কিছুটা কালোয়, কিছুটা সাদায়
পুলিশের নির্দেশ অনুযায়ী আমি তার পেট, পিঠ, তলপেটের চারপাশে একবার শক্ত করে হাত বুলিয়েছি। তার দেহের বেড় এত সুন্দর সুঠাম, আগে স্রেফ দেখেছি; এখন নিজ হাতে তা পরখ করেছি, চমৎকার! এরপর তার কোমরটাকে তন্ন তন্ন করার নির্দেশ পাই। আমি যথাযথভাবে নির্দেশ পালন করেছি। তুষি সাবলীল দাঁড়িয়ে আছে। তার উরু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত শক্ত করে চেপে চেপে পুলিশদের দেখিয়েছি, ওখানে কিছু নেই।
পুলিশের একজন বলল, 'আপনাদের গাড়িতে আর কে?'
আমি বললাম, 'ড্রাইভার আর ফুফুর লাশ। '
'ড্রাইভারকে আসতে বলুন। '
ড্রাইভারও হাত উঁচিয়ে এসেছে। তার সারাদেহ তল্লাশি করা হয়েছে।
একজন বলল, 'চলুন গাড়ি সার্চ করব।
'
আমরা সবাই এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে একজন আমাদের বলল, 'থামুন, এখানেই দাঁড়ান। আমাদের লোক গিয়ে গাড়ি তল্লাশি করবে। '
আমি বললাম, 'আমার একটা অনুরোধ, ফুফুর লাশে পচন ধরেছে। একটু সতর্কভাবে নাড়াচড়া করবেন।
'
আমরা দাঁড়িয়ে আছি। পুলিশের লোক আমাদের গাড়ি তল্লাশি করছে। আমার ফুফুকে তারা একটা লাঠি দিয়ে বাইরে থেকে গুঁতো দিচ্ছে। তারা নিশ্চিত হয়েছে, এটা লাশ; লাশের মতো করে কেউ শুয়ে থাকেনি। আমি দেখছি, লাশের গন্ধে তারা ভেতরে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি।
ভালয় ভালয় সব হয়েছে। তুষি না থাকলে বড় বিপদ হতে পারত। এবার আমাদের ঘরে যাওয়ার পালা। বাড়িতে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই চিন্তায় পড়ে গেছেন।
পুলিশের একজন বলল, 'আপনাদের কাউকে থানায় যেতে হবে।
'
তুষি বলল, 'কেন?'
'আপনাদের গাড়ির আঘাতে আমাদের এক কনস্টেবলের হাত ভেঙে গেছে। তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। সকাল নাগাদ ফিরতে পারবেন। '
তুষি বলল, 'আমরা লাশ ফেলে কিভাবে যাব!'
'আপনি লাশ নিয়ে বাড়ি যান।
লোকটা আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন। '
'না, পারেন না। '
'কেন?'
'আমি যাব। '
তুষি আমাকে লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে বলছে। আমি মানছি না।
একজন মেয়েকে একা আমি কতগুলো পুরুষের হাতে তুলে দিতে পারি না। হোক তারা পুলিশ। পুলিশের অনেক কাহিনী আমি শুনেছি।
আমি বললাম, 'আমরা সবাই যাব; লাশও যাবে। '
একজন আমাকে বলল, 'লাশের সঙ্গে আমাদের কেউ যাবেন।
আপনি আমাদের সঙ্গে থানায় আসুন। '
আমি বললাম, 'দেখুন, আমার স্ত্রী নতুন গ্রামে যাচ্ছে; লাশ নিয়ে তার একাকী যাওয়াটা ঠিক হবে না। '
'আমরা আপনাদের গ্রেফতার করতে চাচ্ছি না। বাড়াবাড়িতে গেলে গ্রেফতার করব। '
তুষি বলল, 'দিদার, তুমি লাশ নিয়ে যাও।
সকালে আমি বাড়ি ফিরব। '
তুষির কথায় আমল দিয়ে আমি বললাম, 'যাও, বাকি খোদার মর্জি। '
তুষিকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিয়েছি। তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে পুলিশরা বসেছে। আমরা বাড়ির দিকে যাচ্ছি।
আর কোনও বিপদ না এলে ঘণ্টাখানেক পর আমরা বাড়ি পৌঁছুব।
গাড়ি চলছে। আকাশটা আরও ফর্সা হয়েছে। গাড়ির জানালা ভেদ করে জোছনা ঢুকে পড়ছে। জোছনা কখনও ফুফুর মুখে, কখনও আমার মুখে, কখনও তুষি যেখানে ছিল সেখানে আছড়ে পড়ছে।
তুষি যখন ছিল, তখন জোছনা ছিল না। তুষির মুখে জোছনার আলোটা গিয়ে পড়লে কী রকম দেখাত! সব সুন্দর একসঙ্গে দেখা যায় না, এটাই নিয়ম।
আমি এখন একা। অসংখ্য ভাবনায় নিমজ্জিত হচ্ছি। তুষির পাশে যে পুলিশটা ছিল, সে হয়ত এতক্ষণে তুষির আরও কাছাকাছি চলে এসেছে।
কিছুক্ষণ পর তুষির গায়ে ধাক্কা লাগবে। তুষির যদি ঘুম আসে, পুলিশটা অন্ধকারে তুষির গায়ে হাত দেবে। তুষির ঘুম ভাঙলে এ-নিয়ে একটা হাঙ্গামা বাঁধবে। আমি মনে মনে আল্লা-আল্লা করছি, তুষির ঘুম না আসুক। পুলিশের সবাই তাগড়া যুবক।
তুষির গায়ে লাগলে আমি যেমন একটু উত্তেজিত হই, ওরাও তেমন হতে পারে।
ফুফুর শরীর থেকে এখন যে গন্ধটা বেরুচ্ছে, তা সহ্য করা যাচ্ছে না। নাকে রুমাল দিয়েছি। এখন তুষি থাকলে গন্ধটা কিভাবে সইত! সে গন্ধ বেশি হলে সইতে পারে না; বমি করে দেয়। পুরুষদের গায়ে ঘামের গন্ধ তো থাকবেই।
না, তুষি বলে কি, 'এই এখনই গোসল সেরে নাও। ' দিনে কয়বার গোসল করা যায়! একদিন তিনবার গোসল করার পর আমার নাক দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করেছিল।
আমি মনে মনে কত কী ভাবছি। একা থাকলে আমার সময় কাটে ভাবতে ভাবতে। ভাবি আর গুনগুন করে গান করি।
আমার এখন তুষির প্রিয় গানটি গাইতে ইচ্ছে করছে।
তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ!
