আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেওয়ারিশ

Only I know what is my goal, My heart is my temple.

(এটি একটি আধা ভৌতিক গল্প। লিখেছিলাম অনেক আগে। কয়েকদিন আগে পড়ে ভয়ে নিজেই ঘুমাতে পারিনি। এ কারণে কারও হার্ট দুর্বল থাকলে গল্পটি না পড়ার অনুরোধ করছি। তবে গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক।

কারও সঙ্গে মিলে গেলেও সেটা কাকতালীয় মাত্র) বেওয়ারিশ কাজী সায়েমুজ্জামান এক: এই সাংবাদিক? এই… পরপর তিনবারের ডাকে আমার ঘুম ভাংগলো। ট্রেনের হাতল ধরে ঝুলছিলাম। পথে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। হঠাৎ চমকে উঠে আমি ট্রেনের হাতল ছেড়ে দিলাম। প্রায় পড়ন্ত আমাকে ধরে ফেললো একটি শীতল হাত।

চেয়ে দেখি আমি এখন ভৈরবের ব্রিজে। নিচে কালো গহীন নদীর স্রোত ট্রেনের শব্দে দিশেহারা। একটি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেচেঁ গেলাম। আমার গন্তব্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। একটি খবরের পেছনে ছুটতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম।

ফিরে আসতে হলো চীফ রিপোর্টারের ফোনের তাগাদায়। জানালেন, ঢাকায় ফিরে খুব জরুরী একটি রিপোর্ট করতে হবে। অন্য পত্রিকায় আসার আগেই এই এক্সেক্লুসিভটি তার চাই। অথচ গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামের বাস-ট্রাকের ধর্মঘট চলছে। ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ট্রেনই একমাত্র ভরসা।

কিন্তু ট্রেনে তিল ঠাইঁ জায়গা নেই। একটি টিকেট পেয়েছি তাও সাংবাদিক পরিচয়ে। এক্সট্রা বগিতে। ভেতরে ঢুকতে পারিনি। আমার সঙ্গে একটি ব্যাগ।

গলার ভেতরে ঢুকিয়ে কায়দা করে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছি। প্রথমে ট্রেনের পাদানিতে একটি পা দিয়ে ঝুলেছিলাম। ফেনী ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বহু কসরতে আরেকটি পা রখতে পেরেছিলাম। এভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত এসেছি তা স্পষ্ট মনে আছে। তার মানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভৈরব পর্যন্ত পথে আমি ট্রেনের হাতল ধরে ঘুমুচ্ছিলাম।

অবিশ্বাস্য। মৃত্যুর সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক করতে যাচ্ছিলাম বিনা বাধায়। বিপদে পড়লে আমি সময় দেখি। হাতে ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটা। আজ ১৫ নভেম্বর, ২০০৬ সাল।

বেচেঁ থাকার এমন আনন্দ আর ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে আমাকে ধরে ফেলা ব্যক্তির দিকে তাকালাম। খোচা খোচা দাড়ি। বোঝা যাচ্ছে গত দু মাসেও তাতে খুরের পোচ পড়েনি। উস্ক খুষ্ক চুল। রক্তশুণ্য চেহারা।

নাকটা থাবরানো। কপালে একটি কাটা দাগ। গায়ে কটকটে একটি হলুদ জামা। পরনে প্যান্ট। এত রাতে তার রং বুঝা যাচ্ছেনা।

অনেকের চেহারা এমন যে, একবার দেখলে পরবর্তীতে দেখা হলে আগে কোথায় দেখা হয়েছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই লোকটির চেহারাটিও কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়াই তেমনি। কৃতজ্ঞতা জানাতে আমি তার দিকে ফের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে বাচানোর জন্য ধন্যবাদ। আসলে কখন ঘুময়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। খবরের পেছনে ছুটে চলা এই আমি পেটি সাংবাদিক মেঘনার বুকে হারিয়ে গেলে খবরও হতে পারতামনা।

