ব্লগার পাঠক হিসেবেই বেশী আনন্দে আছি।
ব্রি নাকি হাইব্রিড ধান নিয়ে খুব একটা আগ্রহী না_ এমনি একটি ধারণা অনেকের মধ্যেই ছিল। কেউ কেউ আরেকটু কঠিন করে বলতেন, ব্রির বিজ্ঞানীরা হাইব্রিডের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু এ কথাগুলো যে সঠিক ছিল না তা এখন প্রমাণিত হয়েছে। ব্রি থেকে কিছুদিন আগে তিনটি হাইব্রিড ধানের (ব্রি হাইব্রিড ধান-২, ব্রি হাইব্রিড ধান-৩ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান-৪) জাত অবমুক্ত করা হয়েছে।
ব্রি হাইব্রিড ধান-৪ আবার রোপা আমন মৌসুমের জন্য। সত্যিকথা বলতে কি রোপা আমনের জন্য এখনও কোন সাড়া জাগানো হাইব্রিড বাজারে আসেনি। এর আগে প্রথম যে জাতটি অবমুক্ত করা হয় সেটি ছিল হাইব্রিড ধান-১। আর সেই জাতটি ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার জন্য নির্দিষ্ট। জাতটি ফলনের দিক থেকে বেশ আশাপ্রদ হলেও জীবনকালের বেলায় বেশ লম্বা।
তাই চাষিদের কাছে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এমনকি বিজ্ঞানীরাও খুব বেশি খুশি ছিলেন বলে মনে হয়নি। কিন্তু হালে যে জাতগুলো অবমুক্ত করা হলো এগুলো ফলন এবং জীবনকাল প্রচলিত যে কোন জাতের তুলনায় অবশ্যই ভাল। আর হাইব্রিডের চাল নিয়ে চাষিদের যে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় ব্রির উদ্ভাবিত জাতগুলো নিয়ে অন্তত সেই অসুবিধায় পড়তে হবে না। অর্থাৎ ভাত ঝরঝরে এবং সুস্বাদু হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিশেষ কথা হলো বিজ্ঞানীরা তাদের পেশাগত মেধা ও ধৈর্য দিয়ে যথাযথভাবে বিচার-বিবেচনা করেই এ জাতগুলো অবমুক্তির জন্য সুপারিশ করেন।
হাইব্রিড-প্রযুক্তির সঙ্গে ব্রির সংশ্লিষ্টতার কথা কিছু বলা দরকার। এদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাইব্রিড ধানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি তার বেশ আগে থেকেই ব্রির বিজ্ঞানীরা এ প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত। না হওয়ার কোন কারণও নেই। কারণ হাইব্রিড ধান প্রযুক্তি পুরোপুরি বিজ্ঞান।
সেই বিজ্ঞান থেকে আমাদের বিজ্ঞানীরা দূরে থাকবে তা ভাবা যায় না। যা হোক হাইব্রিড ধান নিয়ে গবেষণার শুরুটা চীনে। নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার পর বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ দিকে চীন প্রথম হাইব্রিড ধান অবমুক্ত করে। এর অব্যবহিত পরেই আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু হয়।
আশির দশকের শেষ দিকে আমাদের বিজ্ঞানীদের অনেকেই এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
তবে জাত উদ্ভাবনের প্রথাগত কাজ শুরু হয় এরও বছর দশেক পর। কিন্তু প্রথমেই এমনি ধরনের ঝঁক্কিপূর্ণ কোন প্রযুক্তি নিয়ে এগুনো সহজ ছিল না। তবে সরকারের ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বাসনা ছিল। তাই বলা যায়, সরকারি প্রশ্রয়েই এবং ব্রির ছত্রছায়ায় হাইব্রিড ধান সংক্রান্ত একটি প্রকল্প কাজ করতে থাকে। যার উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী।
যেমন, ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো হতে হবে সেচ বা বৃষ্টিবহুল এলাকায় অভিযোজন উপযোগী, সুস্বাদু এবং উচ্চফলনশীল। ভাত অবশ্যই ঝরঝরে হতে হবে। প্রধান প্রধান রোগবালাই-পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে সহনশীল হতে হবে।
নিউক্লিয়াস এবং ব্রিডার বীজ উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের চাহিদা মোতাবেক বীজ উৎপাদনের সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাই হাইব্রিড ধান গবেষণার শুরুতেই এ প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল লাগসই হাইব্রিড ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা। এ লক্ষ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের হাইব্রিড-বিজ্ঞানীরা শুধু নিজেদের পরিবেশ ও সমাজের উপযোগী হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনের চেষ্টায় ছিলেন। এ ব্যাপারে অবশ্যই চীন এবং ইরি থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়া গেছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা এসেছে এডিবি-ইরি (অউই-ওজজও) এবং ডিএফআইডি (উঋওউ) থেকে।