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী, বলে না তো কিছু চাঁদ।
চেয়ে চেয়ে দেখি ফুটে যবে ফুল
ফুল বলে না তো সে আমার ভুল
মেঘ হেরি ঝুরে চাতকিনী, মেঘ করে না তো প্রতিবাদ।
এই গানটা সে মাঝে মাঝে গায়। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'তুষি, তোমার কথা মনে পড়লে আমি কোন গানটা গাইব ?'
তুষি বলেছিল, 'কেন, আমার 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি...' গানটাই পছন্দ, তুমি চাইলে সেটাই গাইতে পার।
'
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আচ্ছা, আমার জন্য মন কাঁদলে তুমি কোন গানটা গাও?'
তুষি বলেছিল, 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি...'
এরপর থেকে একা বসে ভাবতে ভাবতে আমি গানটাই গাই। এখন তুষি নেই। তার জন্য মন কাঁদছে। রাতের বেলায় আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে এ-রকম মন কাঁদে না। দিনে মেঘ থাকলে মন কাঁদে, আর রাতে জোছনা থাকলে।
চাঁদটাকে মেঘ এসে ঢেকে দিলে ভাল হত। না, চাঁদের আলো আরও পরিষ্কার হচ্ছে। আমি যতই তুষির উল্টো দিকে যাচ্ছি আর যতো জোছনা এসে গাড়ির ভেতর ঢেউ খেলছে, ততই আমি বিষন্ন হয়ে যাচ্ছি। লাশ আছে; এখন গান গাওয়াটা সমীচিন হবে না।
তুষি একবার আমাকে বলেছিল, মন যা চায়, তাই করা ভাল।
ভাল বলতে, স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কাজ করলে মানসিক স্বাস্থ্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। মন অসুস্থ হলে শরীরও অসুস্থ হয়। অবশ্য, তুষি কথাটা যখন বলেছিল, তখন আমার পাশে ছিল তুষি, লাশ ছিল না। এখন আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে।
ঐ গানটাই- 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি...। '
এই গানের ব্যাখ্যা নিয়ে একবার ঝগড়া হয়েছিল তুষির সঙ্গে। তুষি গানটি গাইছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'তোমাকে দেখলে কি কেউ তাকিয়ে থাকে?'
'থাকে। '
'তাকে তখন কি তুমি খারাপ কিছু বল?'
'আগে বলতাম, এখন বলি না।
'
'এখন কি তাকে তোমার ভালো লাগে?'
'হ্যাঁ। '
'ছিঃ। '
তুষি হেসে বলেছিল, 'তুমি জান সে কে?'
'কে?'
'তুমি। '
এরপর তার দিকে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। সে আবার গাইতে শুরু করেছিল, 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি...।
'
লাশ পাশে রেখে গুনগুনিয়ে গাইতে শুরু করেছি আমি। নাসের ভাই থাকলে গান গাওয়া যেত না। নাসের ভাই সুরা পড়তেন, আর আমি ভুল ধরার চেষ্টা করতাম। জানি না, বেচারার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে কিনা।
গাড়ি চলছে।
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, 'ভাই, কোন দিকে যাব?'
'কোন দিকে যাব মানে!'
'সামনে দুইটা পথ, কোন দিকে যাব?'
'দুইটা পথ এল কোথা থেকে!'
এটা নিশ্চিতভাবে গানের কুফল। গানের সুফল-কুফল দুইটা আছে। গান গাইলে মন ভালোও হয়, খারাপও হয়। গান গাইলে দুনিয়ার অন্যকিছুর দিকে খেয়াল থাকে না। যাচ্ছি পুকুরিয়ায়, অথচ আমরা খাগরিয়ার দিকে চলে এসেছি অনেক দূর।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও। '
ড্রাইভার বলল, 'একটা কথা বলি?'
'বল। '
'এমন অদ্ভুত মানুষ আমি আর দেখিনি। '
'আমার কথা বলছ?'
'লাশ সামনে নিয়ে কেউ গান গায়!'
'তুমি বুঝবে না, বুঝলে কথাটা বলতে না। তুমি হলে ড্রাইভার।
'
'আমি ড্রাইভার বটে, তোমার মতো ফালতু লোক না। '
'এ-ই তুমি কাকে ফালতু বললে?'
'তোমাকে। '
এ-সব মেয়েলি ঝগড়া। এ ঝগড়া কথায় কথায় হতেই পারে। এ-জন্য গাড়ি থামিয়ে ফেলতে হয় না।
ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বলেছে, 'আর যাব না মিয়া। '
'কেন যাবে না?'
'গেলে একহাজার টাকা বেশি দিতে হবে। '
'দেব, বার শ' টাকা বেশি দেব। '
'মানে?'
'মানে আবার কী, আরও টু হান্ড্রেড টাকা বেশি। '
'এ-সব গান-টান গাড়িতে আর করবে না।
ভাগ্যলক্ষ্মী বলতে একটা কথা আছে। রাস্তা তো ওলট-পালট হবেই। '
'হ্যাঁ করব না। '
'যত্ত সব ফালতু। '
'হ্যাঁ আমি ফালতু।
'
ড্রাইভার গিজগিজিয়ে গাড়ি আবার স্টার্ট করেছে। আমি জানতাম সে স্টার্ট করবে। এখানে আশেপাশে ঘরবাড়ি আছে। আমি যদি এখন চিল্লাই, লোকজন আসবে। বিচার হলে কেউ তার পক্ষে রায় দেবে না।
সবাই বলবে, লাশ নিয়ে যাও। যেতে না চাইলে দু'-একটা লাথিও খাবে। তাছাড়া, তাকে অ্যাডভান্স করেছি সামান্য, আরও তিন চতুর্থাংশ বাকি।
গাড়িটা দুই কিলোমিটার পথ উল্টো এসেছে। রাতের বেলা এই পথ পাড়ি দিতে হলে আমারও খারাপ লাগত।
এখন আমরা ঠিক পথে উঠেছি। গাড়ি চলছে। আমি এখন মনে মনে গাচ্ছি, ড্রাইভারের ভয়ে শব্দ করছি না।
দুনিয়ার এ এক অদ্ভুত নিয়ম। তুষিকে আমি কখনও ভয় পাইনি, আজ পাচ্ছি; আজ তাকে সমীহ করে চলতে হচ্ছে।
ড্রাইভার আমাকে 'ফালতু' বলে বেঁচে যাবে কখনও ভাবিনি, আজ সে আমাকে যেমন ইচ্ছা বলে যাচ্ছে। আজ তাকে আমি ভয় করছি।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার, এখন আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি। গান গাইতে পারব?'
