সাক্ষাতকারে তারেক রহমান : ‘জিয়া পরিবার আর কত নির্যাতন সইবে’
শওকত মাহমুদ, লন্ডন থেকে ফিরে
সেই টগবগে তরুণ তারেক রহমান এখন কেমন আছেন? কবে ফিরছেন দেশে? নাকি খোঁজ-খোয়ানো, স্মৃতি-মেদুর এক রাজনৈতিক নেতা হতে চলেছেন? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির সদরে-অন্দরে আলোচিত এসব প্রশ্নের জবাবে ছেচল্লিশে সদ্য পা দেয়া তারেক রহমান সেই চেনা সলাজ ভঙ্গিতে হাসলেন। প্রথম দেখায় অনাত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা ঘটাতে যা কিনা হৃদয়ভেদী। কিন্তু এবার যেন এই হাসির আড়ালে ছাপিয়ে উঠল ১/১১’র ভয়াবহ স্মৃতি, হাড়-ভাঙার অব্যক্ত যন্ত্রণা; দেশে ফিরবেন কি ফিরবেন না, বাংলাদেশ নিয়ে আর স্বপ্ন দেখবেন কি দেখবেন না—এসবের টানাপড়েন। শেষ নভেম্বরে লন্ডনের আকাশে যেমন এই রোদ-এই মেঘ।
১/১১ থেকে শিশুরা এই রটনায় বড় হয়ে উঠেছিল যে, তারেক রহমান গণতন্ত্র, সুশাসনের খলনায়ক।
হাওয়া ভবন ছিল যত্তসব হাঙ্গামার উত্স। তাকে ঘিরে হিন্দি সিনেমার মতো গল্প বানিয়ে, গল্প ছড়িয়ে কী বিষাক্ত ধিক্কারই না দেগে দেয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র বিনাশের সেই কালো প্রহরে তারেক-গীবত হয়ে উঠেছিল লিভিং স্পেসের নিয়মিত ঘটনা। কী সব শিরোনাম! মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের ছত্রছায়ায় ডিজিএফআই অর্থাত্ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অফিসের কয়েকজন অতিউত্সাহী কর্মকর্তার বানানো সব কাহিনী লাল শিরোনাম হচ্ছিল অনেক দৈনিকে। কিন্তু আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট, সে ধিক্কার সত্যভিত্তিক বা প্রামাণিক ছিল না।
‘উইপন্স অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’ বা কথিত গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের অছিলায় ইরাকে যেমন হামলা হয়েছিল, তারেক রহমানের মধ্যে অমন মারণাস্ত্র খুঁজতে যেন হামলে পড়েছিল কুচক্রীরা। ১/১১’র মূল টার্গেট যেন তারেক। অথচ কী পাওয়া গেল, জাতির সামনে আজ স্পষ্ট।
‘কেন আমার ওপর এই অমানুষিক নির্যাতন হলো? কত তদন্তই তো হলো; কিছুই তো প্রমাণ হলো না। অথচ অত্যাচারের কারণে সারা জীবন আমাকে পঙ্গুত্ব আর অসহ্য বেদনা বয়ে বেড়াতে হবে।
’ অবর্ণনীয় এক আবেগ বুকে চেপে অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বললেন তারেক রহমান ।
‘আমার বাবা জিয়াউর রহমান গ্রাম-গঞ্জে অবিরাম হেঁটে হেঁটে মানুষের মাঝে থাকার রাজনীতি করতেন। আমিও শুরু করেছিলাম সেই হাঁটা। বলুন তো, কেন ওরা আমার মেরুদণ্ড ভেঙে আমাকে স্থবির করতে চেয়েছিল? সেই হাঁটা, সেই রাজনীতি বন্ধ করতে?’ উল্টো আমার দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন বিষণ্ন, অভিমানী তারেক রহমান, ১/১১’র আমলে সবচাইতে বেশি নির্যাতিত রাজনীতিক, যাকে আজীবন বইতে হবে সেই বেদনা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে জড়িয়ে মইনগং গুনে গুনে ১৩টি মামলা দিয়েছিল।
কোনোটাতেই তারেক সরাসরি আসামি নন। আসামিদের আগে ধরে তাদের বানানো স্বীকারোক্তি ছিল তারেককে ফাঁসানোর অস্ত্র। সেই সব স্বীকারোক্তি পিটিয়ে সাদা কাগজে সই করা হয়েছিল, যা পরে আদালতে প্রত্যাহার হয়েছে। ১৩টি মামলার মধ্যে ১১টি উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত আছে, তারেক জামিন পেয়েছেন। ‘দিনকাল’ সংক্রান্ত মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত মামলাটি আদালতের বিবেচনাধীন রয়েছে, সরকার সময় নিয়েছে। কাফরুল থানায় দ্রুত বিচার আইনের অধীনে ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল যে মামলাটি হয়, তাতে তারেককে ফাঁসাতে মরিয়া মইন-ফখরুদ্দীন সরকার দু’দিনের ব্যবধানে দু’বার আইনের সংশোধন করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তা আমলে নেয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ের করা প্রায় দেড় হাজার মামলা তুলে নিয়েছে। বিএনপি নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলাগুলো একচোখা সরকারের দৃষ্টিতে পড়েনি।
তারেকের বিরুদ্ধে স্থগিত একটি মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী। আবার তা পুষিয়ে দিতে বর্তমান আমলে মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছে। অথচ সেখানেও তিনি মূল আসামি নন।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা অভিযোগে তারেক রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্তে তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল আমার।
