সম্রাট আমার ভাই ছিল। রক্তসম্পর্কের না, আমি চিনতামও না তাকে, কিন্তু সে আমার ভাই ছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র, বুয়েটের জুনিয়র, এদেরকে আমি আমার ভাই বলি, তারাও আমাকে তাই বলে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোর জন্য আমি যাদের কাছে ঋণী, এরা আমার সেইসব আত্মীয়। ভার্সিটির ক্যাম্পাস ছেড়ে এসেছি ২ বছরের বেশি হয়ে গেল, এখনো ফটক দিয়ে ঢোকার পরে উদগ্রীব হয়ে তাকাই, কারো না কারো দেখা পেয়ে যাবো ২-১টা সুখ-দুঃখের কথা বলার জন্য, কেউ না কেউ হাসিমুখে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসবে।
হতাশ হইনা, এককালে বন্ধুদের মুখ দেখতাম, এখন জুনিয়র ছেলেপেলেদের হাসিমুখ দেখি। কারো কারো ছটফটে, কারো গম্ভীর চশমাওয়ালা ব্যস্ত মুখগুলো দেখে নিজের পুরনো সময়টাকে হাতড়ে বেড়াই। জীবন নিয়ে খুব বেশি হতাশ হয়ে গেলে এই মুখগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, অনেক কিছু এখনো বাকি, অনেক কিছু করার আছে, ওদের মত আমাদেরও অনেক কিছু দেয়ার আছে।
এই ক্যাম্পাস কখনো আমার কাছে নিজের বাড়ির চেয়ে কম আপন ছিল না, কখনো হবেও না। ভার্সিটির বড় ভাইদের দেখতাম ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার অনেক বছর পরেও ঘুরে ঘুরে আসতে, কিসের মায়ায়, সেটা এখন বুঝি।
আমরা তর্ক করি, আমরা ঝগড়া করি, আমরা কখনো হাতাহাতিও করি, কিন্তু আমরা এক টেবিলে বসে হাত মেলাতেও পারি। এই মুখগুলো কখনো আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি, আমি জানি কখনো আমাকে ফেরাবেও না। এই ছেলেমেয়েগুলো তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত সহপাঠীর জন্য নিজের কাজকর্ম পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাতদিন রাস্তায় পড়ে থাকে, এই যন্ত্রমানবেরা ১০ বছর আগে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া বড় ভাইয়ের দুর্ঘটনার খবর শুনে নিজের পকেট খালি করে দেয়। ৪-৫টা বছরে এই বুয়েট আমাদের এক আত্মা হতে শিখিয়েছে, তাই যখন আমাদেরই কোন একজনকে কোন নির্বোধ বাসচালক চাপা দিয়ে মগজ বের করে দেয়, তখন আমরা তথাকথিত সুশীলদের মত মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি না। সম্ভবত এখনো আমরা পুরোপুরি অমানুষ হতে পারিনি, কাজেই কারো সহপাঠী, কারো ছোট ভাই যখন লাশ হয়ে ফেরে, তখন আমরা সেই মৃত মানুষটার উপরেই দোষ চাপিয়ে দিয়ে তার সমালোচনা করতে পারি না।
আমাদের ভেতর অনেকদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ফুঁসে ওঠে, আমরা রাস্তায় নামি, এতদিনের নির্লজ্জ নীরবতা ঢাকার জন্য আমাদের ছেলেরা বাস ভাঙে, পরিবহণ মালিকদের টাকার কাছে নীরব বেহায়া সরকার আর প্রশাসন আর সুশীল সদাব্যস্ত দেশপ্রেমিক জনতার ঘুম একবারের জন্য হলেও ভাঙবে এই আশায় রাস্তা অবরোধ করে। জানি এসবের কোন ফলাফল নেই, ২ দিন বাদে আমরাও একই পথের পথিক হবো, তবু যতদিন বিবেক সামান্য হলেও খোঁচাখুঁচি করে, ততদিন নিজের কাছে সান্ত্বনা খোঁজা। হায় খোদা, তারপরেও আমরা খারাপ, আমরা দেশের সম্পদ বিনষ্টকারী, কয়েকটা বাসের মূল্য আমাদের, এই মানুষগুলোর জীবনের চেয়ে এতই বেশি!!!
