১। আসাদের চিঠি এসেছে তিন দিন আগে। বেশ কয়েক দিনের ছুটি পেয়েছে। আগামী ২১ তারিখ, বৃহস্পতিবার বাড়ি আসবে। চিঠি পাওয়ার পর থেকেই ছালেহা বেগমের ছটফটানি শুরু হয়েছে।
কবে যে ২১ তারিখ আসবে? বৃহস্পতিবার হতে আর কয় দিন বাকি?
ছেলেটা দেখতে দেখতে এত বড় হয়ে গেল। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়; ছালেহা ভাবে। আসাদের বাবা করিম মিঞা উজানচর প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। আসাদের বয়সই বা কত, পাঁচ কি ছয়? করিম মিঞা ছালেহা বেগমকে ডেকে বলল, বৌ আমাগের আসাদরে একটু সাঁজাইয়ে গুছাইয়ে দাও দিনি, ওরে স্কুলে নিইয়া যাই।
আসাদ পাড়ার ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলছিল।
ছালেহা বেগম ডাকল, আসাদ বাপ! শুইনে যা!
মায়ের ডাক শুনে দৌড়ে আসে আসাদ, মা! আমারে ডাকিছেন?
-হ। তোর বাপ কতিছিল তোরে স্কুলে নিইয়ে যাবি। তুই গোছল সাইরে নে।
মায়ের কথা শুনে আসাদের খুশি যেন আর ধরে না। লুঙ্গি, গামছা নিয়ে কল পাড়ের দিকে ছুটল গোছল করতে।
গোছল শেষ হলে, ছালেহা নিজ হাতে জামা কাপড় পড়ালো, মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে মাথার চুল আঁচড়ে দিল। আসাদ লক্ষী ছেলের মত ওর বাবার সাইকেলের পিছনের সিটে দুই পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল।
করিম মিঞা বলল, শক্ত কইরে ধরিস বাপ! পইড়ে যাতি পাড়স।
-না আব্বা! আমি শক্ত কইরে ধরিছি!
ছালেহা বেগম হাসে। আনমনেই চোখের কোণে জল গরিয়ে পড়ে।
আসাদ কত বড় হয়ে গেছে। মাট্ট্রিকুলেশন আর এফএতে বড় পাশ দিছে। এখন ঢাকায় ভার্সিটিতে পড়ে। বাড়িতে এলে, এক মহূর্তের জন্যও কাছে পায় না ছেলেটাকে। কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায়! দুই তিন গ্রামের লোক আসে ওর সাথে দেখা করতে, গল্প করতে।
তবুও ভাল, এই কয়টা দিন ছেলেটা চোখের সামনে থাকে। ভাল মন্দ দুইটা খেতে পাড়ে। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকে, কী খায় আর না খায়? ছেলেটা ভাঁপা পিঠা পছন্দ করে। ছোট ছোট চিংড়ি সরিষার তেল, কাঁচা মরিচ, পিয়াজ দিয়ে ভর্তা করে দিলে খুব তৃপ্তি নিয়ে ভাত খায়। শিম দিয়ে নুনওয়ালা ইলিশ মাছের ছালুন, বড় বড় আলুর টুকরো দিয়ে গরুর গোশত রান্না খুব পছন্দ করে আসাদ।
বছরে দুই ঈদে দুই বার মাত্র বাড়ি আসে। অবশ্য প্রতি মাসেই একটা করে চিঠি পাঠায়। তেমন বেশি কিছু লিখে না; সে ভালো আছে, পড়া লেখা ভালোই চলছে এই সব। ডাক পিওন চিঠি নিয়ে এলে খুব যত্ন করে ছালেহা বেগম, মুরগি জবাই করে খাওয়ায়।
২।
আজ বৃহস্পতিবার। পাঁচটার শ্যাটল ট্রেনে আসার কথা আসাদের। ছালেহা বেগমের কাল রাতে ভালো ঘুম হয় নি। ফজরের আযানের আগেই একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। কী অলুক্ষণে স্বপ্ন! একটা লাশ দেখতে ঠিক আসাদের মত, কাঁদতে কাঁদতে বলছে, মা! আমারে নিইয়ে যাতি দিও না।
মা! আমারে ধইরে রাহো।
ছালেহা বেগমের ধড়ফড়ানিটা বেড়ে যায়। বাঁশ ঝাড়ের দিকে একটা শিয়াল শব্দ করে কাঁদছে। ছালেহার বুকে ছ্যাৎ করে উঠে। এক অজানা ভয়ে কুঁকরে উঠে।
-বিয়ান বেলায় আমি কী খোয়াব দেকলাম? শুনিছি বিয়ান বেলার খোয়াব ফইলে যায়। ইয়া আল্লাহ! ইয়া রছুল! আমার আসাদরে ভাল রাখিও।
ছালেহা বেগম মনে মনে ভাবে, আসাদ বাড়ি আলি পড়ে মজিদে ছিন্নি দেব। বার বার আয়েতাল কুরছি পড়ে। তবুও ভয় কাটে না।
সকালে ঘরের কপাট খুলে ছালেহার মন আরো খারাপ হয়ে যায়। উঠানে একটা খোঁড়া শালিক তারস্বরে চেচাচ্ছে। সকালে এক শালিক দেখলে অমঙ্গল হয়।
ছালেহা খুব যত্ন করে ভাঁপা পিঠা বানাচ্ছে। খেজুরের গুড় আর নারকেল বেশি দেওয়া পিঠা আসাদ পুছন্দ করে।
সব কয়টা পিঠাই আসাদের পছন্দ মত বানাচ্ছে ছালেহা। আসাদ এলেই ভাত খেতে চাইবে। সকালে কী না কী খেয়ে রওনা দিয়েছে? ছালেহা আসাদের জন্য চিংড়ি ভর্তা, শিম দিয়ে নুনওয়ালা ইলিশের সালুন আর গরুর গোশত রান্না করে রেখেছে।
