গুণীজন
১৯৫৭ সালের দিকে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ নালাপাড়ার একটা মেসে কাজ নিলেন সুকুমার বড়ুয়া ৷ পাঁচ জনের জন্য রান্না করতে হত তাঁকে ৷ খাওয়াসহ মাসে ১৫ টাকা বেতন ৷ সকালে তাঁর রান্না শেষ হওয়ার পর সবাই খেয়ে যখন বাইরে কাজে চলে যেতেন তখন সুকুমার বই পড়ার নেশায় মেতে ওঠেন ৷ সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা, পথের পাঁচালী, কুলি, জনান্তিক আরও সব শিহরণ জাগানো বই ৷ এই বইগুলি, এর ভেতরকার জগৎ, সুকুমারের ভেতরটাকে এবং তাঁর জীবনের অর্থটাকে বদলে দিচ্ছিল সঙ্গোপনে ৷ এই মেসে কাজ করার সময় নিয়মিত চায়ের দোকানে যেতেন তিনি ৷ সেখানে যাওয়ার একমাত্র আকর্ষণ ছিল 'খেলাঘর' আর 'কচি কাঁচার আসর' পড়া ৷ এই প্রচুর পড়াই একদিন তাঁকে সাহস জোগালো ৷ লিখতে বললো ৷ কেউ, কোন মানুষ কিন্তু নয় ৷ নিভৃতে অন্যদের লেখাই তাঁকে লিখতে বলল, উত্সাহ জোগালো ৷ তিনি লিখলেনও প্রথম কবিতা ৷ বৃষ্টি নিয়ে ৷ 'বৃষ্টি নেমে আয়' ৷ প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয় 'খেলাঘর' এর পাতায় ৷ সেটা ৩ জুলাই, ১৯৫৮ সাল ৷ প্রথম লেখা প্রকাশের আনন্দকে অপার্থিব আনন্দ বলে মনে হয়েছে সুকুমার বড়ুয়ার কাছে ৷ আর এই আনন্দের সাথে বাড়তি পাওয়া হিসেবে যোগ হয়েছে পুরষ্কার ৷ জীবনের প্রথম লেখার জন্য তিনি ৩য় পুরস্কার পান ৷
সেই শুরু এরপর আর থেমে থাকেনি দেশের সুপরিচিত ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার লেখা। শুধু ছড়ার জগতে আবদ্ধ থেকে লেখার জন্য তিনি অকল্পনীয় প্রশংসা ও স্বীকৃতি পেয়েছেন ৷
সুকুমার বড়ুয়া জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ৷ ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ৷ পিতার নাম সর্বানন্দ বড়ুয়া ৷ মা কিরণ বালা বড়ুয়া ৷ বাবার পয়সা ছিলনা মোটেই ৷ কিন্তু একটা ছেলের শখ ছিল ৷ সেই শখের ধারাবাহিকতায় তিনি বাবা মায়ের তেরতম সন্তান ৷
জন্মের পর তাঁর নাম কী রাখা হবে এ ব্যাপারে তাঁর পূজা দিদি আর বাবা সর্বানন্দ বড়ুয়া কথা বলতেন ঘুমুতে যাবার আগে ৷ ছোট ভাইয়ের নাম কী হবে এ নিয়ে বোনটির চিন্তার অন্ত ছিল না ৷ হিন্দু মহাভারতের অনেক পাত্র পাত্রীর নাম তাঁদের দুজনেরই জানা ছিল ৷ ফলে প্রতিদিনই নাম বদলে যায় ৷ আজ অর্জুন তো কাল নকুল ৷ তার পরদিন মহাদেব ৷ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে ৷ সেই প্রভাবে কোন কোন দিন তাঁর নাম চীন, জাপান, আমেরিকাও হয়েছে ৷ সেই নাম অর্জুন, মহাদেব, চীন, জাপান ঘুরে সুকুমার বড়ুয়া হলো তাঁর মামা বাড়ির প্রভাবে ৷
তাঁর মামা বাড়ি ছিল তাঁদের বাড়ি থেকে উন্নত ৷ অর্থাত্ অবস্থাসম্পন্ন ৷ ফলে তাঁদের পরিবারের প্রতি মামাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশি ৷ বাবা আর পূজা দিদির প্রস্তাবিত নাম শুনে মামীমা একদিন নাক শিটকোলেন ৷ কি বিশ্রী নাম ৷ ওর নাম হবে সুকুমোল কিংবা সুকুমার ৷ ফলে তাঁর পূজা দিদির নাম রাখার স্বপ্ন মাঠে মারা পড়ল ৷ মহাদেব কিংবা অর্জুন কিংবা নকুল হয়ে গেলেন সুকুমার বড়ুয়া ৷ তাঁর পুজা দিদি রাতে শোবার সময় তাঁকে গল্প শোনাতেন ৷ ঘুরে ফিরে তিনি দুটো গল্পই শুনাতেন ৷ একটা শিয়াল আর ঘুঘু পাখির, আরেকটি পিঠে গাছের গল্প ৷
