কিছুটা কালোয়, কিছুটা সাদায়
এ-মুহূর্তে হয়ত তুষির কথা ভাবির ভাল লাগছে না। লাগার কথা নয়। এখন তাঁর কাছে স্বামীই চিন্তার বিষয়। তিনিও হয়ত বুঝতে পারছেন, শিগগির শহরে না নিলে নাসের ভাই টিকবেন না।
আমি টেলিফোন করে আমার আব্বার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি।
এম্বুলেন্স দরকার। কিন্তু অজপাড়া গ্রামের হাসপাতালে এম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। ট্যাক্সি করে নাসের ভাইকে নিতে হবে। ভাবি নাসের ভাইকে জাগানোর চেষ্টা করছেন।
এখন আমি নির্ঘুম কান্ত বিষন্ন আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত মাথা নিয়ে হাঁটছি।
প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। মানুষ হিসেবে যে সাধারণ চিন্তাটুকু মাথায় কাজ করে, সেটা এখন করছে না। এই মুহূর্তে আমার খাওয়া দরকার। খেয়েই আব্বাকে রিং দেব।
এই এলাকায় প্রচুর মিষ্টির দোকান আছে।
এখন মিষ্টি আমার স্রেফ পেটের ক্ষুধা মেটাবে। এ-ভয়ঙ্কর মনের ক্ষুধা মেটানোর কোনও মহৌষধ বোধকরি ইহজগতে তৈরি হয়নি। আমার কাছে টাকা নেই। ভাবির টাকা নিয়ে আমি খাব। মহিলা মানুষদের টাকায় কিছু খাওয়ার মতো বোকামি আর হয় না! যে কোনও সময় খোটা দিয়ে বসে।
সবদিক থেকে আমি এখন অসহায়।
চরম ুধা নিয়ে আমি থানার দিকে যাচ্ছি। হাত-পা কাঁপছে।
থানায় ওসি সাহেব নেই। ওসি সাহেবের দরকারও নেই।
চারিদিকে দেখছি রাতের কাউকে দেখি কিনা। এক পুলিশ কনস্টেবলকে ডেকে আমার সব কথা বলি। ঐ ভদ্রলোক আমার উপর সদয় হয়েছেন। আমি থিরথির কাঁপছি।
ভদ্রলোক আমাকে ভেতরে ডাকলেন।
তিনি আমাকে হাজতে নিয়ে গেলেন। দেখি, হাজতে তুষি বসে আছে। সে আমাকে দেখেছে। তুষিকে পাগলের মতো মনে হচ্ছে। চুল, মুখ, কাপড়- কোনও কিছুতেই তুষির আগের অবস্থা নেই।
সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে, কথা বলছে না। আমিও তার সঙ্গে কথা বলছি না। আমি বুঝতে পারছি না, বিষয়টা কী হয়েছে।
ডিউটি অফিসারের কাছে জানলাম, তাকে গ্রেফতার করা হয়নি, আটক করা হয়েছে। ছেড়ে দেওয়া হবে।
আমি ডিউটি অফিসারকে বললাম, 'এখনই ছেড়ে দেওয়া যায় না?'
তিনি বললেন, 'না, আনুষ্ঠানিকতা বাকি আছে। '
আমি তুষির কাছে পুলিশের আসল পরিচয় শুনেছিলাম- 'পুলিশ দুই পা-বিশিষ্ট স্থলচর প্রাণী। এরা দেখতে অনেকটা মানুষের মতো। তাদের প্রধান খাদ্য ঘুষ। '
আমার ধারণা, এখন ওসি'র হাতে শ'-পাঁচেক টাকা তুলে দিতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে।
এখন আইনি জটিলতা চলছে, টাকা দিলে সেটা ফরফর খুলে যাবে। কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই। ভাবির কাছে এখন কিভাবে টাকা চাই! তাঁর কাছে যা আছে, তাতে নাসের ভাইকে বাঁচানো যাবে কিনা সন্দেহ।
থানা থেকে বের হয়ে আমি একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকেছি। এই এলাকার মিষ্টির সুনাম আছে।
খাঁটি দুধের ছানা দিয়ে তৈরি হয়। আমার গরম গরম মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে।
হোটেল বয়কে বললাম, 'আচ্ছা ভাই, গরম মিষ্টি হবে?'