সে গাড়ি আবার ব্রেক করেছে।
আমি বললাম, 'সরি ড্রাইভার, গান গাব না।
'
ড্রাইভার বলল, 'মাইকে শব্দ শুনতে পাচ্ছ?'
'হ্যাঁ পাচ্ছি, কী বলছে?'
'কোথাও ডাকাতি হচ্ছে। '
'অসুবিধা নেই, এখানে প্রতিরাতেই ডাকাতি হয়। '
'মানে?'
'মানে বাদ দাও, আমি গান ধরব। '
'এখন আমি কোন দিকে চালাব?'
'সামনের দিকেই চালাবে। '
'ডাকাত পড়লে?'
'আমাদের কাছে সুন্দরী মহিলা নেই, টাকা নেই, মূল্যবান কিছু নেই, একটা লাশ আছে; ডাকাত এলে লাশটা দিয়ে দেব!'
ড্রাইভার বড় করে 'বিসমিল্লাহ' পড়েছে।
দোয়া-দরুদ পড়ে সিনায় ফুঁ দিয়েছে। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'ড্রাইভার, গাড়িতে ওঠার সময় বিসমিল্লাহ পড়নি?'
ড্রাইভার উত্তর করছে না। আমি গান ধরেছি- 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়া, সে কি মোর অপরাধ!' গানে 'প্রিয়' আছে, আমি সেটাকে 'প্রিয়া' বানিয়ে গাইছি। তুষিকে উদ্দেশ্য করেই গানটি গাইছি।
ড্রাইভার কিছু বলছে না। তার ভেতর ডাকাতের ভয় ঢুকেছে। তাকে অভয় দিয়ে লাভ নেই। তার মধ্যে ভয় থাকলে, আমি যেমন ইচ্ছে করতে পারব। না হয়, সে আমার উপর মাতব্বরি করতে চাইবে।
আর পনর মিনিট পরেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব। কিছুদূর গেলেই তুষিদের বাড়ি। এখানে তুষির আম্মা থাকেন। সম্ভবত নয়নও (তুষির বড় ভাই, যে আমার নাকে ঘুষি মেরেছিল) থাকে। ভিতরে ভিতরে আমি আর তুষি যে চুটিয়ে প্রেম করছি, এটা আমাদের কিংবা তুষিদের ঘরের কেউ জানে না।
আর কিছুদূর গেলেই তুষিদের বাড়ির সামনের বটগাছটা দেখা যাবে। এই বটগাছ আমাদের অনেক স্মৃতি বহন করছে। প্রেম, ঝগড়া, প্রতারণা- অনেক স্মৃতি। এই গাছের তলায় তুষি আমার জন্য অপেক্ষা করত। আমিও তুষির জন্য অপেক্ষা করতাম।
গাছের নির্দিষ্ট একটা শেকড়ের নিচে আমরা চিঠি রেখে যেতাম। কোনও কারণে দেখা না হলে পরদিন শেকড়ের নিচে তুষির একটা চিঠি পেতাম। আমি মাঝে মাঝে অন্য শেকড়ের নিচে চিঠি রাখতাম। তুষি না পেয়ে মন খারাপ করত। অভিমান করত।
তাকে ঐ গাছের শেকড়ের নিচ থেকে যখনই চিঠিটা এনে দিতাম, সে হেসে দিত।
মোটকথা, এই বটগাছই আমাদের ভালোবাসার জীবন্ত সাক্ষী। এই গাছটাকে একবার দেখে যাওয়া দরকার। পাশে দাঁড়িয়ে গাছটাকে একবার সালাম করতে মন চাচ্ছে।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার, গাড়ি থামাও।
'
'কেন?'
'সব কেন'র উত্তর থাকে না। '
'ডাকাতি হচ্ছে, আর তুমি বলছ গাড়ি থামাতে, আশ্চর্য!'
'কিসের আশ্চর্য, বলছি, গাড়ি থামাও। '
গাড়ি থেমেছে। দেখতে পাচ্ছি, গাছটি এখন নেই; নিধন করা হয়েছে। আমার মনটা ছলছলিয়ে উঠেছে।
চোখও ছলছলিয়ে উঠেছে। হায়রে বৃক্ষ, তুমি আমাদের প্রেমে ছায়া দিয়েছ, অথচ তোমার মৃত্যুকালে আমরা তোমার পাশে থাকতে পারিনি! আমার মতো দুর্ভাগা এই জগতে দ্বিতীয়টি নেই। আমার ফুফুর মৃত্যুকালেও আমি পাশে থাকতে পারিনি।
জোছনার আলোয় আমি বৃক্ষটার শেকড়গুলো দেখছি। যেখানে আমরা চিঠি লুকিয়ে রাখতাম, সেই শেকড় নেই।
দু'টি বড় শেকড় আছে, যার একটিতে আমি আর অন্যটিতে তুষি বসত। আমি নিহত শেকড় দু'টিকে সালাম করলাম। মৃতের পিছু ছোটাই যেন আমার কাজ!