পাঁচটা কখন বেঁজেছে। সন্ধ্যা হতে চলল।
শ্যাটল ট্রেনও ঠিক সময়ে এসেছে। ছালেহা বেগম রান্না ঘরে বসে ট্রেন আসার শব্দ শুনেছে। আসাদ এখনও এল না। কেন এল না? আজ কি তবে আসবে না? না কি কোনো বিপদ………. আর ভাবতে পারে না ছালেহা। ভাবতেও চায় না।
আজ আসে নি, কাল নিশ্চই আসবে।
৩। চার দিন হয়ে গেল। এখনো আসাদ আসে নি। সকাল থেকেই ছালেহা বেগম কান্নাকাটি করছে।
-আসাদের বাপ! আপনে একটু ঢাকা যাইয়ে দেহি আসেন। আমাগের আসাদরে সাথে কইরে নিইয়ে আসেন। আমার কিছুতিই ভাল ঠেকতিছে না।
করিম মিঞা ঢাকা হলে পৌছতে পৌছতেই আসরের আযান দিয়ে দিল। এর আগে তিনবার সে আসাদের হলে এসেছে।
কিন্তু আজ সব কেমন যেন লাগছে। চারি দিকে নিরব, নিঃস্তব্ধ, একটা শোক শোক ভাব। সময়ও যেন চলতে ভুলে গিয়ে থমকে আছে।
আসাদ ১২১ নম্বর রুমে থাকে। করিম মিঞা আসাদের রুমের দড়জায় আঘাত করল।
আসাদের রুমমেট সোহেল দড়জা খুলল। সোহেলকে আগে যে কয়বার দেখেছে করিম মিঞা, প্রাণোচ্ছল টগবগে ছেলে, সব সময় হাসি খুশি থাকে। অথচ আজ বড় বিষণ্নমাখা ওর মুখ। করিম মিঞাকে দেখে চমকে উঠল সোহেল। আসাদের আরেক রুমমেট কামাল দড়জার কাছে চলে এল।
বিষণ্ণমুখে বলল, কাকা আপনি কখন এলেন? ভিতরে আসেন?
করিম মিঞা আসাদের বিছানায় বসলেন। জিজ্ঞাসু চোখে ঘরটায় চোখ বুলালেন। ভেন্টিলেটরের ফাঁকা দিয়ে একটা চড়ুই একবার রুমে ঢুকছিল, আবার বের হয়ে যাচ্ছিল।
করিম মিঞা বলল, আসাদ কনে? ওরে তো দেখতিছি না?
সোহেল কামাল দুই জনই চুপ করে থাকল। ওদের নিরবতা আর দুই চোখের বিষণ্ণতা করিম মিঞাকে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ করছিল অজানা কোনো আশঙ্কায়।
তবুও মুখে হাসি এনে বলল, কি তোমরা তো কিছু কতিছো না?
সোহেল আমতা আমতা করে উত্তর দেবার চেষ্টা করল।
-কাকা আসাদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
করিম মিঞার মুখের হাসি হারিয়ে গেল।
-কি কতিছো তোমরা? খুঁইজে পাওয়া যাবি না ক্যান? আসাদ কনে গেছিল? ওর তো ২১ তারিখ বাড়ি আসপের কথা ছিল।
সোহেল কামালের চোখের দিকে তাকাল, যেন আশ্রয় খুঁজতে চাইছে।
কামাল বলল, কাকা ২১ তারিখ সকালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে আমাদের একটা মিছিল হওয়ার কথা ছিল। আসাদ ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল, মিছিল শেষ করেই বাড়ি রওনা দেওয়ার জন্য।
কামালের সাথে সাথে সোহেলও বলতে শুরু করল।
-মিছিলে আসাদ আমাদের সাথেই ছিল।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা একটা রক্তাক্ত প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে সোহেল বলল, এই প্ল্যাকার্ডটা আসাদের হাতে ছিল।
আমরা মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের মোড়ের দিকে যেতেই হঠাৎ পুলিশ গুলি শুরু করল।
কামাল বলল, আসাদের বুকে আর ডান পায়ে গুলি লেগেছিল। আমি ওকে নিয়ে মেডিকেলের দিকে আসছিলাম। পুলিশ আমার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পড়ে শুনেছি যারা আহত হয়েছিল, গুলি খেয়েছিল, প্রায় সবাইকে পুলিশ গাড়িতে করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
সোহেল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ঐ দিন দুপুর থেকেই আসাদকে খুঁজছি। হাসপাতাল, থানা, জেলখানা সব জায়গায় খুঁজে দেখেছি। কোথাও আসাদ নেই।
করিম মিঞা কি বলবে বুঝতে পারে না। একটা ভারি পাথর কে যেন তার বুকে বেঁধে দিয়েছে।
শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বার বার হতভাগিনী ছালেহা বেগমের কথা মনে পড়ছে। শুন্য হাতে কিভাবে সে আজ বাড়ি ফিরবে। কি জবাব তাঁকে দেবে।
ভেন্টিলেটরের ফাঁকে তখনো খেলা করছিল চড়ুই পাখিটা।
করিম মিঞা ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকে সেদিকটায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।