আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপরূপা চন্দ্রঘোনা (শেষ পর্ব)

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
চন্দ্রঘোনায় পাহাড়ের গাছে গাছে অর্কিড দিনগুলো ভালোই কাটছে পড়াশুনা নামে মাত্র। সবসময় একটা বেড়ানো বেড়ানো ভাব। আব্বা একদিন আমাদের ভাইবোনদের কর্নফুলী পেপার মিল দেখাতে নিয়ে গেল। ছোটো ছিলাম অত মনে নেই তবে এটুকু মনে আছে এক বিশাল কান্ডকারখানা। নদী দিয়ে কত দুর দুরান্ত থেকে ভাসিয়ে নিয়ে আসা বাশঁগুলো একদিক দিয়ে একটা ফানেলের মত মেশিনে ঢালছে সেখান থেকে ছোটো ছোটো টুকরো হয়ে আরেক মেশিনে।

সেখানে টুকরো গুলো মিশে একটা মন্ড তৈরী হচ্ছে সেগুলো আমরা হাতে নিয়ে দেখলাম,নরম কাদার মত। সেই মন্ডগুলো রোলারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কাগজ হয়ে বের হয়ে আসছে কি অদ্ভূত! তার পর সেই কাগজ বড় বড় রোলারে পেচিয়ে রেখে বিভিন্ন সাইজ করে কেটে রাখছে। আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম সেই অভূতপূর্ব ঘটনা। চলে আসার সময় মিল কতৃর্পক্ষ আমাদের কিছু কাগজ গিফ্ট করলো। আমরা কখন বাসায় আসবো কখন আম্মার কাছে গল্প করবো তার জন্য দৌড় লাগালাম টিলার নতুন পথটার গোড়ায় এসে।

এরপর একদিন রেয়ন মিল ভ্রমন তবে ঐ মিলের কিছুই আমার মনে নেই। সুতরাং কি লিখবো এটা বাদ। এরপর সেই লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা অপরূপ সুন্দর কর্নফুলী নদী পার হয়ে মগ পল্লী বেড়ানো। একদিন আম্মা আমাদের পারসোনাল কাজের জন্য যে সিপাহী ছিল সামসু কাকা তাকে বল্লো আমাদের নদী আর তার ঐপারে ঘুরিয়ে আনার জন্য। সে আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে চল্লো।

আমার বড় ভাই ছিল ঢাকায় সে একটু উচু ক্লাশে পড়তো বলে তাকে এই ভ্রমন কাম ট্রান্সফারে নিয়ে আসা হয়নি। যাক আমরা খুব খুশী খুশী। সাম্পানে করে নদী পার হচ্ছি, শীতকাল নদীর পানি সরের মত স্হির। আমি এখনও পর্যন্ত নৌকায় বসলে আর ঢেউ না থাকলে হাত বা পা না চুবিয়ে থাকতে পারিনা। ঢেউ নেই আমি বার বার হাত দিচ্ছি পানিতে আর সামসু কাকা বার বার বলছে পানিতে হাত না দেয়ার জন্য।

কারণ নদীতে তার ভাষায় কামট আছে। কামট কি তখন বুঝিনি এখন মনে হয় শার্ক বা কুমীর জাতীয় কিছু হবে! যাক ঐ পারে গেলাম পাহাড়ের মাঝে কি নিরিবিলি গাছ পালায় ছাওয়া মগ পল্লী। কাঠের খুটির উপর মাচা করে ওদের ঘর। মাটির পথ বেয়ে হেটে হেটে যাচ্ছি সামসু কাকা বর্নণা দিচ্ছে। মগদের নাপ্পী খাবার কথা, মহিলা তান্ত্রিক সমাজ, পুরুষরা কোনো কাজ করেনা তারা খালি মদ খায় ইত্যাদ ইত্যাদি।

আমরাও দেখলাম ছেলেগুলো বসে আছে আর মহিলারা কাঠ কাটার মতন শক্ত কাজ থেকে সবই করছে। একটা লোককে দেখলাম বিরাট এক দা ধার দিচ্ছে পাথরে ঘসে ঘসে। যথারীতি সামসু কাকা জানালো এটা দিয়ে তারা মানুষের মাথা কাটে! ভয়ে আমরা তিন ভাইবোন জড়োসড়ো। আরেকটু এগোতেই সামসু কাকার তথ্য প্রমান করে এক মগ পুরুষ মদ খেয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে আর ভীষন চেঁচামেচি করছে, বৌটা নির্বিকার ভাবে তার হাতের কাজ করেই চলেছে। ভয়ে সেখান থেকে সরে আসলাম।