লোকটি আমার সঙ্গে করমর্দন করলো। তীব্র ঠান্ডা একটি হাত। নভেম্বরের এই সময়টা আসলে শীতের সঙ্গে প্রকৃতির একটি বোঝাপাড়ার রহস্যময় আতাত হয়। সাঁঝরাতে গরম পড়লেও ভোররাতে কনকনে ঠান্ডা। আমি চীফ রিপোর্টার সারোয়ার ভাইয়ের টেলিফোন পেয়েই ঘামতে শুরু করেছিলাম।

চীফ রিপোর্টার লোকটা একটি পাগলাটে। কিছুটা খ্যাপাটেও বটে। আজকের হরতাল তার কাছে মূল্যহীন। একজন রিপোর্টারের জীবনে যতগুলো কঠিন সমস্যাই আসুক না কেন- তা তার ভাষায় প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। এ কারণে তার কাছে অভিযোগ অনুযোগ করে লাভ নেই।

সেই ফোন পাওয়ার পর এই এখন করমর্দন করে আমি শীতের অস্তিত্ব টের পেলাম। এত ঠান্ডা ওই হাত। ওই হাত ধরে বাইরের ঠান্ডাও আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি কাপতেঁ থাকলাম। লোকটি বললো, কম্পার্মেন্টের ভেতরে আসুন।

ভেতরের সব সিটই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আমিও চেয়ে দেখলাম, আসলেই তাই। যাত্রীরা লাকসাম আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া নেমে গেছেন। ভৈরবে আসার পর এই কর্ম্পার্টমেন্টে সুনশান নিরবতা। আলাদা করে বগি লাগানোর কারণে অন্য বগি থেকে যাত্রিরা এখানে আসতে পারছেননা।

দু একজন যারা রয়েছেন তারা গভীর ঘুমে। তিনজনের একটি আসন দখল করে জানালার দিকে মাথা দিয়ে ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে সামনে মুখ করে শুয়ে দেখলাম, আমাকে বাচিয়ে দেয়া ব্যক্তিও সামনের আসনে বসেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে চেনেন নাকি? -না। -তাহলে সাংবাদিক বলে ডাকলেন কিভাবে? -কাধেঁ ব্যাগ দেখে মনে হয়েছিল, তাই ডাকলাম। এই ব্যাগতো সাংবাদিকরা ব্যবহার করে।

-হুম.. ঠিকই ধরেছেন। আমি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সাংবাদিক। কোথায় যাবেন? -কোথায় যাবো জানিনা। মানুষের সবার গন্তব্যই এক। কেউ বুঝে কেউ বুঝেনা।

-তারপরওতো সাময়িক একটি গন্তব্য থাকে। -আমি ইদানিং এই তূর্ণা নিশীথার নিয়মিত যাত্রী। কেমন এক ভলোবাসায় জড়িয়ে গেছি এই ট্রেনের সঙ্গে। - হমমম.. তূর্ণা নিশীথা নামটির মধ্যে কেমন একটি যেন ভৌতিক রহস্য রয়েছে। অনেক রাতে এর মর্মার্থ বুঝা যায়।

যাই হোক আপনি আজ আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। -সম্প্রতি অনেক মানুষ এই ট্রেনের বলি হয়েছে। রেল লাইনের পাশে আজকাল অনেক লাশ মিলছে। এই আমাকে দেখুন। আমিও এর বলি।

-আপনার আপন কি কেউ মারা গেছেন? -এই জগতের কেউ আপন নয়। তবুও আমি আমার আপনজনদের খুঁজে বেড়াই। ট্রেনের গতি একটু কমেছে। রেল লাইন সংলগ্ন একটি সড়ক। তার বাতিগুলোর আলোতে ভরে গেছে আমাদের কামরা।

লোকটির কথার কোন আগামাথা পেলামনা। কেমন একটি ভৌতিক পরিবেশ। একটি কুকুর রাস্তায় দাড়িয়ে অনবরত ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে। আমার মাথায় রাজ্যের চিন্তা। কেমন গোলমেলে।