তখন ১৯৪৩ সাল ৷ দুর্ভিক্ষের বছর ৷ সারা পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক কালো ছায়া ৷ সুকুমার বড়ুয়ার বয়স মাত্র পাঁচ বছর ৷ বাড়িতে, পুরো পরিবারে বড় দুই বোনসহ ছয়জন সদস্য ৷ কোন জমিজমা নেই ৷ বাবা হাটবাজারে ছোটখাট বেচাকেনা করতেন ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত ৷ জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে ৷ অনাহারে অর্ধাহারে থেকে ভিখিরীর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন ৷ পুরো পরিবারটি চলছে শুধু শাক সেদ্ধ খেয়ে ৷ রুচি বদলের জন্য কোন কোন দিন কলার থোড় কখনোবা ভাতের মাড় খেয়ে দিন যাপন করতে হয়েছে তাঁদের ৷ কোনকোন দিন তাও জুটতো না ৷ অনেক শখের শিশুপুত্র আর বাড়িতে পাঁচ পাঁচটা মুখ ৷ এই হাহাকার সারা পৃথিবীর মত তাঁর বাবার বুকের মধ্যেও বেজেছিল ৷ একসময় বাবা বেরিয়ে পড়েন ভাগ্যন্নেসনে ৷ কেউ জানলোনা কোথায় গেলেন ৷ বাবা আর ফিরে আসেননি সুকুমারদের জীবনে, পরিবারে ।
সেই পূজাদিদি ৷ যিনি বিভূতিভূষনের দূর্গার মতো ছিলেন সুকুমারের জীবনে ৷ অভাবে, নাখেতে পেয়ে অথবা লঙ্গরখানার খিচুড়ি আর জাউ খেয়েও হতে পারে , তাঁর দিদির হাত পা ফুলে গেছে ৷ চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে ৷ একদিন মধ্যম বিনাজুরির সেই দোচালার ছনের ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি ৷ সুকুমার তখন বড় দিদির বাড়ি ৷ এর পনের বছর পর পথের পাঁচালী পড়তে গিয়ে দূর্গার সাথে তাঁর পূজাদিদির মিল দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন সুকুমার ৷
দুর্ভিক্ষের সময় অভাবের কারণে সুকুমারের মা তাঁকে মামাবড়িতে রেখে আসেন। কারণ এখানে খাওয় দাওয়ার সুবিধা ছিল কিছুটা বেশি ৷ সুকুমারের আপন মামারা গরীব হলেও তাঁদের প্রতিবেশীরা ধনী ছিলেন ৷ মামার দুই জেঠতুতো ভাই রামজীবন সওদাগর আর রামজীবন মহাজনের বেশ নামডাক ছিল ৷ কিন্তু বড়লোক হলে কী হবে ৷ রাত পোহালেই ভিখারীর ঠেলা সামলাতে অস্থির হয়ে পড়তেন তাঁরা ৷ তখন এমন সব হিন্দু মুসলিম পরিবারের মহিলারা ভিক্ষায় নেমেছিল, যা কেই ভাবতেও পারতো না ৷ কোন কোন একরোখা ভিখারী গোঁ ধরতো চাল ধোয়া পানি হলেও খাবে, তবুও যাবেনা ৷
মামাবাড়িতে এসে মামীমাকে খুব ভয় পেতেন সুকুমার ৷ কারণ সে বাড়িতে শিক্ষাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো ৷ যে বিষয়টি তাঁর নিজের বাড়িতে ছিলনা ৷ বর্ণজ্ঞান থেকে প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেছেন ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চরমে পৌঁছেছে ৷
দেশে দুর্ভিক্ষ আর হাহাকার বেড়েই চলেছে ৷ পথে ঘাটে রোজ অনাহারে মানুষ মরছে ৷ মামাবাড়িতেও চরম অভাব। সুকুমারের এক স্নেহময়ী জেঠিমা ছিলেন ৷ তাঁকে তিনি দুদুমা বলে ডাকতেন ৷ এরমধ্যেই একদিন সেই দুদুমা এলেন সুকুমারকে বড়দিদির বাড়ি নিয়ে যেতে ৷ সুকুমারের বড়দিদির বাড়ির অবস্থা ভালো ৷ সুকুমারের ভগ্নিপতি ছিলেন গ্রামের মেম্বার ৷