ছলছল চোখ নিয়ে আমি গাড়িতে উঠে এলাম। এ-সময় তুষি থাকলে সেও কাঁদত।
ফুফুকে আমার ধরে দেখতে ভয় করছে।
তাঁর শরীর থেকে বীভৎস দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। তাঁকে ধরতে গেলে বোধকরি দেহ থেকে মাংস খসে আসবে। আল্লা আল্লা করে আর ক'টা মিনিট, আমরা পৌঁছে যাব।
'ড্রাইভার, সামনের গেটটা আমাদের, বামে ঘোরাও। '
ফুফুর শ্বশুর বাড়ি আর আমাদের বাড়ি একই।
ফুফাকে আমি দেখিনি। তিনি আমাদের বংশের লোক। আমার আম্মা কত করে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, 'তোর দাদার দাদা দুইটা বিয়ে করেছিলেন। তোর দাদার বাপেরা এক মায়ের, তোর ফুফার দাদারা এক ভাই, তিনি অন্য মায়ের..। ' এ-সব আমার গোলমেলে মনে হয়।
এই শুনি, এই ভুলে যাই। বংশের হিসাব বলতে আমি যা বুঝি, আমরা চৌধুরী বংশের। কে এই চৌধুরী, কার নাম নিয়ে আমরা গৌরব করি, সে হিসাবও আমার নেই।
ব্রিটিশরা তাদের অনুগতদের আদর করে 'চৌধুরী' উপাধিটা দিয়েছিল। মানে, আমরা ব্রিটিশের গোলাম।
ব্রিটিশকে যখন আমরা ঘৃণা করি, চৌধুরীদের শ্রদ্ধা করার পেছনে কোনও যুক্তি থাকার কথা নয়। তবু, চৌধুরীদের মানুষ সম্মান করে। বিনা পয়সার শ্রদ্ধা পাওয়া গেলে অসুবিধা কী! যেভাবেই হোক, আমরা শ্রদ্ধেয়।
গাড়ির সাইরেন শুনে বাড়ির সবাই রাস্তার দিকে ছুটে আসছে। আমাদের বাড়ির উঠান পর্যন্ত গাড়ি যায়।
ফুফুর মেয়েরা এম্বুলেন্সের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
বিষয়টা মর্মান্তিক। একজন মানুষ ঘর থেকে জিন্দা বেরিয়েছিলেন; তিনি ফিরে এলেন মুর্দা হয়ে। অনেকের মতো ফুফুও হয়ত সবার কাছে মাফ চাচ্ছিলেন, কিন্তু সবাই বলছিলেন, 'আপনি সুস্থ হয়েই ফিরে আসবেন, ইনশাআল্লাহ। ' এখন সবার মনে কথাগুলো তীরের মত ফুটো করছে।
গাড়ি যাচ্ছে ধীরে ধীরে। পেছন পেছন নাসের ভাইয়ের বউ দৌড়াচ্ছেন; বাচ্চাটাও দৌড়াচ্ছে। আমি জানতাম, নাসের ভাইয়ের ছেলেটা হাঁটতে পারে। এখন দেখি, সে দৌড়াতেও পারে। ক'দিন পর সে 'আঙ্কেল আঙ্কেল' করে আমার কাছে টাকা চাইবে।
আমি বলব, 'তোর বাপের কাছে আমি টাকা পাই ব্যাটা। '
সবার ধারণা, লাশের সঙ্গে নাসের ভাইও আছেন। গাড়ি থেকে নেমেই যদি নাসের ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরটা বলি, কী হবে! না, এখনই সেটা বলব না। সকাল হলে বলব।
গাড়ি আমাদের উঠান পর্যন্ত আগে যেত না।
রাস্তা ছোট ছিল। ফুফু নিজের হাতে কোদাল ধরে রাস্তা সংস্কারের কাজ করেছেন। রাস্তার মাথা থেকে লাশটা যদি টেনে-হেঁচড়ে নিতে হত, বড় সমস্যা হত। নিজের হাতে করা কাজের ফল তিনি পেয়েছেন। ভাল কাজের প্রতিফল মানুষ যে কোনও একসময় পায়।
অথচ, এই কাজ করতে গিয়ে ফুফু অনেকের ঝাড়িও খেয়েছেন। আমার আব্বা বলেছিলেন, 'এ-সব কী করছ? মানুষের জায়গা কেটে তুমি রাস্তা বানাবে কেন?' ফুফু বলেছিলেন, 'মানুষের হায়াত-মউত, রোগ-বালাই আছে, একটা রিকশাও তো ঢুকতে পারবে না। '
এই কথা মনে পড়লে আব্বার কান্না থামবে না। তিনি কাঁদবেন আর চা খাবেন। প্রসঙ্গত, শোকার্ত হলে আব্বা ভাত খান না, শুধু চা খান।
আমার দাদির মৃত্যুর পর আব্বা রেকর্ড পরিমাণ চা খেয়েছিলেন। আম্মার হিসাব অনুযায়ী সে সময় তিনদিনে আব্বা খেয়েছিলেন ৭৫ কাপ চা। পরে আম্মা তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন, 'এক কাপ চায়ের দাম যদি ৩ টাকা হয়, একদিনে তুমি ৭৫ টাকার চা খেয়েছ। ' এ-নিয়ে ক'দিন পর পর আব্বাকে রাগাতেন তিনি।
গাড়ি থেকে লাশ নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার ফুফাত বোনরা বেহুঁশ হয়ে গেছে।
তারা বেহুঁশ হবেই। মা মরলে কোন ছেলে-মেয়ে সইতে পারে! মেয়েদের জামাইরাও কাঁদছেন। এটা আমার সহ্য হচ্ছে না। অসুখের সময় যারা ফিরেও তাকাননি, তাঁদের কাঁদার অধিকার নেই।
আমি আব্বাকে বললাম, 'আব্বা, এদের কাঁদতে নিষেধ করুন।
'
আমার আব্বা আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে বললেন, 'বাপ রে, মরার ঘরে কাউকে কাঁদতে নিষেধ করা যায় না। '
বেহুঁশ হলে আর কাঁদলে চলবে না। অনেক ঝামেলা সামনে। এম্বুলেন্সের টাকা দিতে হবে। ড্রাইভারকে আমি বার শ' টাকা বেশি দেব ওয়াদা করেছি।
সব মিলিয়ে এখন ভাড়া এসেছে পাঁচ হাজার টাকা। এই টাকার কথা বললে সবাই আঁতকে উঠবেন। কান্না-টান্না সব বন্ধ হয়ে যাবে।
ফুফুর বড় মেয়ের জামাইকে আমি বললাম, 'ভাইসাব, এম্বুলেন্স ভাড়ার ব্যবস্থা করুন। '
তিনি চোখটা মুছে বললেন, 'কত টাকা?'
'পাঁচ হাজার টাকা।
'
'গাড়ি কি তুমি ভাড়া করেছ?'
