আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবন্ধ : ৭ । রাম বসুর 'তোমাকে' কাব্যগ্রন্থের মার্কসবাদী পর্যবেক্ষণ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

বাংলা কবিতার ধারায় রাম বসু (জ.১৯২৫) আনবিক যুগের শক্তিমান প্রগতিবাদী কবিপ্রতিভা। তাঁর কাব্যমানস জুড়ে রয়েছে নিরীক্ষা প্রবণতা-- ফলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর একক হাতে আণবিক যুগের সাহিত্য মাধ্যম কাব্যনাট্যে বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর কাব্যনাটক রচনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর কাব্যমননে একই সাথে একজন শক্তিমান কবি ও নাট্যব্যক্তিত্বের দ্বৈতাবস্থান বিদ্যমান। আর এজন্যই অবলীলায় তাঁর রচিত প্রায় সকল কবিতায় নাট্যগুণের সমন্বয় লক্ষ করা যায়; যা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক ভিন্নতর কাব্যরস ও কাব্যধারার সৃষ্টি করেছে। অতএব একথা বলার অবকাশ রাখে না যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রাম বসু কাব্যনাট্যকার হিসেবে ইতোমধ্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন।

কাব্যনাট্য মাধ্যমেই সম্ভবত তিনি স্বীয় অন্তর্লোকের ভাব প্রকাশে অধিকতর স্বাচ্ছ্বন্দ্যবোধ করেন। তারপরও তাঁর রচনাবলীর দিকে তাকালে দেখা যাবে, তিনি বিস্তর কবিতাও রচনা করেছেন। কবিতায় তাঁর অর্জন বা ব্যর্থতা কতটুকু তা ভাবীকালের পাঠক বিচার করবেন। তবে ইতোমধ্যেই তিনি বাংলা সাহিত্যে কাব্যনাট্যকার হিসেবে স্থায়ী মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে সক্ষম হয়েছেন। আধুনিক কালের বাংলা কাব্যনাট্য ঘরাণায় একক এবং অদ্বিতীয় ব্যক্তি একথা বলা হলেও বোধহয় অত্যুক্তি হয় না।

রাম বসু কাব্যনাট্যকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সুবিদিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রচনাবলীর দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই-- তিনি বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন তোমাকে শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ রচনার মাধ্যমে। তোমাকে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত রাম বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থটির নাম নিয়ে খানিকটা বিভ্রাট রয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত রাম বসুর 'কবিতা সমগ্রের কাছাকাছি'তে উল্লেখ করা হয়েছে-- গ্রন্থটির নাম ছিল সম্ভবত 'তোমাকে ও অন্যান্য কবিতা'; অথচ এর প্রচ্ছদ ও প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যাবলি যেখানে ছিল, সেখানে শুধুমাত্র 'তোমাকে' নামটি পাওয়া গেছে। তবে 'কবিতা সমগ্রের কাছাকাছি'-এর প্রকাশক রোহীন্দ্র চক্রবর্তী প্রথম কাব্যগ্রন্থটি এ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার পূর্বে কবি রাম বসুর সঙ্গে আলোচনা করেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম তোমাকে হিসেবেই নির্দেশ করেছেন।

বর্তমান সংকলনের প্রকাশক আরো জানিয়েছেন রাম বসুর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির গ্রন্থস্বত্ব বিষয়ক কোনো তথ্যের উল্লেখ ছিল না। 'তোমাকে'-এর প্রথম প্রকশনার তৃতীয় পৃষ্ঠায় একটি ইংরেজি উদ্ধৃতি ছিল বলেও বর্তমান সংকলনের প্রকাশ রোহীন্দ্র চক্রবর্তী জানিয়েছেন। রাম বসুর 'কবিতা সমগ্রের কাছাকাছি'-এর সংকলক আরো জানিয়েছেন, প্রথম প্রকাশিত তোমাকে কাব্যগ্রন্থের ইংরোজি উদ্ধৃতিটি কবি সম্ভবত ফেদেরিকা গার্সিয়া লোরকার রচনা থেকে নিয়েছিলেন। প্রথম প্রকাশিত তোমাকে কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কবিতার শিরোনামগুলো : ‘তোমাকে’, ‘মে মাসের গান’, ‘উত্তর মেঘ’, ‘ভাষণ’, ‘একটা সভা’, ‘এক বুক শস্যের ভিতর’, ‘প্রহরী’, ‘কি খবর’, ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’, ‘বসন্তের গান’, ‘চৌমাথার কথা’, ‘তবু যদি মনে হয়’, ‘অলস দিনের কাব্য’, ‘নবান্ন’, ‘প্রার্থনা এবং চিতা’। অর্থাৎ এগ্রন্থে সর্বমোট ষোলটি কবিতার স্থান সংকুলান হয়েছিল।