মামা বাড়ি থেকে আবার তিনি মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ফিরে গেলেন ৷ কারণ বড়দিদির বাড়ি তাঁদের নিজ বাড়ির পাশেই ছিল ৷ সুকুমারের রানীদিদি আগে থেকেই বড় দিদির বাড়িতে ছিলেন ৷ ভগ্নিপতির ছিল বেশ বড় ধানের গোলা, খড়ের গাদা, বড়বড় গরু ৷ এখানে এসে বহুদিন পর পেটপুরে খাবারের অভিজ্ঞতা হয়েছিল সুকুমারের ৷
মামাবাড়িতে থাকতে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'হাসি-খুশি' পুরোটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ৷ এখানে তাঁর বোন সুমতি প্রথমে হাতে লেখা বই, পরে একটি বাল্যশিক্ষা কিনে পড়তে দিয়েছিলেন ৷ অল্প কদিনের মধ্যে বাল্য শিক্ষা পুরোটা মুখস্থ দেখে সবাই তো অবাক ৷ অনেকেই সে সময় বলাবলি করলেন, ছেলেটার মাথা আছে ৷
দিদি তাঁকে ডাবুয়া খালের পাশে 'ডাবুয়া স্কুল' এ ভর্তি করে দিলেন ৷ কিন্তু সেই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তৃতীয় শ্রেণীর পড়াটা আর শেষ হয়নি সুকুমারের।
স্কুলের হেডমাষ্টার চেয়েছিলেন সুকুমারের পড়াশুনাটা যেন বন্ধ হয়ে না যায়। আর সেকারণে হেডমাস্টার সুশীল বাবু জানালেন , তার পরীক্ষার ফি দিতে হবে না ৷ তারপরেও তাঁর বড় দিদি তাঁকে পরীক্ষা দিতে দেননি ৷ পড়াননি ৷ স্কুলে যাওয়ার সময় বাধা দিলেন ৷ বললেন, যাও গরু ছাগল রাখো, পড়তে হবেনা ৷ প্রচুর কাজের চাপে, ব্যবহারের বস্ত্রের অভাবে যখন সুকুমারকে আর মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না, তখনই মা এসে তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করলেন ৷ নিয়ে গেলেন মামাবাড়িতে।
এরপর মামা বাড়ি থেকে সুকুমারকে চট্টগ্রাম শহরে দামপাড়া পুলিশ লাইনে নিয়ে গেলেন তাঁর মা। কারণ সেখানে তাঁর মামা পুলিশে কনষ্টেবলের চাকরি করেন। মামা, মামী, দিদিমা আর দুই বছরের সাধন এর সাথে সুকুমারও এই প্রথম শহরবাসী হলেন ৷ মামা পুলিশ হিসাবে রেশনের উপর নির্ভরশীল ৷ মাঝে মাঝে অবশ্য পাবলিক রেশন তুলতেন ভোলা বাবুর কন্ট্রোল থেকে ৷ ওখানে তাঁর কাজ ছিল মামাতো ভাই সাধনকে নিয়ে খেলা করা আর পানি সংগ্রহ করা ৷
১৯৫০ সালের ১ জুন ৷ চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ নালাপাড়ার বাবু মনোমহোন তালুকদার এর বাসা ৷ সেখানে মাসিক তিন টাকা বেতনের চাকুরি নিলেন সুকুমার ৷ একটি পাঁচ মাসের শিশুকে সঙ্গ দেওয়া তাঁর প্রধান কাজ ৷ এই শিশুটি এখন চিত্র পরিচালক চঞ্চল বড়ুয়া (ঘর ভাঙা ঘর) ৷ এই পরিবারে এসে জীবনে প্রথম কিছুটা উন্নত শ্রেণীর রুচিশীল মানুষের সাথে পরিচয় হলো সুকুমারের ৷ এতোদিন যাঁদের আশে-পাশে তিনি ছিলেন, তাঁরা সকাল আর রাতের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতেন ৷ সেই জীবন থেকে শিল্প সাহিত্য অনেক দূরের বিষয় ছিল ৷ এই বাড়িটির কর্তাবাবুটি গম্ভীর প্রকৃতির হলেও বেশ স্নেহপ্রবণ ছিলেন ৷ গৃহকর্ত্রী মাসীমা আপন সন্তানের মতো সুকুমারকে ভালোবাসেন ৷ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নাচ, গান, নাটক ইত্যাদি করে ৷ সুকুমারের সাথে তাদের আপন ভাইবোনের মতো সম্পর্ক ৷ কেউই সুকুমারকে আলাদা চোখে, কাজের ছেলে হিসাবে দেখতেন না।