'কে ভাড়া করেছে, সেটা পরে; আগে টাকা দিন। '
তিনি জানেন, গাড়ি যদি আমি ভাড়া করি, তাহলে হাজার খানেক টাকা বেশি দেব। এটা সত্য, আমি দরাদরিটা একটু কম বুঝি। হকার্স মার্কেটে যে কাপড়টা একহাজার হাঁকে, নাসের ভাই সেটা চান পঞ্চাশ টাকায়। আমি দু' শ' টাকার নিচে নামতে পারি না।
এই এম্বুলেন্সটা আমি ভাড়া করলে পাঁচ হাজারের উপরে যেত। আটত্রিশ শ' টাকা নিশ্চয়ই কম। কিন্তু মাঝখানে এক গোলমাল হয়েছে, এটা এখন বলা যাচ্ছে না।
ভাইসাব বললেন, 'মেজ সাবকে একটু বলে দেখ। '
আমি বললাম, 'আমি দেখব কেন, আপনি দেখুন।
'
'বলে দেখ, দেখলে অসুবিধা কী!'
'সেটা আপনি দেখুন। আমার অসুবিধা আছে। '
এরা সবাই ধান্ধাবাজ। ফুফুর রক্ত-মাংস খেয়েছেন ওরা। ফুফুর খড়, খেজুর রস সবই ভাগ করেছেন।
দেখতে পাচ্ছি, মেঝ ভাইসাব বারান্দার এক কোণে বসে কাঁদছেন। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, শ্বাশুড়ির জন্য তাঁর মনটা ফেটে ফেটে যাচ্ছে। বড়টার কান্না থামিয়েছি, এবার তাঁরটা থামানো দরকার। আমি তাঁকে ইশারা করে ডেকেছি।
'মেজসাব, এম্বুলেন্সের ভাড়া নিয়ে আটকে গেলাম।
'
'আগে বললে না কেন! এখন টাকা কোথায় পাব?'
'ফুফু মরবেন, সেটা তো আগে জানতে পারিনি। পারলে বলতাম। '
মেজসাব সম্ভবত মাইন্ড করেছেন। আমি এই মাইন্ডের গোষ্ঠি কিলাই! এই জামাইরা যৌতুক বাবদ ফুফুর সব সম্পত্তি ভাগ করেছেন। এমন পাষণ্ড পৃথিবীতে থাকে না।
অসুখের সময় তাঁরা কেউ একবার দেখেও যাননি।
আমি দেখতে পাচ্ছি, বাকি দুই জামাই বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেন। একেবারে ছোটটা বদনা নিয়ে টয়লেটের দিকে যাচ্ছেন। এই সময় অন্ধকারে ঢুকে যেতে পারলে তাঁকে আর নির্ঘাত পাওয়া যাবে না।
আমি বললাম, 'এ-ই যে ছোটসাব, কথা আছে, টয়লেট থেকে শিগগির ফিরবেন।
'
'হ্যাঁ, আসছি। '
আমি মেজসাবকে বললাম, 'যেভাবেই হোক, পাঁচ হাজার টাকা ব্যবস্থা করুন। '
মেজসাব বললেন 'বড়সাবকে বলনি?'
'বলেছি, তিনি আপনাকে বলতে বলেছেন। '
'একটু অপেক্ষা কর। ব্যবস্থা হবে।
'
চারজনকে দেখতে পাচ্ছি, উঠানের এক কোণে গিয়ে কথা বলছেন। নিশ্চয়ই এম্বুলেন্সের ভাড়ার ব্যাপারে কথা হচ্ছে। এদের কারও এককভাবে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার কলিজা নেই।
এদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি না, এরা কী বলছেন।
আমি সবাইকে রক্তে-মাংসে চিনি। আমার মনে হচ্ছে, বড়সাব বলছেন, 'এটা কারও একার দায়িত্ব নয়। আমরা সবাই মরহুমার মেয়েদের স্বামী। আমরা সবাই ভাগাভাগি করে দেব। '
মেজসাব স্বভাবসুলভ বলছেন, 'এখানে ভাগাভাগির কথা আসবে কেন, যার কাছে আছে সে দিয়ে দিতে পারে।
আমার থাকলে আমি দিয়ে দিতাম। '
সেজসাব ধুরন্ধর লোক। তিনি নিশ্চয়ই বলছেন, 'মেজসাব তো ঠিকই বলেছেন। এখন যার কাছে আছে দিয়ে দিক। আমার কাছে তো আপাতত নেই।
'
ছোটসাবের একটু অতিআনুগত্য দেখানো স্বভাব, শয়তানের মতো। তিনি হয়ত বলছেন, 'আমি আপনাদের কথার বাইরে কখনও যাইনি, যাবও না। কিন্তু, এত রাতে কেউ তো টাকা নিয়ে বেরোয় না। '
তাদের কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি না। আমার ধারণা যদি সত্য হয়, শেষ পর্যন্ত যদি তাঁরা টাকা না দেন, আমি একটা গোলমাল বাঁধিয়ে ফেলব।
এই শয়তানগুলোর মুখোশ খুলে দেব। বড়সাব আমার দিকে আসছেন।
আমি বললাম, 'কী হয়েছে সিদ্ধান্ত?'
'একটু ধৈর্য ধর, ধৈর্যের ফল আছে। '
'ধৈর্যের কথা নয়, টাকার কথা বলুন। '
'হবে, ইনশাআল্লাহ।
'
বড়সাবের ইনশাআল্লাহকে আমি বিশ্বাস করি না। কোনও বিষয় নিয়ে প্রতারণা করার নিয়ত থাকলে তিনি ইনশাআল্লাহ বলেন।
আমি বললাম, 'কখন হবে? ড্রাইভার কী বলছে শুনছেন না?'