রাম বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ তোমাকে-এর প্রকাশনা বিষয়ক তথ্য এখানে বর্তমান পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হলো : প্রথম প্রকাশ : ১৩৫৭; প্রকাশক : শ্রী রোহীন্দ্র চক্রবর্তী, ‘ডাক’ প্রকাশনী, ১ বি রামকৃষ্ণ লেন, কলকাতা ৬; মুদ্রক : ইউনিটি প্রেস, ১১৫ আমহার্স্ট স্ট্রিট, কলকাতা-৯; মূল্য : ১ টাকা; প্রচ্ছদ : শ্রী জগন্নাথ মৌলিক; পৃষ্ঠা : ৪+৪৪= ৪৮। কবি রাম বসু তোমাকে কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে কিছুই লেখেন নি; তাঁর বিনম্র কণ্ঠে প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যের স্থানে অল্প-কথায় ভূমিকার কাজটি সেরেছেন। এই ভূমিকায় তিনি বিনম্র উচ্চারণে জানিয়েছেন : ‘মে মাসের গান’ ছাড়া অন্য সব কবিতাই ১৯৪৯-৫০ সালে লেখা। ‘মে মাসের গান’ লেখা হয় তার আগের বছর। কবিতাগুলি ‘অগ্রণী’, ‘ডাক’ প্রভৃতি প্রগতিশীল মাসিক কাগজে বেরিয়েছিল।

পুনমুর্দ্রণের অনুমতির জন্য সেই সব কাগজের প্রকাশক এবং সম্পাদকদের ধন্যবাদ জানাই। সবশেষে যাদের সহায়তা না পেলে এ বই প্রকাশ করা সম্ভব হোত না তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। তার মধ্যে আছে বন্ধু শ্রী অমল ঘোষ এবং আমার অন্যান্য অনেক সাহিত্যিক ও শিল্পী বন্ধুরা। রাম বসু 'তোমাকে' কাব্যগ্রন্থের নাম শীর্ষক কবিতাটির সূচনায় লোরকার কবিতা থেকে একটি চরণ উদ্ধৃত করেছেন। কবি লোরকার সেই চরণটি হলো : 'Green, how much I want you Green.'৫ এটির অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি না; উদ্ধৃত এই চরণটি দ্বারা কবি চিরসবুজ ও নবীনতার অবারিত উদ্বোধন কামনা করেছেন।

অতএব আমরা বলতে পারি, রাম বসু যাকে উদ্দেশ্য করে তোমাকে রচনা করেছেন, সে কবির দিগন্তপ্রসারিত অনন্ত প্রত্যাশার মতো চিরসবুজ এবং নবীন। কবিতাটি দু’টো ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের শেষের পাঁচ লাইন হচ্ছে নিম্নরূপ : আমার চেতনায় আমার সর্বাঙ্গে তোমার দৃষ্টির আশ্চর্য বিস্তার। পাঁচটা তার একসঙ্গে ঝংকার দিয়ে ছিঁড়ে গেল আমি ভালোবাসি। কবিতার এই স্তবক থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হচ্ছে-- 'তোমাকে' এ কাব্যগ্রন্থে রাম বসু তাঁর যৌবনের আবেগঘন প্রেমের বহিঃপ্রকাশেও অন্তর্গত রহস্য ও বিষয়াদি উঠে এসেছে।

তোমাকে কাব্যে শাশ্বত বিষয় হিসেবে প্রেম উপস্থাপিত হলেও এখানে প্রাধান্য লাভ করেছে আণবিক যুগে বসবাসরত সমাজ জীবন ও ব্যক্তি জীবনের মানসিক সংঘাত সংকট আর বিপন্নতা। কবিতাটির দ্বিতীয়ভাগ থেকে কয়েকটি চরণের উদ্ধৃতি নিলে বিষয়টি আমাদের নিকট আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন কবি বলেন, ‘ইট কাঠ ইস্পাতের স্তূপে/ আলোর পাড়ে সাকোঁর ঝোপে/ অন্বেষণ-ক্ষুব্ধ ভাঙা গড়ার অভিযানে/ তীক্ষ্ণ অভীপ্সায় সমুদ্যত গারদ ভাঙার সঙ্গিন সময়ে/ পৃথিবীর আদিম শক্তির মতো তুমি আছ/ আমাকে দুর্গের মতো দৃঢ় করে রাখে। ’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ব্যক্তি মানুষের, বিশেষত অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তির চেতনালোক ভেঙে চুরমার করে দিয়ে ভবিষ্যতের মানবজীবন এক ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জনের বার্তা বয়ে এনেছিল। ‘তোমাকে’ কবিতায় তার-ই প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

তারপরও কবি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে তাঁর প্রেয়সীর কথা ভেবেছেন। আর কবির প্রিয়তমাও যেন জীবনানন্দ দাশের ‘নাটোরের বনলতা সেন’-এর মতো হাল-ভাঙা ক্লান্ত কিংবা বিধ্বস্ত নাবিককের মতোই শান্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল। রাম বসুর প্রিয়তমাও জীবনানন্দের বনলতা সেনের মতো করে তাঁকে শান্তির আশ্রয় দেয় এবং তাঁকে রক্ষা করবার জন্য তাঁর চারপাশে দুর্ভেদ্য এক দেয়াল তুলে দিয়ে যন্ত্রণাময় প্রতিবেশ পৃথিবীর হাত থেকে কবিকে রক্ষা করেছে। রাম বসু তোমাকে কাব্যগ্রন্থের ‘মে মাসের গান’ কবিতাটি ১৯৪৮ সালে রচনা করেছিলেন। রাম বসুর সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর কাব্যাদর্শে মার্কসীয় দর্শনচেতনার এক বাস্তবানুগ শৈল্পিক সমন্বয় ঘটেছে।