আবেগের কথাবার্তা অনেক বেশি চলে আসছে, যুক্তিবাদী সুশীল দেশপ্রেমিকদের সেগুলো পছন্দ না-ও হতে পারে, কাজেই একটু প্রাতিষ্ঠানিক আর যুক্তিবাদী লাইনেই যাওয়ার চেষ্টা করি। পরিবহণ প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনা (ট্রান্সপোর্টেশন এন্ড ট্রাফিক এন্ঞ্জিনিয়ারিং এন্ড প্ল্যানিং) আমার পড়াশোনার বিষয় ছিল, সেখানে অধমের অল্প যতটুকু জানা হয়েছে, তাতে বলে, আরবান বা শহরের ট্রাফিক ডিজাইনে সবসময়ই "পেডেস্ট্রিয়ান প্রায়োরিটি" থাকবে, সোজা বাংলায় যেটাকে বলে, পথচারীর সাতখুন মাফ। গাড়ির চালক গাড়ির স্টিয়ারিং ধরামাত্র "সুপিরিয়র" বা শ্রেয়তর অবস্থানে চলে যায়,
কাজেই নিয়মকানুন বেশিরভাগটাই তারই মানার কথা, আর যদি না মানে, তবে ঘাড়ে ধরে মানানোর ব্যবস্থা থাকার কথা, তবে সেটা যারা করবেন, সেই সম্মানিত ট্রাফিক ভাইরা সময় সময় ঘাড়ে ধরে চাঁদাবাজি করা আর বেশিরভাগ সময় নাকের লোম ছেঁড়া ছাড়া কিছু করেন বলে মনে হয় না।
চালকের জেব্রা ক্রসিং মানার কথা, চালকের লালবাতি মানার কথা, সুশীলের দল হলফ করে বলুন তো, কয়টা বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি বা রাইডার জেব্রা ক্রসিংয়ে যানবাহন থামায়?
তত্ত্ব বাদ দিই, একটু বাস্তব অবস্থার দিকে চোখ ফেরাই। পলাশীর মোড়ে সম্রাট যেখানটায় মারা গেছে, সেখানে সে আর কোথায় দাঁড়াতে পারতো? ৪ মোড়ের ৪ দিক দিয়ে দানবের মট সেখানে বাস ছোটাছুটি করে, এদিকে রাস্তার ২ পাশে বুয়েটের দুই ক্যাম্পাস, এখনো সেখানে ক্লাস ধরার জন্য ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি করতে হয়, নয়তো দুপুরে খাবার জন্য মূল ক্যাম্পাসে আসতে হয়। ডানা না গজালে ওখান দিয়ে বাসগুলোকে এড়িয়ে কিভাবে আসা যায় আমার জানা নেই, ভাগ্য খুব বেশি ভাল বলেই এতদিনেও ওখানে এমন দুর্ঘটনা মাত্র একটাই ঘটলো। চোখ ফেরান একটু দূরে, আজিমপুরের দিকে, বিভিন্ন কাউন্টার সার্ভিস আর লোকাল সার্ভিসের বাসগুলো কিভাবে একটা আরেকটাকে পাশ কাটিয়ে রাস্তায় থামে কেউ খেয়াল করেছেন? পথচারী খুব বেশি সতর্ক না থাকলে নির্ঘাৎ চাপা পড়বেন, আর চাপা পড়লে তো সুশীলরা আছেনই, ঐ ব্যাটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল কেন, একটা হেলিকপ্টার ভাড়া করলেই তো পারতো! আচ্ছা বলুন তো, আপনাদের মাঝে এমন কোন দুঃসাহসী ব্যক্তি আছেন যে একটা বাসকে দানবের মত ছুটে আসতে দেখেও জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হয়েছেন? পারবেন না, জানি, আমার মত আপনিও জানেন, বাসটা থামবে না, আপনার জীবনের দাম ঐ বাসের দামের চেয়ে অনেক কম, আর সেই দামটা কিন্তু আমি আপনিই কমিয়ে দিয়েছি, প্রতিটা দুর্ঘটনার পরে নীরব ভূমিকা পালন করে, মৃত মানুষটার ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে, অপরাধীকে পার করে দিয়ে।
পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর কি অবস্থা? সম্ভবত আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা ছাত্রছাত্রী যাদের ক্যাম্পাসের মাঝ দিয়ে এমন গতিতে যানবাহন চলতে পারে।
আমরাই সম্ভবত সবচেয়ে দুর্ভাগা দেশ যেখানে দেশের ভবিষ্যতদের জীবনের দামের চেয়ে অর্থলোভী পরিবহন মালিকদের কথার দাম অনেক বেশি, আমরাই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে একজন ছাত্র মারা গেলে শুনতে হয়, ভেঙে ফেলা কয়েকটা বাসের জন্য দেশের বিশাল ক্ষতি হয়ে গেল, কিন্তু যে ছেলেটা বা মেয়েটা মারা গেল, তার মৃত্যুতে দেশের কিছুই হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল, বুয়েট, দেশের শ্রেষ্ঠ ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস যেখানে, তার মাঝখান দিয়ে অনবরত ভারি যানবাহন কিভাবে ঘণ্টায় ৬০-৭০ মাইল গতিতে চলার অনুমতি পায়, সেটা তো বোধগম্য নয়ই, অন্য কোন দেশের লোক যদি জিজ্ঞেস করে যে এই এলাকায় যন্ত্রচালিত যানবাহন ঢোকার অনুমতি পায় কিভাবে, সেটার জবাব কিভাবে আমাদের দেশদরদী সুশীলরা দেন, সেটা জানার খুব ইচ্ছা থাকলো। কোন কোন গণ্ডমূর্খ এরপরেও বলবে, ছেলেমেয়েগুলো