তিনি আমার আব্বার কাছে গিয়ে শেষমেষ তাঁদের কষ্টের কথাটা জানালেন। শাশুড়ির মৃত্যুতে এম্বুলেন্স ভাড়া দেওয়ার সৌভাগ্য তাঁদের নসিবে জুটল না, এজন্য তাঁদের কষ্টের সীমা নেই! আমি ভেটকি মেরে হাসছি।
আমার আব্বা আমাকে কাছে ডেকে বললেন, 'আলমারির ড্রয়ারে টাকা আছে।
চাবি তোর আম্মার কাছে। '
আমি বললাম, 'কিন্তু, আমার একটা কথা আছে আব্বা। '
'বল। '
'ভাইসাবরা টাকা থাকলেও দিচ্ছেন না। ফুফুর ধারে-কাছে এদের থাকার অধিকার নেই।
'
'অসুবিধে নেই। এর শাস্তি খোদার কাছে হবে। '
'এদের শাস্তি ইহকালেও হওয়া দরকার। '
'সেটা মরা-ঘরে নয়, লাশ দাফন হোক, তারপর দেখা যাবে। '
ড্রাইভার চলে গেছে।
দীর্ঘ যাত্রাকালীন অনেক সুখ-দুঃখ, ঝগড়াঝাটির এই সাক্ষীটাকে বিদায় দিয়ে আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম। এই গাড়িতে নাসের ভাইয়ের রক্তের চিহ্ন আছে, আমার গায়ে হেলান দিয়ে তুষির ঘুমিয়ে পড়ার স্মৃতি আছে। সব স্মৃতি বহন করে গাড়িটা গরগর ছুটে যাচ্ছে অনেক দূরে। এই গাড়ি, এই ড্রাইভারের সঙ্গে আমার জীবনে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমার মনটা কেঁদে উঠেছে।
একটি যন্ত্র আর একটি ঝগড়াটে যন্ত্রচালকের জন্য আমার চোখ দিয়ে দরদর পানি বেরিয়ে পড়ছে। এই কষ্ট শুধু নিজে অনুভব করার মতো।
লাশের পেটের উপর একটা লোহার বাটখারা রাখা হয়েছে। আমি জানতাম না, মরার পেটে লোহা রাখলে পেটটা দেরিতে নষ্ট হয়। মানুষের জীবনের পরতে পরতে শেখার অনেক কিছু আছে।
আমার মনে হয় না, এই লোহা লাশকে বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারবে। অনেক আনুষ্ঠানিকতা সামনে। সব কিছু সম্পন্ন করতে ফুফুর কী অবস্থা হয় জানি না!
কিছুক্ষণ পর ফুফুর সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হবে। আব্বা বলছেন, 'লাশকে সামনে নিয়ে তাঁর সম্পত্তির একটা পরিচ্ছন্ন বাটোয়ারা হওয়ার দরকার। ' ফুফুর অসুখের সময়ও এই বাটোয়ারা নিয়ে ঝি-জামাইদের মধ্যে কানাঘুষা হয়েছে।
আব্বা বলছেন, 'সব ঝামেলা শেষ হলেই বুবু'র দাফন হবে; এর আগে হবে না। '
আব্বা ইতোমধ্যে সাত-আট কাপ চা খেয়ে ফেলেছেন। তিনি, ফুফুর চার জামাই, ফজু মেম্বার, আমাদের পরিবারের সব সদস্য উঠানে গোল হয়ে বসেছেন। সবাই চা খাচ্ছেন।
ফজু মেম্বারকে আমি অনেক বছর পর দেখছি।
আমার নাকে নয়নের (তুষির বড় ভাই) ঘুষি মারার বিচার করেছিলেন তিনি। ফজু মেম্বার এখন নামে মেম্বার। গত নির্বাচনে তিনি ভোট পাননি। শুনেছি, তিনি বিচারে পক্ষপাতিত্ব করেন। পাওনার চেয়ে বেশি শাস্তি দেন।
রাগ উঠলে হাত-পা ভেঙে দেন। শুনে আমারও মনে হয়েছে, কথা সত্য। আমি আর নয়নের ঘটনায় তিনি আমার পক্ষে বিচার করেছেন। যা হোক, তাঁকে আমাদের পরিবারের যে কোনও সমস্যায় ডাকা হয়।
সম্পত্তি বাটোয়ারার বিষয়টা স্পর্শকাতর।
এতে পক্ষপাতিত্ব হলে গণ্ডগোল হবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, ফজু মেম্বার কোথাও গণ্ডগোল বাঁধাবেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ফুফুর ঝি-জামাইদের একজন ফজু মেম্বারের আত্মীয় হন।
ফজু মেম্বারের বয়সে ফারাক এসেছে বটে, চলনে-বলনে ফারাক আসেনি। বিচারের আগের সেই পুরনো ডাক এখনও হাঁকেন।
ফজু মেম্বার হাঁক দিলেন, 'দিদারের মা, হুক্কার খবর কী?'
আমি বললাম, 'মেম্বার সাব, আম্মা মুর্দার ঘরে। হুক্কা দেওয়ার মতো কেউ নেই। '
মেম্বার বললেন, 'দিদারের বাপ, পকেটে বিড়ি-টিড়ি আছে?'
'আছে। '
'কথা কি এখন শুরু হবে?'
'না, মেয়েরা একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠুক, তারপর। '
আমার ফুফাত বোনদের বিলাপ কমেছে।
এখন কেউ কেউ উঠানে আসবেন; কথা শুনবেন। সম্পত্তি বাটোয়ারা বিষয়ে তাদেরও কিছু বলার আছে। সকাল হয়েছে। বিচার-আচারে বসতে আমার মন চাচ্ছে না। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি, কখন তুষি আসছে।
তুষিকে একটা কথা বলা দরকার ছিল। সে চাইলে নাসের ভাইকে দেখে আসতে পারত। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, আবার করছেও না। সকাল বেলা তুষি এলে তার দিকে সবার চোখ পড়বে। সবাই জিজ্ঞেস করবে, কে এসেছে, কেন এসেছে।
মুর্দা দেখার জন্য কত মেয়েই তো আসছে। সে হিসেবে তুষি এলে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু তুষি ফর্সা, সুন্দরী। সবাই তার পরিচয় জানতে চাইবে। তাছাড়া, যারা আসছে, তারা সবাই কারও না কারও চেনা, কিন্তু তুষিকে কেউ চেনে না।
যদি কেউ জানে, সে লাশের সঙ্গে এসেছে, নির্ঘাত একটা ফিসফিসানি উঠবে। গ্রামের মহিলারা কারও আঁশ পেলে রশি পাকাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। অথচ, তাদের কে কী করে, সবই আমার জানা।
মুর্দা দেখতে চারদিকের পাড়াগুলো থেকে দলে দলে লোকজন আসছে। মাইকিং হচ্ছে।
এতিম ডাকা হয়েছে। এতিমরা মুর্দার চারপাশে বসে কোরান খতম দেবে। ফুফুদের পরিবার, এতিম সবাইকে একবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে আমাদের ঘরে। একবেলা আমার আম্মা করবেন, পরের বেলা করবেন নাসের ভাইয়ের স্ত্রী, এভাবে পালাক্রমে তিনদিন চলবে। লাশের ঘরে তিনদিন রান্না-বান্না নিষেধ।
নাসের ভাইয়ের স্ত্রী আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কিরে দিদার, তোমার ভাই আসেননি?'
