আগামীর স্বপ্নে বিভোর...
দেবে যাচ্ছে ঢাকা। টেকটোনিক কারণের পাশাপাশি ভূগর্ভস্খ পানির আধারে শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ায় রাজধানী ঢাকা ক্রমে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্খানে ভবন হেলে পড়া সুউচ্চ ভবনের বিভিন্ন স্খানে ফাটলের অন্যতম কারণ হচ্ছে এই দেবে যাওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার এই তথ্য জানান। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি জানা গেছে।
২০০৩ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভূতত্ত্ব বিভাগে বাংলাদেশের টেকটোনিক প্লেটের ত্রিমাত্রিক গতির ওপর পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ওই বছর দেশে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পুটয়াখালী) জিপিএস স্খাপন করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে আরো ১২টি জিপিএস (মধুপুর, রায়পুর, চুনারুঘাট, জুড়ি, জাফলং, জামালগঞ্জ, সীতাকুন্ড, মানিকছড়ি, দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি ও কাপ্তাই)-এ স্খাপন করা হয়। বর্তমানে দেশে ১৭টি জিপিএস রয়েছে।
জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্যে বাংলাদেশে ভূখণ্ডের অণুভূমিক গতি নির্ণয়ের পাশাপাশি ভূপৃষ্ঠের উলম্ব গতির পর্যবেক্ষণও চলছে।
স্খাপিত এসব সিস্টেম থেকে ২০০৩ থেকে ২০০৯ এই সাত বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার বেগে উত্তর-পূর্ব কোণে ধাবিত হচ্ছে। আর একই সাথে বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ কমবেশি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা প্রতি বছর ১৩.৯১ মিলিমিটার হারে দেবে যাচ্ছে।
দেবে যাওয়ার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে গত সোমবার অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশ একটি সক্রিয় বদ্বীপ এবং বেঙ্গল বেসিনের অংশ। এই বেঙ্গল বেসিনের তলায় (বেসমেন্ট) ওপরে রয়েছে প্রায় ২০ কিলোমিটার পুরুত্বের শিলার স্তর।
ওপরের কয়েক শ’ মিটার গঠিত হয়েছে নবীন পলি দিয়ে। অধিকহারে পলি জমা হওয়ায় এর ভারে এবং ইন্ডিয়ান, তিব্বত ও বার্মিজ প্লেটের পরস্পরমুখী সংঘর্ষের কারণে বেঙ্গল বেসিনের তলা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
ঢাকা দেবে যাওয়ার এটাই একমাত্র কারণ নয়। এর সাথে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্খ পানি উত্তোলন। অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, শুধু টেকটোনিক কারণে দেবে যাওয়ার হার এত বেশি হওয়ার কথা নয়।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে গভীর ও অগভীর নলকূপের সংখ্যা হচ্ছে দুই হাজার ৫ শ’র ওপরে। এই নলকূপ থেকে বর্তমানে প্রতিদিন দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, যা ১৯৯৮ সালে ছিল দেড় হাজার মিলিয়ন লিটার। ভূগর্ভস্খ পানির ওপর চাপ বাড়ায় পানির স্তর দ্রুত হারে নেমে যাচ্ছে।
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ৭০-এর দশকের প্রথম দিকে ভূগর্ভস্খ পানির স্তর ছিল ১০ মিটারের মধ্যে। তবে কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে প্রতি বছর ভূগর্ভস্খ পানির স্তর তিন মিটার করে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এই পানির স্তর ৬৮ মিটার নিচে রয়েছে। দ্রুত নগরায়নের কারণে বর্তমানে রাজধানীর মতিঝিল, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, রামপুরা, রমনা, শাহবাগ, ধানমন্ডি এসব এলাকায় পানির স্তর দ্রুত হারে নেমে যাচ্ছে।
অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূগর্ভস্খ যে শিলাস্তরগুলো পানিতে (স্যাচুরেশন) ছিল, তা থেকে পানি সরে যাওয়ার কারণে স্তরগুলো পানিশূন্য হয়ে উলম্ব দিকে সঙ্কুচিত হতে থাকে। এতে স্তরের বালুকণা পুনর্গঠিত না হয়ে সঙ্কুচিত হয়।
দেখা গেছে, যে লেয়ারের পুরুত্ব ছিল এক মিটার, সঙ্কুচিত হয়ে বছরে সেটির পুরুত্ব দাঁড়ায় ৯৯.৯৯ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ সঙ্কুচিত হয়ে এক মিটারের নিচে চলে আসে। কিছু স্তর রয়েছে সিল্ট বা কাদার। পানি সরে গেলে কাদার স্তর সঙ্কুচিত হয় বেশি। ভূগর্ভস্খ থেকে অতিমাত্রায় অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে এই স্তর নেমে যাচ্ছে।
অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, যে হারে পানি তোলা হচ্ছে তাতে ভূগর্ভস্খ জলাধার প্রাকৃতিক নিয়মে পূর্ণ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ঢাকায় প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও পানির স্তর আগের অবস্খায় ফিরে আসছে না। ইটপাথরে যেভাবে রাজধানীর ভূপৃষ্ঠকে ঢেকে ফেলা হয়েছে তাতে পানির ভূগর্ভে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন নগরীতে অধিক হারে ভূগর্ভস্খ পানি উত্তোলনের ফলে সেসব স্খানে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বিশেষ করে ব্যাংকক অন্যতম।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬৭ সালে ঢাকা নগরীর খোলা জায়গার পরিমাণ ছিল ৯২.০৪ শতাংশ।
করোনা ইমেজ থেকে প্রাপ্ত ১৯৬৭ সালে নেয়া ওই স্টাডিতে দেখা গেছে ঢাকায় ইমারত আর রাস্তাঘাট দিয়ে ঢাকা ছিল মাত্র ৭.৫৪ শতাংশ।
আর ২০০৮ সালে গুগল ইমেজ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ঢাকা নগরীর খোলা জায়গার পরিমাণ ৪০.০৬ শতাংশ। কনসিল বা ইটপাথরে ভবনে আবদ্ধ ভূপৃষ্ঠ এরিয়া হচ্ছে ৬৯.৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ দ্রুত নগরায়নের কারণে ঢাকা খোলা জায়গা থেকে কনসিল জায়গার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্খ পানির আধারটি পূর্ণ হওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না। ফলে ফাঁকা জায়গা পূরণ হচ্ছে না।
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার দেবে যাওয়ার কারণটি ব্যাখ্যা করে বলেন, পানির সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে ভূঅভ্যন্তরের স্তরগুলোতে পোর-স্পেয়ার কমে গিয়ে উলম্ব (ভার্টিক্যাল) দিকে সঙ্কোচন হচ্ছে। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠ নিচের দিকে নিমজ্জিত হচ্ছে।
প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞ আইনূন নিশাত বলেন, ভূ-গর্ভ থেকে অপরিকল্পিত ও অধিক মাত্রায় পানি উত্তোলনের কারণে ব্যাংকক ও মেক্সিকোতে দেবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটি ঢাকার জন্য কতটা সত্যিই তা গবেষণায় উঠে আসবে। কেননা ঢাকার মাটির গুণাগুণের কারণে এর ভূ-পৃষ্ঠ দেবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রকৌশলীরা এর আগে সভা-সেমিনারে জানিয়েছিলেন।
বর্তমানে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের আর্থ অবজারভেটরির কোনো গবেষণা থেকে থাকে তা জরুরি ভিত্তিতে জাতির সামনে উপস্খাপন করা দরকার।
বিরূপ প্রতিক্রিয়া
রাজধানীতে যে একের পর এক ভবন দেবে যাচ্ছে বা হেলে পড়ছে কিংবা বিভিন্ন স্খানে ফাটল দেখা দিচ্ছে তা এসবেরই প্রতিক্রিয়া। এই দেবে যাওয়ার কারণে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়ার আগের ইঙ্গিত হচ্ছে ভবন হেলে পড়া বা রাস্তাঘাটের নিচে বা অন্য কোনো স্খানে মাটির নিচে সার্ভিস সিস্টেমে হঠাৎ বিপর্যয়। যেমন গ্যাসপাইপ ফেটে যাওয়া বা পানির পাইপ হঠাৎ লিক হয়ে যাওয়া।
অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দেবে যাওয়ার এই হার শিলার গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে সব স্খানে একই রকম নয়।
এই অসম নিমজ্জনে ভূমির ঢালে পরিবর্তন হয়ে থাকে। ফলে সুয়্যারেজের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হবে। নগরীতে জলাবদ্ধতা বাড়বে। একই সাথে মাটির নিচে ভূগর্ভস্খ যেসব সার্ভিস রয়েছে যেমন গ্যাস, পানির লাইন সেগুলোর ওপর চাপ এবং টান বাড়ছে। যার কারণে সুয়্যারেজ বা গ্যাস পাইপগুলো কোথাও কোথাও হঠাৎ করে ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তিনি বলেন, দেবে যাওয়ার কারণে কোথাও পানির পাইপ লিক করে ভূগর্ভস্খ মাটি ক্ষয় হতে থাকে। একে বলা হয় আন্ডারগ্রাউন্ড সয়েল ইরোশান। এই সয়েল ইরোশানের কারণে পাশের সুউচ্চ ভবনে চাপ সৃষ্টি করবে। স্বাভাবিক কারণে ভবনটি অস্খিতিশীল অবস্খার মধ্যে পড়ে। এক সময় ভবনের বিভিন্ন স্খানে ছোট ছোট ফাটল বা একটু হেলে পড়তে দেখা যায় এবং ভবনটি ভেঙে বা পুরো দেবে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে এবং এর আগে ভবন হেলে বা কাত হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো আসলে দেবে যাওয়ার ঘটনা। ১৯৯৫ সালে কলাবাগানে, ১৯৯৭ সালে বাসাবো ঝিলপাড়ে ভবন ধসে পড়ার এটিই অন্যতম কারণ। বেগুনবাড়ী, নাখালপাড়া, গেন্ডারিয়া ও মিরপুর এলাকায় ভবন হেলে পড়ার পেছনে এই কারণ কাজ করছে বলে অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার মতামত দেন।
খবরটা এখান থেকে প্রাপ্ত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।