কিছুটা কালোয়, কিছুটা সাদায়
গতকালের বৃষ্টির পানি এখনও ছাদে জমে আছে। আজ মনটা উদাস। ছাদের পানিতে নিজের চেহারাটা দেখছি। কখনও এমন ছিলাম না। এখন পানিতে নিজের ছবি দেখতে মন চায়।
পানিতে বাতাস লাগলে চেহারায় ঢেউ খেলে। ভাল লাগে। এই ঢেউয়ের সঙ্গে পুরনো দিনের মজার মজার গানও মনে পড়ে।
আমি ছাদের বদ্ধ পানিতে নিজের চেহারা দেখতে দেখতে গুনগুন গান করছি। তুষিকে খুন করতে ইচ্ছে করছে।
ইচ্ছে হচ্ছে, তার শরীরের রক্ত দিয়ে ছাদের পানিকে লাল করে দিই! গতকালও সে আসবে বলে আসেনি। আজ সকালেও আসার কথা, আসেনি। তার চেহারার রঙ ফর্সা তো কী হয়েছে! এ-রকম ফর্সা মেয়ে আমাদের তল্লাটে অনেক! ভাবছি, সে যদি এসে যায়, তাকে সাফ বলে দেব, আমি ফর্সা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করব না। ফর্সা মেয়েরা নোংরা হয়!
পানিতে নিজের ছায়া দেখতে দেখতে আজেবাজে ভাবছি। আসলে, তুষির জন্য মনটা খুব কাঁদছে।
আমাদের প্রেম হয়েছিল ছয় বছর আগে। এই ছয়টা বছরে স্রেফ একটা দিন দু'জন মন ভরে কথা বলেছিলাম। দু'জন দু'জনের হাত ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। সেটা প্রথম দিকের কথা। শুরুর দিকে প্রেমটা গদগদ হয়।
এখন গদগদ প্রেম করার সময় নেই। দেখলে ভাল লাগে, না দেখলে মনটা কাঁদে, ব্যাস। ওই একদিন ছাড়া বাকি সব দিনই গেছে ঝগড়ায়। দোষত্রুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে সেটা নিয়ে ঝগড়ায় মেতে ওঠাই কাজ!
আজ তুষি এলে বড় গোলমাল বাঁধবে। গোলমালটা শুরু করব আমি।
জিজ্ঞেস করব, `কারও সঙ্গে ডেটিঙয়ে গিয়েছিলে, সময় পাওনি, তাই না?'
তুষি বলবে, 'ছিঃ, এমন কথা বলতে পারলে?'
'শোনো, আমি ফর্সা মেয়েকে বিয়ে করব না। '
'কসম খেতে পারবে?'
'কসম, তোমার কসম। '
'তাহলে আমিও একটা কথা...'
'বল, তোমার মুখ চেপে ধরেছে কে!'
'আমিও বেকার লোকের সঙ্গে প্রেম করব না। '
'কসম কর। '
'কসম, তোমার কসম, তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠির কসম।
'
সে হনহন করে চলে যেতে চাইবে। আমি তার ওড়নাটা টেনে ধরব। সে আর যাবে না। এরপর আমরা দু'জনে হেসে ফেলব। আমি বলব, 'এ-ই গাধি, ঝগড়াটা না করলে তোমার চলে না?'
সে বলবে, 'ঝগড়া তো তুমিই শুরু করলে।
'
'আজ না হয় আমি করলাম; অন্যদিন তো তুমি কর। '
আমাদের মাঝে এটা নতুন কিছু নয়; প্রায় প্রতিদিনই এ-রকম হয়।
পানিতে নিজের ছবি দেখতে দেখতে আবার বৃষ্টি নেমেছে। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। ছবি দেখা যাচ্ছে না।
বৃষ্টি ঘন হয়ে নামছে। বাইরে থাকা যাচ্ছে না। বৃষ্টি হোক, অসুবিধা নেই; এরচেয়েও বেশি বৃষ্টিতে তুষি এসেছে। আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। ছাদের একপাশে ছোট্ট একটা ঘরে আমি থাকি।
মন বলছে, আজ নিশ্চয়ই তুষি আসবে।
তুষি আসতে আসতে আমাদের প্রেমের শুরুর কাহিনীটা বলি।
গ্রামের কথা। চৌধুরী পাড়া এবং খন্দকার পাড়ার মধ্যে হাডুডু খেলার আয়োজন হয়েছে। মাইকিং হয়েছে; হাটে হাটে ঢোলও পেটানো হয়েছে।
ফজু মেম্বার প্রধান অতিথি। হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখতে এসেছে। তুষিও খেলা দেখছে। আমি চৌধুরী পাড়ার পক্ষে। আমরা চৌধুরী বংশ।
খন্দকারদের সঙ্গে খেলব; হারলে লজ্জা পাব। মরিয়া হয়ে খেলছি। আমি তখন এইচএসসিতে। ভাল খেলতে পারি।
খেলায় তুমুল উত্তেজনা।
হঠাৎ দেখি, দর্শকদের মাঝে মারামারি শুরু হয়েছে। ফজু মেম্বারকে কেউ মানছে না। দর্শকরা খেলোয়াড়দের গায়ে হাত তুলছে। একজন আমার মুখে একটা ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখি, যে ছেলেটা আমাকে মেরেছে, সে তুষির বড় ভাই নয়ন।
ওরা খন্দকার বংশের। তারা কখনও আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস করেনি। তার সঙ্গে গতকালও নাস্তা করেছি। আমিও একটা ঘুষি মারতে পারতাম, মারিনি। মুখে রক্ত নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছি।
আমার আত্মীয়-স্বজন নয়নকে মারার জন্য কিরিচ-দা নিয়ে প্রস্তুত। আমার এক দুলাভাইয়ের দো'নলা বন্দুক আছে। তিনিও এসেছেন। তাঁর হুংকার শুনে আমি নিশ্চিত, তিনি নয়নকে আর ইহধামে রাখবেন না। আমার ধারণার পেছনে যুক্তি আছে।
আমাদের বংশের রক্ত গরম। শুনেছি, আমাদের বংশের লোকেরা একদা এক পুলিশকে কবরে জ্যান্ত পুঁতে দিয়েছিল।
অবস্থা বেগতিক। একটা লোক আমাকে ঘুষি মেরেছে, এ-জন্য তাকে মেরে ফেলা হবে, এটা আমার আশ্চর্য লাগছে। আমি আমার ছোটভাইয়ের মাধ্যমে গোপনে নয়নদের বাড়িতে চিঠি পাঠাই, যেন তাঁরা বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
বলে রাখি, আমাদের আর তুষিদের বাড়ির মধ্যে মাইলখানেকের ফারাক।
তুষিকে একা বাড়িতে রেখে সবাই পালিয়েছেন। আমার আত্মীয়-স্বজন নয়নদের বাড়িতে হানা দিয়েছেন। অবশ্য, মেয়ের গায়ে হাত তোলেননি।
ঘটনার পর দু'দিন গত হয়েছে।
আমি কলেজ থেকে আসছি। দেখি, আমার সামনে তুষি দাঁড়িয়ে আছে।
'ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম। '
'কোথায় যাচ্ছ?'