তিনি শুধু সাহিত্যকর্মে নয় ব্যক্তিগত জীবনেও মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন; ‘মে মাসের গান’ কবিতাটি তার স্পষ্ট প্রমাণ। এ কবিতায় তাঁর অন্তর্লোকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা ক্রিয়াশীল ছিল, তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয় : আগুনের ফুলে হোলি খেলা শুরু মে মাসে এসো না আমরা পাহাড়ের মতো দাঁড়াই দানো ডাকা রাতে আমাদের পথে কে আসে সজাগ প্রহরী সবল মুষ্টি বাড়াই আলোক কুন্দে করপুট ভরে নিলাম এ মাটিতে প্রাণ সোমরস ঢেলে দিলাম কবি রাম বসু প্রথম যৌবনে মার্কসবাদী পার্টির সক্রিয়কর্মী হিসেবে জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এর ফলে তাঁর কবিতায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্বন্ধে প্রবল আশাবাদী আকাক্সক্ষা লক্ষ্য করা যায়। একটি মার্কসবাদী পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে তাঁর সেই ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা কাব্যে অবশ্যম্ভাবীরূপে স্থান করে নিয়েছে। এজন্য তিনি কবিতায় সমাজ জীবনের যে প্রতিবেদন ও প্রতিচিত্র নির্মাণ করেছেন সেখানে মার্কসীয় দর্শনের এর প্রভাব পড়েছে।

বলাবাহুল্য তাঁর এই প্রগতিবাদী মার্কসীয় কাব্যমানস আশির্ধ্বো বয়সেও অম্লান। তাই তিনি আজো লেখেন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায়-প্রত্যাশায়। তাঁর এই দীর্ঘ জীবনের সাহিত্যচর্চায় কাব্যমানসের বাঁক পরিবর্তিত হয়েছে। একজন বড় কবির ক্ষেত্রে এই আদর্শিক বা দার্শনিক পরিবর্তন খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। রাম বসু বাংলা কাব্যাঙ্গনে মার্কসীয় দর্শনে দীক্ষিত হয়ে প্রবেশ করেছিলেন; সমাজ পরিবর্তনের প্রত্যাশায় স্বপ্নাতুর চোখে রঙিন চশ্মা এঁটে।

অদ্যাবধি তিনি নিজেকে একজন মার্কসবাদী কবি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। রাম বসু চিন্তাচেতনায় মার্কসবাদী হলেও স্বীয় প্রতিভার প্রদীপ্ত শিখায় প্রতিনিয়ত নিজেকে সময়ের পালাবদলে বদলে নিয়েছেন এবং বিশুদ্ধবাদিতার চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছেন। ফলে পরিণত বয়সে তাঁর কবিতা বিশুদ্ধ কাব্যচেতনায় উদ্ভাসন ঘটেছে। রাম বসুর যৌবনে রচিত তোমাকে কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলিতে মার্কসীয় সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বস্তুজগতকে রোমান্টিক বিপ্লববাদীর এক স্বপ্নিল চোখে দেখেছিলেন। প্রথম যৌবনের বিপ্লবীচেতনায় আবেগাক্রান্ত হয়ে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমাকে'র কবিতাবলিতে তিনি অনেকটা সরাসরিভাবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন।

কবি নিজেও মনে করেন, প্রথম কাব্যগ্রন্থে তিনি অনেকটা ‘চিৎকার’ করেই তিনি প্রথানত প্রচল সমাজ ব্যবস্থার প্রত্যাশিত পরিবর্তন কামনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো আদৌ প্রশংসিত কবি নই। বরং চিৎকারের জন্যে ধিক্কৃত। আমি অবশ্য গর্বিত। অমাবশ্যার রাতে বন্যায় ভাসা মহিষের ডাক শুনেছেন? জ্বলন্ত গোয়ালের গরুর চিৎকার? তারা তখন কোকিল কণ্ঠে ডাকে না।

তাদের ডাক আদিম, জান্তব। এই হল সেন্স অব ইমিডিয়েসি, সেন্স অব আর্জেন্সি। যখন দেখি জীবন ধর্ষিত, ধারাবাহিকতা ছিন্ন, উত্তরাধিকার লাঞ্ছিত আর অগ্নিবর্ণ কাল উপস্থিত তখন আমি চিৎকার করেছি, করবো। তাতে যদি মার্জিত কানে রক্তক্ষরণ হয়, আমি নাচার। ’ সম্ভবত ‘ভাষণ’ কবিতায় এজন্যই রাম বসু তাঁর কাব্যস্বর বেশ খানিকটা উচ্চগ্রামে তুলে ঘোষণা করেন : রবীন্দ্রনাথ, আমার ছুরিকাহত স্বপ্ন আমার সামনে অসহায় লুটিয়ে পড়েছে নির্বাক মিনতির চোখ মেলে ধরেছে ধান খেতের ধারে আষাঢ়ের আকাশের মতো।

রাম বসু তাঁর সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে ‘ভাষণ’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতায় আনবিক সমাজ-জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, দেখেছেন আর উপলব্ধি করেছেন-- তাঁর প্রত্যাশিত সাম্যবাদপুষ্ট পৃথিবী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত এবং সে ব্যধি ক্রমবর্ধিষ্ণু। দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর সময়ে ব্যক্তি জীবন ক্রমাগত এক নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণায় বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুঁজিবাদের এই উত্থান পর্বে ব্যক্তি মানুষ ও অনুভূতিপ্রবণ কবিমানস তীব্র যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করতে থাকে। রাম বসু তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে যৌবনের আবেগ দিয়ে মানব সমাজের তথা ব্যক্তি মানুষের যন্ত্রণাময় এই বিপন্ন ও সংকটময় বিপর্যস্ত পরিস্থিতির উত্তরণ কামনা করেছেন। আর তাই তোমাকে কাব্যগ্রন্থে কবি যৌবনের তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে তিনি ঘোষাণা করেন : এখনো যারা সংশয়াচ্ছন্ন তার ছিঁড়ে যাক আমি চিৎকার করি শত্রুর গুলির চেয়েও অব্যর্থ এখনো যারা নিরপেক্ষ তারা মরে যাক। সুতরাং একথা স্পষ্ট যে কবি রাম বসু এক বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে (মার্কসীয়) বিশ্বাসী এবং গভীরভাবে আস্থাশীল।