বয়টা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সে গরম মিষ্টির কথা জীবনেও শোনেনি।
আমি বললাম, 'আমাকে দুইটা গরম মিষ্টি আর দুইটা নিমকি দাও। '
'ভাই, মিষ্টি তো গরম বিক্রি হয় না।
'
'কেন?'
'মিষ্টি ঠাণ্ডা হলে স্বাদ হয়। '
'আমাকে মিষ্টি খাওয়া শেখাচ্ছ! মিষ্টি খেতে খেতে বড় হয়েছি। '
'আপনি কি গরম মিষ্টি খান?'
আমি গিজগিজিয়ে বললাম, 'আমি গরম মিষ্টি খাই। '
অথচ আমি গরম মিষ্টি কখনও খাইনি। আমি জানি, গরম মিষ্টি বিক্রিও হয় না।
মন চাইলেই যে গরম মিষ্টি পাব সেটা ঠিক নয়। আমার মন তো এখন অনেক কিছু চাচ্ছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, উড়ে গিয়ে শেষবারের মতো ফুফুর চেহারাটা দেখে আসতে; ইচ্ছে হচ্ছে, হাজতের তালা ভেঙে তুষিকে ছাড়িয়ে আনতে; ইচ্ছে হচ্ছে, দৈবিক কোনও শক্তি কাজে লাগিয়ে নাসের ভাইকে সুস্থ করে তুলতে; কোনওটিই আমি পারছি না। জীবনের পরতে পরতে জানা-অজানা এই যে অসংখ্য নিয়ম, তা মেনে নেওয়ার নামই সম্ভবত জীবন- এই কথাটা আমাকে বেশ ভালোভাবেই আচ্ছন্ন করছে।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি ঠাণ্ডা মিষ্টি খেয়েছি।
এখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে নাসের ভাইয়ের খবরটা ঘরে জানাতে হবে। তুষিকে একাকী অনিশ্চয়তায় নিপে করে শহরে যেতে হবে।
এখন সকাল ১০টা। সম্ভবত জোহরের নামাজের পর ফুফুকে দাফন করা হবে। আব্বা এখন শোকে মুহ্যমান।
বাড়িতে টেলিফোন করলাম, 'আব্বা, আমি সাতকানিয়া থেকে বলছি। '
'তোমাকে খোঁজাখুঁজি হচ্ছে; তুমি সাতকানিয়া কেন?'
'একটা ঘটনা আপনাদের বলিনি, কাল নাসের ভাই আমাদের সঙ্গে আসার সময় এক্সিডেন্ট করেছেন। '
'আল্লাহ, অ-আল্লাহ। '
'আব্বা, নাসের ভাইয়ের অবস্থা ভাল নয়, দোয়া করবেন। তাঁকে শহরে নিয়ে যাচ্ছি।
আমার সঙ্গে ভাবিও আছেন। '
'বুবু অসিয়ত করেছিলেন, তাঁর জানাযা নাসেরই পড়াবে। '
'আব্বা, রাখি। '
আব্বা কাঁদছেন। আমিও কাঁদছি।
ফুফুর জীবনে আমরা কিছুই করতে পারিনি। তাঁর জানাযায়ও শরিক হতে পারব না। জানাযা পড়ানোর ব্যাপারে তাঁর অসিয়তও পালন করতে পারব না।
এম্বুলেন্স পাইনি; একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছি। ট্যাক্সিতে নাসের ভাইকে বসিয়ে নিতে হবে।
বসে শহরে যাওয়ার মতো শক্তি তাঁর নেই; তবু যেতে হবে।
নাসের ভাইকে মাঝখানে বসানো হয়েছে। ভাবির গায়ে হেলান দিয়ে বসেছেন তিনি। চোখ একটু খুলছেন আবার বন্ধ করছেন। আটকে আটকে দু'-এক শব্দ বলতে পারছেন।
চোখগুলো হলুদ হয়ে গেছে। চেহারাটা সাদা হয়ে গেছে। দেখতে ভয় হচ্ছে।
নাসের ভাই জিজ্ঞেস করলেন, 'ফুফুর দাফন হয়েছে?'
