প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে টেলিফোনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে দুই দলই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময়ই সংলাপের পক্ষে। বিরোধী দল যদি প্রস্তাব দেয় তাহলে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারকেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে এতে নতুনত্ব কিছুই দেখছি না। আওয়ামী লীগ সব সময়ই সংলাপের পক্ষে। দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ৪ মে বিরোধীদলীয় নেতা সংলাপের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে সরকার উৎখাতের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। হেফাজতকে মাঠে নামিয়ে সরকার পতনের স্বপ্ন তারা দেখেছিল। কিন্তু তা হয়নি। আশা করি জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ বসছে বিরোধী দল যদি কোনো প্রস্তাব দেয় তাহলে আমরা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করুন। অন্যথায় দলীয় সরকারের অধীনে এক তরফা কোনো নির্বাচনের আয়োজন করলে যে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হবে- তাতে আগামীতে ৪২ বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। সংসদে গিয়ে বিএনপিকে নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বানকে প্রধানমন্ত্রীর ফাঁদ আখ্যা দিয়ে ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, আপনাদের পাতানো ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি। কাজেই দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে অবিলম্বে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনুন। সংসদে গিয়ে নির্দলীয় সরকারের কোনো প্রস্তাব দেওয়া হলে আওয়ামী লীগ কণ্ঠভোটে তা নাকচ করে দিয়ে বলবে, সংসদ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগের এই ফাঁদে বিএনপি পা দিতে পারে না। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগকেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল এনে পাস করার আহ্বান জানান তিনি।
ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনরা : চলমান সংকট নিরসনে দুই নেত্রীর সংলাপে বসা নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের দূতিয়ালিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংলাপ-সমঝোতার বিকল্প নেই। বর্তমানে যে সংকট চলছে, তাতে শুধু দেশই নয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও উদ্বিগ্ন। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবের টেলিফোন এমনই একটি সতর্কবার্তা। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে আলাপ-আলোচনায় বসে আগামী নির্বাচনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য পন্থা বের করা উচিত। নইলে শুধু গণতন্ত্রই ক্ষতিগ্রস্ত নয়, দুই নেত্রীর জন্যও শুভকর হবে না। বিশিষ্টজনেরা আশা প্রকাশ করেন, বান কি-মুনের ডাকে সাড়া দিয়ে অচিরেই দুই নেত্রী সংলাপে বসবেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিশ্লেষকরা এসব কথা বলেন। সংবিধান অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে প্রধান দুই দল এখনো বিপরীত অবস্থানে। অবশ্য দেশের বিশিষ্টজন ছাড়াও এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সংলাপ-সমঝোতার তাগিদ এসেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সংলাপের আহ্বান প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, দুই নেত্রীকে বিশ্বনেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলমান সমস্যার সমাধান করা উচিত। এতে শুধু তাদেরই নয়, গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল হবে। তবে এখন দেখার বিষয় দুই নেত্রী কী করেন? আমরা আশা করি, শীঘ্রই সংকট উত্তরণে তারা সংলাপে বসবেন।
তবে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বান কি-মুন সংলাপের আহ্বান জানালেও দুই নেত্রী স্ব স্ব অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। এতেই বোঝা যায় সংলাপ কোন দিকে যাবে। আমাদের দেশের নেতানেত্রীরা তাদের অবস্থানে অন্ধ। কিন্তু সংলাপ-সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই চরম মূল্য দিতে হবে। এতে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, জাতিসংঘ মহাসচিবের ফোন কল মানেই একটি বাড়তি প্রেসার। রাজনৈতিক দলগুলোর আশা করি এটা বুঝতে বাকি নেই। বোঝা যাচ্ছে এখন শুধু বাংলাদেশের জনগণই নয়, জাতিসংঘও আগামী নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি, জাতিসংঘের কথায় নয়, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করেই প্রধান দুই নেত্রীকে সংলাপে বসা উচিত। নইলে এর বিকল্প হচ্ছে সংঘাত-সংঘর্ষ। আর তা নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক দলের কাম্য হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হচ্ছে দুই নেত্রীর সংলাপ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব যা বলেছেন তা বাংলাদেশের মানুষেরই প্রতিধ্বনি। বন্ধু হিসেবে তিনি দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও আশা করি, জাতিসংঘ মহাসচিবের ডাকে সাড়া দিয়ে দুই নেত্রী আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি করবেন। এতে দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। তবে বান-কি মুনের ডাকে সাড়া দেওয়া-না দেওয়া দুই নেত্রীর ব্যাপার। আমি মনে করি, তাদের ইতিবাচকভাবেই বিষয়টি দেখা উচিত।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের ভাষায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কোনো দেশের পরামর্শ কাম্য নয়। তবে জাতিসংঘের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, আমরা জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র। এই হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিব সংলাপের আহ্বান জানাতেই পারেন। একে ইতিবাচকভাবেই দেখা উচিত। দুই নেত্রীকে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে আলাপ-আলোচনায় বসা উচিত। নইলে শুধু গণতন্ত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দুই নেত্রীর জন্যও শুভকর হবে না। আমরা আশা করি, বান কি-মুনের ডাকে সাড়া দিয়ে অচিরেই দুই নেত্রী সংলাপে বসে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সমাধান বের করবেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, জাতিসংঘ একটি ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। আমার মনে হয়, দুই নেত্রীর সদিচ্ছা না থাকলে বান কি-মুন কেন, বারাক ওবামা সংলাপের আহ্বান জানালেও লাভ হবে না। এ জন্য দুই নেত্রীকে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাইরে গিয়ে দায়িত্বশীল হতে হবে। অবিলম্বে সংলাপে বসে চলমান সমস্যার সমাধান করতে হবে। নইলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা কারোর জন্যই কল্যাণকর হবে না। বান কি-মুনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'আজ দেশের ৯০ ভাগ মানুষই নয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। জাতিসংঘ মহাসচিব অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। আমরা তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আর এর উদ্যোগ নিতে হবে ক্ষমতাসীন দলকেই। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, আওয়ামী লীগ কখনই আলোচনা-সমঝোতা বা সংলাপের বিপক্ষে নয়। তবে তা হতে হবে সংবিধানের আলোকে। আর আলোচনার উপযুক্ত স্থান হচ্ছে জাতীয় সংসদ। বিএনপির কোনো প্রস্তাব থাকলে তারা সংসদে এসে দিতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারি। জাতিসংঘের আমরা সদস্য, সে ক্ষেত্রে তারা আমাদের নিয়ে কথা বলতেই পারে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে কোনো বিদেশি মাধ্যম প্রয়োজন নয়। আওয়ামী লীগ এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি বিএনপি ধানাই-পানাই বাদ দিয়ে, অসাংবিধানিক দাবি থেকে সরে নির্বাচনে আসবে। তাহলে কারোরই হস্তক্ষেপ করার দরকার নেই।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।