১৯৫২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে সুকুমার তাঁর এক মামাতো ভাইয়ের সাথে ভৈরব বাজার চলে এলেন ৷ সেখানে বাবুর্চির কাজ নিলেন ৷ দুজনের জন্য রান্না করার কাজ ৷ সুকুমারের মা তখন মামাবাড়িতে ৷ দক্ষিণ নালাপাড়ার বাবু মনোমহোন তালুকদার এর বাসার চেয়ে এখানে এই রান্নার কাজে দুটাকা বেশি মাইনে পেতেন ৷ কিন্তু এই বেশি আয়ের চাকরির জন্য নয়, এখানে কাজ করার পেছনে ভিন্ন একটি উত্তেজনা কাজ করতো সুকুমারের ভেতর ৷ কারণ এখানে এসেই পেলেন মামাতো ভাইয়ের সংগ্রহে রাখা 'দেব সাহিত্য কুটির' এর মজার মজার শিশু সাহিত্য সংকলন ৷ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সেইসব পড়া শুরু করতেন ৷
এর ছমাস পর চট্টগ্রামের সেই পুরোনো বাসায় দেখা করতে গেলেন সুকুমার ৷ তাঁরা বললেন, পাঁচ টাকা মাইনে কি আমরা দিতে পারিনা ? তোর মা কেন পড়ানোর নামে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ? কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়ছিস ?' সুকুমার বললেন, 'গল্প কবিতার বই পড়েছি অ-নে-ক ৷' সবাই হেসে ফেললেন ৷ সেই বাসায় আবার কাজ নিলেন এবং সেখানে তিনি আরো দুবছর ছিলেন ৷
কিন্তু পর্যাপ্ত বেতনের অভাবে সে বাসার কাজ ছেড়ে দিয়ে এক চায়ের দোকানে কাজ নিলেন তিনি ৷ সেখানে সাত টাকা বেতন ছিল ৷ দক্ষিণ নালাপাড়ার সুখেন্দু বিশ্বাস নামের সেই ব্যক্তির দোকানে ১৯৫৫ সালে ১০ মাস কাজ করেছিলেন তিনি ৷
এরপর ১৯৫৭ সালের দিকে সবকিছু ছেড়ে আবার সেই দক্ষিণ নালাপাড়ার পুরোনো বাসায় ফিরে এলেন তিনি ৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন সেই বাড়িতে মনোমহোন তালুকদারের পরিবারের লোকজন কেউ থাকেনা, বাসাটা এখন মেস হয়ে গেছে ৷ সেই মেসে মাসে ১৫ টাকা বেতনের কাজ নিলেন সুকুমার বড়ুয়া ৷ পাঁচ জনের জন্য রান্না করতে হয় ৷ কিন্তু ১৫ টাকা বেতনে তাঁর আর চলছিল না ৷ মাকে টাকা পাঠালে বাকি টাকা দিয়ে নিজের চলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে ৷ সেই কাজ ছেড়ে ১৯৫৯ সালে কিছুদিন ফলমূল বিক্রি করলেন ৷ এরপর আইসক্রিম, বুট বাদাম ইত্যাদি বিক্রি করেও রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন ৷ লালদিঘির পাড় থেকে শুরু করে উজারা সিনেমা হল পর্যন্ত অনেক কিছু ফেরি করে বিক্রি করে বেড়িয়েছেন সুকুমার ৷ অবস্থাসম্পন্ন বড় বড় আত্মীয়রা দূর থেকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন ৷ অনেকে আক্ষেপও করেছেন ৷ দানিয়ালাপাড়ায় মাসিক পাঁচটাকায় বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে এলেন তিনি ৷ অনেকদিনপর আবার মায়ের সাথে থাকা শুরু হল ৷ কিন্তু রোজগার আর খরচের তারতম্যের কারণে জীবন প্রায় থেমে যায় যায় করছে ৷ মেসে থাকতে ঢাকার পত্রিকায় ছয় সাতটি লেখা বেরিয়েছিল ৷ এখন কিন্তু লেখালেখি নিয়ে ভাবার অবকাশও নেই ৷