আমি বললাম, 'না, জোহরের পরে হবে। '
'আমরা কি জানাযার আগে পৌঁছাব?'
'নাসের ভাই, আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি।
আপনার প্রচুর রক্তরণ হয়েছে। '
'আমি কি মারা যাব?'
'শুধু শুধু মরবেন কেন! রক্ত দিলে ঠিক হয়ে যাবেন। '
নাসের ভাই বললেন, 'হায় রে ফুফু!'
তিনি চোখ থেকে পানি বের করে দিয়েছেন। আমার খুব খারাপ লাগছে। ভাবিও কাঁদছেন।
আমি নাসের ভাইয়ের হাতে হাত রাখলাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, নাসের ভাই শেষ কথাগুলো বলছেন। শহরে যাওয়া পর্যন্ত তিনি টিকবেন না।
নাসের ভাই আবার চোখ বন্ধ করলেন।
গাড়িটা ঐ জায়গায় এসেছে, যেখানে নাসের ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি জায়গাটা দেখছেন না। দেখলে তাঁর মনে বিরাট একটা চোট লাগত।
ভাবি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, 'দিদার, দিদার, তোমার ভাই থিরথিরিয়ে কাঁপছে। ' আমি নাসের ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম।
আমার বুকে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে নাসের ভাই ইন্তেকাল করলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তাগড়া এক যুবতী স্বামীহীনা হলেন। তারচেয়ে বড় কথা, চার বছরের একটা শিশু কখনও চিন্তা করতে পারবে না, তার পিতার চেহারাটা কী রকম ছিল। ভাবি এখনও বুঝতে পারেননি, তাঁর স্বামী আর নেই।
আমি ড্রাইভারকে বললাম, 'আমরা শহরে যাব না। '
ভাবি বললেন, 'কেন?'
'শহরে যাওয়ার মতো শক্তি নাসের ভাইয়ের নেই। '
'কী বলছ দিদার!'
'আমি ঠিক বলছি। '
ভাবির বোধোদয় হয়েছে। তিনি পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেন; কাঁদছেন না।
কথাটা সত্য- অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।
ড্রাইভার গাড়ি ফিরিয়েছে। আমি বললাম, 'ড্রাইভার, এখানে এম্বুলেন্স পাওয়া যায় না?'
ড্রাইভার বলল,'একটু অপো করলে শহর থেকে একটা গাড়ি আসবে। '
আমি বললাম, 'আমাদের হাসপাতালেই নিয়ে চল। '
হাসপাতালের সবাই নাসের ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সমব্যথী হলেন।
ভাবি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। হাসপাতালের নার্সরা ভাবির মাথায় পানি ঢালছেন। এখন বাড়িতে খবরটা জানানো দরকার। তুষিকেও খবরটা না জানালে অন্যায় হবে।
আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে।
আব্বাকে রিং করলাম। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, 'নাসেরের খবর কী?'
আমি বললাম, 'ফুফুর জানাযাটা একটু বিলম্বিত করা যায় না?'
'তোমরা কি তিনটার আগেই পৌঁছাতে পারবে?'
'দুইটা জানাযা একসঙ্গে হবে। '
আব্বা বড় করে ইন্নালিল্লাহ পড়লেন। এরপর আমি শুধু হ্যালো হ্যালো বলতে থাকলাম। আব্বা কিছু বলছেন না।
আমি থানার দিকে যাচ্ছি। ভাবির হাতে যে টাকাটা ছিল, সেটার বেশি খরচ হয়নি। প্রয়োজনে পুলিশের হাতে পাঁচহাজার টাকা ঘুষ তুলে দিয়ে তুষিকে ছাড়িয়ে আনব।
এখনও আটক আছে তুষি। হাজতের দরজায় গিয়ে তুষিকে ইশারা করলাম।
তুষি এগিয়ে এসেছে। তাকে বললাম, নাসের ভাই ইন্তেকাল করেছেন। সে স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে; আর পা বাড়াচ্ছে না।
মনস্তাত্ত্বিক ফর্মুলায় নাসের ভাইয়ের ঘটনাটা তুষির জন্য ভালো হওয়ার কথা। যে ঝড়-ঝঞ্ঝাটা তার উপর দিয়ে গেছে, তাতে তার মনে ব্যথার পাহাড় স্থির হয়েছে।
এখন আরেকটা ঢেউ এসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মনটা হালকা হবে।
আমি বললাম, 'তুষি আমি টাকা নিয়ে এসেছি, তোমাকে নিয়ে যাব। '
'ঘুষ দিয়ে ছাড়াবে?'