'মাফ চাইতে এসেছি। '
'কে পাঠিয়েছে তোমাকে?'
'কেউ না।
'
'আমাকে মেরেছে তোমার ভাই, তুমি মাফ চাইবে কেন?'
এরপর তুষি আমার হাতটা ধরে ফেলে- 'ভাইয়া, আমাদের মাফ করে দিন। '
আমি বললাম, 'তুমি আমার হাত ধরেছ কেন?'
তুষি আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তুষির চেহারার দিকে আমি ভাল করে তাকাই।
তুষি বলল, 'ভাইয়া, আম্মু যেতে বলেছেন। '
'আমাকে?'
'জ্বী।
'
'কেন, মাফ চাওয়ার জন্য?'
তুষি কিছু বলছে না। আমি তুষিকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ফিরে আসছি। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি, তুষি আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। যতবার দেখেছি, ততবার সেভাবেই দেখেছি।
রাতে বিচার বসেছে।
ফজু মেম্বার হাতে লাঠি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দু'পক্ষের লোক হাজির হবে। আমি বারান্দায় পড়ার টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, তুষি আমাদের ঘরে ঢুকছে। ঘরের লোকজন যদি জানে, তুষি নয়নের বোন, হাড়গোড় চুরমার করে ফেলবে।
তুষিকে আমার পাশে দেখে আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, 'মেয়েটা কে?'
আমি বললাম, 'ওর বাড়ি খন্দকার পাড়া, বিচার দেখতে এসেছে। '
এরপর দু'পক্ষের লোকজনে আমাদের উঠান ভরে যায়। সবার মাঝে তুষিও হারিয়ে যায়।
বিচারে ফজু মেম্বার নির্দয়। তাঁর লাঠিপেটা যে দেখেনি, সে বিশ্বাস করবে না, মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে।
বদি চোরাকে শুধু একবার পিটিয়েছিলেন, এখনও সে লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না।
ফজু মেম্বার হুংকার ছাড়লেন- 'নয়ইন্যা এসেছিস?'
'আসসালামু আলাইকুম, এসেছি। '
'আয়, সামনে আয়। অ-দিদারের মা, হুক্কায় তামাক আছে?'
আমার আম্মা হুক্কাটা মেম্বার সাহেবের সামনে এগিয়ে দিলেন। পুরো মজলিস নিরব।
হুক্কা টানার পর মেম্বার সাহেব কী জানি কী করেন!
'এ-ই নয়ইন্যা, দিদারের গায়ে হাত তুলেছিস?'
'না মেম্বার সাব। '
'সত্য করে বল। '
'না মেম্বার সাব, আমি তুলিনি। '
'দিদারকে তাহলে মারল কে?'
মজলিসের মাঝখান থেকে তুষি বলে ওঠে, 'মেম্বার সাব, আসসালামু আলাইকুম। '
মেম্বার সাহেব বললেন, 'তুমি কিছু বলবে?'
'নয়ন ভাই দিদার ভাইকে মেরেছে।
'
'তুমি নিজ চোখে দেখেছ?'
'জ্বী। '
মেম্বার সাহেব এখনও হুক্কা টানছেন। তাঁর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। তিনি বললেন, 'একজন মেয়ের সাক্ষ্যে বিচার হবে না। '
মজলিস থেকে আরও ক'জন একই কথা বললেন, 'জ্বী মেম্বার সাব, আমরা দেখেছি।
'
মেম্বার সাহেব বললেন, 'দিদারের মা, খাঁটি সরিষার তেল আছে?'
