আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চন্দ্রকথা -পলায়ন

গোধুলি ভালবাসায় ভিজে একসারা একাকী একজন।

তোমাকে দেখার চোখ দেয়নি ঈশ্বর আধেক আধাঁর তাই, আধেক ভাস্বর... গা কেপেঁ জ্বর এসেছে। মাথার মধ্যে এই কয়টি লাইন ঘুরছে অনবরত। রাতের ট্রেন ছুটে চলেছে কোন এক অজানার পথে। চন্দ্র আর আমি দাঁড়িয়ে মুখোমুখি।

প্রবল বাতাসে উড়ছে চন্দ্রের ঝলমলে নীল ওড়না। আধো আলো আর আধাঁরীতে রহস্যময়ী দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ধারণ করে। চোখ জ্বালা করছে। বিচলিত হয়ে পড়ি নিজের এই দুরাবস্থা দেখে। জ্বরের ঘোরে পাগল হয়ে গেলাম নাকি? চন্দ্র উসখুস করে বলে উঠে 'আপনার কি হয়েছে? এত অস্থির হয়ে আছেন কেন?' 'ননা না কিছু হয়নি' বিচলিত আমি লজ্জায় একদম এতটুকু হয়ে গেলাম।

আপনি কি একাই যাচ্ছেন? লজ্জা অসস্তি কাটাতে জিজ্ঞেস করলাম। ' না আমার হাসবেন্ড আছে সাথে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি মাত্র একবার গিয়েছিলাম। তো এইবার ও ছুটি নিয়েছে বেশ কদিন থাকব বাড়িতে' চন্দ্রকে বেশ সুখী মনে হলো। মনটা কেন জানি দমে গেল।

বেশ চমৎকার একটা রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে ছিল আর আমিও পাগলের মত কি সব ভাবছিলাম। হাসি পেল। কথা বলতে বলতেই পরের স্টেশন এসে গেল। 'চলু্ন আপনাকে পৌঁছে দিই'। চন্দ্র হেসে বলল 'হ্যাঁ চলুন।

আপনার সাথে সময়টা বেশ ভালই কাটল। চলুন না আমাদের সাথে। সারা রাত বেশ গল্প করা যাবে। আমার হাসবেন্ড কিন্তু খুব মিশুক। ভাল লাগবে আপনার দেখবেন।

' আমার মনটা খুব পালাই পালাই করছিল। বললাম 'এই ভাল। এখানেই শেষ হোক আলাপচারিতা। ' প্ল্যাটফর্মে প্রচন্ড শোরগোলের মাঝে পথ করে যেতে যেতে কথা বলছি। চন্দ্ররা প্রথম শ্রেণীতে যাচ্ছে।

সেই দিকে দ্রুত এগিয়ে যাই। ওর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় নিচ্ছি এমন সময় কাদের যেন চাপা স্বরের কথা ভেসে আসে কামরার ওপাশ থেকে। চন্দ্র কেন জানি আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে দরজার সামনে দাঁড়ায়। কি শুনছে ও? ওর দিকে তাকিয়ে চমকে যাই। মুখ থেকে সব রক্ত কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়েছে।

কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলাম। তার আগেই চন্দ্র তীরবেগে সরে আসল দরজার কাছ থেকে। নেমে গেল আবার প্ল্যাটফর্মে। দরজাটা খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কালক্ষেপণ না করে নীচে নেমে গেলাম।

ভীড়ের মাঝে কোথায় গেল চন্দ্র? ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাই। ও কী শুনেছে আড়িপেতে যে দৌঁড়ে নেমে গেল? অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে। এক পাশে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো মানুষের ভীড়ের মাঝে খুঁজছি সেই অনিন্দিত মায়াবী মুখ। কে যেন পাশে এসে দাঁড়ায়।