'হুঁ। '
'না, ঘুষের টাকায় আমি ছাড়া পেতে চাই না।
'
অনেক শক্ত মেয়ে তুষি। তার উপর বয়ে যাওয়া অসংখ্য অন্যায়ের প্রতিশোধ সে কিভাবে নেয় স্রেফ আল্লাহই জানে! আমি বললাম, 'ওসির হাতপায়ে ধরে হলেও একটা ব্যবস্থা করব। '
'দিদার, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে, সে অন্যায় একদিন তোমার উপর ভর করবে। '
'তাহলে কী করব?'
'তুমি ওসিকে অনুরোধ কর, যাতে হাসপাতালে গিয়ে লাশটা দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। আমি আবার হাজতে ফিরে আসব।
'
তুষি যা বলেছে, তাই আমি করেছি। ফলাফলটা একটু অন্যরকম হয়েছে। ওসি সাহেব বলেছেন, 'তুষিকে আর হাজতে থাকতে হবে না। আমরা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছি। '
আমি বললাম, 'এখন কোনও জটিলতা নেই?'
'নেই, এখন মেয়েটি যেতে পারবে।
'
'ওসি সাহেব আপনাকে ধন্যবাদ। এই আইনি জটিলতা সরাতে আমি পাঁচহাজার টাকা নিয়ে এসেছি। আপনি চাইলে সেটা রাখতে পারেন। '
ওসি সাহেব হাসলেন। তিনি সম্ভবত আমার মতো পাবলিক আর দেখেননি।
তাঁর ভাগ্য খারাপ! তুষিকে ছাড়ার কথাটা পাঁচ মিনিট পরে বললে টাকাগুলো তাঁর হাতে যেত।
তুষিকে বললাম, 'আমার চিরুনি আছে। মাথাটা গুছিয়ে নাও। '
মাথা আচড়ানোর পর তুষিকে এখন আর পাগলাটে লাগছে না। ওড়না না থাকার কারণে একটু উগ্র লাগছে।
সেই আগের মতোই আমরা তিনজন, ড্রাইভারসহ চারজন আরও একটা লাশ নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। গতকাল নাসের ভাই ফুফুর লাশ সামনে নিয়ে দোয়া-দরুদ পড়েছিলেন, আজ তাঁর লাশ সামনে নিয়ে কেউ দোয়া দরুদ পড়ছে না।
নাসের ভাই ধর্মীয় লেবাসের লোক ছিলেন। তাঁর সহধর্মীনির আগেকার রেকর্ড যাই হোক, বিয়ে করার পর তিনিও নাসের ভাইয়ের লেবাস পেয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, স্বামী মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্ত্রীত্বের অধিকার হারিয়েছেন।
স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকা কিংবা তাঁকে সামনে নিয়ে কান্নাকাটি করা, এমনকি তাঁকে সামনে নিয়ে দোয়া দরুদ পড়ার অধিকারও তাঁর নেই। তিনি সম্ভবত সে-কারণেই কিছু পড়ছেন না।
আমি পড়ছি না, কারণ, আমার মন চাইছে না। তুষি কেন পড়ছে না জানি না। সম্ভবত সে নিজেকে এখন দোয়া দরুদ পড়ার অযোগ্য ভাবছে।
এই ভাবাটা অতিরিক্ত। যদি পরিবেশ পরিস্থিতি অনকূল হয়, তুষিকে একটি প্রশ্ন করব। প্রশ্নটা হচ্ছে, কোনও লোক যদি নিজের গায়ে গুলি করে মারা যায়, সেটা কী হয়?
