আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নবাজ তরুণদের প্রকৌশল শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র চুয়েট

জাগরী একটি নির্দলীয় মঞ্চ যেখানে বাংলাদেশের যুবসমাজ দেশের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সচেতন,সোচ্চার ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে পারে। www.jagoree.org  

চারপাশ জুড়ে ছোট ছোট পাহাড়। পথজুড়ে সারি সারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দিন নেই রাত নেই কোকিল, শালিক আর নাম না জানা হরেক পাখির কিচিরমিচির। এখানে সেখানে কৃষ্ণচূড়ার ছড়াছড়ি।

প্রধান ফটক দিয়ে একটু ভেতরে ঢুকতেই গোলচত্বর। বিশাল এক কড়ই গাছ অভিভাবক হয়ে চত্বরটিকে আগলে রেখেছে। গোলচত্বরের পাশ দিয়ে ছোট একটি হ্রদ আরও ভেতরের দিকে চলে গেছে। এ চত্বরটা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রকৌশল জীবনের কষ্টকর মুহূর্তগুলো এক নিমেষেই চাঙ্গা হয়ে যায় এ চত্বরে এসে বসলে।

এতক্ষণ শুনছিলেন বাংলাদেশের পাঁচটি সরকারী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ক্যাম্পাসের কথা। চুয়েটের প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে এ গোলচত্বর ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সাক্ষী এ গোলচত্বর। ইতিহাসের পাতা থেকে চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে প্রায় ২৫ কি.মি. দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক নয়নাভিরাম পরিবেশে গড়ে উঠেছে চুয়েট। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কসংলগ্ন পাহাড়ঘেরা এ ক্যাম্পাসটি প্রায় ১৬৩ একর জায়গা নিয়ে ১৯৬৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরম্ন করে।

তখন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র ১২০ জন। এরপর ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি), চট্টগ্রাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিআইটিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) রূপানত্মর করা হয়। শিক্ষা কার্যক্রম তড়িৎকৌশল, যন্ত্রকৌশল ও পুরকৌশল _এ তিনটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরম্ন করলেও তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগের প্রসারের কথা চিনত্মা করে ১৯৯৯ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগটি নতুনভাবে সংযোজন করা হয়। এরপর ২০১০ সালে স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের আওতায় স্থাপত্য এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা (ইউআরপি) বিভাগ দুটি চালু হয়।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিন অনুষদের অধীনে ছয়টি বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আগামী বছরই খুলতে যাচ্ছে পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং প্রকৌশল নামে আরেকটি বিভাগ। এছাড়া রয়েছে ইনস্টিটিউট অব এনার্জি টেকনোলজি, আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সেন্টার ফর ইনফরমেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগ। ছাত্র-ছাত্রীদের কথা বর্তমানে চুয়েটের শিক্ষার্থী দুই হাজারেরও বেশি। ছাত্র রাবি্ব বললেন, ছায়া সুনিবিড় নিরিবিলি এ ক্যাম্পাস পড়াশোনার জন্য একবারে আদর্শ জায়গা ।

প্রকৌশল পড়তে আগ্রহী হলেন কেন? প্রশ্ন করলে এবার উত্তর দিলেন অঙ্কন। বললেন, 'বিয়ের পাত্রের বাজারে প্রকৌশলীদের কদর বেশি, তাই। ' সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল পড়ল সবার মাঝে। 'ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হওয়ার। সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই চুয়েটে পড়তে আসা।

' জানালেন আসাদ। এবার সবাই একমত হওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যারা এখানে পড়তে এসেছেন তারা জানালেন, ঘরবাড়ি বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে। প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু ক'দিন যেতেই ক্যাম্পাসের মনোরম সৌন্দর্য আর একদল মনের মতো বন্ধু পেয়ে পুরো ক্যাম্পাস এখন তারাই মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন।

বিদেশী শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন এ ক্যাম্পাসে। নেপালের অবধিস, ওয়াজি, আনন্দ জানালেন এখানে তাদের এত ভাল লাগবে তা কখনও চিনত্মাই করেননি। বাংলাদেশীদের সংস্পর্শে এসে তারা মুগ্ধ । প্রকৌশল জীবনটা অনেকখানিই যান্ত্রিক। সারাদিন ক্লাস, সেশনাল, কুইজ-ভাইভা, পরীক্ষা।

