পতাকায় ফালগুন মানচিত্রে বসন্ত
‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মতো আসব না আর ফিরে কোনো দিন...’
কিংবা
‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে’
এমন বহু হৃদয়স্পর্শী গান দিয়ে অগণিত মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন বাংলা গানের কিংবদন্তি গায়ক ও সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তার সুললিত কণ্ঠ থেকে ধ্বণিত হতো মাধুর্যময় অসাধারণ সংগীত। শুদ্ধ সংগীতের জাদুকর হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি।
তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গান গেয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ক্যাম্পে সঙ্গে ঘুরতেন।
একাত্তরে চ্যারিটি শো-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তা দান করেছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরে।
তাঁর ‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে; কিন্তু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি, প্রতিবাদ করতে জানি’ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তরে সেদিন শক্তি যুগিয়েছিল।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ১৬ জুন বারানসিতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৌশলী হওয়ার জন্য শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেও পড়া শেষ না করে নিজেকে সংগীতে যুক্ত করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতার বেতারে প্রথম গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে তার সংগীতজীবনের শুরু হয়।
তবে নবম শ্রেণীর সহপাঠীবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার গান গাওয়ার জন্য তাকে ইডেনের স্টুডিওতে নিয়ে যান।
স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই ইডেন রেডিও স্টেশনে তার প্রথম পরিচয় হয়। সংগীত জীবনের প্রথমদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অনেকেই ‘ছোট পঙ্কজ মল্লিক’ বলে ডাকতেন। তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বীকার করেছিলেন, গায়কী জীবনের শুরুতে পঙ্কজ কুমার মল্লিক ছিলেন তার আদর্শ।
১৯৪৫ সালে তিনি বাংলা ছায়াছবি 'নিমাই সুন্ন্যাসী'তে প্রথম নেপথ্য গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীতেরও একজন প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। ১৯৪৪ সালে তার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় ।
‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও’, ‘মনে রবে কিনা রবে আমারে’, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরিষ শাখায়’, ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে’, ‘শুধু তোমার বাণী’ ‘আমার রাত ফুরালো ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গানগুলো ছিলো এই রেকর্ডে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দ মঠে’র নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে হিন্দি ছায়াছবির জগতে প্রবেশ করেন। হিন্দি ছবি ‘নাগিন’ এর সংগীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষস্থানও পেয়েছিলেন।
কেবল সংগীত পরিচালকই নন বহু হিন্দি ছবির নেপথ্য গায়কও ছিলেন হেমন্ত।
লেখক হিসেবেও তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ছাত্রজীবনে ‘বাতায়ন’ ও ‘দেশ’ পত্রিকায় তার বহু গল্প প্রকাশিত হয়।
আধুনিক বাংলা ও হিন্দি প্লেব্যাকের যুগস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অনেকবার বাংলাদেশে এসেছেন। ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবির গান রেকর্ড করতে।
বাংলাদেশের গান প্রসঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের গান করাপ্ট হয়নি তবে ভবিষ্যতে হবে’। মন্তব্য করেছিলেন ‘যন্ত্রের নয়েজ’ সুরের মৌলিকতা নষ্ট করছে। আজ হয়তো তার কথার সত্যতা কিছুটা পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট অবদান রাখার জন্য রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন ।
প্রত্যাখ্যান করার কারণ হিসেবে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার চেয়ে তা তুচ্ছ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এই গুণী শিল্পীর জীবনাবসান হয়।
অমর সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জীবনের ৬৯ বছরে 'পথের কান্তি ভুলে', ‘সুরের আকাশে’, কোনো এক গায়ের বধূর কাহিনী, আমি দূর হতে তোমাকেই দেখেছি, পাল্কি চলরে‘, ‘রানার রানার’, ‘আজ দু’জনার দুটি পথ’, ‘এই বালুকা বেলায়’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘ এই রাত তোমার আমার‘ ইত্যাদি অজস্র গান গেয়েছেন। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মাধ্যমে তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।
মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই বা আসি হেথা ফিরে' আজও আমার মনে গেঁথে আছে, যা ভোলার নয়, ভোলা যায় না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।