তুষি বলবে, 'আত্মহত্যা। '
'এই আত্মহত্যা প্রশংসিত না ঘৃণিত?'
'ঘৃণিত। '
'আর যদি কেউ তাকে গুলি করে হত্যা করে, সেটা কী হবে?'
'হত্যা।
'
'সে তখন কী?'
'শহীদ। '
'শহীদ কি ঘৃণিত না প্রশংসিত?'
'প্রশংসিত। '
এর পর আমি বলব, 'তুষি, তুমিও প্রশংসিত। তুমি নিজেকে খুন করনি, অন্য কেউ তোমাকে খুন করেছে। ' যাক, সেটা সময়-সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করব।
এখন সেই পরিস্থিতি নেই।
তুষিকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, 'তুষি, আমি মারা গেলে তুমি কি আমার চেহারা দেখবে?' এ-সময় এ-ধরনের প্রশ্নের উত্তর হয়ত সে ক্রোধবশত 'না' করবে। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, তুষি সেটা পারবে না। আমি মরার পর সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে।
আমরা তুষিদের বাড়ির সামনে এসে গেছি। আমার মনে পড়ল, তুষি কিছু খায়নি; ভাবিও খাননি। ভাবি হয়ত সকালে কিছু খেয়েছেন। রাতে সেই যে একসঙ্গে খেয়েছিলাম, এরপর তুষি আর খায়নি। আমি বললাম, 'তুষি, এখনই কিছু খেয়ে নিই; দু'-দু'টা মরার ঘরে খাওয়া-দাওয়া থাকবে না।
'
কেউ কিছু বলছেন না। আমার কথায় কেউ কানও দিচ্ছেন না। দু'জনই সম্মোহিতের মতো একদিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, 'ভাবি, কিছু খেলে কি ভাল হবে?'
ভাবি আমাকে এ-মুহূর্তে গর্দভ ভাববেন। তাঁর স্বামী ইন্তেকাল করেছেন, সামনে লাশ, এ-সময়টায় কোনও স্ত্রী স্বভাবত খান না।
সবাই যে স্বামীর শোকে খান না তা নয়, লাজ-শরম বলতে একটা কথা আছে। আমার মনে হয়, ভাবি শোকে খাবেন না।
আমি বললাম, 'ড্রাইভার দাঁড়াও। খাদ্যের ব্যবস্থা করি। '
তুষি গাড়িতে ওঠার পর এ-ই প্রথম মুখ খুলল।
সেও ড্রাইভারকে বলল, 'দাঁড়াও। '
তুষিকে বললাম, 'তোমরা বস, আমি হালকা খাবারের ব্যবস্থা করি। '
তুষি বলল, 'না। '
'কেন?'
'আমি নেমে যাব। '
'এই বৃষ্টিতে তুমি কোথায় যাবে?'
'বাড়ি যাব।
'
'না, তুমি যাবে না। আমাদের সঙ্গে এসেছ, আমাদের বাড়ি যাবে। লাশ দাফন হওয়ার পর আসবে। '
'দিদার, আমি বাড়ি যাব বলছি, যাব। '
'লাশের গাড়ি থেকে নেমে যেতে তোমার বিবেক বাধছে না।
'
'আমার বিবেক বলছে তোমাদের সঙ্গে না যেতে। '
'তুষি...'
তুষির উত্তর সম্ভবত এখানেই শেষ! ভাবিকে বললাম, 'ভাবি, তুষিকে আমাদের সঙ্গে যেতে বলুন। '
ভাবি দৃশ্যত আমার কথা শোনেননি। বৃষ্টি ভেদ করে তুষি চলে যাচ্ছে। আমি তুষির দিকে তাকিয়ে আছি।
বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত আমি তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সে একবারও আমার দিকে ফিরে তাকায়নি।
এক ঝটকা বাতাস দিয়ে বৃষ্টিটা থেমে গেল। যেন তুষিকে রুখতেই বৃষ্টি নেমেছিল! প্রকৃতি আমাকে সহায়তা করতে চেয়েছিল, পারেনি। তুষিকে রোখা বড় কঠিন!