১৯৯০ সালের ২০ নভেম্বর স্বৈরাচারী সরকারের মদতে এক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে শহীদ মঈনুল রোডের বাড়িতে জোর করে ঢুকে তারেককে আক্রমণ করেছিল। বেগম জিয়ার সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে সেদিন সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই হামলার পর তারেককে যেমন শান্ত দেখেছিলাম, সেদিনও শুনলাম তার অকম্পিত কণ্ঠ। ৭ মার্চ রাতে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে নিতে এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমার জন্যে দোয়া করবেন।
’ এরপর দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন। মা বেগম জিয়ার অঝোর কান্না আর প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তারেককে ওরা নিয়ে যায়। ১২টি মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তারেক রহমান আর সুস্থ নেই। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে স্ট্রেচারে গিয়ে লন্ডনের প্লেনে উঠেছিলেন ১১ সেপ্টেম্বর।
৫৫৪ দিন কারাবাসের পর পিজি হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়া মায়ের বুকে বেদনার্ত তারেকের রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন পিজি হাসপাতালের বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল। তারপর থেকে তারেক লন্ডনে, চিকিত্সায়। আগের চাইতে এখন খানিকটা সুস্থ। কিন্তু কোনোদিনই সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন না।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। সারাক্ষণই শরীরে যন্ত্রণা হয়। জানালেন, মেরুদণ্ডের ভেঙে যাওয়া হাড়টা জোড়া লেগেছে বাঁকা হয়ে। ডাক্তাররা বলেছেন, সম্পূর্ণ আরোগ্য কখনওই সম্ভব নয়। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ফিজিওথেরাপি নেন।
আরও চিকিত্সা দরকার।
বেদনার্ত অতীতকে খুঁড়ে তুলতে, স্মরণে আনতে বিমর্ষ তারেকের বেশ অনীহা। তবু আমার সন্ধানী জিজ্ঞাসায় বললেন, ২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বার বার ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি।
কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি। ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় আমি কারাগারে। কোনো ডাক্তার নেই। চিকিত্সা হয়নি।
প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে?
সামরিক শাসনামলের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়া শরীরি নিপীড়নে মৃতপ্রায় তারেক রহমান ২০০৮-এর জানুয়ারি আদালতে জীবনের নিরাপত্তা চাইলেন। বললেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চোখ বেঁধে (২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা) আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ।
কোনো সন্ত্রাসী নই। এর আগে আমার চিকিত্সার জন্য আদালত নির্দেশ দিলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রিমান্ডে আবার নির্যাতন হলে আমি বাঁচব না। ’ অথচ সবার মনে আছে, ডিজিএফআই’র মিডিয়া-পেষণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তারা সেদিন মিডিয়ায় বার বার দাবি করেছিলেন, তারেক রহমানকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কিন্তু জাতি দেখেছে, ডাক্তাররা রিপোর্ট দিয়েছেন, অমানবিক নিগ্রহে তারেক নিশ্চল।
আদালতের নির্দেশক্রমে ২৯ জানুয়ারি তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে একটি মেডিক্যাল বোর্ড পরীক্ষা করে সুপারিশ করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির জন্য। কোনো চিকিত্সায় কাজ হচ্ছিল না। ৯ জুন অ্যাম্বুলেন্সে করে আদালতে নেয়া হলে কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারেও বসে থাকতে পারেননি। এরপর পেইন কিলার দিয়েও তার ব্যথা কমানো যাচ্ছিল না। সে বছরের আগস্টে হাসপাতালের প্রিজন সেলে টয়লেটে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি।
ডিজিএফআই’র প্রবল চাপ উপেক্ষা করে দেশের শীর্ষ চিকিত্সকদের এক মেডিক্যাল বোর্ড তারেক রহমানকে চিকিত্সার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করে। বোর্ড দেখতে পায়, নির্যাতনে তারেকের মেরুদণ্ডের ৬ ও ৭ নম্বর হাড় ভেঙে গেছে। মেরুদণ্ডের ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে গেছে। চোখে, হৃদযন্ত্রে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এসবের চিকিত্সা সম্ভব নয়।
