...
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, দায়দায়িত্ব, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছে, সভা-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও জোরদার হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধা প্রত্যাহারের হুমকি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ। ঘর পোড়া আগুনে আলুপোড়ানোর ধান্ধায় ওঁৎ পেতে আছে আমেরিকা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি কী ফল বয়ে আনবে
এটাকে বলা যেতে পারে একটা পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদনের প্রাক-দলিল অথবা প্রাক-সমঝোতা।
এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্বার্থ এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্পাদিত হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের যে নিজস্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত আইনি এবং মানগত কাঠামো রয়েছে, সেগুলোকে তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়। অথচ এ ধরনের সমঝোতা কাঠামোতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট অঙ্গীকার থাকে না। যেসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, সেসব বিষয়ে বাংলাদেশের কর্মপন্থা ও অবস্থান কী হবে তারই একটি প্রাক-নির্ধারণ হচ্ছে এই টিকফা।
বাংলাদেশে টিকফার ইতিহাস
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে মার্কিনরা সরকারের ওপর টিকফা চুক্তি সই করার জন্য চাপ প্রয়োগ শুরু করে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও টিকফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করা থেকে পিছিয়ে আসে জনমত টিকফার বিপক্ষে থাকার কারণে।
টিফা বা টিকফা যে নামেই হোক, এ চুক্তির মধ্যে কী ধরনের শর্ত রয়েছে, সে সম্পর্কে দেশের মানুষের কোনো ধারণা নেই। কারণ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সমান গুরুত্ব দিয়ে গোপন রেখেছে। টিফা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারগুলোর এ রকম গোপনীয়তার কারণে জনগণের মধ্যে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের হাতে আছে ২০০৫ সালে প্রস্তাবিত TIFA-এর খসড়া।
এই খসড়া টিফার সঙ্গে কী সংযোজন হবে আর কী বিয়োজন হবে, তাও নির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকে।
সামরিক কৌশল
বাণিজ্য চুক্তির আড়ালে টিকফা বা টিফার সামরিক গুরুত্বও রয়েছে। ভূ-কৌশলগত দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগর মার্কিন প্রভাবে রাখার জন্য টিফার সামরিক গুরুত্ব রয়েছে। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের পরই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। মার্কিনদের চীন ঘেরাও নীতির ফলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্থান।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও শুধু বাণিজ্যই এসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তির একমাত্র লক্ষ্য নয়, ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে মার্কিনদের প্রভাব বিস্তার করাও এসব চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য।
বিশেষ করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যুক্তরাষ্ট্র যেসব রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে এই যুদ্ধ চালাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যস্বার্থের সঙ্গে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট স্বার্থও যুক্ত হয়ে পড়েছে।
সরকার কেন চুক্তির খসড়া প্রকাশ করছে না
যখন এ ধরনের চুক্তিতে জনমানুষের স্বার্থ রক্ষা করা হয় না, তখনই অস্বচ্ছতা তৈরি হয়। সামনে নির্বাচন।
তাই এ ধরনের চুক্তি প্রকাশ হয়ে পড়লে সরকার সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে। এই অস্বচ্ছতা দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় খুব ভাল ফল বয়ে আনবে না।
এই চুক্তি হলে আমরা কী ধরনের অসুবিধার মধ্যে পড়ব
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাজার উন্মুক্ত করার ব্যাপারে আমাদের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটাই এই বহুপক্ষীয় দরকষাকষি ফোরামের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উন্নয়নশীল সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা যে ছাড়গুলো স্বাভাবিকভাবে পেয়ে থাকি, সেগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
সেসঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আলোচনায় আমাদের এক প্রাকার দ্বৈত অবস্থান তৈরি হবে।
বাণিজ্যিক সুবিধার মিথ্যা তথ্য
বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য আসলে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধার তেমন কোনো ফল পাচ্ছে না। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির প্রায় শতকরা ২৩ ভাগ গেছে, সেই হিসাবে এ বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ প্রদান করেছে কমপক্ষে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে, তার ছয় গুণেরও বেশি।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের জোগান দিচ্ছে প্রতিবছর! এবং যুক্তরাষ্ট্রই মুক্তবাজার নীতিমালা ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে! (আনু মুহম্মদ, দৈনিক প্রথম আলো, ২৩/০৫/২০১৩)
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনা করে আইএমএফই স্বীকার করছে যে, যে বছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার পণ্য আমদানি বাবদ ৩৩ কোটি ডলার আমদানি শুল্ক আয় করল, সে বছরেই সমপরিমাণ শুল্ক তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে আয় করল। অর্থাৎ ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এটাই বিশেষ সুবিধা! (আনু মুহম্মদ, দৈনিক প্রথম আলো, ২৩/০৫/২০১৩)
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছে, টিকফা চুক্তির মধ্যেও এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর আরোপিত উচ্চহারে শুল্ক কমিয়ে তাদের গড় শুল্কহারেরও সমান করে, তাতে যে পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে, তাতে ৪০ লাখ শ্রমিকের মজুরি তিন মাস অতিরিক্ত শোধ করেও নিরাপত্তাজনিত সব ব্যয় বহন সম্ভব হবে।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পোশাক যে দামে বিক্রি হয়, তার শতকরা ৬০ ভাগই পায় সে দেশের বায়ার ও বিখ্যাত ব্র্যান্ড বিক্রেতারা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
বাকি ৪০ ভাগের মধ্যে উৎপাদন প্যাকেজ ও পরিবহন খরচ এবং মালিকের মুনাফা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকের মজুরি একেবারে তলায়, শতকরা ১ ভাগেরও কম।
অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র টিফা করতে পারেনি। অথচ ওই সব দেশের সঙ্গে মার্কিনদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্যসম্পর্ক। এসব দেশের তালিকায় রয়েছে কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতের মতো দেশগুলো।
টিফা আসলে সেই সব দেশের সঙ্গে করা হয়, যেসব দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল।
আমাদের স্বাধীনতাকে রুখে দিতে ১৯৭১-এর পরও যে আমেরিকা বিরোধিতা করেছে, তার সঙ্গে কেন ‘সুসম্পর্ক’ রাখে আওয়ামী লীগ, তা জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন।
বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও আমেরিকান এসব আগ্রাসনের বিপক্ষে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এ দেশের মালিক দেশের জনগণ। এ চুক্তির ফলাফল ভোগ করতে হবে জনগণকে।
সরকারের উচিত এ চুক্তিতে কী আছে তা জনগণের সামনে প্রকাশ করা।
এদেশের সিংহভাগ মানুষই বিশ্বমানবতার শত্রু আমেরিকার সঙ্গে সুদূর প্রসারী কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এবং চুক্তি সই করার সকল অপতৎপরতা বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব
মুল ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।