আমাদের ঘরে এখন দুইটা লাশ।
নাসের ভাইয়ের জানাযার জন্য নতুন করে মাইকিং হচ্ছে। দলে দলে লোক আসছেন। আমাদের উঠান একটি জনসমুদ্র!
লাশ দু'টি উঠানে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি দু'টি লাশ আমাদের এলাকায় অনেকেই দেখেননি। দু'টি জানাযা একসঙ্গে হবে, এ-নিয়ে একটা কৌতূহল বিরাজ করছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, ফুফুর জানাযা আগে হবে, যেহেতু তিনি আগে ইন্তেকাল করেছেন। দাফন হবে একসঙ্গে। দু'জনকে পাশাপাশি কবর দেওয়া হবে। নাসের ভাইকে পাশে পেয়ে ফুফু নিশ্চয়ই খুশি হবেন! তিনি তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন।
ফুফুর লাশ আনার পর সবাই যেভাবে কেঁদেছিলেন, নাসের ভাইকে আনার পর সেভাবে সবাই কাঁদছেন না।
শোকের মাত্রা বেড়ে গেলে কান্নার মাত্রা কমে যায়। কিন্তু অকস্মাৎ ভাবি চিৎকার মেরে মেরে কাঁদতে শুরু করেছেন। সবাই তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী এভাবে কাঁদলে বিশ্রী লাগে। আব্বা ভাবিকে বারণ করছেন, 'মেয়েরা ওভাবে কাঁদে না।
'
ভাবি ও-সব শুনতে পাচ্ছেন না। তিনি কেঁদেই চলেছেন। আব্বা এবার শাসনের সুরে বললেন, 'ঘরে কেউ কাঁদলে অসুবিধা হবে। '
ভাবির কান্না থেমেছে। জোর করে কারও কান্না এভাবে থামিয়ে দেওয়াটা বিপজ্জনক।
কান্নার সঙ্গে ভেতরের সব শোক বেরিয়ে যায়। কান্নাটা চেপে রাখতে হলে সব দুঃখ-কষ্টও আটকে থাকে। এর চাপ সইতে না পারলে মানুষ হার্ট ফেল করে। মহিলারা বেশি করে; কারণ, তাদের স্নায়ু পুরুষদের তুলনায় দুর্বল।
আমি ভাবিকে টেনে আমাদের জেঠার ঘরে নিয়ে গেলাম।
তাঁকে বললাম, 'ভাবি, কাঁদুন, ইচ্ছে মতো কাঁদুন, এখানে আব্বা আসবেন না। '
আমার কথায় ভাবি না কাঁদুক, নিশ্চয়ই তাঁর মনটা হালকা হবে। তিনি দেয়ালে হেলান দিয়ে ল্যাপ্টা মেরে ফ্লোরে বসে আছেন।
ভাবি আমাকে বললেন, 'দিদার, তোমার ভাইকে একটু পরে দাফন করা যায় না!'
'ফুফুকে আর রাখা যাবে না। সবাই বলছেন, ভাইকেও একসঙ্গে দাফন করতে।
'
'তোমার ভাইয়ের শরীর তো এখনও ঠিক আছে। '
'তা ঠিক আছে, কিন্তু জানাযা পরে হলে এত লোক পাওয়া যাবে না। '
ভাবি এবার কথা বন্ধ করে শব্দ করে করে কাঁদছেন। আমি আব্বার কাছে গিয়ে বললাম, 'ভাবি বলছেন, ভাইকে পরে দাফন করতে। '
আব্বা একটা চিৎকার দিলেন, 'সে কী বুঝবে! অবুঝ মহিলা!'