চট করে ফিরে তাকাই। চন্দ্র! 'আপনি কোথায় ছিলেন? আর এমন করে দৌঁড়ে নেমে আসলেন কেন? কি...'প্রশ্নটা শেষ করতে পারলাম না। চন্দ্র আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দিল। সমস্ত অস্তিত্ব যেন কেঁপে গেল সেই স্পর্শে। ওর দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম।

চন্দ্র কাঁদছে! বড় বড় চোখ দুটি নিমেষেই ভরে গেল পানিতে। ভয়ার্ত গলায় ফিসফিস করে বলল 'আপনি যে আমাকে চেনেন কারো কাছে স্বীকার করবেন না। ওরা আপনাকে দেখেছে। আমার জন্য আপনি বিপদে পড়েন এটা আমি চাই না। প্লীজ যা বলছি তাই করবেন।

ট্রেন ছাড়বে এখনি। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। 'এক নিঃশ্বাসে কথা কটি বলে থামল। আমার বিস্ময় বাড়ছেই। ঘটনার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।

ট্রেনের দিকে একবার তাকালাম দেখি চার পাঁচ জন ষন্ডা মার্কা লোক সাথে নিয়ে নেমে আসছে সুদর্শন এক লোক। বুঝলাম এই লোকই চন্দ্রের স্বামী। লোকগুলি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। ওরা চন্দ্রকে খুঁজছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও নিরাপদ না।

কিছুমাত্র না ভেবে চন্দ্রের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। দ্রুত সরে যাচ্ছি ভীড়ের ভেতরে। যাতে ওরা খুঁজে না পায় আমাদের। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কালো মত মোটা এক লোক ঠিকই দেখে ফেলল।

ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। চারপাশ থেকে লোক গুলি দ্রুত পায়ে ছুটে আসছে। যেকোন মুহুর্তে ধরে ফেলবে। সামনে দিয়ে ছুটে চলা বগিটার দিকে একবার তাকালাম। চন্দ্রের হাত ধরে ছুটতে শুরু করলাম।

এক লাফে ট্রেনে উঠে পড়লাম। এক সেকেন্ডের জন্য ওরা মিস করল। কিন্তু পেছনের বগিটায় ঠিকই উঠে পড়তে পারল। চন্দ্রের স্বামীর হিংস্র মুখটা দেখতে পেলাম এক পলকের জন্য। খুনীর দৃষ্টি! চন্দ্র কি যেন বলার চেষ্টা করে আবার থেমে গেল।

ট্রেন আপাতত নিরাপদ কিন্তু খুব বেশীক্ষণের জন্য না। সামনের স্টপেজ আসার আগেই কিছু একটা করতে হবে। তার আগে জানা দরকার চন্দ্রের পুরো ইতিহাস। ' চন্দ্র আপনি কি খুলে বলবেন আসলে কী ঘটছে এখানে? প্লীজ কাঁদবেন না। এটা কান্নাকাটির সময় না।

যেকোন সময় এই লোকগুলি ধরে ফেলতে পারে আমাদের। খুব দ্রুত সরে যেতে হবে এখান থেকে। তার আগে আমার জানা দরকার আপনি কি বিপদে নিজেকে জড়িয়েছেন। প্লীজ খুলে বলুন। ' চন্দ্র কান্নাভেজা গলায় যা বলল তা অনেকটা এরকম-অনেক দিন ধরেই চন্দ্রের স্বামী শহীদের যাতায়াত ছিল ওদের বাসায়।

যখনই বাসায় যেত ওদের সবার জন্য কোন না কোন গিফট নিয়ে যেত। ওর বাবা মায়ের খুব প্রিয় পাত্র হয়ে যায় অল্পদিনের মাঝেই। এক পর্যায়ে শহীদ তার বাসনা ব্যক্ত করে তাদের কাছে যে সে চন্দ্রকে বিয়ে করতে চায়। চন্দ্রের বাবা মা সানন্দেই রাজী হয়ে যান। শিক্ষিত, সুদর্শন অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলে তাদের মত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, এত তাদের পরম সৌভাগ্য।