তিনি নিজেকে তথাকথিত নিরপেক্ষ কবি হিসেবে মনে করেন না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন রাম বসু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসবোধ গোপন করেন নি; বরং তাঁর কবিতায় এবং অন্যান্য রচনায় স্পষ্টভাবে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর আদর্শিক ভাবনা প্রসূত কবিতা যদি সাহিত্যের আলংকারিক মানদণ্ডে নিম্নমানের বলেও বিবেচিত হয় সেক্ষেত্রে তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই কবি হিসেবে স্বীকৃতির জন্য। ‘ভাষণ’ কবিতার শেষ স্তবকে এজন্যই তিনি আরো স্পষ্ট করে জানিয়েছেন : রবীন্দ্রনাথ, আমরা তীব্র ঘৃণায় পবিত্র হয়েছি আমরা তীক্ষ্ণ হিংসায় আগ্নেয় গিরি আমাদের ভালোবাসায় উজ্জ্বল পৃথিবী। কবি রাম বসু হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

প্রসঙ্গত রাম বসুর অনুজ কবি অনন্ত দাশ তোমাকে কাব্যের উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তার কবিতায় আমি স্পর্শ করলাম সমাজবাদী কবিতার আর এক দিগন্তকে যা সমর সেনের মত স্পষ্ট ও সোচ্চার নয়, কিংবা মনীন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তি চৈতন্যের মধ্য দিয়ে সমাজ মুক্তির সংকল্প নয়; এ যেন আরও গভীর গূঢ় মনোৎসারিত মানুষের সেই আদিম চেতনায় যার সঙ্গে প্রকৃতির নিয়ত দ্বন্দ্বে আধিপত্য পাচ্ছে সমাজের ক্রমমুক্তির কথা। ’ এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রাম বসুর 'তোমাকে' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর কবি পূর্ণেন্দু পত্রীও গ্রন্থটির যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন। বারো বছর সেই অসহায় তরুণ আজ অন্ধকার কবাট ভেঙ্গে ফেলেছে কুন্দ ফুলের মতো ভোর বেলার আলো যুগান্তরের অন্ধকারকে ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি সেই দুঃসাহসী যুবক মিছিলের মাথায় এগিয়ে যাই। কবিতার এই শেষ স্তবকে কবি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে তথা যুবসমাজকে ‘দুঃসাহসী’ হয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছেন।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘স্বাধিকার’ অর্জনের যে স্বপ্ন কবি দেখেছিলেন তা সাতচল্লিশের দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে এলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে কবির প্রত্যাশিত সাম্যবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র্র ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটে নি। কবি অনন্ত দাশ আরো বলেন, ‘[...] বাংলা কবিতায় মার্কসবাদের এত স্পষ্ট এবং শিল্পিত প্রয়োগ তার আগে কেউ করেন নি। ’ অনন্ত দাশের এই মন্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত হওয়া না গেলেও একথা সত্য যে, রাম বসুর কবিতায় মার্কসীয় চিন্তাচেতনার আবেগকম্পিত প্রকাশ থাকলেও তা শিল্পমণ্ডিত সৌকর্যে হীরকদ্যুতি ছড়ায়। রাম বসুসহ সমকালের অন্যান্য কবিসাহিত্যিকগণ প্রতিবেশ পৃথিবীতে মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। তাঁর অব্যবহিত পূর্বকালের বাংলা কবিতায় অরুণ মিত্র (১৯০৯-), দীনেশ দাশ (১৯১৫-'৮৬), সমর সেন (১৯১৬-’৮৭), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-), মনীন্দ্র রায় (১৯১৯-), মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৯২০-) প্রমুখ কবিসাহিত্যিক মার্কসীয় সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কবিতায় তেজোদ্দীপ্ত প্রতিভাষ্য নির্মাণ করেছিলেন।

শিল্পে সাহিত্যে সমাজের মানুষকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মার্কসবাদের তাত্ত্বিকচর্চা কিংবা গগণবিদারী আওয়াজ তুলে কোন লাভ হয় না। কেননা সমাজের মানুষকে বাদ দিয়ে মার্কসবাদের চর্চা একাধারে বৈজ্ঞানিক এবং মার্কসবাদের পরিপন্থী। রাম বসুর সংকলনের প্রকাশক সৌমিত্র লাহিড়ী ‘রামদার কবিতা সমগ্রের কাছাকাছি’ শীর্ষক দীর্ঘ ভূমিকায় তাঁর প্রথম কাব্য 'তোমাকে'-এর করেছেন এভাবে-- রাম বসু ‘তোমাকে’ কাব্য সংকলনে ছিলেন ‘প্রবল প্রেমিক এবং পরাক্রান্ত যোদ্ধা’। পরবর্তী সময়ে নিজের কাব্যাদর্শ এবং মতাদর্শ দর্শন চর্চার মধ্যবর্তিতায় আরও দৃঢ় করে তুলেছিলেন কবি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই সাম্যবাদী আন্দোলনে যে মতাদর্শগত সংগ্রাম প্রবল ছায়াপাত ঘটিয়েছিল; রাম বসুর অনেক কবিতাতেই তা লক্ষ্য করা যায়।