তবে একটি জাত উদ্ভাবন প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ।
এ ফাঁকে সরকারকে বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিতে হয় বীজ আমদানির। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চীন-ভারত থেকে জাত আমদানি করেই অনেকটা তড়িঘড়ি করে অন্তর্বর্তীকালীন সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে চাষিদের প্রলুব্ধ করতে থাকে।
এসব প্রক্রিয়ায় গবেষণা ও বীজ অনুমোদনের বিস্তারিত ধাপগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। ইতোমধ্যে বেশকিছু হাইব্রিড ধান শুধু উচ্চ ফলনের কারণেই চাষিরা পছন্দ করে ফেলে।
কিছু হাইব্রিড প্রথম বছরে জনপ্রিয়তা পেলেও পরে সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তারপরেও দেশের হাইব্রিড বীজের আমদানি বাড়তে থাকে। উল্লেখ্য, সরকার যখন হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমতি দেয় তখন কিন্তু একটা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। সেটি ছিল যে তিন বছরের মধ্যে অবশ্যই দেশে বীজ উৎপাদন করতে হবে। বাস্তবে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে খুব বেশি এগুতে পারেনি।
তবুও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক বা সুপ্রিম সিডের মতো গতিশীল কিছু প্রতিষ্ঠান বীজ উৎপাদনের ব্যাপারে ভাল অগ্রগতি দেখাতে সক্ষম হয়।
এক খতিয়ান অনুসারে ১৯৯৮-৯৯ সালে আমদানিকৃত বীজের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০০ মেট্রিক টন। ২০০৮-০৯ এ পরিমাণ দাঁড়ায় ৮১৫০.৬৩ মেট্রিক টন। দেশে বীজ উৎপাদন শুরু হয় ২০০১-০২ থেকে। সে বছর উৎপাদিত বীজের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৩৭ মেট্রিক টন।
কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ২১৫০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমদানিসহ মোট বীজের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০০০ মেট্রিক টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছরের হাইব্রিডের আবাদি আওতা দেখানো হয়েছে ১০ লাখ হেক্টর। অর্থাৎ বর্তমানে হাইব্রিড ধান আমাদের বোরো উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের যে পরিচিতি তার জন্য বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোই এ কৃতিত্বের দাবিদার।
তারা এ প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে। ব্রির যাত্রা কেবল শুরু। আর ব্রি কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাকে এ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়াটাই বেমানান। তাই দেশীয় এবং লাগসই প্রযুক্তির খাতিরে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ব্রির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। এজন্য ব্রির পক্ষ থেকে জোরদার পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের কথা বলা হয়েছে।
প্রথাগত গবেষণার যে পরিবেশ তা এখনও পাবলিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথায়ও সম্ভব না। তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিককালে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী নিয়োগ দিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছুটা গবেষণার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তারা বীজ উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে ব্রিকে সাহায্য করতে পারেন। বাজার এবং বিতরণ প্রক্রিয়ার জন্য যে উত্তম নেটওয়ার্ক দরকার তা কেবল প্রাইভেট সেক্টর থেকেই আশা করা যায়। তাই বাজার-বিপণনে প্রাইভেট সেক্টর ব্রিকে সাহায্য করতে পারে।