আমার আম্মা সরিষার তেলের শিশিটা মেম্বারের সামনে রাখলেন। নয়নের সারা পিঠে তেল মাখা হল। লাঠির হাতল ছাড়া বাকিটা তেলে চকচক করছে। তাঁর কাছে স্বাভাবিকভাবে দু'টা লাঠি থাকে। একটা ভেঙে গেলে দ্বিতীয়টা ব্যবহার করেন।
আজ একটা। অপরাধ লঘু, তাই একটা লাঠি ভাঙলেই শেষ। আর মারবেন না।
নয়ন কান ধরে মেম্বার সাহেবের সামনে নতজানু হয়ে বসে আছে।
ফজু মেম্বার হুক্কা টানছেন।
এরপরের চিত্রটা হবে ভয়াবহ। পিঠ থেকে শুরু করবেন তিনি। পাছা রান হাঁটু গোড়ালি মেরে থেনথেনে করে দেবেন। এরপর নয়ন ল্যাঙচাতে ল্যাঙচাতে বাড়ি যাবে।
আমি দেখছি, তুষি কাঁদছে।
ভাই যেটুকু অপরাধ করেছে, তাতে এত ভয়াবহ শাস্তি হওয়ার কথা নয়। ফজু মেম্বার বলে কথা। তাঁর শাস্তির ইতিহাস খারাপ, বলা যায় ভয়াবহ।
ফজু মেম্বার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'বিসমিল্লাহ'।
আমি মুখ খুললাম, 'মেম্বার সাব, নয়ন তো মেরেছে আমাকে, আমিই তাকে মারব।
এক ঘুষির বদলে দশটা ঘুষি মারব। আমার মন শান্তি পাবে। মেম্বার সাব, লাঠিটা আমাকে দিন। '
'দেখ ব্যাটা, শাস্তির একটা নিয়ম-কানুন আছে, পরিমাণ আছে। কোন অপরাধের শাস্তি কতটুকু, তা তুই জানবি না।
নয়ইন্যা যে অপরাধ করেছে, তাতে তার একটা হাত ভাঙা যায়, দুইটা হাত কখনও নয়। কারণ, সে এক হাতে তোকে মেরেছে, দুই হাতে নয়। '
'জ্বী মেম্বার সাব, আমি ওভাবেই মারব। '
তিনি আমার হাতে লাঠিটা তুলে দিলেন। আমি মারতে উদ্যত হলাম।
নয়ন আমার দু'পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি তুষির দিকে তাকালাম। সে কাঁদছে। তুষির মায়ের চেহারাটা পর্দা-ঢাকা। সম্ভবত তিনিও কাঁদছেন।
নয়নকে দু'হাত ধরে আমি দাঁড় করালাম। বললাম, 'দেখ নয়ন, তুমি এসএসসি পরীক্ষার্থী; পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। তোমার জানা উচিত ছিল, কারও মুখে ঘুষি মারাটা অন্যায়। উত্তেজনার সময় তুমি সেটা বুঝতে পারনি। আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম।
ভাল করে লেখাপড়া কর। কখনো অন্যায় করবে না। '
আমার খুব ভাল লাগছে। আমি একটা লোককে মাফ করে দিতে পারলাম। কাউকে নীতিবাক্য শোনানোর বয়স আমার এখনও হয়নি; ভাগ্যক্রমে শোনাতে পারলাম।
নিজেকে সবার চেয়ে বড় মনে হচ্ছে। আমার আম্মাও আমার কাজটা সমর্থন করলেন।
এরপর তুষির মা আমাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমি তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তাঁর বুকের মধ্যে ঢুকে গেলাম। দেখলাম, তুষিও হেচকি তুলে কাঁদছে।
আমার ধারণা, সেদিন থেকে তুষির মনে আমার জন্য একটা জায়গা তৈরি হয়ে যায়। বলতে কী, তুষিকেও আমার ভালো লেগে যায়।
বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসও বইছে। অসুবিধা নেই, এরচেয়ে বেশি বৃষ্টিতেও তুষি আমার বাসায় এসেছে। তুষি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে।
আমিও ঢাকায়, মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। বাসায় বসে কবিতার মতো কিছু না কিছু লেখি। এজন্য মাঝে মাঝে সে আমাকে পাগলও বলে। বলুক, আমি তুষির জন্যই সব লিখি, আমি তুষির জন্যই পাগল!
কল বেল পড়েছে। বৃষ্টির শীত-শীত বাতাসেও মনটা গরম হয়ে উঠেছে।
যাকে বলা হয় উষ্ণহৃদয়। ভালোবাসা করলে মনটা কখনও মারাত্মক রকমের ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আবার কখনও আগুনের চেয়েও গরম হয়। ঠাণ্ডা-গরমের এমন উত্থান-পতন প্রেমিকরা ছাড়া কেউ বোঝে না! আমার মন এখন গরম। দরজাটা খুলে দিয়েছি। তুষি নয়, আমার জেঠাতো ভাই এসেছেন।
এই জেঠাতো ভাইয়ের নাম নাসের আহমাদ চৌধুরী। 'আহমেদ' লিখলে তিনি মাইন্ড করেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, শব্দটা যেহেতু আরবি, আরবি উচ্চারণই এখানে প্রযোজ্য। মিম-এর উপর জবর হলে 'আহমাদ' হয়, 'আহমেদ' হয় না।
নাসের আহমাদ ভাই অনেক দিন থেকে আমার বাসায় আসেন না।
আমার টিউশনির টাকা থেকে তাঁকে ছয় হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম দুই বছর আগে। এখনও ফেরত দেননি। টাকাটা না দিলে তিনি বিয়ের সোনা কিনতে পারতেন না। টাকা দিতে না পেরে বেচারা আসেন না। আমি মাঝে মাঝে তাঁদের বাসায় যাই।
তাঁর ছেলেটা আমার সঙ্গে হাসে। তখন টাকার কথাটা আমার জোরেশোরে মনে পড়ে। মনে মনে বলি, এই টাকাটা দিয়ে সোনা কিনে আমি যদি বিয়ে করতাম, আমারও এ-রকম একটা ছেলে হত, এ-রকম হাসত।
আমি কথাটা তুষিকেও বলেছি, 'আর কতোদিন এ-রকম আসা-যাওয়ায় থাকবে। সেই ছয় বছর আগে বিয়ে করলে এতদিনে আমাদের সন্তান স্কুলে যেত।
'
তুষি বলে, 'মাস্টার্স না করে আমি বিয়ে করব না। '
আমি বলি, 'বিয়ে করে কি মাস্টার্স করা যায় না?'
'সবাই বলে যায়, আসলে কিন্তু যায় না; অনেক দেখেছি। '
'মাস্টার্স না করলে অসুবিধা কী?'
'তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। কথায় কথায় তুমি আমাকে অশিক্ষিত বলবে। '
'মাস্টার্স পাশ করলেও তোমার মনটা অশিক্ষিত থাকবে।
'
'কী বললে?'
প্রতিদিনের মতো ঝগড়া শুরু হয় আর নিজের মতের উপর সে এক শ' ভাগ অটল থাকে। প্রসঙ্গত বলি, তুষি প্রথম প্রথম আমাকে 'আপনি' বলত, এখন 'তুমি' বলে। আগে একটু বেখাপ্পা লাগত, এখন লাগে না। তাছাড়া, আমি দেখেছি, আমার বন্ধুদের প্রেমিকারা তাদের 'তুমি' বলে ডাকে। তারা আমাকে বলেছে, প্রেম গাঢ় হলে 'আপনি'টা 'তুমি' হয়ে যায়।
নাসের ভাইকে বললাম, 'আসসালামু আলাইকুম। বসুন। '
'বসার সময় নেই। তাড়াতাড়ি প্যান্ট-শার্ট পরে নে। '
'কেন, কী হয়েছে?'
