আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চন্দ্রকথা- প্রেম

গোধুলি ভালবাসায় ভিজে একসারা একাকী একজন।

ভোর হচ্ছে। সারা রাত ধরে চলা তান্ডবের পর যেন সব পাপ ধুয়ে মুছে একটু একটু করে ফুটে উঠছে ভোরের পবিত্র আলো। সারা রাত ধরে ক্লান্তিহীন বৃষ্টির পর ভোরের এই অস্ফুট আলো শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। পথের দু ধারের বনানী ধীরে ধীরে জেগে উঠছে হাজারো পাখির কলতানে।

কি ভালই যে লাগছে আমার! সমস্ত অস্তিত্ত যেন বুভুক্ষ হয়ে ছিল একটু আলো দেখার জন্য। প্রাণভরে উপভোগ করছি ভোরের এই বিশুদ্ধ বাতাস। সারা রাতের দুর্ভাবনা উৎকন্ঠা যেন কেটে গেল এক নিমেষেই। বসে আছি এক যাত্রী ছাউনিতে। ঘন্টাখানেক আগে এটা আমরা খুঁজে পেয়েছি।

সেই থেকে ঠাঁয় বসা। অপেক্ষা একটি ভোরের। চন্দ্র ঘুমিয়ে আছে আমার কাঁধে মাথা রেখে। মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে ঘুমের ঘোরে। দুঃস্বপ্ন দেখছে হয়ত।

যতবার ওকে দেখছি মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। ভোরের প্রথম আলোয় দেখছি এক অপ্সরীকে। চোখ ফেরাতে পারছি না কেন জানি। কাল রাতে আধো আলো আধো অন্ধকারে দেখা মেয়েটিকে এখন খুব অচেনা লাগছে। চন্দ্র আমার সর্বনাশ করে ফেলছে।

জোয়ারের মত অপ্রতিরোধ্য গতিতে আসছে প্রেম। আমি তার আগমনী শুনতে পাচ্ছি মনের অতলে। কাল সন্ধ্যায়ও কি ভাবতে পেরেছিলাম আজ এই ভোরে কি পেতে যাচ্ছি আমি। গত কয়েক ঘন্টায় যা যা আমি করেছি তার সাথে পুরোনো অরন্যকে মেলাতে পারছি না। মামার বাড়িতে হাজারো লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করে বড় হওয়া অবহেলিত একজন মানুষ।

বাবার মৃত্যুর পর মা চলে এসেছিলেন মামার সংসারে আমাকে নিয়ে। সারাদিন ঝিয়ের কাজ করে মা দু' বেলা দু' মুঠো খাওয়া আর আমার লেখাপড়াটা অতি কষ্টে চালিয়ে নিত। মামার বড় সংসার। অনেক গুলো ছেলে মেয়ে। সন্ধ্যায় সবাই যখন জোরে জোরে নামতা মুখস্থ করত দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোট্ট অরন্যও শুনে শুনে শিখত।

মামা আমার আগ্রহের জন্যই কি না কে জানে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তার জন্য অবশ্য একটা ঝিকেও ছাড়িয়ে দিলেন মামী। মা থাকতে আর কাজের লোকের কি প্রয়োজন! আমার মা দিন রাত খেটে খেটে রক্ত পানি করে আমায় বড় করে তুলেছেন। স্বপ্ন দেখতেন অনেক বড় হব অনেক টাকা কামাবো। মামার ঋণ শোধ করব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই মা চলে গেলেন আমাকে সম্পুর্ন একা করে দিয়ে। মামার বাড়ির দরজা বন্ধ হলো। সেই দিন গুলির কথা ভাবলে এখনও বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। পড়ার সময়টুকু ছাড়া বাকী সময়টা কেটে যেত টিউশন করে। বন্ধুরা যখন সবাই বিকেলে মাঠে বসে আড্ডা দিত আমার সনয় কাটত তখন বাচ্চাদের অংক শিখিয়ে।

আট দশটা সাধারণ ছেলের মত আমারও ইচ্ছে করত কারো ভালবাসা পেতে কিন্তু নিজের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে অমন সাহস কখনও করতে পারিনি। কতটা তৃষিত এই মন ভালোবাসার জন্য বুঝলাম আজ এই ভোরে। আনমনেই বিড়বিড় করে আবৃতি করি ওর কানে কানে- 'ভালোবাসা কই, এতো মৃত্যুর মুখোমুখি কল্পনা ছুঁয়ে ক্লান্তির কাছে যাওয়া, বাসনার মুখে অঙ্গার জ্বেলে জ্বেলে, ওষ্ঠের লাল অমৃতে চুমু খাওয়া...' চন্দ্র জেগে উঠছে। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে তাকাই পাছে ধরা পড়ে যাই এই ভয়ে। আমার কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসে ও।

লাজুক চোখে তাকিয়ে দেখে একবার। অপরাধী গলায় বলে ' আমাকে ডাকেননি কেন?' ওর দিকে তাকালাম। হাসি পেল ওর লজ্জা দেখে। এর মাঝে কত কি যে হয়ে গেল আমার তা যদি ও জানত! হেসে বলি 'ডাকব কেন? আপনি খুব ক্লান্ত ছিলেন এই টুকু ঘুমের খুব দরকার ছিল তো। ' দূর থেকে গাড়ীর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