রাস্তায় সাবধানে চলে না কেন? সেইসব মহামূর্খদের অবগতির জন্য জানাই, প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে ভারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ, এমনকি গাড়ি চলতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয় এবং সেটাও সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাজেই নিজের এলাকায় ছেলেমেয়েরা সামনে তাকাবে নাকি আকাশের তারা দেখে হাঁটবে সেই অধিকার তাদের আছে, বরং নিজেদের ধিক্কার দিন যে আমরা সেই অধিকার তাদের দিতে পারছিনা।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব কষ্টের কিছু স্মৃতি আছে, আমার অনেকদিনের পুরনো এক বন্ধু ৩ বছর আগে মারা গিয়েছিল গাড়ি দুর্ঘটনায়, মাত্র এক বছর আগে মারা গেছে আরেক বন্ধু, দেড় বছরের একটা মেয়ে রেখে, উল্টোদিক থেকে আসা বাসটা গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
মাত্র এক মাস আগে আমার এক ছাত্রীর ২ বোন মারা গেছে হাইওয়েতে, এবারও উল্টোদিক থেকে আসা বাসের কাণ্ড। প্রতিটা দুর্ঘটনায় পরিবারের অন্য মানুষগুলোর অবর্ণনীয় কষ্ট দেখেছি, নিজের কষ্ট টাও জানি। হাইওয়েতে বাসগুলো কিভাবে চলে সেটা অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই জানেন, তবে আজকাল শহরেও কিভাবে সামান্য জায়গা দিয়ে বাসগুলো চলে সেটাও মনে হয় কাউকে বলে দিতে হবে না। বেশিরভাগ চালকের লাইসেন্স ভুয়া, হেলপাররাও চালায় অনেক সময়, ধরার বা দেখার কেউ নেই। এমনকি ট্রাফিক ধরলেও অনেক যাত্রীকে উল্টো ট্রাফিককেই গালি দিতে দেখেছি, তাদের সময় যে মহামূল্যবান।
ভাইয়েরা, যার যায়, সে বোঝে, আজ আপনি রাস্তার যে মানুষটাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়াকে নীরব সম্মতি দিলেন, কালকে সেখানে আপনারই কোন প্রিয়জন পড়ে থাকবে, অন্যায়কে বাড়তে দিলে সেটা আপনার ঘাড়েই ছোবল বসাবে, কোন ভুল নেই।
এলোমেলো অনেক কথা বলে ফেললাম, শেষ করি। বরং আমার যেসব ছোট ভাই-বোনরা তাদের সহপাঠীর জন্য রাস্তা অবরোধ করেছে, বাস ভাঙচুর করেছে, তাদের ২-১টা কথা বলেই শেষ করি। আমি বুয়েটে পড়তাম বলে বাড়তি কোন গর্ববোধ ছিল না, যেকোন ছাত্র বা কর্মচারীর যে প্রাতিষ্ঠানিক গর্ব থাকে, সেটুকুই ছিল। কিন্তু আজকে আমি বলতে পারি, ওরা যা করেছে, আমি তার জন্য গর্বিত।
নিজেদের সহপাঠী, নিজেদের ছোট ভাইয়ের জন্য যে ওরা রাস্তায় নামতে পেরেছে, সুশীলের মত খামোকাই নিজের ভাইয়ের জীবনের চেয়ে কয়েকটা বাসের দাম বেশি ভাবেনি, একটা অন্যায়কে প্রতিরোধ করার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে, সেজন্য এই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি গর্ব বোধ করছি। আমরা বড় বেশি সুশীল, বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক, বড় বেশি জড় হয়ে গেছি, আমাদের মাঝে মাঝে একটু নাড়াচাড়া দেয়া দরকার, নইলে এই জীবন্মৃত অবস্থা থেকে আমরা জাগবো না। আমাদের ক্যাম্পাসে আমরা নির্ভয়ে হাঁটতে চাই, একটা মানুষের জীবনের চেয়ে সারা পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রের দাম বেশি না, যদি মানুষ মেরে দেশের উন্নতি করতে হয়, আমাদের সেই উন্নতির দরকার নেই।
সুশীলের দল, আমরা বাস ভাঙ্গার সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব, আপনারা আমাদের ভাই খন্দকার খানজাহান সম্রাটের জীবন ফিরিয়ে দিন। যদি তা না পারেন, তবে দয়া করে দূরে গিয়ে কেঁচোর মত গর্ত খুঁড়ে বসে থাকুন, এই শোকের মুহূর্তে আপনাদের শকুনের চিৎকারে আমাদের বিরক্ত করবেন না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।