বছর খানিক এভাবে কাটলো ৷ এরপর মাকে আবার মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন ৷ আর নিজে ফিরে গেলেন সেই পুরোনা মেসে ৷ আগের বেতনেই ৷ এখানে একটা সান্ত্বনা আছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করার সুযোগটা পাওয়া যায় ৷ এরমধ্যে দৈনিক জামানা পত্রিকায় একটা দীর্ঘ লেখা নিয়ে গেলেন তিনি ৷ নাম, 'পথের ধূলো' ৷ করুণ কবিতা ৷ কবিতাটি জসীম উদ্দীন এর 'কবর' কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা ৷ এই কবিতাও পড়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর মেসেই ৷
এরমধ্যেই ঢাকায় আসার জন্য মন তৈরী হয়ে গেছে সুকুমারের ৷ কারণ তাঁর মন বলছে, এখানে থাকলে আসলে কিছুই হবেনা ৷ কিন্তু জীবনে উপার্জন আর সুনাম দুটোরই দরকার আছে ৷ তাই মিথ্যে বলতে হলো তাঁকে ৷ মেসের কর্মকর্তাদের একদিন বললেন, 'আমি এক ছাপাখানায় প্রশিক্ষণের কাজ পেয়েছি ৷' কবি হয়ে বাবুর্চিগিরি যেমন পোষায় না তেমনি মানায়ও না ৷ বড় ভাইয়ের মতো স্নেহপ্রবণ সবাই সুকুমারকে মুক্তি দিতে রাজি হলেন ৷
মহানন্দে সাতটাকা দশ আনার টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন সুকুমার বড়ুয়া ৷ ঢাকায় এসে পেলেন দাদাভাইকে, ইত্তেফাক অফিসে ৷ তারপরে বাবু দেবপ্রিয় বড়ুয়ার (অবসরপ্রাপ্ত বাসস প্রধান) সাথে পরিচয় হল ৷ তোপখানা রোডে তাঁরা সাতজন মেস ভাড়া করেছেন ৷ কাজের লোক দরকার ৷ আবারও চাকরি মিলে গেল ৷ মাথাপিছু পাঁচটাকা করে সাতজনের জন্য পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনের চাকরি ৷ চাকরিতো হলো কিন্তু লেখা আর হয়না ৷ তবুও অনেক কষ্ট করে লিখলেন 'ছারপোকার গান' আর 'খাওয়ার গান' শিরোনামের দুটি লেখা ৷ ১৯৬১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৷ মাকে হারিয়ে একদম একা হয়ে পড়লেন সুকুমার বড়ুয়া ৷
১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে চৌষট্টি টাকা বেতনের চাকুরী হয় সুকুমারের ৷ ১৯৬৩ সালে তোপখানা রোডে ছয় টাকায় বেড়ার ঘর ভাড়া করে এই প্রথম স্বাধীনভাবে প্রচুর লেখালেখি শুরু করেন। কচিকাঁচার আসর, খেলাঘর আর মুকুলের মাহফিলে এসমস্ত লেখা ছাপা হতে থাকে ৷ ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী হন। ১৯৯৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোর কিপার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬৪ সালের ২১ এপ্রিল ননী বালার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুকুমার বড়ুয়া ৷ চট্টগ্রামের গহিরা গ্রামের এক বিশিষ্ট শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার মেয়ে ননী বালা ৷ সুকুমার বড়ুয়া চার সন্তানের জনক ৷ তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলে ৷
১৯৭০ সালে 'পাগলা ঘোড়া', ১৯৭৬ সালে 'ভিজে বেড়াল', ১৯৭৯ সালে 'চন্দনা রঞ্জনার ছড়া', ১৯৮০ সালে 'এলোপাতাড়ি', ১৯৮১ সালে 'নানা রঙের দিন', ১৯৯১ সালে 'সুকুমার বড়ুয়ার ১০১টি ছড়া', ১৯৯২ সালে 'চিচিং ফাঁক', ১৯৯৫ সালে 'কিছু না কিছু', ১৯৯৭ সালে 'প্রিয় ছড়া শতক', ১৯৯৭ সালে 'বুদ্ধ চর্চা বিষয়ক ছড়া', ২০০৬ সালে 'ঠিক আছে ঠিক আছে' গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়। এছাড়া সুকুমার বড়ুয়ার আরও অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
