প্রকৌশল, এভিয়েটর, য্যোতির্বিদ, চিকিৎসক, কবি এবং সংগিতজ্ঞ। ফিরনাসের আবিস্কার গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল আল-মাকাতা নামক পানি ঘড়ি। এছাড়াও স্বচ্ছ কাঁচ তৈরিতে অবদান রাখেন তিনি। কাচ দিয়ে নক্ষত্রপুঞ্জের একাধিক মডেল তৈরি করেন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি একজন এভিয়েটর হিসাবে।

ষাটোর্ধ বয়সে ফিরনাস আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেন। তার ৬০০ বছর পরেও লিওনার্দ দা ভিঞ্চী পাখা লাগিয়ে আকাশে ওড়ার মডেল তৈরি করেও তার বাস্তবে রূপ দেন নাই সেখানে ফিরনাস নিজেই নিজের মডেল পরীক্ষা করে দেখার দুঃসাহস করেন। শরীরে পালকের তৈরি পোশাক পরে আর দুই হাতে ডানা লাগিয়ে আকাশে বহু মানুষের সামনে আকাশে উড়েছিলেন ফিরনাস, কিছুদুর উড়ে আবার আগের যায়গায় অবতরণও করেছিলেন। কিন্তু অবতরণ করার সময় তিনি আহত হন, তার পিঠে আঘাত লাগে। বৃদ্ধ বয়সে ফিরনাস আর দ্বিতীয়বার ওড়ার চেষ্টা করেন নাই।

স্বর্ণযুগের একজন বিখ্যাত মনিষী ছিলেন আবু আল কাসিম আল জাহরাওয়ী (৯৩৬-১০১৩), পশ্চিমে তিনি পরিচিত আবুলকাসিস নামে। তিনি ছিলেন খলিফা দ্বিতীয় আল হাকিমের চিকিৎসক। এই চিকিৎসক, সার্জন এবং প্রসাধনবীদ সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন সার্জনদের আদী গুরু হিসাবে। আধুনিক অস্ত্রপাচারের কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু অস্ত্রই আল কাসিমের আবিষ্কার। এছাড়াও রোগ মুক্ত করতে অঙ্গ কর্তনের পদ্ধতিও তার হাত ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রবেশ করে।

তারা লেখা কিতাব আল তাসরিফ পরবর্তিতে লেটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আল তাসরিফ চিকিৎসক বিশেষ করে সার্জনদের কাছে পরবর্তি ৫০০ বছর যাবত অন্যতম প্রামান্য পুস্তক হিসাবে টিকে ছিল। আরেকজন বিখ্যাত মনিষি আল-যারকালি(১০২৯-১০৮৭) বিখ্যাত ছিলেন তার সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদদের একজন হিসাবে। জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়াও যন্ত্র প্রকৌশলে তিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন। নিজের দ্বিমুখী প্রতিভা কাজে লাগিয়ে তিনি যেসব আবিস্কার করেন তার মধ্যে বিখ্যাত হয়ে আচে এমন একটি পানি ঘড়ি যা একি সাথে দিন ও রাতের সময় এবং চান্দ্র মাসের তারিখ নির্ধারণ করতে সক্ষম ছিল, অর্থাৎ একি সাথে ঘড়ি এবং ক্যালেন্ডারের কাজ করতো।

এছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যার টলেডিয়ান টেবিলে অবদান রাখেন তিনি। দীর্ঘদিন যাবত এই টলেডিয়ান টেবিল গ্রহ এবং নক্ষত্রের অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক টেবিল হিসাবে বিখ্যাত ছিল। এই টেবিলের মাধ্যমে একি সাথে মিশরিয়, রোমান, চান্দ্র এবং ফারসি মাস এবং তারিখ এবং সেই তারিখ অনুযায়ি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান জানা যেত। ইবনে বাজা, ইবনে তুফায়েল, ইবনে রুশদ, ইবনে কাম্মাদ, ইবনে বেত্রুজি প্রমুখ মনিষির চিন্তা এবং কর্মে প্রভাব রাখেন যারকালি। ইউরোপে তিনি পরিচিত ছিলেন আরজাকেল নামে।

এছাড়াও আল মারজিতি, ইবনে আল সাফার, আবু আল সালত, আল তারতুসি, ইবনে জুহর, ইবনে আল বাইতার এহেন আরো বহু আন্দালুসিয়ান মনিষি জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখায় রাখেন যুগান্তকারী অবদান। এই প্রবন্ধে যেহেতু মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদানের ফিরিস্তি বর্ণনার চেয়ে সেই অবদানের পেছনের কারণ, মুসলিম বিজ্ঞানীদের দর্শন এবং পরবর্তিতে পতনের সামাজিক কারণের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তাই আন্দালুসিয়ান মনিষিদের অবদানের বিস্তারিত ফিরিস্তি দেয়া থেকে বিরত হচ্ছি। আল-আন্দালুসের শুরুর দিকের বিজ্ঞানীদের ধর্ম এবং দর্শন বিষয়ক অবস্থানের ব্যাপারেও খুব বেশি কিছু জানা যায় না। এর একাধিক কারণ রয়েছে। শুরুর এই সময়টায় ভৌত বিজ্ঞানের চর্চা যে পরিমান হয়েছে, মৌল দর্শনের চর্চা ততটা হয় নাই।