বাইরে মেঘের কবল থেকে এই নিশীথ রাতে চাঁদটি ক্ষণিকের জন্য মুক্তি পেয়েই আলো বিতরণ শুরু করেছে। কয়েকটা চামচিকা তার আলোতে উড়াউড়ি করছে। হঠাৎ আসা দমকা বাতাস উদাস করে দিল আমাকে। ভাবি, পৃথিবীর সকল অনর্থেরই অর্থ আছে। শুধু আমার কোন অর্থ নেই।

এই বয়ে চলা ট্রেনের একটি গন্তব্য আছে। আমার নেই। কোথায় গিয়ে যে থামবো; জানিনা। আমার ওপাশে শুয়ে থাকা ব্যক্তির পরিচয় আমি এখনো পাইনি। তার আধ্যাত্মিক কথায় আমি হারিয়ে গেছি।

এখন আমি আমার নিজের পরিচয় খুঁজছি। আমি কে-তা ওপাশের লোকটির মতোই জানিনা। একটু ভয় লাগলো। ভাবলাম, ঢাকায় পৌছাতে সকাল হয়ে যাবে। দিনের আলোতেই এর সঙ্গে কথা হবে।

এদিকে ক্লান্তির হাত ধরে ঘুম অক্টোপাসের মতো আমাকে আকড়ে ধরেছে। একসময় গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম। দুই: ট্রেন এমন একটি বাহন যা ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাড়িয়ে থাকলেও ভেতরের যাত্রীরা কারণ জানতে পারেন না। কারও কোন জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতাও যেন নেই। এ কারণে আমিও জানতে পারলামনা ঘন্টা দুয়েক কেন দাড়িয়ে ।

শেষ রাতের দিকে ট্রেন থেমে যাওয়ায় যাত্রীরা অনেকেই ঘুম থেকে উঠেছেন। কেউ কেউ জানালা দড়জা নিজ উদ্যোগেই বন্ধ করে দিয়েছেন। আজকাল যা দিনকাল পড়েছে। ট্রেনেও ডাকাতি হচ্ছে। সর্বস্ব নিলেও ওদের হচ্ছেনা।

ধরে ধরে লোকজনকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে বাইরে। এরা রেল লাইনের পাশের ঘুপচির মতো গড়ে ওঠা বস্তিতে বেড়ে ওঠা কোন সন্তান। ভুখা পেটে প্রতিদিন রেল লাইন ধরে বয়ে চলা ট্রেনের যাত্রীদের সন্তানদের খাবার নিয়ে আদিখ্যেতা দেখতে দেখতে দেখতে এরা বড় হয়। এরাই পরে শ্রেণী বৈষম্যের প্রতিশোধ নেয় এভাবে। কোন কারণ ছাড়াই হত্যা করে।

শীতের কোলে গুটিসুটি মেরে আরও ছোট হয়ে যা হবার হবে ভেবে আবারও এপাশ হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালের আলোর সঙ্গে একপাল লোক কামরায় ঢুকে আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে সোজা করে আমার পাশে দুজন বসে গেল। আমি চোখ মেলে সামনের রাতের সহযাত্রীকে খুঁজলাম। দেখলাম, তিনি নেই। সেখানে অন্য তিনজন যাত্রী।

নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে হলো। ঠিকানা দূরের কথা, লোকটির নাম পর্যন্ত জানা হলোনা। পুরো কামরাটি দেখলাম। কোথাও তিনি নেই। আমার উল্টোদিকে একজন যাত্রীকে উঠে জানালা বন্ধ করতে দেখেছিলাম।

তাকে আবার দেখলাম। বললাম, আমার সামনের আসনে বসা যাত্রীটি যার গায়ে হলুদ জামা, গালে ছোপছোপ দাড়ি, কপালে কাটা দাগ, তাকে দেখেছেন কি? তিনি নির্বিকারভাবে বললেন, দেখেছি, আপনার সামনের আসনে কেউ ছিলনা। আপনাকেই দেখেছিলাম একা একা কথা বলতে। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। কোনমতে তেজগাওঁ রেল স্টেশনে নেমে পড়লাম।