'তোকে যেটা বলছি সেটা কর।
'
আমি শার্ট পরে প্যান্টটা বিচলিতভাবে এদিক-ওদিক খুঁজছি। নাসের ভাই বললেন, 'শনি ফুফু আর নেই। '
'ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। '
আমি প্যান্ট না পরে খাটে আড়াআড়ি শুয়ে থাকলাম।
'আচ্ছা নাসের ভাই, চিকিৎসার অভাবে ফুফু মারা গেলেন, তাই না?'
'হ্যাঁ।
'
'আমার টিউশনির টাকা থেকে শনি ফুফুকে তিন হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ক'দিন পর সেটা পাব। হায়রে পৃথিবী! এখন ফুফুও নেই, সেই তিন হাজার টাকাও নেই। পৃথিবীতে কেউ থাকবে না, কিছু থাকবে না। '
নাসের ভাই হয়ত মন খারাপ করলেন।
কারণ, তাঁর কাছেও আমি টাকা পাই।
নাসের ভাই বললেন, 'দিদার, প্যান্টটা পরে নে। মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে যেতে হবে। '
'মেডিকেলে কবে এনেছিলেন?'
'কাল এনেছিলাম, আজ মারা গেলেন। '
'নাসের ভাই, আমরা এখন তাড়াহুড়া করে গেলে ফুফু তো আর বেঁচে উঠবেন না।
ছোটখাট ক'টা কাজ সেরে একটু পরে যাই। '
তুষির সঙ্গে দেখা করে যাওয়া দরকার। তাকে বলে না গেলে কত কিছু মনে করতে পারে সে।
আবার বেল পড়েছে।
রুম থেকে শুনতে পাচ্ছি, বাইরে বাড়িওয়ালি বকবক করছে।
পাঁচ থেকে ছয় তারিখ হলে ভাড়ার জন্য বাথরুম পর্যন্ত টাকটাক করে ডাইনি। ফুফু না মরে এই ডাইনি মরলে ভাল হত! না, এরা মরবে না; অনেক দিন বাঁচবে। এদের ওষুধের অভাব নেই। ফল-ফ্রুট খায়। আশি বছর বয়সেও শরীর তাজা থাকে।
দরজাটা খুলেছি।
'এ-ই, আজ কয় তারিখ জান না। ঘুমিয়ে আছ নাকি। প্রতি মাসে ভাড়ার জন্য ঘুরবে কে। আমি তোমাদের চাকরানি নাকি।
দেখলে তো ভদ্রলোকের ছেলে মনে হয়। '
আমি ঝিম মেরে আছি। আমার মরহুমা ফুফুর প্রতি প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তিনি আমার পাওনা টাকাটা দিয়ে মরতে পারতেন। এই টাকাটা পেলে ডাইনির চেহারাটা দেখতে হত না।
আমরা চৌধুরী বংশের ছেলে। জনমে এমন কথা বলে কেউ ফিরে যেতে পারেনি। নাসের ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। কোন কাজটা তিনি করেন না। বউয়ের ব্লাউজ-পেটিকোট লাগলে সেটা কি তিনি দেন না! আমার টাকাটা কেন দেবেন না?
নাসের ভাইকে বললাম, 'আপনি মেডিকেলে গিয়ে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করুন, আমি আসছি।
কোনও কারণে আমি না এলে আপনি চলে যাবেন। আমি জানাযার আগে পৌঁছাব। '
নাসের ভাই বাড়িওয়ালিকে বললেন, 'খালাম্মা, আজ আমাদের ফুফু মারা গেছেন। তাঁর লাশ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। ফিরে দিদার বাসাভাড়া পরিশোধ করবে।
'
'প্রতি মাসে তো ফুফু মরে না। নাখান্দার বাচ্চা। '
আমার আর সহ্য হল না। আমি বাড়িওয়ালির নাকে একটা ঘুষি মেরে দিয়েছি। নাক দিয়ে দরদর রক্ত বের হচ্ছে।
আমার মনটা একটু হালকা হয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়ার কষ্টের অভিজ্ঞতা আমার আছে। ডাইনি কষ্ট পাবে; মরবে না। আমি প্যান্টটা কোনওরকম ঢুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
বাড়িওয়ালি অপ্রস্তুতভাবে হাত নাড়ছে, 'এ-ই, এ-ই..'
বাড়িওয়ালিকে আরেকটা গলা ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে হুক এঁটে দিয়েছি।
ছাদ থেকে ডাইনি সারাদিন চিল্লালেও কেউ শুনবে না।
নাসের ভাই বললেন, 'কী করলি তুই!'
'যা করেছি, ঠিক করেছি। আল্লাহ যা করেন, ভাল'র জন্যই করেন। '
'এখন বাসায় আসবি কী করে!'