রাতে আবার পরদিনের জন্য প্রস্তুতি। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা সময় বের করে নেন নিজেদের জন্য। 'ভাই চুয়েটের হল লাইফের মতো জোস্ আর কিছু নেই' বললেন সজীব। সারাদিনের ব্যসত্মতার পর অনেকেই দল বেঁধে বসে যান কার্ড আর ক্যারম খেলায়। খেলার ফাঁকে ফাঁকে চলে আড্ডা।

এ আড্ডা কখনও চলে রাতভর। 'চুয়েট ছেড়ে যখন যাব সবচেয়ে বেশি মিস করব এই আড্ডাটা' জানালেন কামরম্নল। ক্লাস শেষে কেউ কেউ যান শহরে টিউশনি করাতে। যারা খেলাধুলায় ভাল তারা চলে যান চুয়েটের বিশাল খেলার মাঠে। শিক্ষার্থীরা জানালেন, এ মাঠ আর মাঠের ধার ধরে চলে যাওয়া পথটা দিয়ে হাঁটলে মনটা অন্যরকম হয়ে যায়।

তাই শিক্ষার্থীদের সবাই প্রতিদিন বিকেলে দল বেঁধে একপাক অবশ্যই ঘুরে নেন এ জায়গাটা। একদল আছে হলের ছাদে বসে শুরম্ন করেন গানবাজনা। গানের আসরে গিটার, হারমোনিয়াম যেমন থাকে তেমনি থাকে একতারা আর ঢোল। আছে একটা বাউল-ফকির সংঘ। বিদু্যতের লোডশেডিং শুরম্ন হলেই বসে যায় বাউল আসর।

হাছন, লালন, শাহ আবদুল করিমসহ নানা সাধকের গান চলতে থাকে একের পর এক। অন্যান্য সুবিধা চুয়েটে ছাত্রদের জন্য ৪টি ও ছাত্রীদের জন্য ১টি হল রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চুয়েটের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহ ও তারেক হুদার নামে চুয়েটের দু'টি হলের নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশাল অবদানের জন্য ড. কুদরত-এ খুদার নামে একটি হলের নামকরণ হয়। তবে বাকি দু'টি হলের এখনও কোন নামকরণ হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল দু'টির নামকরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন। চুয়েটের শিক্ষার্থীরা কারিগরি খাতে গত কয়েক বছরে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। আর এর নেপথ্যে রয়েছে চুয়েটে রোবট ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণাকারী ছাত্র সংগঠন 'অ্যাসরো' (এন্ড্রমিডা স্পেস এ্যান্ড রোবটিক রিসার্চ এ্যাসোসিয়েশন) এবং 'আরএমএ' (রোবো মেকাট্রনিঙ্ অ্যাসোসিয়েশন)। আগামী বছর আনত্মর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এ সংগঠনগুলো অংশ নিতে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি সংগঠন।

এর মধ্যে রয়েছে চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি, জয়ধ্বনি, গ্রীন ফর পীস এবং নাটকের দল বাংলা নাট। এ সংগঠনগুলো পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তবুদ্ধি চর্চা। চুয়েটের এ সংগঠনগুলো তাদের সাফল্য দিয়ে গৌরবান্বিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। 'পড়াশোনার এত চাপ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে সংগঠন চালান?' জবাবে গ্রীন ফর পীসের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বললেন, 'শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা মেলে ধরতে আর পড়াশোনার একঘেয়েমি দূর করতে এসব সংগঠনের সৃষ্টি। তাই যারা আগ্রহী তারা ঠিকই সময় বের করে নেন।

' ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি খায়রম্নল বাসার জাহিদ বললেন, 'আমাদের সংগঠনের এ আড্ডার মাঝ থেকেই বের হয়ে নতুন নতুন গঠনমূলক সব পরিকল্পনা। ' আর এ সব পরিকল্পনা বাসত্মবায়নে চুয়েটের স্বপ্নবাজ তরম্নণরা ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে। তাই দেশজুড়েই চুয়েটের সংগঠনগুলোর সাফল্যের গান । দেশগড়ার কারিগর হবু প্রকৌশলীরা তৈরি হচ্ছেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য। স্বপ্নবাজ এসব মেধাবী তরম্নণ শুধু শিক্ষাদীক্ষাতেই নন, মানসিকতাতেও দেখাতে চান আধুনিকতা আর সৃজনশীলতা।

তাই তারা জানালেন তাদের আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয়ের কথা। বললেন-'আমরা করব জয়, নিশ্চয়। '

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.