আমি যুক্তিবাদী মানুষ। একজন রিপোর্টার। আমি বিশ্বাস করি দুই দুইয়ে চার হয়। কখনোই পাচঁ হয়না। হলে বুঝতে হবে সেখানে অন্য কারও অনুপ্রবেশ হয়েছে।

আমার গতরাতের সহযাত্রী স্বপ্ন ছিলনা- এটা আমি নিশ্চিত। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার মানিব্যাগে থাকা সর্বশেষ ভিজিটিং কার্ডটি তাকে দিয়ে বলেছিলাম, দেখা করবেন। তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই দেখা হবে। আমি জানি, সে আমাকে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাচিয়েঁছে। মনিষী হেগেল বলেছেন, মানুষের নিজের অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় কিছু নেই।

পাঠককে আগেই বলে রাখছি, যে এই ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার আসলেই দেখা হয়েছিল। আর সে কারণেই এতবড় গল্পের অবতারণা। সকাল ১০টায় দৈনিক মানবজমিন অফিসে চলে আসলাম। চীফ রিপোর্টারের সাথে দেখা করলাম। বললেন, যা পেয়েছেন লিখে দুই ঘন্টার মধ্যেই জমা দেবেন।

তারপর বড় একটি এ্যাসাইনমেন্ট আছে। আজকালতো ‘উনি বলেন’ ‘তিনি বলেন’ টাইপের রিপোর্টারে অফিস ভরে গেছে। উনারা কিছু না বললে তাদের রিপোর্ট নেই। রিপোর্ট খুঁজতে হবে। তারপর বের করে আনতে হবে।

পত্রিকা পড়েছেন আজকে? আমি বললাম, জ্বি পড়েছি। -কোন রিপোর্ট চোখে পড়েছে? -নাতো! -আসলে আপনি রিপোর্টার হতে পারবেন না। এতবড় ঘটনাগুলো আপনার চোখে পড়েনি। বেশ কয়েকদিন ধরেই এটি নিয়ে সংবাদ হচ্ছে। - আমি বুঝতে পারছিনা।

আপনি বলে দেন, আমি যত কঠিনই হোক করে দেখবো। -আজকের পেপারগুলো ভালো করে পড়েন। দেখবেন, কয়েকটি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গেছে বলে সংবাদ ছাপা হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই এ ধরনের সংবাদ ছাপা হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করতে হবে।

এজন্য আপনাকে তিনটি স্থানে যেতে হবে। এসব বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। সেখানে গিয়ে গত এক সপ্তাহে, মাসে এবং বছরে কতটি বেওয়ারিশ লাশ তারা দাফন করেছে- তার তথ্য পাবেন। দেখবেন, অনেক লোকজন তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের খুঁজতে সেখানে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

আঞ্জুমান তাদের দাফনকৃত বেওয়ারিশ লাশের তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বের করতে হবে সেখানে হারিয়ে যাওয়া লোকজনকে খুজতেঁ গিয়ে কেউ লাশের ছবি দেখে সনাক্ত করতে পেরেছেন কিনা? এরপর যাবেন জুরাইন কবরস্থানে। সেখানে এসব বেওয়ারিশ লাশ কবরস্থ করা হয়। প্রত্যেক কবরের একটি করে নম্বর আছে। লাশের ছবিতে ওইসব নম্বর দিয়ে রাখা হয়।

সেখানে গিয়ে কয়েকটি জিনিস খুঁজবেন। লোকজন যারা স্বজনের ছবি সনাক্ত করেছেন তারা দেখবেন সেই নম্বরের কবরে নামধাম লিখে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। সেগুলো নোট করে আনবেন। সেখানে এ পর্যন্ত কতজন তাদের স্বজনদের কবর খুজেঁ পেয়েছেন তাদের সংখ্যাটাও লাগবে। সর্বশেষ যাবেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।