'এই বাসায় আর আসব না। এ-সব বাড়িওয়ালিকে সকাল-বিকাল দুইটা করে পাছায় লাথি দেওয়া দরকার।
'
বাসায় আমার কাপড়-চোপড়, চারপায়া, চেয়ার, টেবিল আর ক’টা বই আছে। সব বিক্রি করলে আড়াই হাজার টাকা হতে পারে। বাসাভাড়া বাকি দেড় হাজার টাকা। একহাজার টাকা ক্ষতি। অসুবিধা নেই।
ঢাকা শহরে কত টাকা এদিক-ওদিক খরচ হয়। এখন থেকে একমাস রিকশায় চড়ব না, হাঁটব। ক্ষতিটা এডজাস্ট হয়ে যাবে।
বাসার মূল ফটকের বাইরে গিয়ে দেখি তুষি আসছে। আমাকে দেখেছে; হাসছে।
এই বেচারি জানে না, এখন আমার মনের অবস্থা কী! জানলে হাসত না। আমি হাসছি না। হাসির একহাজার পাওয়ারের ওষুধ খাইয়ে দিলেও এখন আমার মুখ থেকে হাসি বেরুবে না। তুষি নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে, দু'বার কথা দিয়েও না আসার কারণে 'দিদার ভাই' রাগ করেছে। তুষি সেটা ভাবুক, ক্ষতি নেই।
তুষি একেবারে কাছে চলে এসেছে। আমি তাকে না চেনার ভান করে পাশ কাটাতে চাচ্ছি। সে আমার হাত ধরে ফেলল।
আমি গদগদ প্রেম করি সেটা নাসের ভাই জানলে কিচ্ছু হবে না। তাঁকে আমি আর শ্রদ্ধা করি না।
কিন্তু, তিনি যদি আমার আব্বাকে এ-সব কথা বলেন! তাও তেমন সমস্যা নয়। ক্ষতি হবে: বাড়ি থেকে মাসিক যে হাজার টাকা পাই, সেটা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। অবোধ ছেলেটি'র যে অভিনয় করতাম তাঁদের কাছে, সেটা জনমের মতো শেষ।
পিতা-পুত্রের সম্পর্কহানির বড় নেতিবাচক দিকটা হচ্ছে, আমাদের বিয়েটা তাঁরা মেনে নেবেন না। ভবঘুরে হয়ে থাকতে হবে।
চৌধুরী বংশের সম্মানহানি হবে। বংশের ছোট-বড় কেউ আমাকে দাম দেবে না। বড়রা স্নেহ না করলে আমার তেমন অসুবিধা হবে না। ছোট কেউ যদি আমাকে দেখে সালাম না করে মাথায় আগুন ধরে যাবে। গালে আস্ত একটা চড় লাগিয়ে দেব।
গোলমাল বেঁধে যাবে। ধ্যাৎ, এ-সবকে আমি পরোয়া করি না!
নাসের ভাইকে তুষির পরিচয়টা দিলাম- 'এটা তুষি। খন্দকার পাড়ার নয়নের ছোটবোন। '
'নয়ন মানে সেই নয়ন...'
'হ্যাঁ, আমার নাকে ঘুষি মেরেছিল। '
'মা'শাআল্লাহ।
তো, এখন কোথায়?'
'অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। '
নাসের ভাই বললেন, 'তুষি, আজ আমাদের ফুফু ইন্তেকাল করেছেন। মেডিকেলে লাশ..'
'ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমিও আপনাদের সঙ্গে মেডিকেলে যাব।
'
আমি বললাম, 'তুষি, আমার ফুফু পরহেজগার মহিলা ছিলেন। অনাত্মীয়া বেপর্দা কেউ গেলে মরহুমার রুহে গুনাহ বর্ষিত হবে। '
নাসের ভাই বললেন, 'তুষি, তুমি ফুফুর জন্য দোয়া কর। দেরি হলে বাসায় তোমার জন্য চিন্তা করবেন। '
নাসের ভাই হাঁটছেন।
আমি তুষিকে নিয়ে তাঁর পেছন পেছন হাঁটছি।
'এই গাধি, তুমি মানুষ না অমানুষ?'
'আমার কী সমস্যা হয়েছে জান?'
'সব জানি। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই। খোদার কসম, আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে তোমার-আমার সম্পর্ক শেষ। '
আমি চলে গেলাম।
তুষি থ দাঁড়িয়ে আছে।
একটা রিকশায় চেপে আমি আর নাসের ভাই মেডিকেলের দিকে যাচ্ছি। এক দুই মিনিট করে সময় যত এগুচ্ছে, ততই কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। এখন আমার ফুফু নেই, বাসা নেই, তুষিও হয়ত নেই। অন্যসময় বিষন্নতায় ভুগলে আমি মিষ্টি খাই।
মিষ্টিতে বিষন্নতা কমে।
কষ্টে মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাসও হয়েছে তুষির কারণে। একবার তুষির গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। তাকে দেখতে গেলে সে তার গরম হাতটি আমার হাতে রেখেছিল। হাতটা পুড়ে যাচ্ছিল; আমার ভেতরটাও পুড়ে যাচ্ছিল।
ফিরে আসার পথে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল, মিষ্টি খেলে কষ্টটা একটু কমবে। বগুড়ার ছানার মিষ্টি খেয়েছিলাম। সত্যি, ব্যথাটা কমেছিল। এরপর থেকে কোনও কারণে মনটা আহত হলে মিষ্টি খাই।
আজও মিষ্টি খাব।
'এই রিকশা থামাও। '
নাসের ভাই বললেন, 'কেন, কী হয়েছে?'
'মিষ্টি খাব। বগুড়ার ছানার মিষ্টি। '
'এটা একটা কথা হল।
মেডিকেলে লাশ রেখে তুই মিষ্টি খাবি?'
'হ্যাঁ। '
নাসের ভাই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভাবখানা দেখে মনে হল, এই সময়টাতে মিষ্টি খাওয়া অমানুষিক কোনও কর্ম হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি খাবেন?'
