মহলদার
এটা সবার জানা যে বাংলাদেশের নববর্ষের দিন আগের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। এখনো হিন্দু ধর্মের প্রায় সমস্ত ধর্মানুষ্ঠাই চলে আগের ক্যালেন্ডারের তিথি নক্ষত্র ও তারিখ অনুযায়ী। তাই আগের চৈত্র সংক্রান্তি হিসাবে এবারের নববর্ষের দিন ছিল চড়ক পূজা। এই পূজা দেশের বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য যদিও এটা বর্তমান সময়ে অনেকটা বিলুপ্ত। সুনামগঞ্জ আসার পরে জানতে পেরেছি এখনো এই অঞ্চলে অনেক পুরাতন বেশ কছু আচার-অনুষ্ঠান টিকে রয়েছে যার মধ্যে এই চড়ক পূজা অন্যতম।
জানার পর থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলাম সুযোগ পেলে এটা দেখব। অবশেষে এল সেই কাঙ্খিত দিন। সকালে শহরে উদিচীর আয়োজিত (দায়সারা গোছের) বর্ষবরণ অনুষ্ঠান কিছুক্ষণ দেখে সুনামগঞ্জ থেকে বাইক নিয়ে রওনা দিলাম বিশ্বম্ভর পুর উপজেলার উদ্দেশ্যে। যদিও জেনেছিলাম অনুষ্ঠান শুরু হবে দূপুরের পর তবুও কিছুটা আগেই রওনা দিলাম, পথে ঘাটে থেমে কিছু গাঁও-গেরামের ছবি তোলার ইচ্ছা নিয়ে। ওদিকে আমার অফিস কলিগ ও আরো কিছু পরিচিত জনদের পরিবার সহ নববর্ষের দিন সুরমায় নৌকাভ্রমনে না থাকায় সবাই আমার উপর রাগান্বিত।
তবে সবাইকে আশ্বস্ত করলাম রাতে খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান মিস করবো না।
নির্দিষ্ট সময়ের বেশ আগেই পৌঁছে গেলাম অনুষ্ঠান স্থলে। জানতে পারলাম তিন জায়গাতেই নাকি এই অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবে আমি ওখানেই থাকলাম। সবে লোক সমাগম শুরু হয়েছে।
আবহাওয়া মোটামুটি ভাল। তবে আকাশে কিছুটা মেঘের আনাগোনা। একটু চিন্তায়ই ছিলাম। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ার মধ্যেও ১৫-২০মিনিটের মধ্যেই বর্ষা নামতে পারে এখানে। বৃষ্টি হলে সুনামগঞ্জ ফেরা কঠিন হয়ে যাবে, তাছাড়া ক্যামেরার ভাল ব্যাগও সাথে নিইনি।
বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সেরে খোল, করতাল আর ডঙ্কা সহযোগে সন্ন্যাসীরা(এই পূজায় যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের সন্ন্যাসী বলা হয়) মাঠে প্রবেশ করলেন দল বেঁধে। পরনে তাদের গেরুয়া রংয়ের কাপড়, গলায় গামছা, কারো গায়ে গেঞ্জি কিংবা কেউ খালি গায়ে। সাথে লাল কাপড় পরিহিত দু'জন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী কে দেখতে পেলাম। শুরু হল গান- "তোমরা বাহির হয়ে দেখরে কে আইল নদীয়ায়"। গোল হয়ে সারি বেঁধে ঘুরে ঘুরে বিশেষ ঢংয়ে বাদ্যের সাথে গান।
কতদিন যে এইজাতীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিইনি। পুরুষানুক্রমে আবর্তিত কোন সুপ্রাচীন উৎসবের চিরায়ত মহড়া দেখে সত্যিই ভাল লাগছিল আমার। ইতোমধ্যে মাঠের চারিদিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। আমি কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করলাম এবং ছবি তোলার ইচ্ছার কথা জানালাম। তারা আমাকে স্বাগত জানালেন।
আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
