চারপাশে যখন রাষ্ট্রতন্ত্রের সম্মিলিত পাপ
ফকির ইলিয়াস
=======================================
ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার আশরাফ কোরেশী বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে পাকিস্তানের কোনো আপত্তি নেই। রাষ্ট্রদূত আরো বলেছেন, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাতে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ পাকিস্তানের বাধা দেয়ার কোনো কারণ নেই। সংবাদটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য বেশ স্বস্তির।
কারণ বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ। এই দেশের মানুষ এবং সরকারের অবশ্যই ক্ষমতা এবং অধিকার রয়েছে রাষ্ট্রের দাগি ব্যক্তিদের বিচার করার।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীও একটি প্রেস ব্রিফিং দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান তার পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। যা একটি শুভ লক্ষণ।
পাকিস্তান এই বিচারকাজে কোনো বাধা হবে না বলেই মনে করে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশে প্রায় চার দশক সময় পর যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, তা অবশ্যই শুভ লক্ষণ। ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটি’ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগনামা দাখিল করেছে। পত্রপত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী সরকারের ‘তদন্ত সেল’ এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যুদ্ধাপরাধীদের অতীত ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বর্ণনা অনুযায়ী দেশের এই প্রজন্ম আবারো জানতে পারছে, সেইসব নরঘাতকদের লোমহর্ষক অতীত। জামাতের কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মতিউর রহমান নিজামী, গোলাম আযম, আলী আহসান মুজাহিদ, বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জাতীয় পার্টির আব্দুল জব্বার ইন্জিনিয়ার , আওয়ামী লীগের এম পি মোসলেম উদ্দিন প্রমুখের ঘটনাবলী এই প্রজন্মের বাঙালি জানিয়ে দিচ্ছে, স্বজাতির প্রতি কতোটা নিষ্ঠুরতম হয়ে এরা দাঁড়িয়েছিল পাক হানাদারদের পক্ষে। একটি বিষয় এ প্রসঙ্গে আলোচিত হচ্ছে বেশ জোরালোভাবে। আর তা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের ছত্রছায়ায় কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধী লুকাচ্ছে না তো? আমরা জানি সময়ের আবর্তনে অনেক সুবিধাবাদী রাজনীতিক বাংলাদেশে ‘ভোল’ পাল্টেছে। এরা অনেকেই নিজেদের অতীত ঢেকে দিয়ে বিশেষ করে ‘ডানপন্থী’ মোর্চার হাতে হাত মিলিয়েছে।
‘যোগদানের’ রাজনীতির নামে এদের কেউ কেউ যে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়নি, তাও কিন্তু নয়। তাই লেবাস বদল করে কোনো যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের পাক বাহিনীর দোসররা ‘দিনবদলের রাজনৈতিক ধারা’র সঙ্গে ঘাপটি মেরে বসে আছে কি না, তাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
আমরা প্রায় সকলেই স্বীকার করি, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যে বৈষম্যহীনতার চেতনায় স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনা রাষ্ট্রতন্ত্রে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার যে লালিত স্বপ্ন ছিল তা বারবার খান খান হয়ে গিয়েছে নানা কারণে। রাষ্ট্রের কাঠামো-অবকাঠামোতে মানবতা, সততার প্রখর চেতনা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
অপ্রয়োজনীয় অনেক খাতে রাষ্ট্রীয় বাজেট অনেক বেশি থাকলেও শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ হয়নি। ফলে এই প্রজন্ম আশানুরূপ সুশিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি। এই ব্যবসায়িক প্রসারমান সুযোগের সুবাদে দেশে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো।