আর বিএডিসি-কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে তো ছাতার মতো আগলে রাখতে হবে পুরো পদ্ধতিকে।
আগেই বলেছি যে, দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন হাইব্রিড বীজ ব্যবসা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা কেউই ব্রির মতো করে (ঝপরবহঃরভরপ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয) কোন জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করেনি বা তাদের সেই ধরনের চিন্তা-ভাবনাও নেই।
ব্রির বিজ্ঞানীদের কাছে ফলন একটা ফ্যাক্টর মাত্র। এ সঙ্গে ধানের অভিযোজন উপযোগিতা, পীড়ন পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা, ভাতের আকার, স্বাদ, প্রোটিনের পরিমাণ, এমাইলোজ ইত্যাদি গুণ খেয়াল রাখতে হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যারা বিদেশ থেকে জাত আমদানি করে নিজেদের উদ্ভাবিত জাত হিসেবে বাজারজাত করছেন তারা এদিকে নজর দেন বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে ব্রির গবেষণাগারে শতাধিক হাইব্রিড ধানের এমাইলোজ পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু ব্রির মানদ- অনুযায়ী মাত্র ৫টি জাত এ পরীক্ষায় পাস করতে পেরেছে। অর্থাৎ অধিকাংশ জাতের এমাইলোজের পরিমাণ ২৫ শতাংশের কম। এ অবস্থায় বলতে গেলে সব জাতেরই ভাত গলে যাবে।
যা সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এমাইলোজের সঙ্গে গাইসেমিক ইনডেক্সের বিপরীত সম্পর্ক বিদ্যমান। কম এমাইলোজ মানে গাইসেমিক ইনডেক্সের পরিমাণ বেশি হওয়ার কথা। আর এ সমীকরণ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে। প্রচলিত হাইব্রিডের চালগুলোকে মিলাররা (চালের কলের মালিক) যখন যাঁতায় পিষে চিকন জাতীয় অন্য কোন চালের ব্রান্ডে পরিণত করে তখন চালের পুষ্টিগুণ, ফাইবার ইত্যাদি কমই অবশিষ্ট থাকে।
এগুলো কিন্তু ব্রির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানই মনোযোগ দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা রাখে। যারা ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে গবেষণা করবে বা যারা পেশাগতভাবে গবেষক না তারা কখনই ধানের পুষ্টি মানের বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়। কারণ এসব ব্যাপারে আলাদাভাবে জোর দিয়ে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। হলে হয়তো অনেক জাতকে পত্রপাঠ বিদায় করতে হতো।
তারপরও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের (উদাহরণস্বরূপ বিএডিসি) কর্ণধাররা তাদের আমদানিকৃত জাতের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তারা বলছেন, ভাত নরম হলে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু আমি বলছি, নরম ভাত কোন কোন কর্ণধারের পছন্দ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ঝরঝরে ভাতই খায়। তাদের কথা মনে রাখতে হবে।
ক'দিন (২২ জুন ২০১০) আগে ব্রিতে হাইব্রিড ধান নিয়ে একটা ওয়ার্কসপ হলো।
সেখানে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কেউ কেউ একমাত্র হাইব্রিড ধানকেই পরিত্রাতার ভূমিকায় বসিয়েছেন। এবং তাদের দাবি বিজ্ঞানীরা যেন সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যান। আমি মনে করি, তাদের এ দাবি যুক্তিযুক্ত নয়। শুধু হাইব্রিডনির্ভর ধান দিয়ে আমাদের খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা সম্ভব না। কারণ হাইব্রিড ধান, ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির অনেকগুলো প্রযুক্তির একটি প্রযুক্তি মাত্র।
আর এটা যে এখনও খুব পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি তাও নয়। তাই ইনব্রেড (উফশী) ধানকে কোনকালেও অবহেলা করা যাবে না। তবে ইনব্রেড ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড ধান আমাদের খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমরা যারাই হাইব্রিড নিয়ে কাজ করিনে কেন, আমাদের হাইব্রিড যেন আমাদের আমজনতার মনের মতো হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।