ইমানের পরীক্ষা হয় সংকট কালে। ইমানের পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত থাকুন।
আখতারুজ্জামান লাবলু (ভোরের কাগজ, ১৭ জুলাই ২০১০): এক সময় ফুটপাতের চেনামুখ আলমের দিনরাত কেটেছে একবেলা-আধাবেলা খেয়ে না খেয়ে। টহল পুলিশের লাথি আর লাঠির গুঁতো খেয়ে ছুটতেন এদিক-সেদিক। সেই আলম এখন নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
জীবন ব্যবস্থার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের নামও পাল্টে যায়। তিনি এখন আর আলম নয়, চৌধুরী আলম। রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে তার নামে এখন রুম বুকিং দেয়া থাকে। রাত কাটান আলিশান প্রাসাদে, দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিলাসবহুল গাড়িতে। শুধু তাই নয়, তিনি ৬৭ লাখ টাকা আয়কর দিয়ে ৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সাদাও করেছেন।
সঠিক খুঁটি আর অর্থবিত্তের প্রতাপে রাজনীতিতে যুক্ত হতেও বেগ পেতে হয়নি তাকে। জোট সরকারের ক্ষমতার ৫ বছর চলাফেরা করেছেন পুলিশের গানম্যান সঙ্গে নিয়ে। পুলিশের বড়কর্তা থেকে শুরু করে সবাই সমীহ করে চলতেন। সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস ঢাকার মেয়র থাকাকালে তারই ক্যাডার হিসেবে রাজনীতিতে হকার আলমের পদচারণা শুরু হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছেও তিনি এখন এক প্রিয়মুখ। তাদের হাত ধরেই তিনি এখন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আলমের এই ঈর্ষণীয় উত্থানে তার বাল্য বন্ধুরাও থ বনে গেছেন। তার এই অভাবনীয় উত্থান আলাদীনের চেরাগের সেই কল্পকাহিনীকেও হার মানিয়েছে।
চৌধুরী আলমের ঘনিষ্ঠ সূত্র আরো জানায়, নোয়াখালীর গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে রাজধানীতে আসা কিশোর আলম এক সময় কাওরান বাজার এলাকায় সবজি বিক্রি করতেন। পরে তিনি গুলিস্তানের ফুটপাতে হকারি শুরু করেন। বিএনপি সরকারের ’৯১-৯৬ টার্মে তিনি ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে মালিক সমিতির চাঁদা আদায়ের লাইনম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির কারণে পুলিশ তাকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় এবং আটকাদেশ দেয়। সময়ের আবর্তে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে আলমের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বারবার গ্রেপ্তারকে তিনি রাজনৈতিক হয়রানি বলে প্রচার করে সুবিধা আদায় শুরু করেন। ক্ষমতার প্রভাবে এবং মির্জা আব্বাসের আশীর্বাদে তিনি এফডিসি গেটের কাছে রেলওয়ের সম্পত্তি দখল করে গড়ে তোলেন প্রাইভেট বাহিনী। এতে অগ্রাধিকার দেয়া হয় নোয়াখালী থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী তরুণদের।
সূত্র জানায়, নগরীর ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে কাপাসিয়া, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ ২০টি রুটে প্রতিদিন ১২/১৩শ বাস চলাচল করে থাকে। এসব বাস থেকে বিভিন্ন নামসর্বস্ব শ্রমিক সংগঠনের নামে চৌধুরী আলমের ক্যাডাররা প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ টাকা করে চাঁদা আদায় করে আসছে। এছাড়া গুলিস্তান রেলওয়ে সুপার মার্কেট, বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, সেগুনবাগিচা সিটি করপোরেশন মার্কেট, বঙ্গবাজার বাংলাদেশ সুপার মার্কেট, তোপখানা ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট ঘিরেও রয়েছে চৌধুরী আলমের নিয়ন্ত্রণ এবং তার ক্যাডাররা এসব মার্কেটে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে আসছে। এভাবেই অবৈধ আয়ের উৎস থেকে চৌধুরী আলম শূন্য থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন অঢেল সম্পদের অধিকারী চৌধুরী আলম নগরীর ব্যস্ততম বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকার পীর ইয়েমেনী মার্কেটে একাধিক দোকান, রাজধানীতে ৭টি বাড়ি এবং বেশ কয়েকটি নামী ব্র্যান্ডের গাড়ির মালিক।