আমি বললাম, 'তাকে পরে দাফন করলে তো কোনও অসুবিধা নেই।
'
'জানাযায় লোক হবে না। '
'না হোক, সবাই তো আরও কিছুক্ষণ দেখার সুযোগ পাবে। '
'তোমরা যা ইচ্ছা কর' বলে আব্বা লাশের গোসলের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আব্বা ভাবির মনের আকুতিকে পাত্তা দেননি। সম্ভবত তিনি সেটা বুঝতেই পারেননি।
যাকে সে আজীবন জীবনের সবচে' কাছের মানুষ ভেবেছে, সে কিছুক্ষণ পর সবচে' দূরে চলে যাবে।
আমি ভাবিকে গিয়ে বললাম, 'ভাইয়ের জানাযা পরে করার দায়িত্ব আমি নিলাম। '
কান্নার মাঝেও ভাবির চেহারায় অস্ফূট একটা আনন্দের রেখা ভেসে উঠেছে। নিয়ম-নীতির কারণে তিনি উঠানে স্বামীকে দেখতে যেতে পারছেন না, অথচ তাঁর মনটা তাঁকে দেখার জন্য ছটফট করছে। দেখতে না পারুক, ঘর আর আঙিনার ব্যবধানে তাঁর স্বামী এখনও আছে, এটা ভাবতে তাঁর ভালো লাগছে।
আমি নতুন করে মাইকিং-এর ব্যবস্থা করলাম। মাইকিং-এর ভাষা লিখে দিয়েছি, 'সম্মানিত এলাকাবাসী, আসসালামু আলাইকুম। চৌধুরী পাড়া নিবাসী নাসের আহমাদ চৌধুরীর জানাযা অনিবার্য কারণবশত বাদ আসর অনুষ্ঠিত হইবে। শফিকুন্নাহারের জানাযা পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিকাল তিনটায় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হইবে। আপনারা দুইটি জানাযায় যোগদান করিয়া মরহুমদ্বয়ের রুহের মাগফেরাত কামনা করুন।
'
মাইকে নতুন ঘোষণা শোনার পর কানাঘুষা শুরু হয়েছে। স্ত্রীর ইচ্ছায় স্বামীর জানাযা বিলম্বিত হওয়ার ঘটনাও অনেকে জেনে গেছেন। আমার আব্বা লজ্জিত হয়েছেন। সমাজের সম্মানী মানুষের ঘরে মহিলার কথায় জানাযা বিলম্বিত হয়, সেটা শরমের ব্যাপার! আব্বা জনসমক্ষ থেকে আপাতত প্রস্থান করেছেন।
আমার ভালো লাগছে।
একজন মহিলার দাম্পত্য জীবনের সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ একটা চাওয়াকে আমি পাওয়ায় পরিণত করতে পেরেছি। আঙিনায় হাজার মানুষের ফিসফিসানিতে ভাবির কিছু যায় আসে না। দাফন করার পর হাজার মানুষ মিলে চাইলেও একজন স্ত্রীকে এক সেকেন্ডের জন্য সেই স্বামীটা এনে দিতে পারবে না।
আমাদের ঘরেও উত্তেজনা চলছে। একাংশ নাসের ভাইকে পরে দাফন করার পক্ষে, অন্যপক্ষ বিরোধী।
আমি আঁচ করছি, কিছুক্ষণ পর ফুফুর লাশ নিয়ে যাওয়ার পর ঘরে একটা বিশ্রী দৃশ্য তৈরি হবে। বাকি সবাই জানবে, অন্য লাশটা স্ত্রীর মর্জিতে যাচ্ছে না।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ফুফুর জানাযায় আমি দুর্ভাগা শরিক হতে পারছি না। বলা যায়, ইচ্ছে করেই শরিক হচ্ছি না। ফুফুর জানাযায় অসংখ্য লোক শরিক হবে, আমি একজন না গেলে কিচ্ছু হবে না।
ফুফুর কফিন নিয়ে সবাই মসজিদের সেহেনের দিকে যাচ্ছেন। মসজিদটা দূরে নয়; আমাদের বংশের মসজিদ। ঘরের পুরুষ-মহিলা সবাই যাচ্ছেন। ঘরে আমি আর ভাবি ছাড়া কেউ নেই। উঠানে নাসের ভাইয়ের পাশেও কেউ নেই।
এখন ভাবিকে উঠানে এনে নাসের ভাইয়ের চেহারাটা ভাল করে দেখানো যাবে। ভাবি ইচ্ছেমতো স্বামীর চেহারাটা দেখুন। এটা শেষ দেখা। পরকালে তাঁদের ফের দেখা হবে কিনা, এটা তাঁদের কৃতকর্মের ওপর নির্ভর করে।
আমি বললাম, 'ভাবি, চলুন।
'
'কোথায়?'