নাসের ভাই কিছু বললেন না। রিকশায় বসে রইলেন।
আমি একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম।
দোকানদারকে বললাম, 'বগুড়ার ছানার মিষ্টি আছে। '
'ভাই, সব মিষ্টির আলাদা আলাদা নাম আছে। এই নামে কোনও মিষ্টি নেই। '
'এত কথা বল কেন? না থাকলে নাই বলবে।
'
দোকানি কতগুলো মেয়ের সামনে আমাকে ভেঙচি কাটল, যেন জীবনে আমি মিষ্টি খাইনি। আমার একটা বদভ্যাস আছে। মেয়েদের সামনে আমাকে ছোট করা হলে সহ্য হয় না। এজন্য অনেক লোককে আমি অপদস্থ করেছি। নিজেও অপদস্থ হয়েছি।
আল্লাহ যা করেন, আমি একটা জুতা খুলে দোকানির মুখের সামনে নিয়ে গেলাম। দোকানির মুখ কান সব লাল হয়ে গেছে। মুহূর্তেই তার গোঁফের পাশ দিয়ে ঘাম বেরিয়েছে। জুতাটা আবার পায়ে দিয়ে রিকশার দিকে ফিরলাম।
এ-সময় আমার চেয়ে দুঃখী মানুষ বোধ করি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
থাকলেও সেটা তুষি। কারণ, তার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন করে এসেছি।
নাসের ভাইকে বললাম, 'মিষ্টি খাওয়া হয়নি। '
তিনি উত্তর করলেন না। ভাবলাম, তিনি উত্তর করলেই কী, না করলেই কী! তাঁকে আগে সম্মান করতাম; এখন করি না।
সম্মান তিনি রাখতে জানেননি। আমার মনের খবর জানলে তিনি আমার উপর রাগ করতেন না। মানুষের মন বোঝার জন্য যোগ্যতার দরকার হয়। তাঁর সেই যোগ্যতা নেই।
দু'-একটা বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে।
বৃষ্টি আরও বাড়লে আমার মনটা তুষির জন্য কেঁদে উঠতে পারে। আল্লাহ চাইলে বৃষ্টিটা না নামাতে পারেন। তিনি সর্বশক্তিমান। জানি না, আমার মতো গুনাহগারের উপর তিনি কতটুকু সদয় হন।
বৃষ্টি আরেকটু ঘন হয়েছে।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার সাব, পর্দাটা টানান। '
ড্রাইভার বলল, 'স্যার পর্দাটা আজ আনিনি। বৃষ্টি কমে যাবে। '
মুরব্বিদের কাছে শুনেছি, বিপদ এলে সব একসঙ্গে আসে। জানি না, আর কতো বিপদ আমার ঘাড়ে ভর করবে।
ড্রাইভারকে কিছু বললাম না। আমি জানি, কথা বাড়াতে গেলে রিকশাঅলার নাক দিয়েও নিশ্চিতভাবে রক্ত বের হবে।
নাসের ভাই ড্রাইভারকে একটা থাপ্পড় দিলেন। সে প্রতিবাদ করল না। আমার খারাপ লাগল।
থাপ্পড় মারলে আমি মারতে পারতাম। তাঁর মন তো আমার মতো খারাপ হওয়ার কথা নয়। আমি প্রতিবাদ করলাম, 'আপনি গরিব লোকটাকে মারলেন কেন?'
নাসের ভাই কিছু বললেন না। রিকশাঅলা বেচারা লাল গাল নিয়ে রিকশার প্যাডেল দাবতেই থাকল। সে বুঝতে পেরেছে, পর্দা না আনাটা তার অপরাধ।
অপরাধের শাস্তি কোনও না কোনও সময় পেতেই হয়।
রিকশা মেডিকেলের গেটে গিয়ে থেমেছে। নাসের ভাই ড্রাইভারকে একটা দশ টাকার নোট দিলেন। আমি ড্রাইভারকে আরেকটা পাঁচ টাকার কয়েন দিলাম।
নাসের ভাই বললেন, 'পাঁচ টাকা বেশি দিলি কেন?'
আমি বললাম, 'এটা তার পাওনা।
আপনি তাকে থাপ্পড় দিয়েছেন, সে প্রতিবাদ করেনি। সে চাইলে আপনাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে গালটা লাল করে দিতে পারত। '
নাসের ভাই কিছু বললেন না। কী বলবেন! আমি জানি, আমি ঠিক কথাটাই বলেছি। তাঁকে আমি রক্তে-মাংসে চিনি।
তিনি গরিব মারার লোক। ধার নিয়ে তিনি আর শোধ দেন না।
মেডিকেলের তের নাম্বার ওয়ার্ডের করিডোরের এক কোণায় শনি ফু'র লাশটা উত্তর-দক্ষিণ করে ফেলে রাখা হয়েছে। আশেপাশে কেউ নেই। একটি অন্ধকার জায়গায় লাশটা রাখা হয়েছে।
হায়রে শনি ফু। শনি ফু'র হুংকারে আমাদের তল্লাট কেঁপে কেঁপে উঠত। সেই শনি ফু আজ শুয়ে আছেন। অন্ধকারে। একা।
আমি লাশের মুখের কাপড় সরালাম। আমার মনে হয়েছে, তিনি হাসছেন। আগের মতো তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এখনই বলবেন, 'এ-ই কুত্তার বাচ্চা, এতদিন পর ঢাকা থেকে এলি?' আমি কেঁদে ফেলেছি। মোটা তরতাজা শরীর নিয়ে আমার আব্বার একমাত্র বোনটি চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন।
আমি নিরবে কাঁদছি।
নাসের ভাই শব্দ করে হু হু কাঁদছেন। শনি ফু জীবিত থাকতে কাঁদতে দেননি। বলতেন, 'মরদ লোকেরা কাঁদলে অলক্ষ্মী আসে। ' আমার দাদী মারা যাওয়ার পর কাঁদতে চাইলেও তাঁর ভয়ে কাঁদতে পারিনি। লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি।
আজ চাইলে আমিও শব্দ করে কাঁদতে পারি।
শনি ফু'কে অনেকে 'বাঘিনী' বলতেন। তাঁর ভয়ে তল্লাটে চোর-ডাকাত আসতে পারেনি। বাঘাবুকের ফুফুর দিলটিও ছিল দরাজ। উজাড় করে খাওয়াতেন।
রুটি দুইটা থেকে তিনটা না নিলে বলতেন, 'ফকিরনির পোলা'। পরীক্ষার আগে সালাম করতে গেলে হাতে পাঁচ শ' টাকার নোট গুঁজে দিতেন। গোলা থেকে ধান বিক্রি করে এ-টাকা জোগাড় করে রাখতেন। মনে মায়াও ছিল এক সাগর। ঢাকা থেকে গেলে বুকে টেনে নিতেন; ছাড়তে চাইতেন না।
শেষ দিকে আর্থিক অনটনে পড়ে গিয়েছিলেন বেচারি।
কাঁদলে চলবে না। ঢাকা থেকে ফুফুকে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। এম্বুলেন্স ভাড়া করতে হবে। আমার কাছে মাত্র ত্রিশ টাকা আছে।
মিষ্টি খেলে থাকত বিশ টাকা। এম্বুলেন্স ভাড়ায় আমি কিছু দিতে পারব না; নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। নাসের ভাইয়ের কাছে টাকা আছে কি নেই, জানতেও মন চাইছে না। লোকটা এমন কিপ্টা, চার-পাঁচ মাইল হেঁটে টিউশনি করেন, বাসেও ওঠেন না। আমার পাওনা টাকাটা আমি এখন চাইব।
'নাসের ভাই, আমাকে হাজার খানেক টাকা দিন। এম্বুলেন্সে এডভান্স করব। বাকিটা বাড়িতে গিয়ে ব্যবস্থা করব। '
নাসের ভাই দুইটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে দিলেন। দৃশ্যত, তিনি খুব খুশি।
এখন টাকাটা তিনি আমার পাওনা থেকে কাটতে পারবেন। লোকটাকে দেখতে আমার এখন ঘেন্না হচ্ছে। মনে মনে বলছি, কারও মরায়ও যদি না লাগে, ধুত্তুরি আপনার টাকা। বউকে শাড়ি কিনে দিতে তো আপনার হাত বন্ধ থাকে না। দেখব, আপনার লাশ কার টাকায় যায়!