নোয়াখালী তার গ্রামের বাড়িতে তৈরি করেছেন রাজকীয় প্রাসাদ। এলাকায় তিনি বিশাল দানবীর হিসেবে পরিচিত। সেই সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবেও তার রয়েছে বিশেষ পরিচিতি। প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্যাডার বাহিনীর জোরে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর এখন তিনি স্বপ্ন দেখেন ঢাকা-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য হওয়ার।
সূত্র জানায়, ঢাকার সাবেক মেয়র ও সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের শিষ্য চৌধুরী আলম।
তার হাত ধরেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট ও ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালকে টার্গেট করে ’৯১-৯২ সালে চৌধুরী আলম চাঁদা আদায়ের কথিত লাইনম্যান হিসেবে সেই যে মাঠে নামেন তারপর থেকেই তার প্রভাব প্রতিপত্তির পরিধি দিনদিন বাড়তে থাকে। গড়ে তোলেন বিশাল সিন্ডিকেট ও নেটওয়ার্ক। ব্যবসায়ী ও হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি তার আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। এসব কিছুকে জায়েজ করতে আলম রাজনীতিতে পুরোদমে সক্রিয় হয়ে উঠেন।
বিএনপির মিছির-মিটিং-এ লোকজন সরবরাহ এবং নানা কারণে চাররঙা পোস্টার ছাপিয়ে তিনি দলের সিনিয়র নেতাদের নজর কাড়েন। তোপখানা, সেগুন বাগিচা তার অধিনস্ত ক্যাডাররা মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত এবং তার ক্যাডারদের অস্ত্র ভাণ্ডার রয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বঙ্গবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর মির্জা আব্বাসের আশীর্বাদে এক সময়ের হকার চৌধুরী আলমকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর বঙ্গবাজারে রহস্যজনক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকশ দোকান পুড়ে ছাই হয়।
সর্বস্বান্ত হন শতাধিক ব্যবসায়ী। আর এতে কপাল খুলে যায় আলমের। ভস্মীভূত এলাকায় সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে অভিজাত ‘সিটি ট্রেড সেন্টার’ মার্কেট গড়ে তোলার নামে চৌধুরী আলম পজেশন বিক্রি করে হাতিয়ে নেন কয়েক কোটি টাকা। প্রভাব প্রতিপত্তি আর টাকার গরমে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে চৌধুরী আলম বিএনপির মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করেন। শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন না পেয়েও হতাশ হননি।
বিএনপির দাপুটে নেতা থাকাকালীন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালু মনোনয়ন পেলে আলম তার আনুগত্য স্বীকার করেন এবং এরপর থেকেই ফালুর মিছিল-মিটিং মানেই টিভি পর্দায় আলমের চেহারা দেখা মিলতে শুরু করে।
সূত্র জানায়, বড়ো মাপের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা ব্যবসায়ী না হয়েও চৌধুরী আলম ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা করেছেন। শতকরা সাড়ে ৭ ভাগ হারে তিনি ৬৭ লাখ টাকা আয়কর দিয়ে ৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সাদা করেছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, চৌধুরী আলম রাজনৈতিকভাবে একজন নেতা হলেও পুলিশের কাছে তিনি সন্ত্রাসীদের গডফাদার। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় রয়েছে দেড়শতাধিক মামলা ও জিডি।
এছাড়া দুদক তার বিরুদ্ধে ৪টি মামলা দায়ের করে। যার একটিতে তার বিরুদ্ধে দণ্ড দেয়া হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।