সেখানে একটি বিশাল ফ্রিজের ড্রয়ারে লাশ সংরক্ষণ করা হয়। সেসব লাশের স্বজনদের না পাওয়া গেলে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের হাতে দাফনের জন্য তুলে দেয়া হয়। পরে পুলিশের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। আজকের রিপোর্ট বেওয়ারিশ লাশ পর্যন্তই থাকবে। আপনার কাজ হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডোমদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা।

এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে আপনাকে আরেকটি রিপোর্ট করতে হবে। এই বেওয়ারিশ লাশের সবগুলো দাফন করা হয়না। এদের অনেকেই কঙ্কাল হয়ে যায়। একটি কঙ্কালের দাম ২০-২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রচুর বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হওয়ার পর এই কঙ্কাল ব্যবসা জমজমাট।

বড়লোকের অপদার্থ সন্তানগুলো এসব মেডিকেলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ভর্তি হয়। এরা ডাক্তার ভাব নেয়ার জন্য প্রথম বর্ষেই একটি করে কঙ্কাল কেনে। তার মানে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫-১০ হাজার কঙ্কালের চাহিদা এ দেশে রয়েছে। আর এর সঙ্গে ডোমরাই ওৎপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে হচ্ছে। মানুষের ২০৬ খানা হাড়।

এগুলো একটি একটি করে অক্ষত রেখে পুরো কঙ্কাল বের করে আনা সহজ কাজ নয়। কোন কারখানা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। এখানে দুইয়ে দুইয়ে পাচঁ হয়েছে। বুঝলেন। আপনাকে এটি অনুসন্ধান করে বের করে আনতে হবে।

একটু ভয় লাগতে পারে। তবে রিপোর্টার হতে গেলে এসব ভয়কে জয় করে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে। আমি চীফ রিপোর্টার সারোয়ার হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কি হৃদয়হীন মানুষ। হরতালে কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে পৌছালাম তার একটু খোঁজও নিলেননা।

আজকের দিনটি আমার জন্য বিশ্রামের দরকার ছিল। তা বলার সুযোগও পেলামনা। গল্প মনে পড়ে গেল। একজন রিপোর্টারের কোন রিপোর্টই ছাপা হচ্ছেনা। চীফ রিপোর্টার লেখা রিপোর্টারের মুখের উপর ছুড়ে মারেন।

আর বলেন, রিপোর্ট কি জিনিস তাই জানেন না। রিপোর্টার হতে এসেছেন। একটি কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা রিপোর্ট হয়না। কিন্তু কোন মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা রিপোর্ট হয়। এটা বুঝতে হবে।

প্রতিদিন এই উদাহরণ শুনতে গিয়ে রিপোর্টার বিরক্ত হয়ে যান। তিনি রাস্তা থেকে বহু কষ্টে একটি কুকুর ধরে এনে চীফ রিপোর্টারের টেবিলে রেখে তার পা কামড়ে ধরে বলেন, নিন। এবার আপনাকে একটি রিপোর্ট দিলাম। চীফ রিপোর্টার রেগেমেগে আগুন হয়ে কুকুরের ওপর একটি লাথি বসিয়ে দিলেন। আর বেচারা রিপোর্টার রেগে চীফ রিপোর্টারের পায়ের ওপরই কামড় বসিয়ে দিলেন।

পরের দিন অবশ্যই খবর হয়েছিল। তবে তা কুকুরকে কামড়ানোর জন্য নয়। খবরের হেড লাইন ছিল, চীফ রিপোর্টারকে কামড়ে চাকুরী থেকে বরখাস্ত হলেন রিপোর্টার। আজ আমারও ইচ্ছা করছে, চীফ রিপোর্টারকে কামড়ে নিজেই খবর হয়ে যাই। তিনি কঙ্কাল আর মানুষের শোক নিয়ে তাথ্যিক বাণিজিকিকরণের জন্য কি করে হৃদয়হীনভাবে অবলীলায় কথাগুলো বলে গেলেন।