কবি রাম বসু যখন কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন সে সময় মার্কসবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে তাত্ত্বিক মতাদর্শগত সংঘাতে দলের ভাঙন চলছিল। এই ভাঙনের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছিল; মার্কসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কবি রাম বসু এবং তাঁর সমকালের অন্যান্য কবিদের ওপর। রাম বসুর অন্তর্মানসে সমকালীন বাস্তবতার প্রভাবে দর্শনগত ভাঙচুর ঘটেছিল তা নিশ্চিত। তারপরও তিনি কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আণবিক যুগের বিপন্নতা সংকটময়তা কিংবা জটিলতা প্রগতিশীল অভিজ্ঞানের আলোকে এক নবতর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রদীপ্ত প্রত্যাশার প্রদীপ বাংলা কবিতায় জ্বালিয়েছেন। অন্যদিকে ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে কাব্যনাট্যচর্চার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল কবি রাম বসু সে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

সাধারণত কোন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ অপরিণত, অপরিপক্ক এবং কাঁচা হাতের রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা কোন কোন কবির ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর প্রথম রচনাটিই ‘মাস্টার পিস’ বা প্রধানতম রচনা হিসেবে সাহিত্যের ইতিহাসে এবং মহাকালের গর্ভে স্থান করে নেয়। অথবা ঐ লেখকের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি স্বরূপ কাজ করে। সাহিত্য সমালোচনার এই সূত্র কোনো সাহিত্যিকের সামগ্রিক রচনাকর্মের মূল্যায়নের সুনির্দিষ্ট কোন সূচক বা একমাত্র পরিমাপক নয়। রাম বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে নি তবে তাঁর সৃজনপ্রতিভার উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং কাব্যপ্রতিভার প্রদীপ্ত শিখায় কবি হিসেবে তিবি ক্রমাগত সমৃদ্ধি অর্জন করেছেন।

রাম বসু 'তোমাকে' কাব্যগ্রন্থের অপরিণত এবং বিপ্লববাদী রোমান্টিক কাব্যঘরাণার গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিনিয়ত স্বীয় সৃজনপ্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন ‘প্রকৃত কবি’ হয়ে ওঠার পথে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। রাম বসু 'তোমাকে' কাব্যের বিপ্লববাদী রোমান্টিক কাব্যঘরাণার সীমানা পেরিয়ে পরবর্তীতে আণবিক যুগের দার্শনিক অভিজ্ঞানের আলোকে আর্থ-সামাজিক জীবন ব্যবস্থাকে আত্মস্থ করেছেন এবং শুদ্ধতর কাব্যঘরাণায় প্রবেশ করেছেন। তবে রাম বসু তাঁর এই কাব্যজীবনে তিনি জগজ্জীবন এবং সমাজের মানুষকে বাদ দিয়ে কখনো কাব্যচর্চা করেন নি। তাঁর কবিতায় মার্কসীয় দর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাব থাকা সত্ত্বেও কলাকৈবল্যবাদী আলংকারিক বিচারে তাঁর সব রচনাই শিল্পোত্তীর্ণ। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখা যায় প্রকৃত দীক্ষায় নিজেকে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই তাঁর কবিতায় সমাজ, মানুষ এবং তাদের সংগ্রাম, সমকালীন প্রতিবেশ পৃথিবীর বিক্ষুব্ধতা সর্বোপরি ব্যক্তি মানুষের অন্তর্লোকের রহস্যভেদে নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন।

রাম বসুর এই কাব্যমানসের পরিচয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমাকে'-এর অনেক চরণ বা পংক্তিতে পাওয়া সম্ভব। পরিণত বয়সে রাম বসুর রচনায় যেভাবে মানব জীবনের অন্তর্গত অনুভূতি রহস্যানুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ করা যায়, তার যাত্রা শুরু হয়েছিল 'তোমাকে' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে আজীবন আধুনিক যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের অন্তর্গত রহস্যকে ভেদ করার চেষ্টা করেছেন। রাম বসুর কবিতায় মানব জীবনের অন্তর্গূঢ় রহস্যানুসন্ধানের প্রাথমিক প্রয়াস পাওয়া যায় তা তোমাকে কাব্যগ্রন্থ থেকে এ বিষয়ক দু’একটি উদাহরণ গ্রহণ করা হলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন : ক. একি হতে পারে আমি আর কোনোদিন ধানের শীষ ছুঁয়ে যাব না কাস্তেকে বাঁকিয়ে ধরে প্রতিবেশীকে ডাকব না একি হতে পারে আমি আর কোনদিন গান গাইব না? খ. তবু যদি মনে হয় এ জীবন বন্দীশালা ধূসর ধূলায় ধানের সোনালি শিষ আকাশ জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় মনে অনেক কথা বলে নাকো, চেনা নদী হঠাৎ শুকায় অনুভব হিম ম্লান, সব স্মৃতি পরদেশী অরণ্যে ঘুমায়; বকুল বনের ঘ্রাণ অর্থহীন, ভাঙ্গাচোরা কবিতার সুর ফড়িং-এর দেখা নেই, মৃত্যুর অসহ্য গন্ধে বিবর্ণ সময় মনে মনে সেতু নেই, নীরবতা ভিত গাঁথে আরো কত দূর অন্ধকারে পাখি সব ভয়ে ভয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কথা কয় তখন একটা সুর মনে এনো-- এ জীবন দুরন্ত বিস্ময় 'তোমাকে' কাব্যগ্রন্থ থেকে রাম বসুর এই অন্তর্ভেদী কাব্যদৃষ্টির অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া সম্ভব।