গান শেষে শুরু হলো বাদ্যের তালে তালে নৃত্যের মাধ্যমে অসুর-দবতাদের যুদ্ধ (মহিষাসুর বধ পালা) এর উপস্থাপন। চারিদিক দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষ উপভোগ করছে। ওদের সাজ-সজ্জা, অভিনয় দেখে কখনো কখনো উচ্ছসিত করতালি, হাসির রোল কিংবা হর্ষধ্বনিতে মুখরিত চারিদিক। ওদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য মেঘে ঢেকে চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল।
আমার ছবি তোলার আশার গুড়ে বালি। এক্সট্রা ফ্লাসের অভাব টের পেতে লাগলাম। ছবি কালো কালো। ওদের খুব কাছে যেয়েও ছবি তোলার উপায় নেই, অসুর দেবতাদের যুদ্ধ বলে কথা। সবাই দ্রুত বেগে ছোটাছুটি করে যুদ্ধ করছে।
যাই হোক আমার নিরাশার মাঝে শেষ হলো অসুর দেবতার যুদ্ধ পর্ব। কোন ভাল ছবিই ধারণ করতে পারলাম না। তবে উপভোগ করলাম সম্পূর্ন অপেশাদার শিল্পীদের নিজস্ব সাজ-সরঞ্জাম সহযোগে প্রত্যন্ত বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করার খানিকটা নির্মল আনন্দ।
এর পর আরো একাধিক পর্ব চলল বিভিন্ন বিষয়ের। যেমন-তন্ত্র শক্তির সাহায্যে(যেটা স্থানীয়রা গভীর ভাবে বিশ্বাস করে) অজ্ঞান করে ফেলা, উন্মাদ করে ফেলা, ভাঙ্গা কাঁচের উপর দিয়ে হাঁটা, হাতে দা দিয়ে কোঁপানো, ধারাল দায়ের উপর দাঁড়ানো ইত্যাদি।
এর অধিকাংশই বাদ্যের তালে তালে নেচে। সব শেষে শুরু হল এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণীয় পর্বের, যেগুলোর জন্য সম্ভবত বেশী লোক জড়ো হয়। শুরু হল টিউব লাইট চিবানো, লোহার ফলা দিয়ে চামড়া ফুটো করা, জিহ্বা ফুটো করা, লোহার আংটায় মানুষ গেঁথে চরকীর মত ঘুরানো। আমি কাছে যেয়ে ছবি তোলার সুযোগ পেলাম। চলুন দেখি কয়েকটি ছবি-
মানুষের চামড়া যে এত শক্ত হয় আমার জানা ছিলনা।
আর ওই ফলা গুলো ঢুকানোর সময় কেউই কোন আহ্-উহ্ পর্যন্ত করছিলনা দেখে অবাক হচ্ছিলাম। অন্যদের বক্তব্য তন্ত্রবলে নাকি ব্যথামুক্ত ভাবে করা হয় সবকিছু। তান্ত্রিককেও দেখলাম লোহার ফলা, আংটায়, টিউব লাইটে মন্ত্র পড়তে। কিন্তু আমার মত যারা তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাসী নয় তারা কিভাবে মেলাবেন হিসাবটা! যে লোকগুলো এতক্ষণ ধরে কত কষ্ট করে গান-বাজনা, অভিনয় করে অনেকটা কান্ত হয়ে পড়ার কথা, অথচ তারাই আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক এক জন নিজেকে গেঁথে নিতে আগ্রহী লোহার ফলায়। কোন রক্তপাত নেই, কোন ব্যথাও নেই যেন ওদের।
সত্যিই অবাক হয়েছি। পিঠে লোহার আংটায় গেঁথে ঘোরানোর কথা দু’জনকে। অথচ আগ্রহী ৫ জন। তান্ত্রিক গুরু কাকে রেখে কাকে বিঁধবেন এই নিয়ে মহা ঝামেলা। একজন আবার বলে বসল খবরের কাগজে ছাপা হবে, আমাকে বিঁধতেই হবে।
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি কোন খবরের কাগজের নই, এমনি ছবি তুলছি। তখন সে তার ইচ্ছা প্রশমিত করল। তবে তার পিঠ দেখাল, দেখলাম পিঠে অনেক দাগ। আগে বেশ কয়েকবার সে করেছে। যাই হোক এই অনুষ্ঠানের প্রথম অংশ বেশ উপভোগ করলেও শেষ এইসব কান্ড কারখানা দেখে খারাপ অনুভূতি হল আমার।
এই যুগে এখনো এইসব কেমন যেন বেমানান ঠেকছিল। শুনলাম রাতে আছে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান, আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা। কিন্তু তা যে দেখা সম্ভব হবে না। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে ইতোমধ্যে। মেঘ আরো গাঢ় হচ্ছে।
বর্ষা নামতে পারে। আমাকে যে এখনি রওনা দিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।