সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষকের কারাদণ্ডের রায়ের পর শিক্ষক-সমাজ যে-প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে সরকারের (সেনাবাহিনীর) টনক নড়েছে অবশেষে। এতদিন শিকদের মুক্তির ব্যাপারে ঢাবির উপাচার্য-সিন্ডিকেট ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছিল, এখন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়াররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। শিক্ষকদের কর্মসূচি স্থগিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন, একজন উপদেষ্টাও সেই আহ্বান জানিয়েছেন, আলোচনা এবার হচ্ছে সমানে সমানে। শিক্ষকসমাজ হয়তো এতদিন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বিচারপ্রক্রিয়া পর্যবেণ করছিল, ইতিবাচক রায়ের জন্য অপো করছিল। কিন্তু যে-রায় হয়েছে, তাতে শিক্ষকসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়েছে।
অনুমান করি সচেতন নাগরিকেরাও এই রায় মেনে নিতে পারেননি। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ মৌনমিছিল হয়েছিল, তা পত্রিকা-টিভি চ্যানেলে সংবাদ আকারে এসেছিল। কিন্তু রাজশাহীর চার শিক্ষক কারাদন্ড ভোগ করছে, তাহলে তারও জেলে থাকা উচিত। তাকে জেলে পোরার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
তবে সেনাবাহিনী তার ইগো পুরোমাত্রায় প্রয়োগের শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ডিজিএফআইয়ের মেজররা গ্রেফতারকৃত ও কারাদন্ডভোগকারী শিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাচ্ছে ক্ষমা চাইতে, মুচলেকা দিতে। তাহলে সহজেই ব্যাপারটা নিস্পত্তি হয়ে যায়। এই ইস্যুটা দ্রুত সমাধান করতে সরকারও এই মুহূর্তে খুব আগ্রহী। কিন্তু এতদূর আইনী লড়াই করে পরিবারগুলো ক্ষমা চাইবে কেন? ক্ষমা চাইলে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা বাকি যতটুকু আছে তাও থাকেনা। অন্যদিকে ঢাবির শিকদের ফোনে, এসএমএস-এ হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে কর্মসূচি প্রত্যাহার করার জন্য।
তবে এই ঘটনার এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মোচড় যে ক্যান্টনমেন্ট এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাঁটা দিয়েছে।
আর জনগণের যে-অংশটি মনে করতেন যে দলবাজি করা শিক্ষকদের উচিত শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তারাও এতদিনে জেনেছেন যে দন্ডপ্রাপ্ত শিকেরা দলবাজির বিরুদ্ধে চিরকাল কাজ করেছেন। তাই শিক্ষকদের পক্ষে জনসমর্থনও বাড়ছে দ্রুত।
বিজ্ঞ আদালতের রায় শোনার পর অন্য অনেকের মতো আমিও মর্মাহত হয়েছি। কিন্তু অন্য অনেকের চেয়ে আমার অনুভূতি অনেকটা গভীর।
কারণ চারজনের মধ্যে তিনজনই আমার প্রত্য সহকর্মী। দুলালচন্দ্র বিশ্বাস আমার প্রিয় সহকর্মী। শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের প্রতি উদ্দীপ্ত করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। সেলিম রেজা নিউটন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন আমার প্রিয়তম বন্ধু। এই বন্ধুত্ব কেবল সামাজিক বন্ধুত্ব নয়, এর সঙ্গে কর্মের যোগ রয়েছে, রয়েছে মতাদর্শিক সমরূপতা।
সমাজতন্ত্রীরা এধরনের সম্পর্ককে বলে কমরেড। এর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের বিষয়টি যোগ করলে বোঝা যাবে আমার অনুভূতির তীব্রতা। আমরা একসঙ্গে মিডিয়া ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন করতে থাকি বিভিন্ন লেখা-প্রকাশনা-সেমিনারের মাধ্যমে। অধুনালুপ্ত 'এডকমসো' জার্নাল, 'মানুষ' পত্রিকার সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যায় কাজ করি সেলিম রেজা নিউটনের নেতৃত্বে। আমি আর মামুন সম্পাদনা করতে থাকি 'যোগাযোগ' পত্রিকা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের সেইসব কয়েকটি বছর আমার জীবনে উজ্জ্বলতম সময়। সত্যিকারের শেখার সময়। ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক হলেও অপর শিক্ষক মলয় ভৌমিককে মূলত চিনতাম থিয়েটার-ব্যক্তিত্ব হিসেবে। রাজশাহীর থিয়েটার চর্চাকে তিনি সম্প্রসারিত করেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। মোনাজাতউদ্দিনের সঙ্গে একসময় তিনি সাংবাদিকতা করেছেন উত্তরবঙ্গ থেকে।
তার কন্যা আমার বর্তমান কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।
তবে এই শিক্ষকদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আজকের আলোচনায় হয়তো অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ঠেকবে। কারণ রায় হয়েছে আদালত থেকে এবং এই রায়ের ভিত্তি নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক আইন। এই রায়পরবর্তী আলোচনায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রসঙ্গ হয়তো অবান্তর। কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং একটি ব্লগে আমার পোস্টকে ঘিরে নানা জনের মন্তব্যে এটা বুঝতে পেরেছি যে, জনগণের একাংশ মনে করেন শিকরা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অধঃপাতে ঠেলে দিচ্ছে, তাই এইরকম 'রাজনীতিবিদ' শিক্ষকদের বিচার হওয়াটা বরং খুব কাজের কাজ হচ্ছে।
তিনজনকে কাছ থেকে দেখে এবং চতুর্থজনকে দূর থেকে বুঝে আমি এই দাবি করছি যে, এরা বরাবরই লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বহু দূরে থেকে নিজস্ব গবেষণা-অধ্যয়ন-কর্মকাণ্ড নিয়ে মগ্ন থাকতেন, বরং লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে তারা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সরব ছিলেন। অথচ সাজা হলো এই চারজনেরই।