'উঠানে। চলুন, কেউ নেই। নাসের ভাইকে একবার ভাল করে দেখবেন। '
ভাবি একটা লাফ দিয়ে উঠানে চলে এসেছেন। আমি লাশের মুখ থেকে কাপড়টা টেনে আনলাম।
ভাবি অপলক তাঁর প্রিয়তমের চেহারাটা দেখছেন। আজ নাসের ভাই ভাবির পর-পুরুষ। এখন তাঁকে ছুঁলে পাপ হবে!
আমি বললাম, 'ভাবি, ভাইকে আপনি একবার ধরে দেখবেন না?'
'এতে কি তোমার ভাইয়ের উপর পাপ বর্ষিত হবে?'
'না, হবে না। '
আমি জানি না, পাপ হবে কি না। এ-সময় একজন অসহায়ের হৃদয়ের ব্যাকুলতার সব ভাষাকে আমি পরখ করতে পারছি।
আমি ভাবছি, খোদাকে আমি বলব, এ-কারণে যদি তাঁর পাপ হয়, তা আমার কারণে হয়েছে। আমি খোদার কাছে অনুরোধ করব, তিনি যেন এ-পাপের বোঝা আমার ওপর চাপান।
ভাবি তাঁর স্বামীর মুখ, মাথা, হাত, হাতের আঙুল সব ছুঁয়ে দেখছেন। অন্যসময় এই হাত পরম মমতায় তাঁকে জড়িয়ে ধরত। এখন ধরছে না, আর ধরবেও না।
ভাবি লাশের বুকে তাঁর মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে আছেন। তিনি সম্ভবত তাঁর প্রেমিকের মনের কথাগুলো মন থেকে গুনগুন শুনতে পাচ্ছেন!
আমি বললাম, 'ভাবি, এবার চলুন, জানাযা থেকে লোকজন ফিরবে। '
সম্ভবত জানাযা শেষ হয়েছে। ভাবির ছেলেটা মসজিদ থেকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আঙ্কেল, আঙ্কেল, কবরের দিকে আঙুল দেখালে আঙুল পচে যায়, তাই না?'
আমি বললাম, 'না। '
'কিন্তু আব্বু বলেছিলেন, পচে যায়।
'
'তাহলে যায়। '
'আমার দাদা দেখিয়েছেন। তাঁর আঙুল পচে যাবে। '
'হ্যাঁ, যাবে। '
ছেলেটা আমার কাছ থেকে নাসের ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সে আমাকে বলল, 'আঙ্কেল, দাদুমণিকে কবর দেওয়া হবে, তাই না। '
আমি বললাম, 'হ্যাঁ। '
'আব্বুকেও কি কবর দেওয়া হবে?'
আমি চোখকে আর বেধে রাখতে পারিনি। ছেলেটি বলল, 'আঙ্কেল আপনি আব্বুর জন্য কাঁদছেন?'
'না। '
'আম্মু কার জন্য কাঁদছে?'
আমি ছেলেটিকে বুকে টেনে নিয়ে বললাম, 'চল, গোরস্থানে যাই।
দাদুমণিকে দেখব। '
আমরা দু'জন গোরস্থানের দিকে যাচ্ছি। জানাযা শেষে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। আমার ধারণা, অনেকেই জানতে পেরেছে, আমি জানাযা পড়িনি। জানলেও তেমন সমস্যা নেই।
আমি একটা ভাল কাজ করার জন্য জানাযা থেকে বিরত থেকেছি!
আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার আব্বু তোমাকে কী বলে ডাকতেন?'
'মুশি। '
'মুশি ডাকলে কি তোমার ভাল লাগে?'
'না, ভাল লাগে না। '
'কেন?'
'সবাই বলে, 'মুশি একটা ঘুষি খাবে?'
'কী ডাকলে তোমার ভাল লাগে?'
'টারজান। '
'তোমাকে আমি টারজানই ডাকব। '
এরপর View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।