এছাড়াও মূল আরব ভূখন্ডের মুসলিম সাম্রাজ্যের চেয়ে অনেক দিক দিয়েই ভিন্ন ছিল মুসলিম পাশ্চাত্য। ধর্মীয় সহনশিলতার দিক থেকে আল আন্দালুস ছিল মধ্যযুগের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। যদিও ইহুদি এবং খ্রীস্টানদের খাতা কলমে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসাবে জিজিয়া কর দিতে হতো, কিন্তু ধর্মীয় সহনশিলতা, নিরাপত্ত্বা এবং জীবন যাপনের মানের দিক থেকে তারা ইউরোপের যেকোন যায়গা থেকে ভাল অবস্থানে ছিল। আন্দালুসিয়ায় জোর করে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা ছিল বিরল, অবশ্য এই ক্ষেত্রে জিজিয়া কর লাভের আকাঙ্খা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রিয় সেনা বাহিনীর একটা বড় অংশই ছিল ইহুদি।

জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিম এবং ইহুদিরা হাতে হাত ধরে সামনে এগিয়েছে। বাগদাদে যেমন শিক্ষা ব্যাবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়া হয়েছিল নেস্টরিয়ান খ্রীস্টানদের তেমনি কর্ডোফা, সেভিল, টলেডোয় শিক্ষা, প্রশাসন, স্বাস্থ্য সেবায় ভাল ভাল পদ শিক্ষিত ইহুদি এবং খ্রীস্টানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ইহুদিদের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগের সূত্রপাত এই আল আন্দালুসেই। এছাড়াও মূল আরব ভূখন্ডের মতো কট্টরপন্থী এবং শক্তিশালী কোন আলেম সমাজের অস্তিত্বের কথাও জানা যায় না। মুসলিমদের সাম্রাজ্য হলেও প্রাশাসনিকভাবে আল আন্দালুসের চরিত্র ছিল তৎকালিন সময়ের হিসাবে অনেকটাই সেকুলার ধরণের।

মিশ্র সংস্কৃতির কারণে বিচিত্র এই সমাজে ব্যাক্তি মানুষের ধর্মীয় এবং দার্শনিক ধারণা নিয়ে সামাজিক মাথাব্যাথা ছিল না বললেই চলে। আরব ভূখন্ডে যেমন একেবারে শুরু থেকেই দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের ধর্ম বিরোধীতার অভিযোগ সইতে হয়েছে, জীবন বিপন্ন হয়েছে, ইনকুইজিশনের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তেমন ঘটনা ঘটে নাই স্পেনের প্রথম দিকের মুসলিম বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে। তবে তায়ফা আমলের শেষ দিকে এসে দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে ধর্মোবিরোধীতার অভিযোগ এবং হত্যার ঘটনা ঘটে। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় মুসলিম স্পেনের উত্থানের পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা যায় সেগুলো হচ্ছে- ১। আব্বাসিয় খেলাফতের সাথে প্রতিযোগী মনোভাব এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় আব্বাসিয়দের পাল্লা দেয়ার প্রচেষ্টা।

২। খলিফা এবং অন্যান্য শাসকদের সরাসরি পৃষ্ঠপোশকতা। ৩। বহু পাঠাগার প্রতিষ্ঠা এবং বই পুস্তকের বিশাল সংগ্রহ। ৪।

মুক্ত এবং সহনশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুবিধা। আগেই উল্লেখ করেছি, মুসলিম স্পেনের অসংখ্য মনিষির চিন্তা এবং কর্ম আলোচনা করা সম্ভবা না এই প্রবন্ধে। আপাতত আমরা এই অঞ্চলে মুসলিমদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় উন্নতি এবং পেছনের নিয়ামকগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। তবে আমাদের মূল আলচ্য বিষয় মুসলিম স্পেনের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার চুড়ান্ত বিকাশ নিয়ে। আসলে স্পেনিয় মুসলিমদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সর্বোচ্চ বিকাশ এবং পতন একি সূত্রে গাথা।

সর্বোচ্চ বিকাশ আর পতনের এই কাহিনি বর্ণনা করতে গেলে আসে তিন জন মহা মনিষির নাম, এরা হচ্ছেন ইবনে বাজা, ইবনে তুফায়েল এবং ইবনে রুশদ। প্রাচীন গ্রিসে যেমন সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের মধ্যে ছিল গুরু শিষ্য সম্পর্ক তেমনি মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে বাজা-তুফায়েল-রুশদের মধ্যেও ছিল গুরু শিষ্যের সম্পর্ক। শুধু এই না আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এই দুই ভিন্ন সময়ের ত্রিমুর্তির মাঝে মিল রয়েছে। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হলেও এই তিনজনই ছিলেন গ্রিকদের উৎকর্ষের শেষ সময়ের প্রতিনিধি। পিথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস, হেরাক্লিটাস এরা সবাই ছিলেন এই বিখ্যাত ত্রিমুর্তির পূর্বজ।

কিন্তু বিশদ লেখনি, প্রতিভা, বহুমুখি কর্মযজ্ঞ আর প্রভাবের দিক থেকে এই তিনজন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন পূর্বজদের। মুসলিম পাশ্চাত্যের ইতিহাসে বাজা-তুফায়েল-রুশদএর ক্ষেত্রেও একি কথা খাটে। মুসলমানদের এই ত্রিমুর্তি অবশ্য শুধু স্পেনের না পুরো মুসলিম দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগের শেষ প্রতিনিধি, এবং নিজেদের বহুমুখি কর্মযজ্ঞ আর লেখনির মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভিন্ন জাতির কাছে নিজেদের সভ্যতার জ্ঞান হস্তান্তর করে গেছেন। সক্রেটিসকে যেমন বিষপান করিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল তেমনি ইবনে বাজাকেও হত্যা করা হয়েছিল বিষ প্রয়োগ করে। পরবর্তি পর্বগুলোতে আমরা ইবনে বাজা, ইবনে তুফায়েল এবং ইবনে রুশদের অবদান, ধর্ম ও দর্শন, পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.