হৃদয়হীন মানুষগুলোই কি রিপোর্টার নাকি রিপোর্টার হয়েই মানুষ হৃদয়হীন হয়- এ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারলামনা। হয়ত কয়েকদিন পর আমার কাছের মানুষগুলোই তা বলতে পারবে। তিন: দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময়ের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। পথ চলতে গিয়ে এসময় প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করতে করতে বাতাসও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি সেই ক্লান্তি গায়ে মেখেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের পথ ধরলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে যে পথটি বকশি বাজারের দিকে গেছে সেই পথে একটু এগিয়ে বাম দিকে পথটি মর্গে গিয়ে মিলেছে। এটি কলেজ ভবনের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে। একটু পুর্ব দিকে গিয়ে উত্তর দিকে মুখ ফেরাতেই দেখতে পেলাম দুইটি নেড়ি কুকুর। গায়ে কোন চামড়া নেই। চারপাশে একটি বিকট গন্ধ ছড়িয়ে।

আমি অবশ্য এখানে আসার আগে ডোম সেকান্দারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসেছি। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। একটা সুনসান নিরবতা চারদিক ঘিরে । আমাকে দেখে কুকুর দুইটি একটু শব্দ করলো। সামনেই লাশকাটা ঘর।

পশ্চিম দিকের ঘরে দুইটি লাশ দেখতে পেলাম। দুটি লাশই হোগল পাতার পাটি দিয়ে বাধা। শুধু পা দেখা যাচ্ছে। গা ছমছম করে উঠলো। সিড়ি বেয়ে দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে উঠলাম।

মেঝেতে একটি লাশ। সাদা কাপড়ে ঢাকা। একজন ডাক্তার লাশের বুক বরাবর হাত বেধে দাড়িয়ে। ডোম অপারেশনের যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রস্তুত। কাটার, সুই, সুতা, প্যাকেট।

আমি তাদের পেছন দিকে বলে আমাকে কেউ দেখতে পায়নি। বুঝলাম, এখনই একটি লাশের পোস্ট মর্টেম করা হবে। লাশটির ওপর থেকে সাদা কাপড়টি সরিয়ে ফেলা হলো। একজন কিশোরীর লাশ। আজকের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে-ধর্ষণের পর মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।

তার মৃত্যুর কারণ এবং ধর্ষণের আলামত দুটোই সংরক্ষণ করতে হবে। ফলে তার পূর্ণ দেহ উন্মুক্ত করায় এ মুহুর্তে একটি কিশোরী মেয়ের দেহ আমার সামনে। কয়েকদিন আগেও আমি নারীদেহ দেখেছিলাম। আমার বান্ধবী সান্তনার। আমার সহপাঠি।

তাকে নিয়ে আরেক সহপাঠি স্বর্ণার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। স্বর্ণা একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। আমরা বন্ধুরা মাঝে মাঝে হল থেকে দল বেধেঁ ওর বাসায় বেড়াতে যেতাম। ওই দিন বিকালে আমরা বাইরে বেড়াতে যাবো। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি।

শুধু সান্তনা দেরী করছে। আমার উপর দায়িত্ব পড়লো তাকে তাড়া করার। আমি ঘরে ঢুকে তো স্থির। কাপড় পড়ার জন্য কাপড় খুলে ফেলেছে সে। পুরোপুরি নগ্ন।

মাটি ফুড়ে ওঠা পাহাড়ের মতো বুকজোড়া উন্মুক্ত স্তন। আমার পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কি এমন আকর্ষণ। আমাকে দেখে সান্তনা বললো, দেখতো আমার এ দুটো ঝুলে পড়লো কিনা? আমি বললাম, না ধরে বুঝবো কিভাবে? সান্তনা বললো, মার খাবি, শয়তান। চোখ দিয়ে দেখবি।

একটু অপেক্ষা কর। আমার ব্রার হুক দুটো লাগিয়ে দিতে হবে। আমার চোখ দুটো তখন রক্তবর্ণ। হাত-পা কাপছেঁ। আমার ভেতর থেকে সাড়া আসছে।