'এসেছেন। '
'কই, দেখলাম না তো!'
'দেখবেন। '
'কী সব বলছ, এখন কোথায়?'
আমি ভাবিকে একদিকে ডেকে নিয়ে গেলাম। বললাম, 'ভাবি, একটা কথা বলব, ঘরে কাউকে এখন বলা যাবে না। পরে বলা যাবে।
'
'বলব না। '
'কসম করুন। '
'খোদার কসম। '
'বিচলিত হবেন না, শুনুন, আসার সময় গাড়ি ছোটখাট একটা এক্সিডেন্ট করেছে। নাসের ভাই হাতে আঘাত পেয়েছেন।
তাঁকে সাতকানিয়া হাসপাতালে রেখে এসেছি। '
'সত্যি করে বল, বেশি আঘাত পেয়েছে, না সামান্য!'
'সামান্য। '
'কসম করে বল। '
'খোদার কসম। '
'দিদার, তাঁকে দেখতে যাওয়াটা কি ভাল হবে না?'
'হবে।
কিছুক্ষণ পর আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরুব। '
'হ্যাঁ। '
'শুনুন, আমার কাছে টাকা নেই। হাতে টাকা রাখবেন। '
'কত টাকা লাগতে পারে।
'
'যা আছে সব রাখবেন। '
'আমার কাছে তোমার ভাইয়ের দশহাজার টাকা আছে। '
আমি ভাবিকে লাশ দাফনের পর যেতে বলতে পারতাম। কিন্তু নাসের ভাইয়ের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। রক্তক্ষরণ শেষ পর্যন্ত বন্ধ করা না গেলে বিপদের আশঙ্কা আছে।
আমার ভয় হচ্ছে। আমরা ট্যাক্সি নিয়ে বের হওয়ার পর যদি তুষি আসে, সে বিচলিত হয়ে আমাকে খুঁজবে। কারণ, এই ঘরে আমিই কেবল তার পরিচিত।
সম্পত্তি বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উঠান মানুষে গমগম করছে।
সূর্য উঠেছে। তুষি এখনও আসেনি। আমি আর ভাবি সবার অজান্তে সাতকানিয়ার উদ্দেশে বের হচ্ছি। কিছুক্ষণ পর হন্যে হয়ে আমাদের খোঁজা হবে।
ট্যাক্সি নিয়ে সাতকানিয়া যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা।
ভাবি আর আমিই যাচ্ছি। ভাবি ছেলেটা কার হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন জানি না। ছেলেকে একা রেখে তিনি কোথাও যান না। আজ যাচ্ছেন। সম্ভবত স্বামীর আহত হওয়ার খবর শুনে হ-য-ব-র-ল হয়ে গেছেন।
স্বামী খুব আদরনীয় বস্তু। জানি না, তুষি আমার জন্য এমন করে কিনা! ক্ষণে ক্ষণে তুষির কথা মনে পড়ছে।
গাড়ি চলছে। আমি ভাবছি, ভাবিকে এখন যদি যথাযথ ঘটনাটা না বলি, তিনি নাসের ভাইকে হঠাৎ দেখে হার্টফেল করবেন। বিপদের খাতায় আরও একজনের নাম যোগ হবে।
সব ঘটনা একসঙ্গে বলব না, একটু একটু করে প্রস্তুত করে তুলব। এটাও আমি শিখেছি তুষির কাছ থেকে। সে কোনও খারাপ ঘটনা একসঙ্গে বলে না, ধীরে ধীরে বলে। আমাকে ঐ ঘটনার প্রতি প্রস্তুত করে তোলার জন্যই নাকি এভাবে বলে। যাক, এটা ভাল।
'ভাবি,আসল ঘটনাটা হচ্ছে..'
'কী!'
'তেমন কিছু না, হাত দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। '
'রক্ত বেশি যাচ্ছে?'
'না, তেমন বেশি না। আচ্ছা ভাবি, একটা মেয়ের কথা বলি। '
'কোন মেয়ে?'
'আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি..'
'দিদার, এ-সব বলার সময় এখন নয়। '
'কেন ভাবি!'
'ঘরে লাশ, তোমার ভাই মেডিকেলে।
আচ্ছা, ডাক্তাররা কী বলেছে?'
'বলেছে, এখানে রক্তপাত বন্ধ না হলে শহরে নিতে হবে। '
'কী বলছ!'
ভাবি একটা নিঃশ্বাস ফেলে গদিতে হেলান দিয়েছেন।
ভাবি বললেন, 'দিদার, কোনও গাড়ির সঙ্গে কি ধাক্কা লেগেছিল?'
'না, আমরা ডাকাতের কবলে পড়েছিলাম। '
'তারপর?'
'নাসের ভাই এক ডাকাতকে থাপ্পড় মারে। ডাকাত বেটি সঙ্গেসঙ্গেই নাসের ভাইয়ের হাতে গুলি করে।
'
'ডাকাত বেটি মানে?'
'হ্যাঁ, এক ডাকাত ছিল মহিলা। '
'গুলি হাতে করেছে, না অন্য কোথাও?'
'হাতে। হাতের রগগুলো সম্ভবত ছিঁড়ে গেছে। '
'ডাক্তাররা কি রক্তপাত বন্ধ করতে পারছিল না?'
'ডাক্তার ছিল না। নার্সরা চেষ্টা করছিল, পারছিল না।
'
'তুমি এ-সব আগে বলনি কেন!'