একদিন চন্দ্রের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর দু'মাস খুব সুখেই ছিল ওরা। মাঝে মাঝে শুধু অনেক লোকজন আসত ওদের বাসায়। তখন চন্দ্রকে বেশ সেজেগুজে তাদের সামনে যেতে হত। চন্দ্রের স্বামী ব্যবসায়ী তার কাছে নানা ধরনের লোকজন আসবে এটাই স্বাভাবিক।

তবুও চন্দ্রের কেন জানি ভাল লাগত না এই ব্যাপারটা। মাঝে মাঝে বেশ ঝগড়াও হতো শহীদের সাথে। মাস খানেক আগে এই লোক গুলোর সাথে খুব ঘনিষ্টতা হয় শহীদের। প্রায়ই বাসায় ডেকে নিয়ে আসে দাওয়াত করে। চন্দ্রকে ওরা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত।

শহীদ ইচ্ছে করেই ওকে বারবার ওদের সামনে ঠেলে দিত। একদিন হঠাৎই শহীদ এসে বলল 'তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নাও মা খবর পাঠিয়েছে'। শ্বশুরবাড়ীর সাথে তেমন কোন যোগাযোগ কখনই ছিল না। চন্দ্র বেশ খুশীমনেই যেতে রাজী হল। যে কদিন ওখানে থাকবে অন্তত এই লোকগুলোর আনাগোনা তো বন্ধ হবে।

স্টেশনে যখন ওরা এলো। তখন দেখে ঐ লোকগুলাও এসেছে সাথে খুব কেতাদুরস্ত এক নতুন লোক। ট্রেনে ওঠার সময় কেমন করে যেন ও আলাদা হয়ে যায় ঐ দলটা থেকে। বাকী ঘটনা অনুমেয়। চন্দ্রের মোবাইল বাজতে শুরু করেছে।

শহীদ!! চন্দ্রকে ফোন রিসিভ করতে বললাম। চন্দ্র ভীত সন্ত্রস্ত গলায় বলল 'হ্যালো- ওপাশ থেকে শহীদের চিৎকার ভেসে এলো 'তোমার এত বড় সাহস! অন্য এক লোকের হাত ধরে পালাচ্ছো? এত তাড়াতাড়ি প্রেমিকও জুটিয়ে ফেলেছো? চন্দ্র ভালয় ভালয় ফিরে এসো নইলে তোমার প্রেমিকের হাড়টুকুও খুঁজে পাবে না। 'কি চাও তুমি?' চন্দ্র ফুঁপিয়ে ওঠে। 'শোন এরা মানুষ ভাল নয় ওদের লীডারের কাছে খুব উঁচু দরে তোমাকে বেচেছি। এখন যদি ঠিকঠাক মত মাল ডেলিভারী দিতে না পারি আমার কিমা বানিয়ে ছাড়বে এরা।

চন্দ্র কি বুঝতে পারছ আমার কথা? ভাল...'চন্দ্র লাইন কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মোবাইলটা ওর হাত থেকে নিয়ে অফ করে দেই। রাগে আমার সমস্ত শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। ' চন্দ্র আপনি কাঁদবেন না। একটা অমানুষের জন্য কাঁদাও অন্যায়।

কথা বলতে বলতে চন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে যাই। চন্দ্রের রক্তশুণ্য মুখে যেন মূর্তিমান আতংক ভর করেছে। চট করে পেছনে ফিরে তাকাই। রক্ত হিম হয়ে গেল। সেই পাঁচটা ষন্ডা মার্কা লোক! এরা কেমন করে এই বগিতে আসল! মোষের মত একটা লোক প্রচন্ড বেগে ছুটে আসছে।

'অরন্য'- তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল চন্দ্র। বাতাসে যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগল অ-র-ন্য , অ--র--ন্য... (চলবে) চন্দ্রকথা-পরিচয় Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।