নিশ্বাস ঘন হয়ে গেছে। দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে বিসুভিয়াসের মতো সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিতে ইচ্ছা করছে সবকিছু। কে যেন বলছে, সামনের শরীরের ভাজেই তোমার জীবনের আবিস্কার। আমি সান্তনাকে কিছু বলতে পারিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সান্তনা কাপড় পড়তে পড়তে অভিজ্ঞের মতো বলেছিলো, পুরুষদের আসলে একটি নারীদেহ দরকার।

এটা ছাড়া তোরা আর কিছুই বুঝিসনা। অথচ এই শরীরের মধ্যে যে একটি প্রাণ আছে; নারীদেহ দেখলে তোরা সেটাই ভুলে যাস। আমি তখন জবাব দিতে পারিনি। আজ আমার চোখের সামনে একটি কিশোরী নারীদেহ। অথচ কতটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছি, আমার সামনে যে দেহটি রয়েছে সেটি একজন মেয়ের।

তার স্তন সান্তনার চেয়েও সুডৌল। মাখনো ময়দা ঝাঝালো গরম তেলে ছেড়ে দেয়ার পর ফুলে ওঠা নতুন পিঠার মতো। মোমের মতো শরীর এক অজানা রহস্যের ভেদ উন্মোচন করছে। নাভীর একটু নিচ থেকে কেশ আচ্ছাদিত যৌনাঙ্গ। আজ এই মুহুর্তে সান্তনাকে বলতে ইচ্ছা করছে, সামনের এই দেহটি আমার ভেতরে কোন অনুভুতি সঞ্চার করতে পারেনি।

এ কারণে তোর শরীর দেখে গড়ে ওঠা অনুভূতি আসলে দেহের প্রতি ছিলনা। ছিল আত্মার প্রতি। তোর প্রাণের প্রতি। ডাক্তার ঝুকে পড়ে যৌনাঙ্গ যন্ত্রপাতি দিয়ে খুড়ে খুড়ে ধর্ষণের আলামত নিলেন। এবার অপারেশনের ব্লেড হাতে নিলেন ডোম।

বাম স্তনের নিচ দিয়ে একটি পোচ দিয়ে ডান স্তনের নিচ পর্যন্ত টেনে নিলেন। পরে বুকের খাচার হাড় যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো ব্লেড। সোজা টেনে নেয়া হলো নাভি পর্যন্ত। দেহটা হা করে ভেতরের লাল অংগ প্রত্যংগ দেখিয়ে দিল অনায়াসে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে শব্দ করে উঠতেই ডাক্তার আমাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, আপনি কে? আমি বললাম, আমি সাংবাদিক।

-আপনার এ স্থানে আসা ঠিক হয়নি। পরবর্তীতে মানসিক সমস্যা হতে পারে। - বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে রিপোর্ট করতে এসেছি। এ স্থানে না এসে উপায় কি? সবগুলো বেওয়ারিশ লাশগুলো কি পোস্টমর্টেম করা হয়? -বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করা হয়। কোন আঘাতে মৃত্যু হয়েছে কিনা- তা উল্লেখ করে রিপোর্ট দিতে হয়।

পরে পুলিশ এর উপর ভিত্তি করে ইউডি মামলা করে তদন্ত শুরু করে। ডোম সেকান্দার ততক্ষণে তার কাজ শেষ করে সুই সুতো দিয়ে কাটা শরীর কাথা সেলাই করার মতো করে জোড়া দিচ্ছে। কিছু অংগ প্রত্যংগ বাইরে একটি পলিব্যাগে নেয়া হয়েছে। এগুলো ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হবে। কাজ শেষ করে সেকান্দার আমাকে সাথে নিয়ে মুল ভবনের দিকে ঢুকলেন।

আমাকে দাড় করিয়ে রেখে ভেতরের দিকে নিজের কক্ষে গেলেন। একা দাড়িয়ে থাকতে একটু ভয় পেলাম। তার সঙ্গে আমি যেতে চাইলাম। আমাকে নিতে রাজি হলেন না। আমার মনে সন্দেহ।