ঘুরতে ঘুরতে বেশ বেলা হোলো। পাহাড়ের উপর থানা সেখানেও গেলাম খুবই সুন্দর চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য যা আমরা আগেই শুনেছিলাম। ওখানে আমাদের বিস্কিট কলা কি সব খেতে দিল মনে নেই। এরপর আমরা ফিরে আসছি, আবার সেই নদী সাম্পান আবার সেই হাত চুবানো। সামসু কাকা বার বার না করছে আর ভয়ংকর কামটের ভয় দেখাচ্ছে আর আমার হাত অজান্তে চলে যাচ্ছে পানিতে।

হটাৎ ঠাস্‌ করে আমার গালে এক চড়। আমিতো হতভম্ব হয়ে সামসু কাকার দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নীচু করে রইলাম,অধিক শোকে পাথরের অবস্হা। সামসু কাকা অপ্রস্তত। আমার ছোটো ভাইবোনরা তো থ। আর আমি যে কিনা এখোনো পর্যন্ত প্রচন্ড অভিমানী কেউ একটা খোঁচা বা কঠিন কথা বল্লে কেঁদে ভাসাই,কতদিন পর্যন্ত মন খারাপ থাকি।

আর ছোটো বেলার অবস্হাতো আরও ভয়ংকর, না খেয়ে থাকা, ঘরের পেছনে লুকিয়ে থাকা, আব্বা যেয়ে খুজে এনে নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়া কত ঘটনা। আম্মার হাতে এই জীবনে দু একবার হালকা করে চুল টানা ছাড়া আর কোনো নির্যাতনের কাহিনী নেই, সেই আমি!! নৌকা ঘাটে ভিড়ল, আমার পা চলছেনা আস্তে আস্তে হেটে বাসায় আসছি । চোখের পানিতে রাস্তা ঝাপসা হয়ে আসছে। গলার মধ্যে কান্না দলা পাকিয়ে ব্যাথা করছে । ভাইবোনরা চুপ, তারা খালি আমাকে দেখছে লুকিয়ে লুকিয়ে।

বাসায় আসলাম আমিতো সোজা পিছনের পরিত্যক্ত রান্নাঘরটায় গিয়ে একটা কাঠের গুড়ির উপর বসার সাথে সাথে এতক্ষনের জমানো কান্নার ধারা নেমে আসলো। পরে শুনেছিলাম আমার মার কাছে ভাইবোনের নালিশ দেয়া, সামসু কাকার আম্মার পায়ে পড়ে মাফ চাওয়া ইত্যাদি। তারতো সরকারী চাকুরী, চলে না গেলেও শাস্তিমূলক বদলী তো অবশ্যাম্ভাবী। প্রচন্ড নরম মনের অধিকারী আমি সামসু কাকার করুন মুখের দিকে চেয়ে এতো খারাপ লাগছিল বলার নয়। পরদিন আব্বা বারান্দায় তার হাজার বার পড়া শরৎ রচনাবলী পড়ছে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আর মাঝে মাঝে বাগানের গোলাপ গুলোর দিকে চেয়ে দেখছে।

আমি আস্তে করে চেয়ারের হাতলটায় বসলাম। আব্বা এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বল্লো 'কিছু বলবে মা?' আমি আব্বার কাধে মুখ লুকিয়ে বল্লাম 'আব্বু তুমি সামসু কাকাকে শাস্তি দিওনা'। আব্বু বললো 'কেন সে তো তোমাকে চড় মেরেছে' ! আমি বল্লাম আমার যে ভীষন খারাপ লাগছে ওনার জন্য, কোথায় কোন গহীন জঙ্গলে বদলী হবে, কতদিন পর পর বাড়ী গিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখবে, তাছাড়া সেতো আমায় নিষেধ করেছিল কামট আমাকে কামড়ে দেবে বলে আমি তো শুনিনি'। আব্বা কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে চেয়ে বল্লো' তাই হবে মা তুমি যা চাও'। মন থেকে একটা ভার নেমে গেল যেন।

আব্বাও অনেক নরম মনের মানুষ ছিলেন তার মুখের দিকে চেয়ে মনে হোলো সেও ভারমুক্ত হোলো। শেষ লেখকঃ মাহজাবীন জুন
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.