'বললে আপনি চিল্লাচিল্লি করতেন। মরার ঘরে বিশ্রী কাণ্ড হত। '
ভাবি হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাঁর নাক দিয়েও পানি বেরুচ্ছে। নাকের শিকনি আর চোখের পানি এক হওয়া অলক্ষুণে।
তাছাড়া, মেয়েদের নাক দিয়ে শিকনি বের হলে খুব বিশ্রী লাগে। চোখের পানি বের হলে মেয়েদের সুন্দর লাগে।
আমি বললাম, 'ভাবি, নাক মুছে ফেলুন। '
তিনি ক্ষণে ক্ষণে নাক মুছছেন; নাকটা লাল হয়ে উঠেছে।
আমার প্রতিবেশি ভাবিরা নাসের ভাইকে বউপাগলা বলেন।
আমার এখন প্রশ্ন জাগছে, ভাবিকেও স্বামীপাগলা উপাধি দেওয়া দরকার। মেয়েরা মেয়েদের ছোট করে না। আজ বিপদটা কাটুক। পাড়ার সব ভাবির কাছে গাড়ির ভেতর তাঁর কান্নাটা অভিনয় করে দেখাব।
'ভাবি, আপনি কি এখন নাসের ভাইয়ের জন্য কাঁদছেন?'
'তুমি কথা বলবে না, প্লিজ।
'
'তাহলে আপনি একা যান, আমি যাব না। '
ভাবি আমার হাতটা চেপে ধরেছেন। আমার খারাপ লাগছে। আমাদের দেবর-ভাবি সম্পর্কটা শুকনো। ভাবি আমাকে ডাকেন 'গেছো'।
'গেছো' বলে সম্ভবত তিনি আমার মনকে গাছের মত শক্ত বোঝাতে চান। সত্যি, আমার মন গাছের মতো শক্ত; ভাবির সঙ্গে মিশি না।
আমি বললাম, 'ভাবি, হাতটা ছাড়বেন?'
তিনি হাতটা ছেড়ে দিয়েছেন বটে, আরও কাছে এসে বসেছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'বিয়ের আগে আপনি কি ভাইয়ার সামনে কোনও সময় কেঁদেছিলেন?'
'দিদার, এখন কি এ-সব জিজ্ঞেস করার সময়!'
'হ্যাঁ, সময়। আমি আপনাকে যে মেয়েটার কথা বলছিলাম, সে আমার সামনে কখনও কাঁদেনি।
'
ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, 'তার নাম কী?'
'তুষি। '
'হিন্দু না মুসলমান?'
'হিন্দু হলে আপনার কোনও অসুবিধা আছে?'
'হিন্দু হলে এ-বিয়েতে আমার মত নেই। '
'ভাবি, তাহলে আপনার সঙ্গেও আমি নেই। আমি নেমে যাচ্ছি। '
'এটা কি তুমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করছ?'
আমি ড্রাইভারকে ট্যাক্সি থামাতে বললাম।
গতরাত যে জায়গায় পুলিশের লোকেরা তুষিকে নিয়ে গিয়েছিল, আমি সেখানে মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবির পাশে যখন গিয়ে বসেছি, তখনও আমার চোখ টলটল করছে।
ভাবি বললেন, 'তুমি কাঁদছ কেন?'
'তুষিকে আমি খুব ভালোবাসি ভাবি। '
'সে এখন কোথায়?'
'সম্ভবত থানায়। '
'থানায় কেন?'
'পুলিশের লোকেরা সঙ্গে নিয়ে গেছে।
'
আমি ভাবিকে আমাদের পুরো ঘটনাটা বললাম। ভাবি গভীর মনযোগ দিয়ে আমার সব কথা শুনলেন। আমাদের প্রেম এবং গতরাতে তুষিকে হারিয়ে ফেলার বেদনায় ভাবিও বিষন্ন হয়ে উঠলেন।
পৃথিবীতে কালক্রমে হাজারো ঘটনা ঘটে। এগুলোর কোনটা বড় কোনটা ছোট, কোনটা কোনটাকে ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বোঝা মুশকিল।
আমাদের ঘরে লাশ, হাসপাতালে নাসের ভাই কাতরাচ্ছেন, এরপরও তুষির না ফেরার বিষয়টা আমাদের মনকে ক্ষতবিক্ষত করছে। তুষির জন্য আমি কাঁদছি। ভাবিও চোখ থেকে তুষির জন্য নতুনভাবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন।
আমাদের ক্রস করে যাওয়া প্রায় সবগুলো গাড়ি আমি দেখছি। তুষি আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়েও আমাদের ঘরে পৌঁছে যেতে পারে।
নাসের ভাইকে দেখার পর আমরা থানায় গিয়ে তুষির খবর নেব।
আমরা থানা পার হয়ে হাসপাতালে ঢুকেছি। নাসের ভাই ঘুমিয়ে আছেন। ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। নিথর ঘুমে আচ্ছন্ন নাসের ভাই।
চেহারাটা সাদা হয়ে গেছে। শ্যামলা বর্ণের মানুষ এ-রকম সাদা হয়ে যায়! রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি, কমেছে। ডাক্তার নেই, নার্সরা যে যেভাবে পেরেছেন, নাসের ভাইয়ের আকুতিতে চেষ্টা করেছেন। খবর নিয়ে জেনেছি, রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার কার্যকর কোনও ওষুধ তাঁরা দিতে পারেননি। আপাতত ব্যান্ডেজ দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়েছে।
নার্সরাও সন্দেহ করছেন, তাঁর হাতের অনেকগুলো রগ ছিড়ে গেছে।
ডাক্তাররা বৃহস্পতিবার প্রায়শ আসেন না। এলেও তেমন রোগী দেখেন না। হাফ ডে'তে হাজিরা দিয়ে চলে যান। কথাটা শুনে কিঞ্চিত উত্তেজিত হই।
কিন্তু এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়! আমাদের দেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত এটা কালক্রমে স্বাভাবিক হয়ে চলে আসছে। তাছাড়া, এটা গ্রামের হাসপাতাল। এখানে তদারকির কেউ নেই। ডাক্তার নিজেই এখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তুষির ভাষায়, এটা মগের মুল্লুক।
ভাবি পাথর হয়ে নাসের ভাইয়ের পাশে বসে আছেন। আমি নার্সকে একপাশে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'রোগী কি বেঁচে আছেন?'
'অবস্থা খুবই খারাপ। এখনই শহরে না নিলে সমস্যা হতে পারে। '
আমি নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এখানে কি একটা মেয়ে আমাদের রোগী দেখত।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।