তারপরও একথা সত্য যে, তাঁর এই অন্তর্ভেদী কাব্যচেতনার বিকাশ পরিণত বয়সের সৃজনকর্মে ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। সম্ভবত তাঁর এই অন্তর্ভেদী রহস্যানুসন্ধানের অভীপ্সা থেকেই তিনি কবিতায় নবতর আঙ্গিক আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। মানব অন্তরের রহস্য উদ্ঘাটন করতে তিনি যে কাব্যাঙ্গিক ব্যবহার করেন-- তা কাব্যনাট্যের। কাব্যনাট্য রচনার পশ্চাতে মূলত ক্রিয়াশীল ব্যক্তির অন্তর্লোকের রহস্যময়তা মঞ্চে দৃশ্যময় করে তোলা। কবি হিসেবে তিনি মানব অন্তরের রহস্যকে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন তা একমাত্র কাব্যনাট্যাঙ্গিকেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

ফলে রাম বসু কবিতা রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করলেও কাব্যনাট্যকার হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মার্কসীয় সমালোচনার দৃষ্টিতে বলা হয় কোনো কবির ভেতর বহুস্বরের সমাগম না ঘটলে তিনি মানব জীবনের অনন্ত রহস্যকে ভেদ করতে পারেন না। আর রাম বসুর কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানব জীবনের অন্তর্গত রহস্যময়তাকে চিত্রিত করা। ফলে অবচেতনেই তিনি তাঁর রচনায় ‘বহুস্বর’-এর সমাবেশ ঘটিয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমাকে'-এর কবিতাবলিতে স্পষ্টভাবে মার্কসবাদী প্রভাবে বহুস্বরের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়।

এ গ্রন্থে যে তাঁর বহুস্বরের মার্কসীয় দর্শনগত বহুস্বরের প্রভাব অনেক কবিতায়-ই রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এখানে একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে : আমরা প্রতিরোধ গড়েছি আমরা প্রতিবাদ এনেছি গারদের গরাদে মর্গের দরজয় দাঁতে হাতুড়িকে চেপে ধরে যখন অজ্ঞান মেয়েকে সরিয়ে নিলাম টোপান রক্ত আমার হাতের পাতায় পাতায়; তখন যুগান্তরের পাথর খোদাই করা আমি পৃথিবীর ভালোবাসার সম্পদ নিয়ে স্পর্ধার মতো বাইরে এলাম; এত আলো। এত আলোয় বাঁচতে চাই পৃথিবীকে ভালোবাসি ভালোবাসি এই অন্ধ গায়কের মতো মুগ্ধ দিনগুলোকে। উদ্ধৃত স্তবকে কবির অন্তর্গত অভিজ্ঞান নিঃসন্দেহে সামষ্টিক চেতনার দ্যোতক। তিনি এ কবিতায় সর্বনামের ক্ষেত্রে একবচনের পরিবর্তে বহুবচন ‘আমরা’ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়-- সকলকে নিয়ে বাঁচতে চান।

এ কবিতায় তাঁর ব্যক্তিগত একক সত্তায় ‘আমরা’ সর্বনামের মধ্য দিয়ে বহুস্বর ধ্বনিত হয়েছে। এভাবেই রাম বসুর ব্যক্তি চেতনা নৈর্ব্যক্তিক তথা সামষ্টিক ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। কোনো কবির অন্তর্মানসে এ ধরনের সামষ্টিক অস্তিত্বচেতনার উদ্ভাসন লক্ষ করে কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং নিম্নরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হন : As a human being he may have moods and will and personal aims, but as an artist he is "man" in higher sense he is "collective man" one who carries and shapes the unconscious, psychic life of mankind. মানব জীবনের এই অন্তর্গত রহস্যময়তা সামষ্টিক ভাবনা চেতন অথবা অবচেতনভাবেও থাকতে পারে। কবির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিকে মানবকল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে পারাই তাঁর সৃজনকর্মের সার্থকতা। কিন্তু সকলেই তো ব্যক্তি চেতনাকে সামষ্টিক ভাবনায় রূপান্তরিত করতে পারেন না।

অথবা কোনো কোনো কবির ক্ষেত্রে অবচেতনে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নাও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘টেক্সট’-এর বিনির্মাণ প্রতিবেদন-ই সমালোচকের একমাত্র অবলম্বন। ‘টেক্সট’-এর প্রতিভাষ্যের বিনির্মাণ প্রক্রিয়াই সমালোচনা সাহিত্যের সঠিক পদ্ধতি। আর তাই কবিতার সমালোচনা প্রসঙ্গে টি.এস. এলিয়ট জানিয়েছেন : 'Honest criticism and sensitive appreciation is directed not upon the poet but upon the poetry.' এলিয়টের বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট যে, তিনি মূলত ‘টেক্সেট’-এর পাঠ-প্রতিবেদনের মাধ্যমে এর নবতর বিনির্মাণকেই সমালোচনা-সাহিত্যের কর্তব্য মনে করেন। কবিতার সমালোচনা প্রসঙ্গে এলিয়টের এ মন্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করা যেতে পারে; ‘টেক্সট’ রচনার পর তা লেখক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং মহাকালের গর্ভে আভ্যন্তরীণ বিষয়-বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকের গৌরবে তা স্থান করে নেয়।