তাদের বিরুদ্ধে আনীত মূল অভিযোগ, ছাত্রবিক্ষোভে 'উস্কানি' দেয়া, আদালতে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত অভিযোগ টিকেছে একটিই, জরুরি আইন ভঙ্গ করে ছাত্রদের মৌনমিছিলে অংশ নেয়া। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা কী ছিল, এর কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত আর কতটুকু নৈরাজ্য সেসব বিশ্লেষণে না গিয়ে শুধু এটুক বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যাপকভাবে মারধরের কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিবাদ-র্যালি হয়েছে, তাতে সংহতি জানিয়ে ঐ চারজন শিক্ষক নৈতিকভাবে ঠিক কাজটিই করেছেন।
আইনের কাছে তা দোষের হলেও হতে পারে, কিন্তু 'সমাজ তাদের দোষী মনে করছে না' -- বলেছেন বিশিষ্ট আইনবিদ শাহদীন মালিক। সমকালে ৬ ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত তার কলামে তিনি বলেছেন, আদালতের কাজ শুধু আইন অনুযায়ী বিচার করা নয়, তাতে ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা হচ্ছে কি-না সেদিকে দৃষ্টি রাখা। এটা অনস্বীকার্য যে, আদালত আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ এবং আইন অনুযায়ী বিচার করার বাইরে তাদের আর কোনো দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না। কিন্তু আদালত যখন আরিক অর্থে অন্যায় আইন প্রয়োগ করেন, তখন ফলাফলও অন্যায় হয়ে যায়।
শাহদীন মালিকের বক্তব্য থেকে আমরা এটা বুঝতে পারি, উস্কানির অভিযোগের যথার্থতা যখন প্রমাণিত হয়নি, বিজ্ঞ আদালত তখন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চায় তাদের অবদান বিবেচনায় রেখে, এই শিকদের বেকসুর মুক্তি দিলেও দিতে পারতেন।
কিন্তু আদালত 'আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ' থাকতে চেয়েছেন, তাই এই আইনের প্রয়োগ 'আক্ষরিক অর্থে' হয়েছে। আইনের শাসন আমাদের মানতে হবে, আইনী প্রক্রিয়ায় আমাদের লড়তে হবে। কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত শিকদের মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী হবার ব্যাপারে আমি অন্তঃত দু'টি ঘটনা পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছি। একটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন আটককৃত চার অধ্যাপকের মুক্তির ব্যাপারে সরকারের প থেকে তাকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এই মুক্তিপ্রক্রিয়া রাবির শিক্ষকদের বেলায়ও কার্যকর হতে পারে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো। প্রভাবশালী উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের রায়পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে সমকালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে সরকার নমনীয় ভূমিকা নিতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, শিক্ষকদের বিচার যখন হয়ে গেছে, তখন সরকার আইনগত পদপে নিতে পারে। সরকার তাদের ক্ষমা করে দিতে পারে, বিচার স্থগিত করে দিতে পারে, আবার শাস্তি কমিয়েও দিতে পারে।
বোঝা যাচ্ছে দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আটককৃত শিক্ষকদের বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে সরকার খানিকটা নমনীয় হয়ে উঠেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্য অনেকের সঙ্গে আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আটককৃত ও সাজাপ্রাপ্ত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে মুক্তি দিন।
আরেকটি বিষয়ের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি রচনাটি শেষ করতে চাই। আটককৃত শিক্ষকদের ঘিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ খুবই হতাশাজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সিন্ডিকেট, শিক্ষকসমিতি যেক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তির ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার শিক্ষকদের মুক্তির ব্যাপারে যেন বিরুদ্ধাচরণ করছে।
আমি মনে করি এই ক্ষেত্রে সেই 'দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী' কাজ করছে। যেহেতু আটককৃত শিক্ষকরা সবাই প্রগতিশীল মতাদর্শের এবং যেহেতু বর্তমান উপাচার্য বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের মনোনীত, আর সিন্ডিকেটসহ অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে যেহেতু জামায়াতপন্থীদের দাপট আছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের মুক্তির ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে। শিক্ষকরা গ্রেফতার হবার পরপরই আগ বাড়িয়ে উপাচার্য বলে বসেছিলেন গ্রেফতারকৃতদের চাকরি সাময়িকভাবে চলে যাবে। পরে সেটা প্রত্যাহার করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আইনী ব্যবস্থা নেয়, শিক্ষদের পরিবারকে মানসিক সমর্থন দেয়া ইত্যাদি কোনো পদক্ষেপ রাবি কর্তৃপ নেয়নি। সংবাদে প্রকাশ, এখন এই সাজাপ্রাপ্ত চার শিককে অচিরে বরখাস্ত করার জন্য জামায়াতপন্থী শিক্ষকেরা উপাচার্যকে চাপ দিচ্ছেন।
পরবর্তী সিন্ডিকেটের সভায় এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। রাবি কর্তৃপক্ষের কাছে আমার দাবি, যেহেতু রায় হয়েছে নিম্ন আদালতে এবং বিচারপ্রক্রিয়া এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, তাই উচ্চ আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত এধরনের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কলঙ্ক' দয়া করে আর বাড়াবেন না।
ডিসেম্বর ০৯, ২০০৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।