তার মানে কি ভেতরে আরো লাশ। কঙ্কাল তৈরী হচ্ছে নাকি? ভাবনা মেঘ হয়ে বৃষ্টি হওয়ার আগেই ডোম সেকান্দার হাজির। আমাকে নিয়ে গেলেন লাশ রাখা হিমঘরে। একটি মৃত্যুশীতল শব্দে ফ্রিজটি চালু রয়েছে। বললাম, আমাকে লাশগুলো দেখতে হবে।

বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন লাশ। রিপোর্টটাকে সুখপাঠ্য তথ্যবহুল করতে হবে। বিশাল ফ্রিজের একেকটি ড্রয়ার টেনে সেকান্দার বললেন, বেশিরভাগ লাশই এখন রেল লাইনের পাশে পাওয়া যাচ্ছে। লাশগুলো দেখে দেখে বর্ণণাগুলো নোটে তুলে নিলাম। আমার নোটবই ফুলে ফেঁপে এখন গর্ভবতী।

একটি চৌকস রিপোর্ট প্রসব করার জন্য যথেষ্ট। ভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিত। সৃষ্টি সুখের উল্লাস আমার ভেতরে। এ রিপোর্টটি প্রকাশ হলে দেশব্যাপী সাড়া পড়ে যাবে। কপালে একটি পুরুস্কারও জুটে যেতে পারে।

কিন্তু মনে অতৃপ্তি টের পাচ্ছি। কে যেন বহুদূর থেকে আমাকে সাংবাদিক বলে ডাকছে। স্থানটি ত্যাগ করতে চাইলাম। কি যেন মনে করে ফিরে আসার আগে আমি একটি ড্রয়ার টেনে বের করলাম। ভেতরের লাশটি চিৎ করে শোয়ানো।

চোখ খোলা। আমাকে দেখছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে। স্তম্ভিত। বিস্মিত।

রিপোর্টের বেলায় অনেক বিষয় নিজের চোখে দেখেও তা লেখা যায়না। রেল লাইনে দাড়িয়ে অপর প্রান্ত সরু হয়ে মিলে গেছে দেখা গেলেও তা লেখা যায়না। কারণ বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, রেল লাইন সবখানেই সমান। চোখে যা দেখছি তা সত্য নয়। কিন্তু আজকের এ লাশ দেখে আমি কি ব্যাখ্যা দেবো? এ ব্যক্তিটি গত রাতে ভৈরবের ব্রীজে ওঠার আগে ট্রেনের দড়জা থেকে আমাকে হাত ধরে টেনে ভেতরে তুলে দিয়েছিলেন।

ইনি তো আমার জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছেন। মানুষের জীবন কেউ বাঁচিয়ে দিলে অমানুষ না হলে তাকে কেউ ভুলেনা। লাশটিকে বারো করে দেখলাম। হ্যাঁ, সেই খোচা খোচা দাড়ি। বোঝা যাচ্ছে গত দু মাসেও তাতে খুরের পোচ পড়েনি।

উস্ক খুষ্ক চুল। রক্তশুণ্য চেহারা। নাকটা থাবরানো। কপালে একটি কাটা দাগ। গায়ে কটকটে একটি হলুদ জামা।

পরনে প্যান্ট। তার রং বুঝা যাচ্ছেনা। অনেকের চেহারা এমন যে, একবার দেখলে পরবর্তীতে দেখা হলে আগে কোথায় দেখা হয়েছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই লোকটির চেহারাটিও কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়াই তেমনি। অস্বাভাবিক স্বরে আমি সেকান্দারকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই লাশ কবে-কোথায় পেয়েছেন? সেকান্দার জবাব দিল, প্রায় দুমাস আগে একদিন সকালে পুলিশ এ লাশটিকে এনে রেখে গেছেন।

তারা বলেছেন, লাশটি ভৈরব এলাকায় রেল লাইনের পাশে পাওয়া গেছে। প্রতিদিন অনেকেই এখানে আসেন তাদের স্বজনদের খোঁজে। কিন্তু এর খোঁজে কেউ আসেননি। আজকেই এ লাশটিকে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের হাতে তুলে দেয়া হবে। এটা বেওয়ারিশ লাশ।

৫০৮, সূর্যসেন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।