অন্যদিকে মহাকালের গর্ভে সময়ের পালাবদলে লেখক হারিয়ে যান অথচ তাঁর রচনা-কর্মটি যুগযুগ ধরে টিকে থাকে। আর তাই হাজার বছর আগের কোনো রচনা যদি এ কালের সমালোচকের হাতে তুলে দিয়ে তার পাঠপ্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয় তাহলে হাজার বছর পরের ঐ সমালোচক নিশ্চয় হাজার বছর পূর্বের প্রতিবেশ-পৃথিবীর পরিবেশ পাবেন না, বরং তিনি তাঁর কালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় উক্ত রচনাকর্মের মূল্যায়ন করবেন। কেননা এক্ষেত্রে সমালোচকের সামনে একমাত্র উপাত্ত অথবা উপাদান হিসেবে হাজার বছর পূর্বের ‘টেক্সট’খানাই প্রধান ও একমাত্র অবলম্বন। সমকালীন বাস্তবতার অভিজ্ঞতা ছাড়াও সমালোচকের সামনে তুলনামুলক উপাত্ত হিসেবে থাকে তাঁর কালে রচিত ‘টেক্সট’ এবং সমকালীন লেখকবৃন্দ। এজন্য এলিয়ট কবিতার সমালোচনা করতে চান এভাবে : I have tried to point out the importance of the relation of the poem to other poems by other authors, and suggested the coception of poetry as a living whole of all the poetry that has ever been written. অর্থাৎ যেকোন কবির সাহিত্য-কর্ম সমালোচক তৎকালীন রচনাদি এবং সমকালীন কবিসাহিত্যিকের সৃজনকর্মের মধ্য দিয়ে পূর্বতন রচনাকর্মের সামগ্রিক পরিচয় এবং মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়।

গ্রীক পণ্ডিত হোরেস ভালো রচনা এবং রচয়িতার উদ্দেশ্যে তাঁর কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যে লেখক বলতে পারেন, দেশের কাছে, বন্ধুর কাছে তাঁর ঋণ কি, পিতামাতা, ভাই এবং অতিথির প্রতি তাঁর কতটা ভালবাসা থাকা উচিত; একজন সেনেটরের বা একজন বিচারকের কর্তব্যই বা কি, যুদ্ধে প্রেরিত একজন সেনাপতির ভূমিকাই বা কি তিনি নিশ্চয়ই জানেন কি করে তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলোর প্রত্যেকের মুখে প্রকাশের যথার্থ ভাষা যোগাতে হবে। অনুকরণ ক্রিয়ায় রত শিল্পী হিসেবে একজন অভিজ্ঞ কবির উচিত হবে আদর্শের জন্য মানুষের জীবন ও চরিত্রের দিকে বার বার তাকানো এবং তা থেকেই তিনি জীবনের প্রতি বিশ্বস্ত ভাষা ভঙ্গীটি আবিষ্কার করে নিবেন। ’ হোরেসের বর্ণনায় একথা স্পষ্ট যে, তিনি কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে বারবার মানুষের, সমাজের এবং তাঁর প্রতিবেশ পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকানোর পরামর্শ দিয়েছেন। মার্কসীয় সাহিত্য সমালোচনাতত্ত্বও সামষ্টিক জীবন তথা বা সমাজ জীবন তথা মানুষের ওপর লেখকের দায়বদ্ধতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তত্ত্বগত এসব আলোচনার আলোকে রাম বসুর তোমাকে কাব্যের বিষয়াভ্যন্তরে বিশ্লেষণী প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাঁর ব্যক্তি অভিজ্ঞতা সামষ্টিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি সর্বদা সমর্পিত।

তাঁর এই মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যে প্রতিবেশ পৃথিবীর সামষ্টিক প্রতিভাষ্য তিনি নির্মাণ করেছেন তা কখনো কখনো অকবি সুলভ বা কাব্যতত্ত্বের বিচারে সৌন্দের্যের হানী ঘটিয়েছে। তবে একজন রাম বসুর কবি হয়ে ওঠার পক্ষে প্রাথমিক এই প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। কবি রাম বসু মার্কসবাদে আজীবন তাঁর বিশ্বাস অটল রেখে কাব্যচর্চা করেছেন। এবং হোরেসের পরামর্শ অনুযায়ী বারবার ফিরে তাকিয়েছেন তাঁর প্রতিবেশ পৃথিবী, সমাজ জীবন ও মানুষের দিকে। এই পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, তা পরবর্তী সময়ে রচিত কবিতা ও কাব্যনাটকের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

সমালোচকের আসনে বসে যে কোনো সৃজনশীল (ঈৎবধঃরাব) রচনার সমালোচনা করাও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সমালোচনার এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে টি.এস. এলিয়ট সমালোচনা-সাহিত্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন : 'I maintain even that the criticism employed by trained and skilled writer on his own work us the most vital, the highest kind of criticism; and ... that some creative writers are superior to others solely because there critical faculty is superior.' টি.এস. এলিয়টের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো কোনো সৃজনশীল লেখকের সমালোচনা বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকতে পারে; আর এ ধরনের সৃজনশীল লেখকদের রচনা উৎকৃষ্টমানের হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এলিয়টের এই বক্তব্যটি স্মরণে রেখে কবি রাম বসুর রচনাকর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আবারো এলিয়টের 'their critical faculty is superior' মন্তব্যটির সত্যতা প্রমাণিত হয়। কেননা রাম বসু সবসময়ই তাঁর যেকোন সৃজনকর্মের বড় সমালোচক হিসেবে নিজেকেই দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। আর তাই লক্ষ করা যায়, কালের পালাবদলে তাঁর সৃজনক্ষমতা ক্রমোন্নতির দিকে যাত্রা করেছে।