এখন লন্ডনের শুশ্রূষায় তিনি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। কিন্তু নির্যাতনের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, হবেও সারা জীবন। বাংলাদেশে অনেকে মনে করেন, ১/১১তে তারেককে অচল করার ষড়যন্ত্রের বড় দুটি কারণ হলো; ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পেছনে বড় হেতু ছিল তারেকের সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা, দক্ষ নির্বাচনী প্রচারণা। দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদী শক্তির ভবিষ্যত্ কাণ্ডারী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত হয়ে উঠছিল।
স্বল্পাহারী তারেক রহমান ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে বলছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে তদন্তকারীরা যে সিরিয়াসলি তদন্ত করেছে, তা মনে হয় না।
চারশ’ স্যুটকেস ডলারে ভরে সৌদি আরবে পাচারের অভিযোগ তুললে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, একটি ডিসি-১০ বিমানের কার্গোহোলে কত স্যুটকেস আঁটে বা একজন যাত্রী অত স্যুটকেস কীভাবে নিয়ে যেতে পারে—সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কিনা। এরপর তারা আর সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। সরকার ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ওইসব বিপথগামী অফিসার স্রেফ আক্রোশের বশে আমাকে নির্যাতন করেছে। তদন্তকারীদের কিছু জ্ঞান তো থাকতে হয়। আমাকে নিঃসাড় করে দেয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য।
’ ওইসব তদন্তকারী ওরফে নির্যাতকদের চিনতে পেরেছেন কিনা জানতে চাইলে তারেক ‘না’ সূচক মাথা নাড়লেন।
তারেক রহমানের এখন নির্বাসিত জীবন। খুব কম লোকের সঙ্গে সাক্ষাত্। পরিবার নিয়ে নিভৃতে থাকেন। চিকিত্সাতেই তার মূল মনোযোগ।
রাজনীতি বা দলের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললে চলে। লন্ডনে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করেছেন পারিবারিক পরিবেশে। যুক্তরাজ্য বিএনপি’র আহ্বায়ক কমরুদ্দিন দারুণ একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে গেছেন তিনি। এখন ভাবছেন, আইন পড়বেন।
ইন্টারনেটে দেশ সম্পর্কে যতখানি জানার জেনে নেন। আমার কাছে দেশের অবস্থার খোঁজ করলেন। এশিয়ান হাইওয়ে, করিডোর, সমুদ্রসীমা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মিডিয়া—নানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাংলাদেশে তো এখন হাওয়া ভবন নেই, তারেক রহমান নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে কি দুর্নীতি-অনিয়ম-সিন্ডিকেট বাণিজ্য-কমিশন সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে? কত কিছুই না তখন লেখা হয়েছে।
মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, বাংলাদেশের রাজনীতির মানদণ্ডে একজন রাজনীতিক যা করে থাকেন, আমি তার সীমা কখনও অতিক্রম করিনি। ’ আপনার সঙ্গে অনেকে ছিল, কারও কারও দুষ্কর্মের দায় আপনার উপর পড়েছে বলে মনে হয়? ‘হতে পারে কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু যখনই আমার নলেজে এসেছে, ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি মূলত দলের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছি।
দুঃস্থদের সাহায্য করেছি। ’
শরীরজুড়ে যন্ত্রণা, কিন্তু কথায় বা শব্দ চয়নে তারেক রহমানের সর্তকতা একটুও কমেনি। প্রতিটি বাক্য গুছিয়ে বলেন, শেষ করেন, চিন্তার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা বা অবসাদ নেই। প্রতি শব্দের উচ্চারণে, স্বরের প্রক্ষেপণে তাল ও লয়ের পরিমিতি প্রবল। তরুণ এই রাজনীতিকের কণ্ঠে স্মৃতি জাগল—‘বাংলাদেশ নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখেছি।
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারের একটা রূপকল্পের পাশাপাশি দেশকে সবল, স্বনির্ভর করার স্বপ্ন—দুটিই একসঙ্গে কাজ করেছে। আমি ব্যাপক জরিপের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করেছিলাম, দেশের কোন থানায় কোথায় এক বিঘার বেশি জমিতে কত ফলের বাগান আছে, মাছের চাষ হচ্ছে। সেসব কৃষক বা উদ্যোক্তাকে সহায়তা করা, দুঃস্থ, কর্মহীনদের উত্পাদনমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার ছক বানিয়েছিলাম। রাসায়নিক সার আমাদের জমির উর্বর শক্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই দেশীয় পদ্ধতির সার ব্যবহার, শিল্প, বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপায়সমূহ চিহ্নিত ও বাস্তবায়ন করার বিষয়গুলো আমার কম্পিউটারে সবসময় থাকত।