রাষ্ট্রের নীতিমালার তোয়াক্কা না করে তারা চরিতার্থ করছে তাদের বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি। এই চর্চার সুবিধা নিয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তিও দেশে গড়ে তুলেছে তাদের মন মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যারা প্রকারান্তরে সেই ‘মওদুদীবাদী’ চেতনার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছে এই প্রজন্মের মননে।
দুই
দেশের রান্নার গ্যাস, পানীয় জলের সংকট তীব্রতর অবস্থা ধারণ করেছে। এই সংকট নিরসনে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, গ্যাস ও পানি সংকট ‘আমাদের সম্মিলিত পাপের ফসল। ’
রাষ্ট্রের কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন ‘রাষ্ট্রীয় সম্মিলিত পাপ’ আখ্যায়িত করেন, তখন নানা ধরনের প্রশ্ন সামনে চলে আসে।
কে বা কারা পাপ করেছে? কেন করেছে? প্রজন্ম সেইসব পাপের কুফল ভোগ করবে কেন? ‘সম্মিলিত পাপ’ কথাটি রাষ্ট্রের সকল মানুষের ওপর বর্তায়। অথচ খুঁজলে দেখা যাবে, এই পাপ জনগণের নয়। পাপটি রাষ্ট্র শাসকদের। কারণ রাষ্ট্রীয় গাফিলতির কারণে রাষ্ট্রে যে সব নৈতিক ক্ষত তৈরি হয়, এর দায় জনগণ নেবে না। নেয়ার কথাও নয়।
আর রাষ্ট্রীয় চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ যদি অপরাধজনিত কাজ করে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিভিন্ন সময়ের রাষ্ট্র শাসকরা সেই দায়িত্বটি পালন করেননি। তাই এই দায়ভার জনগণেরও তা বলা বোধহয় ঠিক নয়। বর্তমান সরকারের শীর্ষ স্থানীয়রা প্রায়ই নানা কথায় পূর্ববর্তী জামাত-বিএনপি জোটের ওপর দোষ বর্তাচ্ছেন। দোষ ওরা করেছিল বলেই তারা জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
তাই বিপুল ভোটে জিতে যে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদেরকে কাজের মাধ্যমে স্থবিরতার আগল ভেঙে ফেলতে প্রত্যয়ী হতে হবে। জঞ্জাল সাফ করা সহজ কাজ নয়। তারপরও শুরুটা করতেই হবে কোথাও না কোথাও। তা না হলে পূঁতিগন্ধযুক্ত অতীত ঘেঁটে লাভ কিছুই হবে না। বরং প্রজন্ম ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়বে বর্তমান সরকারের প্রতিও।
বর্তমান মহাজোট সরকার প্রায় দেড় বছর সময়ের কাছাকাছি পার করছে। এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রায় কার্যকরসহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজই হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। মহাজোটকে নির্বাচনী ওয়াদাগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে খুব মনোযোগের সঙ্গে। যুদ্ধাপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
কেউ কেউ আওয়ামী লীগের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধীদের ছায়া আবিষ্কারে ব্যস্ত রয়েছেন। তারা ব্যস্ত হতেই পারেন। কারণ এসব অপশক্তি রঙ পাল্টে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে তা হতে পারে না। হতে দেয়া যায় না।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত, খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো মীরজাফররা সেসময় আওয়ামী লীগেই ছিল।
অথচ জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে এদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। ইতিহাস সে সব ঘটনার আজো সাক্ষী হয়ে আছে। এভাবেই বিশ্বাসঘাতকদের একটি মহল এখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে একটি বলয়ের মাঝে রেখেছে। যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকৃত অবস্থা জানাতে চায় না কিংবা চাইছে না।
রাষ্ট্রের চারপাশে যখন সম্মিলিত পাপ দানা বাঁধে তখন তা প্রতিহত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই ক্ষণে এসব হায়েনাচক্র নীরব থাকবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা মরণ কামড় মারতেই পারে। তাই সবদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রে যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কেউ সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে পরিশুদ্ধ হাতে।
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ।
ঢাকা । ১০ এপ্রিল ২০১০ শনিবার প্রকাশিত
ছবি- সনজা গার্টনার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।