সুকুমার বড়ুয়া তাঁর লেখালেখির জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁকে ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার,, ১৯৯২ সালে ঢালী মনোয়ার স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে বৌদ্ধ একাডেমী পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ সম্মাননা, ১৯৯৭ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে আলাওল শিশু সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে চোখ সাহিত্য পুরস্কার, ভারত, ২০০৪ সালে স্বরকল্পন কবি সম্মাননা পদক, ২০০৬ সালে অবসর সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এখন তাঁর অধিকাংশ সময় কাটে নিজের লেখাগুলিকে সংরক্ষণ করার চিন্তায় ৷ তিনি আজীবন বুকের ভেতর একটি বড় স্বপ্ল লালন করছেন ৷ সেটি চট্টগ্রামে সুকুমারের পৈতৃক ভিটায় 'সুকুমার শিশু তীর্থ' নামে একটি শিশু পাঠাগার স্থাপন করা ৷ এই পাঠাগারটি স্থাপন করার জন্য তিনি সামাজের সকলের কাছে আবেদন জানান ৷ বেঁচে থাকাকালীন তিনি এই পাঠাগারের কাজ শেষ করতে চান।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: সুকুমার বড়ুয়া জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ৷ ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ৷
বাবা-মা: বাবার নাম সর্বানন্দ বড়ুয়া ৷ মা কিরণ বালা বড়ুয়া ৷ তিনি বাবা মায়ের তেরতম সন্তান ৷ পড়াশুনা: বর্ণজ্ঞান থেকে প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি মামা বাড়ির স্কুলে পড়াশোনা করেছেন ৷ এরপর বড় দিদির বাড়িতে এসে তিনি ডাবুয়া খালের পাশে 'ডাবুয়া স্কুল' এ ভর্তি হন ৷ কিন্তু সেই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়।
কর্মজীবন: অল্প বয়স থেকেই তিনি মেসে কাজ করেছেন, ফলমূল, আইসক্রিম, বুট বাদাম ইত্যাদি ফেরী করে বিক্রি করেছেন তিনি ৷ এরপর ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে চৌষট্টি টাকা বেতনের চাকুরী হয় তাঁর ৷ ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী হন।
১৯৯৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোর কিপার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
সংসার জীবন: ১৯৬৪ সালের ২১ এপ্রিল ননী বালার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুকুমার বড়ুয়া ৷ চট্টগ্রামের গহিরা গ্রামের এক বিশিষ্ট শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার মেয়ে ননী বালা ৷ সুকুমার বড়ুয়া চার সন্তানের জনক ৷ তিন মেয়ে ও এক ছেলে ৷
তথ্য সূত্র
সুকুমার বড়ুয়া, উত্তম বড়ুয়া, অরূপ রতন বড়ুয়া, রঞ্জনা বড়ুয়া, রাশেদ রউফ, নাওশেবা সবিহ্ কবিতা, চারুলতা, ভোরের কাগজের ইষ্টু কুটুম বিভাগ, টইটুম্বুর, জোবাইর হোসাইন সিকদার, স্বপন কুমার বড়ুয়া, নজরুল ইসলাম নঈম, তপন বাগচী, মাশরুফা মিশু, আলী আজম, শফিকুল আলম টিটন, সবুজের মেলা প্রমুখ ৷
মূল লেখক: পথিক সুমন
পুনর্লিখন : গুণীজন দল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।