খাল কাটার বিষয়ে বিশদ পরিকল্পনা বানিয়েছিলাম। শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রেখে সেচে ব্যবহার, বন্যার সময় পানি নিষ্কাশন, শহীদ জিয়ার দেশ-জাগানো কর্মসূচিগুলোর পুনরুজ্জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে ছিলাম। কাজও শুরু হয়েছিল। ’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই তারেক বুঝলেন, প্রশ্নকারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা উত্থাপনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। যে প্রশ্নটি ব্যাপক মানুষের।
‘ওই পর্বই কি শেষ পর্ব? দেশে আর ফিরবেন না? রাজনীতি আর করবেন না? স্বপ্নের রূপায়ণ কি থেমে থাকবে?’ একনাগাড়ে আমার ওইসব জিজ্ঞাসায় কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। হট টাওয়েলে বারকয়েক হাত মুছলেন। হৃদয়াবেগের বিহ্বলতা ছড়িয়ে পড়ল। হাসিতে আড়াল করতে চাইলেও পরোক্ষ বিস্তৃত অভিমান। ‘কেন যাব বলুন তো শওকত ভাই! জিয়া পরিবার আর কত নির্যাতন সইবে? আমার বাবা দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিলেন।
আম্মা আমাদের নিয়ে কত কষ্ট করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু গ্রেফতার, নির্যাতন, হামলা, মামলা, বাড়ি থেকে উচ্ছেদসহ নানা ষড়যন্ত্র তাকে সইতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আমার ভাই কোকো অসুস্থ, বিদেশে, মামলায় পড়েছে। আমি, আমার পরিবার নিয়ে বিদেশে। এখানে না এলে বাঁচতাম কিনা জানি না।
আম্মা বাংলাদেশে একা, পরিবারের সঙ্গ-বঞ্চিত। দেশ ও দলের কাজে ব্যস্ত। এটা কি স্বাভাবিক অবস্থা? আমার জন্যে, কোকোর জন্যে আমাদের ছেলেমেয়েরাই বা কেন সাফার করবে?’
আমার কোনো জবাব ছিল না, কারোরই থাকার কথা নয়। কোন শব্দটি অন্যায্য? কিন্তু তারেক রহমানের ৪৫তম জন্মদিনে দেশজুড়ে তার রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের দাবি যে জোরালো হয়ে উঠছে, সে প্রসঙ্গে তার মন্তব্য চাইলাম। নিরুত্তর তারেক রহমান।
হতে পারেন তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে; কিন্তু এই বয়সে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচাইতে সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে অগ্নিপরীক্ষায় যে তিনি উত্তীর্ণ, সে সত্যের অস্বীকৃতিও তো অসম্ভব। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্-যাত্রায় শামিল হবেন, না অভিমানে দূরে থাকার বিবাগী অনুভূতিতে পুড়বেন? মনে পড়ে যায় এক স্মরণীয় উক্তির কথা—‘A political leader must keep looking over his shoulder all the time to see if the boys are still there. If they aren’t still there, he’s no longer a political leader.’
শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দায় নিয়ে কতকাল তারেক রহমান রইবেন দূরে? এ প্রশ্নে আবারও হাসলেন, যার গূঢ় অর্থ হয়তো এমন—সময়ই বলে দেবে। মন্তব্য করলেন, বিএনপি’র কাউন্সিল নিয়ে তো শুনছি দেশজুড়ে দারুণ প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। এই কাউন্সিল থেকে বিএনপির নবযাত্রা শুরু হবে।
আমার বিশ্বাস, একজন নতুন তারেক রহমান তৈরি হচ্ছে।
নতুন এক ধরনের অস্মিতাবোধে তার অন্তরাত্মা নতুন করে জাগছে, সে দূরাভাস অস্পষ্ট থাকে না। ৫৫৪ দিনের যন্ত্রণাময় কারাবাস, প্রায় ১৪ মাসের নিভৃত প্রবাস জীবন এই তরুণকে ‘আমি আছি’ ‘আমি যে আমি,’ এই অনুভূতিতেই দাবিয়ে রাখছে। দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ, তৃণমূল রাজনীতির দুর্লভ অভিজ্ঞতার সঙ্গে স্নায়ুবিক অনুভূতি, চাঞ্চল্য, দীর্ঘশ্বাস, অশ্রুপাত, শিহরণ যে রূপে দেখা যায় তাই অস্মিতাবোধ।
মেরুদণ্ড ভেঙেছে তারেক রহমানের। কিন্তু মচকাননি।
অপরিসীম মনের জোর তার বরাবরের শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধকে এখনও ম্লান করতে পারেনি। আগে বিদায় দিলেন আমাকে। সন্ধ্যায় গাড়িতে উঠতে উঠতে মনে পড়ল কবির সেই উক্তি— ‘সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার পরে/অন্তবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।