আমি বললাম, 'আপনার হাতে আর টাকা নেই?'
'নেই।
'
টাকাটা নাসের ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, 'আপনি এম্বুলেন্স ঠিক করুন। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি। '
আমি তুষির হোস্টেলের উদ্দেশে বেরুচ্ছি। তুষি সঙ্গে থাকলে দীর্ঘ যাত্রায় ভাল হবে; কষ্ট আর আনন্দ মাখামাখি হবে।
মেডিক্যালের গেটে গিয়ে তুষিকে দেখে চমকে উঠি।
তুষিও মেডিক্যালে আসছে। আশ্চর্য, তুষি আসার আগে আমার মনে জানা হতো, আজ চিন্তাও করতে পারিনি তুষি আসবে। হতে পারে এটা তার শক্তি। অন্যসময় সে জানান দিয়ে আসে, আজ জানান দেয়নি!
'মেডিকেলে কেন এলে?'
'তোমার ফুফুকে দেখতে। '
'আমার ফুফু তোমার কে হন?'
'আমি তোমাদের সঙ্গে যাব।
'
'তোমার যাওয়া নিয়ে বাড়িতে কত কথা হবে জান? এ-সব কথার উত্তর দেবে কে!'
'হোক, আমি যাব। '
'টাকা আছে তোমার কাছে?'
'হুঁ, শ'-পাঁচেক আছে। '
নাসের ভাই দশটা এম্বুলেন্স ইতোমধ্যে দেখেছেন। ড্রাইভাররা কমপক্ষে চার হাজার চাচ্ছে। নাসের ভাই আটত্রিশ শ' টাকার উপরে উঠছেন না।
আমাদের অঞ্চলের একটা গাড়ি আটত্রিশ শ' টাকায় রাজি হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। ড্রাইভার সাহেব এতে রাজি না হলে নাসের ভাই আরও বিশটা গাড়ি দরকষাকষি করতেন। লাশে পচন ধরত।
তুষি গাড়িতে উঠছে।
নাসের ভাই কিছু জিজ্ঞেস করছেন না; ফুঁসে আছেন। লোকটার উচ্চ রক্তচাপ আছে। এ-সব বিষয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও তিনি পারেন। আমি বয়সে ছোট; আমার সামনে নিজেকে খানিকটা মাতব্বরও তিনি ভাবতে পারেন। নিজের ক্ষতি নিজে করলে আমার করার কী আছে।
মাঝখানে লাশটা শুইয়ে দিয়ে আমরা দু'পাশে বসেছি। আমি আর তুষি একপাশে, নাসের ভাইয়ের মুখোমুখি। তিনি আমাদের দিকে দেখছেন না। চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, গোস্বায় তাঁর পেট ফেটে যাচ্ছে। এমন কাণ্ড তিনি হয়ত বাপদাদার জন্মেও শোনেননি।
আমি এ-সব পরোয়া করি না। আমার টাকা দিয়ে তুষি যাচ্ছে, কার কী!
গাড়ি চলছে।
নাসের ভাই দোয়া-দরুদ পড়ছেন। মুর্দার পাশে দোয়া-দরুদ পড়লে তাঁর রুহে শান্তি বর্ষিত হয়। আমি যতটুকু জানি, আমার ফুফু জীবনে বড় কোনও গুনাহ করেননি।
যৌবনে স্বামী মারা গেলেও চার-চারটি মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেননি। বিকলাঙ্গ ছোট মেয়ের সেবা করেছেন। মেয়েরা যাতে স্বামীর ঘরে শান্তিতে থাকে, সেজন্য সব সম্পত্তি মেয়েদের স্বামীদের নামে লিখে দিয়েছেন। তাঁর ভিটার খেজুরের রস পর্যন্ত ভাগ করে নামিয়ে নিয়েছেন মেয়ের স্বামীরা। তার বদৌলতে মরার আগে একটা আঙ্গুরও পাননি।
চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন। ধর্মকে খেলাপ করতে দেখিনি। এরপর তাঁর গুনাহ থাকতে পারে না। তবুও মানুষের অজান্তে কত গুনাহ হয়ে যায়। মরার পর দোয়া-দরুদের বরকতে সেটা কেটে যায়।
নাসের ভাই পড়ুন, সেটা ভাল হচ্ছে। কিন্তু, পড়ার সময় ভুল করলে মরহুমার রুহে উল্টো পাপ বর্ষিত হতে পারে। আমি দেখছি, তাঁর পড়ায় ভুল আছে।
'নাসের ভাই, আপনি ভুল পড়ছেন। আপনার ক্বাফ, সোয়াদ উচ্চারণ শুদ্ধ হচ্ছে না।
'
নাসের ভাই কিচ্ছু বলেননি। তিনি এবার ছোট ছোট করে পড়ছেন। মাখরায ঠিক মতো হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। তুষি আমাকে গুঁতো দিয়ে বারণ করছে।
আমি বললাম, 'আমি তো ভুল কিছু বলিনি।
'
তুষি বলল, 'তুমিও পড়। শুদ্ধ করে পড়। '
'শুদ্ধ করে পড় মানে?'
'পড়তে বলছি। '
মন চাচ্ছিল তুষিকে শক্ত কিছু একটা শুনিয়ে দিই। কিন্তু মুর্দা সামনে রেখে এটা ঠিক হবে না।
নাসের ভাইয়ের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলতে মন চাচ্ছে।
'নাসের ভাই, নাসের ভাই। '
'বল। '
'দূরের পথ; আমাদের তো কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। '
'তোরা খা, আমি খাব না।
'
'সেটা একটা কথা হল, আমরা খাব আপনি খাবেন না!'