কি আসছে বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি আড়ালে যেতে বলি চন্দ্রকে। একটা বাস আসছে। হাত ইশারায় থামতে বলি। বাসটা থামতেই উঠে পড়লাম।

কোথায় যাবে এটা জানতে চাইলাম কনট্রাকটরের কাছে। লোকটা জানালো গোবিন্দপুর। গোবিন্দপুর। নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে। অজিত! আরে ওখানেই তো অজিত থাকে।

মনে পড়েছে একবার অজিতের সাথেই গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। অজিত আমার একমাত্র বন্ধু যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। চন্দ্রকে বললাম অজিতের কথা। অজিত আমার রুমমেট ছিল ভার্সিটিতে এবং একমাত্র বন্ধু । সে ছিল আমার সব সুখ দুঃখের সাথী।

ভার্সিটি থেকে বের হবার পর ও ফিরে যায় গোবিন্দপুর পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরতে। আর আমি এক কারখানায় কাজ নিয়ে চলে যাই দূরে। তবে যোগাযোগ রেখেছি সবসময়। গত পাঁচটা বছরে যদিও একবারও দেখা হয়নি ওর সাথে। অনেক দিন পর প্রিয় বন্ধুকে দেখব ভেবে খুব উচ্ছসিত হয়ে পড়েছিলাম তাই চন্দ্রের অন্যমনস্কতা খেয়াল করিনি।

চন্দ্র হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে। চমকে ওর দিকে তাকাই। আবার মনে পড়ে যায় সবকিছু। কাঁদছে আমার প্রথম প্রেম। অজানা ভয়ে আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার।

প্রচন্ড খারাপ লাগছে। এমন ভয়ংকর সময়ে কান্নাটা অস্বাভাবিক নয়। চন্দ্রের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্তও সব ঠিকঠাক চলছিল। স্বামী সংসার নিয়ে সুখী তো ছিল চন্দ্র।

ও কি আর জানত যে স্বামীকে ও পেয়ে সুখী সেই ওর জীবন বিপন্ন করে তুলবে! ওকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। ব্যথিত চিত্তে দেখছি ও ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। 'চন্দ্র প্লীজ কাঁদবেন না। ভয় পাবেন না প্লীজ। আপনাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে না দিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।

আপনি বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে। আমি আছি চন্দ্র আমি আছি আপনার পাশে। ' চন্দ্র কান্নাভেজা গলায় বলে ' আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। কাল যদি আপনি না থাকতেন তাহলে ওরা আমাকে...' কান্নায় গলা বুজে এল ওর। ' কিন্তু ওরা আপনাকে ধরতে পারেনি তাই না? কিচ্ছু হবে না দেখবেন।

' হেসে ওকে অভয় দেবার চেষ্টা করি। 'আমরা কোথায় যাচ্ছি?' চন্দ্র উৎসুক হয়ে জানতে চায়। 'আপাতত এখান থেকে দূরে সরে যেতে চাই। গোবিন্দপুরে অজিত থাকে। ওর ওখানে যাওয়া যেতে পারে।

তার আগে বাস থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিতে হবে। ' বললাম আমি। চন্দ্রকে দেখছি খুব সন্তর্পণে। চোখদুটি মানছে না কোন শাসন। বিবশ হয়ে বসে আছি।

মনের ভেতর চলা প্রচন্ড ঝড়ে টালমাটাল আমি। আবেগের অথৈ জলে ভাসছে সমস্ত অস্তিত্ত। চন্দ্র একবার তাকিয়েও দেখল না আমায়। সেই যে কখন থেকে উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে দূরে! কি যে দেখছে এত সেই জানে। দুর্ভাবনার কালো ছায়া চন্দ্রকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

আর আমি সদ্য প্রেমে পড়ে বিহবল হয়ে পড়েছি। গোবিন্দপুর। দাঁড়িয়ে আছি বিশাল এক প্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে । অজিত আছে কিনা এখন কে জানে। সকাল ৭ টা বাজে।

বাড়িতেই তো থাকার কথা। যাহোক সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ডোরবেল বাজাই। অজিতই দরজা খুলল। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর ' অরন্য তুই!! সত্যি তুই? ওহ গড! আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি?' ওর বজ্রবেষ্টনীর ভেতর ছটফট করে উঠি 'ছাড় ছাড়। ' হাসতে হাসতেই চন্দ্রের দিকে তাকায় অজিত কৌতুহল নিয়ে ওকে কিছুক্ষণ দেখে।

আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায়-'কি রে কাকে নিয়ে এসেছিস? ভাবী নাকি? বিয়ে করলি কবে? একবার জানানোর প্রয়োজনও মনে করলি না? হড়বড় করে এক গাদা প্রশ্ন করেই চলেছে গাধাটা। ভীষন বিব্রত বোধ করছে চন্দ্র। সেটা খেয়াল করেই অজিতকে থামাই ' আরে থাম থাম। আমাদের কি বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবি?' অজিত হেসে আহবান করে আমাদের। চলবে... চন্দ্রকথা-গ্রহণ Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।