রাম বসু এজন্যই বোধ হয় শেষের দিকে কাব্যনাটক রচনায় অধিকতর মনোনিবেশ করেছেন। একথা আমাদের জানা যে, প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমাকে' থেকেই কবিতায় নাট্যগুণের সমন্বয় সাধনের প্রয়াস ক্রিয়াশীল ছিল। উপরন্তু 'তোমাকে'-এর গভীর পর্যবেক্ষণে উঠে আসে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই নাট্যগুণের চমৎকার সমন্বয় রয়েছে। উল্লেখ্য তোমাকে কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো কবিতা নাট্যসংলাপাত্মক এবং বর্ণনাধর্মীও বটে। যেমন তাঁর ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কবিতার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করলে বিষয়টি পাঠকবৃন্দের নিকট আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে : খোকাকে শুইয়ে দাও তোমার বুকের ওম থেকে নামিয়ে ওই শুকনো জায়গাটায় শুইয়ে দাও, গায় কাঁথাটা টেনে দাও অনেক্ষণ বৃষ্টি থেমে গেছে।

কবিতার এই স্তবকে কাব্যভঙ্গি সম্পূর্ণ যে নাট্যসংলাপাত্মক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং রাম বসুর কবিতায় নাট্যগুণের সমাবেশ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই আভাসিত হয়েছিল। রাম বসুর পরবর্তীকালের 'মলিন আয়না' (১৯৬৯), 'মন্ত্রখুঁজি' (১৯৮১) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'মন্ত্রখুঁজি আকাশে মাটিতে', 'নিজের মুখোমুখি আধঘণ্টা' (১৯৮৬), 'ওরা চারজন' (১৯৮৬) এবং 'একগুচ্ছ কাব্যনাটক' (১৯৮৮) গ্রন্থের অন্তর্গত 'ব্রীজ', 'নীলকণ্ঠ', 'নিশিপাওয়া', 'তন্দ্রাভেঙে ফেরা', 'রাজকীয় পদশব্দগুলি', 'পাহাড়ের ডাক', 'পার্থ ফিরে এলো', 'জন্মদিন, কুষ্ঠরোগ সারে'-- সবই কাব্যনাটক। এছাড়াও তিনি সমিদ্ধ সময় (১৯৯২) গ্রন্থে কালের রাখাল, তখন সূর্যাস্ত শীর্ষক আরো দুটো কাব্যনাটক রচনা করেছেন। রাম বসুর এই সৃষ্টি সম্ভারের দিকে তাকালে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কবির সৃজনপ্রতিভার সৃষ্টিমুখ কোন্ দিকে ছিল।

সুতরাং একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, তাঁর সৃজনপ্রতিভার ঝোঁক কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে অধিকতর আকর্ষিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত একথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাম বসুর সৃজনকর্মের ব্যপ্তি জুড়ে কবিতার সংখ্যা নগণ্য নয়; যদিও তাঁর প্রধান ঝোঁক ছিল কাব্যনাটক রচনার দিকে। পাশাপাশি একথাও সত্য যে, রাম বসু শুধু কাব্যনাটক রচনাই করেননি তেমনি কবিতাও রচনা করেছেন বিস্তর। আনবিক কালের প্রতিবেশ পৃথিবীর সংকট সংঘর্ষ এবং ব্যক্তি হৃদয়ের যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ নিয়ে তাঁর একক হাতে কবিতা এবং কাব্যনাটক উভয়ই রচনা করেছেন সমান দক্ষতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজ-জীবনের বাস্তবতা তাঁর কবিতায় উঠে আসে এভাবে : ওরা কারা আজো পথে পথে ঘোরে সরীসৃপ ওরা কারা মৃত্যুর পূজায় হাসিকে হত্যা করে ওরা কারা শিশুর মুখে ঢালে বারুদের গন্ধ এমন সকালকে কারা বিদ্রুপ করে, কারা? এখনো কি সূর্য ওঠে, পাখিরা গান গায়, সমুদ্র চঞ্চল হয় এখনো কি পাহাড়ের মাথায় চাঁদ দেখে মানুষ থমকে দাঁড়ায়? জার্মান কবি গ্যেটের কবিতা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মার্কসীয় সমালোচক জর্জ টমসন যে মন্তব্য করেছেন তা যেকোন ভাষা-সাহিত্যের মার্কসবাদী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

জর্জ টমসন মনে করেন : কবি শুধুমাত্র তার নিজের জন্যই বলেন না, তার স্বজনদের জন্যেও বলেন। তাঁর আর্ত উচ্চারণ হচ্ছে তাদের আর্তি, যেটা শুধুমাত্র তিনিই উচ্চারণ করতে পারেন। এই বিষয়টিই একে গভীরতা দান করে। কিন্তু স্বজনদের জন্যে তাকে বলতে হলে তাকে অবশ্যই তাদের সাথে দুঃখ কষ্ট সইতে হবে; আনন্দ ভাগ করে নিতে হবে, কাজ করতে হবে, করতে হবে সংগ্রাম। তা নইলে তিন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।