'বললাম তো, আমার ক্ষিদে নেই। '
'রাত হয়ে গেলে পথে দোকান খোলা পাওয়া যাবে না। '
আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। ছোটখাট একটা বাজারের সামনে গাড়ি থেমেছে। তখন রাত আটটা।
এই বাজারে মিষ্টি জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে না। তুষি ভাতের সঙ্গে ভর্তাজাতীয় কিছু পছন্দ করে, এসব এখানে থাকবে না। এটাও কম বিপদ নয়। রুচিমাফিক খাবার না পেলে খাওয়াটাই অসার।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার সাব, সামনে চল।
বড় কোনও বাজার পেলে দাঁড়াবে। '
গাড়ি ফের স্টার্ট নিতে সময় নিচ্ছে। তেলও আছে। ইঞ্জিনে বোধহয় ডিস্টার্ব আছে। আল্লাহ না করুন, মাঝখানে যান্ত্রিক সমস্যা হলে মহাবিপদ হবে।
ড্রাইভারকে বললাম, 'বিসমিল্লাহ বলে স্টার্ট করনি?'
ড্রাইভার বলল, 'করেছি। '
খোদার মরজিতে গাড়ি স্টার্ট হয়েছে।
নাসের ভাই এখন ছোট করে বিলাপ টেনে টেনে পড়ছেন। তাঁর কাঁদার অভ্যাসটা নতুন নয়। স্ত্রীর ডেলিভারি সমস্যার সময়ও তিনি কেঁদেছিলেন।
আসলে, কান্না আসার জন্য মুক্ত মন দরকার। হাজারো ঝামেলা এসে চেপে ধরলে বিশেষ কোনও ঘটনায় কান্না আসে না। স্ত্রীর ডেলিভারির সময় সব খরচ বহন করেছিলেন শ্বশুর। আর এখন গাড়িভাড়াটা এডভান্স করেছি আমি। সুতরাং, তাঁর কান্না না এসে কার আসবে! আমার মাথায় ঝামেলার যে পাহাড়, তাতে কান্না আসতে সময় লাগবে।
গাড়িটা একটা বড় বাজারের সামনে গিয়ে থেমেছে। আমি বড় মিষ্টির দোকান দেখতে পাচ্ছি। বড় হোটেলও দেখতে পাচ্ছি। এসব হোটেলে গলাকাটা দাম হয়। গলাকাটা হোক, হাতকাটা হোক, খেতেই হবে।
আমরা ঘরে পৌঁছুতে নির্ঘাত রাত দু'টা বেজে যাবে। লাশের পাশে নাসের ভাই বসে আছেন। কিছু বলছেন না। নামছেনও না। তাঁর জন্য কলা-পাউরুটি নিয়ে আসব।
হোটেলে ঢুকেছি। আমরা ভাত, ভর্তা ও মাংসের অর্ডার দিয়েছি। হোটেলের লোকজন তুষির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এর আগে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে আমি অনেকবার উত্তেজিত হয়েছি। অনেকের সঙ্গে হাতাহাতিও হয়েছে।
যুবক ধরনের এক বয় তুষির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলছে, 'স্যার গরম পানি দেব?'
'লাগবে না। '
'কোক-টোক লাগবে?'
'এ-ই গাধা, ঠাণ্ডা বাতাস হচ্ছে, দেখছ না!'
'আপনি অভদ্রভাবে বলছেন কেন?'
'দেখ্, আমি যদি ভদ্র না হতাম, তোর মুখে গরম ডাল মেরে দিতাম। '
বয়ের পক্ষে আরও একজন এসেছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে খাবারের দিকে মনোনিবেশ করলাম। শুধু ডালটা গরম, বাকি সব ঠাণ্ডা।
ভর্তা তো কোনও রকম খাওয়া যায়। মাংস ঠাণ্ডা হলে বিড়ালেও খায় না! শালার হোটেল-অলাদের রুচি কী রকম! ওরা দু'জন সরে গেছে।
আমি বললাম, 'এ-ই তুষি, অন্য কিছু খাবে?'
'না, চলবে। রাতটা কোনও রকম পার করতে পারলে হল। '
'আচ্ছা তুষি, একটা কথা বলি?'
'বল।
'
'আজ আমরা ঝগড়া করব না, কী বল?'
'ঝগড়া তো তুমিই শুরু কর। '
'আজ করব না। '
আমি বললাম, 'আরেকটা কথা বলি?'
'বল। '
'আমাকে সহ্য করতে তোমার কষ্ট হয়, তাই না?'
'এ-সব কেন বলছ?'
'আমার সঙ্গে যখন কথা বল, তখন কি ভালোবেসেই বল?'
'এ-সব কথা বলার সময় অনেক হবে। নাসের ভাই লাশ নিয়ে বসে আছেন।
'
নাসের ভাইয়ের জন্য কলা-পাউরুটি নিয়েছি। কিন্তু তিনি নেবেন না। নেবেন না তো না নিন, শক্ত কথা বলার দরকার কী! তিনি বললেন, 'লাশ সামনে নিয়ে কোনও মানুষ পেট পুরে খেতে পারে, আগে দেখিনি!'
'নাসের ভাই, কথাটা কি আমাকে বলছেন?'
'না। '
তুষি আমাকে গুঁতো দিয়ে ঝগড়ায় যেতে বারণ করছে। মনে মনে ভাবছি, এই কথাগুলোর জবাব একদিন না একদিন দেব ইনশাআল্লাহ।
কথার মুরব্বিয়ানাকে আমি থু মারি।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার, গাড়ির ইঞ্জিনিয়ার পেয়েছ?'
'গাড়ি আর সমস্যা করবে না। নিজেই ঠিক করে নিয়েছি। '
গাড়ি চলছে। আমরা কর্ণফুলী সেতু পার হয়ে এসেছি।
রাত বারটার পর আরও কয়েক মিনিট হয়েছে। নাসের ভাই ঘুমাচ্ছেন। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। তুষিও আমার কাঁধে মাথাটা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
আমি বললাম, 'এ-ই তুষি, শোনো, নাসের ভা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।