আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধার গ্রাম ইসলামপুর গ্রামের ৫/৬ মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন তাদের পরিবার প্রায় ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছে



৭১ সালে যখন পাঞ্জাবী পার্শ্ববর্তী বেরীগাঁও গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করে আশপাশের গ্রামের নিরীহ মানুষের উপর নির্মম অত্যাচার চালায় তখন ইসলামপুর গ্রামের ৫৬ জন তরুন ঐক্যবদ্ধ ভাবে শপথ নিয়ে ছিলো এক সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের শরীর বিলিয়ে দেওয়ার। তাদের সামনে দুটি রাস্তা খোলা ছিলো একটি যুদ্ধ করে মরার আর অপরটি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার। তারা প্রথমটি বেছে নিলেন। একথা ইসলামপুর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ফজলুর রহমানের। স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা মরণপন লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছিলেন রক্তস্নাত স্বাধীনতা আর লালসবুজ পতাকা কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে জীবনযুদ্ধে আজ তারা অনেকটাই পরাজিত সৈনিক।

তাদের প্রতিটি দিন চলে নানান টানাপোড়েন আর অভাব অনটনের মধ্যেদিয়ে। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের একটি গ্রাম ইসলামপুর। এ গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় ৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার বসবাস তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন বেঁচে আছেন ৫১ জন। গ্রামের নাম কাগজেপত্রে ইসলামপুর হলেও লোকমুখে পরিচিতি পাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার গ্রাম।

ইসলামপুর গ্রামের ৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে গ্রামের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সেক্টররের স্মৃতি বিজড়িতত ইসলামপুর গ্রাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী বেরীগাঁও গ্রামে পাক হায়নারা শক্তিশালী ঘাঁটিস্থাপন করে। আশপাশের গ্রাম গুলোতে চালায় নির্মম নির্যাতন সেখানে লুটতরাজ,ধর্ষণ ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। তা দেখে গ্রামের একদল যুবক পাঞ্জবীদের প্রতিহত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

সেখান থেকে শুরু হয় তাদের যুদ্ধে যাওয়ার গল্প। অবস্থান ও প্রকৃতি : ইসলামপুর গ্রামের পূর্বদিকে কদমতলী হাটি ও চিনাউড়াগ্রাম - পশ্চিমে নারায়নতলা গ্রামের কুমিল্লাহাটি -দেিণ খাগেরগাঁও-উত্তরে মালাইগাঁও এরই মধ্যে এক কিলোমিটার দীর্ঘ ইসলামপুর। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে হালুয়ারঘাট থেকে রিক্সা অথবা মোটরসাইকেল চড়ে বেলাবরহাটি- বেরীগাঁও-ষোলঘর- ভৈষেরপাড়- মঙ্গলকাটা- খাগেরগাঁও আর সিসি রাস্তা পারি দিয়ে ইসলামপুওে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশ দ্বারের রাস্তার দুইপাশে রয়েছে বাঁশঝাড়,সুপারীবাগান,শিমুলবাগান। ইংরেজী এস অরের আকৃতির আকাবাঁকা সড়কের মধ্যদিয়ে যেতে হবে ইসলামপুর গ্রামে।

ইসলামপুর গ্রামের এক কিলোমিটার পশ্চিমে ভারতের কামারভিটা গ্রামের মধ্যদিয়ে ধলাইনদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধলাইনদীর উৎসমুখ মেঘালয় পাহাড়ের ঝর্না। সবুজাভ স্বচ্ছশীতল জল ইসলামপুর গ্রামসহ পাশ্ববর্তী বেশ কয়েকটি গ্রামের জমি গুলো কে শস্য শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে। গ্রামের মেঠোপথের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে রয়েছে একজন মুক্তিযোদ্ধার বসত বাড়ি। তাদের ঘর গুলো টিন শেড।

কারও কারও আবার মাটিরঘর। ইসলামপুর গ্রামে মধ্যপাড়া,পশ্চিমপাড়া,দণিপাড়া,উত্তরপাড়া,দনিপূর্বপাড়া,উত্তর -পশ্চিমপাড়া, উত্তরপশ্চিমপাড়া,কদমতলীপূর্বপাড়া সহ ৮ টি পাড়ামহল্লা রয়েছে। প্রায় অধা কিলোমিটার দূরে দূরে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি। দিনযাপনের গ্লানি: তখন শেষ বিকেল। সুর্য্য অস্তাচলে যাওয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পথিমধ্যে জিজ্ঞাস করলাম ইসলামপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তথ্য কারকাছ থেকে জানা যাবে। ইতিমধ্যে ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ সড়কের পাশে আমন জমির মধ্যদিয়ে সহজ রাস্তায় পাশ্ববর্তী বাজারে যাচ্ছেন। তার হাতে বাজারের ব্যাগ ও শূন্য তেলের বোতল। ও চাচা দূর থেকে ডাক দিলাম ও মুক্তিযোদ্ধা চাচা আপনি একটু আমাদের সাথে কথা বলবেন, সালাম দিয়ে নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করলাম চাচা কই যান, তিনি মৃদু হেসে বললেন বাজারে। নাম মোঃ আবুল কাশেম।

বয়স (৬৪) কাঁচা পাকা চুল দাড়ি। পরনে সাদা রংয়ের পাঞ্জাবীও ঝুড়িপ্রিন্টের লুঙ্গি। তিনি বলেন, বাজারে যাইতাছি তো ঠিকই কিন্তু জিনিসপত্রের যে দাম যে টাকা ভাতা পাই তাদিয়ে চাল কিনতেই সব শেষ বাকীতে বাজার করতে হয়। আমারা কোন খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। লেইখন আমরার ভাতা যেন বাড়াইয়া দেন প্রধানমন্ত্রী।

একথা শুধু একজন আবুল কাশেমের নয় গ্রামের সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধার। তাদের পরিবারের কথা : ইসলামপুর গ্রামের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফের বিধাব স্ত্রী রাজিয়া খাতুন বলেন,৬ বাচ্চাকাচ্চার সংসার টেকার অভাবে বাচ্চাকাচ্চাদের লেখাপড়া করাইতে পারতেছিনা। ঘরদুয়ার বাইনাইতে পারছি না,ভাতার লাগি কত মানুষের কাছে গেছি কান্দাকাটি করছি কিন্তু কিছুই হয় নাই। আব্দুল লতিফের ছেলে শাহীন মিয়া বলে, আব্বা মারা যাওয়ার পর ইস্কুলও যাওন বন্ধ কইরা দিছি। এখন খাতা কলম রেখে দিয়ে সংসারের হাল ধরছি।

তার মেয়ে হাসিনা বেগম বলে সরকার বিনাবেতনে মেয়েদেও লেখাপড়ার ব্যবস্থা কইরা দিছে ঠিকই কিন্তু পেটে ভাত দেওনের ব্যবস্থা করে দেয় নাই। অপর একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে বলেন মাইনষে কয় মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান কিন্তু আমাদের এখন পরের বাড়িয়ে কাজকাম কইরা ভাত খাওন লাগে। অপর এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার স্ত্রী উঠোনে সামান্য ধান শুকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাকে তার স্বামীর কোথায় প্রশ্ন কররে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, তাইনে ভোলাগঞ্জ গেছে কাম করতো। ৬ জন বাচ্চাকাচ্চার সংসার একার পে চালাইতো পারে না। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সোবাহান বলেন, আমরা তিন বেলা পেটপুরে ভাত খাইতে পারিনা।

অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে গ্রামের অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পরিজন। ৫/৬ মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে তাদের পরিবার ভিুকে পরিণত হয়েছে। তাদের পরিবারের জন্য খাসজমি বরাদ্ধ দেয়ার দরকার। তাদেও সবার দাবী মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার পরিমাণ যেন বাড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.