গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত
দৈর্ঘ : ২৩৮ মিনিট
রঙ : রঙিন
দেশ : আমেরিকা
ভাষা : ইংরেজি
পরিচালনা : ভিক্টর ফ্লেমিং
প্রযোজনা : ডেভিড ও সেলজনিক
চিত্রনাট্য : সিডনি হাওয়ার্ড, মূল উপন্যাস : মার্গারেট মিচেল
সঙ্গীত : ম্যাক্স স্টাইনার
অভিনয় : ক্লার্ক গেবল, ভিভিয়ালে, লেসলি হাওয়ার্ড, টমাস মিচেল, বারবারা ও’নীল
চিত্রগ্রহণ : আর্নেস্ট হলার
সম্পাদনা : হাল কার্ন
শিল্প নির্দেশনা : লাইলে আর হোয়েলার
কাহিনী সংক্ষেপ : গৃহযুদ্ধ চলাকালীন জর্জিয়ার এক তুলাবাগানের প্রেক্ষাপটে এ ছবির গল্প গড়ে উঠেছে। খামার মালিকের চঞ্চল কন্যা স্কার্লেট ভালবাসে এসলে উইলকেসকে। কিন্তু এসলে’র সঙ্গে মেলানি হেমিল্টনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এসলে’র কাছে প্রশ্রয় না-পেয়ে স্কারলেট নজর দেয় রেথ বাটলারের দিকে। কিন্তু দূরন্ত রেথ বিয়েতে আগ্রহী নয়।
এক রকম জেদের বশেই স্কারলেট অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে। তবু এসলে’র প্রতি তার টান যায় না। স্কারলেট দুটো বিয়ে করেও সুখী হতে পারে না। যুদ্ধের দামামায় সে রেথকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে যায়। কিন্তু রেথও শেষ পর্যন্ত তার কাছে ধরা দেয় না।
গৃহযুদ্ধ আর স্কারলেটের অস্থিরতা পাশাপাশি চলে। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছেও স্কারলেট দেখে তার পিতার বাড়ি-ঘর সব ভেঙে গেছে। খামারের এক বিন্দু অংশও অবিশিষ্ট নেই।
বিশেষত্ব : মার্গারেট মিচেল তার সারা জীবনে একটি মাত্র উপন্যাসই লিখেছিলেন। ১০৩৭ পৃষ্ঠার ঢাউস উপন্যাস গন উইথ দ্য উইন্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে।
১৯৩৯ সালে এ উপন্যাস অবলম্বনে ছবি করার আগেই উপন্যাসের বিক্রি সে সময় ১৫ লাখ কপি ছাড়িয়ে যায়। এ উপন্যাস পুলিৎজার পুরস্কারও পায়। প্রযোজক ডেভিড ও সেলজনিক উপন্যাস ছাপা হওয়ার পর পরই লেখকের কাছ থেকে এর চলচ্চিত্র কিনে নেন ৫০হাজার ডলারে। তখন পর্যন্ত এটিই ছিল কোন উপন্যাসের সব্বোর্চ্চ মূল্য। শুধু উপন্যাসের ক্ষেত্রেই নয়, প্রযোজক দরাজ দিলে খরচ করেছেন এ ছবিতে।
সে সময় পর্যন্ত এটিই ছিলো সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি। প্রায় ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ ছবি ১৯৩৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর আটলান্টায় মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার আগে ছবির প্রচারণা চলে তিন বছর ধরে। আর মুক্তির পাওয়ার পর শুধু হলিউডে নয়, সারা বিশ্বেই এ ছবি একটি ইতিহাস হয়ে ওঠে। মূল কাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়েছে অসংখ্য উপকাহিনী।
তবে নেহাত গল্প নয়, প্রায় ৩ ঘন্টার এ ছবি জুড়ে রয়েছে হলিউডি দক্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন। এ ছবির সংলাপ যেমন ধারালো তেমনি মূল্যবান এ শিল্প নির্দেশনা। দূর্দান্ত সেটের সঙ্গে আছে আছে অসাধারণ কিছু সূর্যাস্তের দৃশ্য। আর সবার উপরে আছে ক্লার্ক গেবল ও ভিভিয়ান লে’র অসাধারণ অভিনয়। অস্কারে ১৩ নমিনেশন ও ১০টি পুরস্কার পায় এ ছবি।
শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, চিত্রনাট্য, অভিনেত্রী, শিল্প নির্দেশনা, সেরা রঙিন ছবি, সম্পাদনা, পার্শ¦ চরিত্র সহ দুটি বিশেষ অস্কার পায় এ ছবি। উল্লেখ্য, এর আগে কোন ছবিই ছয়টির বেশি অস্কার পায়নি। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিট্যুট সেরা একশ ছবির মধ্যে এটিকে চতুর্থ স্থানে ঠাঁই দিয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়িক ভাবে আমেরিকার হট ছবি আদর্শ উদাহরণ হিসাবে এ ছবির নাম উল্লেখ করা যায়। হলিউডের স্বর্ণযুগের উৎকৃষ্ট নমুনা এ ছবি।
মহাকাব্যিক এ ছবিকে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি বলা হয়।
বিশেষ তথ্য : ১. হলিউডের চিত্র জগতে এ ছবিতেই প্রথম নারী চরিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়। নবাগত ভিভিয়ান লে’র চোখ দিয়ে গৃহযুদ্ধের আগের ও পরের সময়টাকে তুলে ধরা হয়েছে।
২. ক্লার্ক গেবল এ ছবিতে সবার পছন্দের তালিকায় ছিলো। কিন্তু ভিভিয়ান লে’কে আবিষ্কার করতে দুই বছর ধরে ১৪০০ অভিনেত্রীর অডিশন নেয় প্রযোজক-পরিচালক।
জোয়ান ক্রুফোর্ড, বেটি ডেভিস, পলেত্তা গডার্ড, ক্যাথারিন হেপবার্ন, জিন আর্থার, জোয়ান বেনেটের মতো উঠতি অভিনেত্রীরা অডিশন থেকে বাদ পড়েন। গেবলের পারিশ্রমিক যেখানে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার ছিলো, সেখানে ভিভিয়ানের পারিশ্রমিক ছিলো ২৫ হাজার ডলার মাত্র।
৩. পরিচালক হিসাবে ভিক্টর ফ্লেমিং-এর নাম গেলেও এ ছবির পুরোটা পরিচালনা তিনি একা করেননি। আসলে তিনি প্রায় অর্ধেকের মতো অংশ পরিচালনা করেছেন, বাকীটুকু পরিচালনা করেছেন স্যাম উড, উইলিয়াম ম্যানজিস, জর্জ কাকর ও রিভস ইসন। সে সময় এমজিএম-এর সাথে উইজার্ড অব ওজ ছবিতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন ফ্লেমিং।
এমজিএম সে ছবি দ্রুত শেষ করার জন্য তাকে ডেকে নিয়ে যায়।
৪. আটলান্টা পুড়ে যাচ্ছে Ñ শুধুমাত্র এই একটি দৃশ্য ধারণের জন্য ২৫ হাজার ডলার ব্যয় করা হয়। এই দৃশ্য ধারণের সময় শহরের নাগরিকরা সত্যি সত্যি আগুন লেগেছিলো ভেবে ফায়ার ব্রিগেড ডেকেছিলো। আটলান্টা শহর পুড়ে যাওয়ার এই দৃশ্য ধারণ করতে পুরনো কিছু সেট পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
৫. চিত্রনাট্যকার সিডনি হাওয়ার্ড ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই এক দূর্ঘটনায় মারা যান।
শুরুতে এ ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে ভিক্টর ফ্লেমিং সন্তুষ্ট ছিলেন না। তা কথা মতোই প্রযোজক আরও দুজন চিত্রনাট্যকারকে নিয়োগ দেন। কিন্তু মৃত হাওয়ার্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই শেষ পর্যন্ত পর্দায় শুধু তার নামই দেয়া হয়।
৬. লে গার্মেস এ ছবির চিত্রগ্রহণ শুরু করেন। কিন্তু মাস খানেক কাজ করার পর তার ফুটেজ উজ্জ্বল মনে না-হওয়ার তাকে বাদ দিয়ে আর্নেস্ট হলারকে নেয়া হয়।
৭. ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষার জন্য উপন্যাসিক মার্গারেট মিচেল আটলান্টার কার্নেগি লাইব্রেরির সহকারীদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। তারা শুধু গৃহযুদ্ধ নয়, পোশাক, অস্ত্র, পারফিউম, সঙ্গীত সব কিছুই যথার্থ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে, সে সময়ের জীবিত কোন ব্যক্তির নাম যেন উপন্যাসে চলে না-আসে।
৮. এতো সতর্কতার পরও শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘাপলা রয়েই গেছে। ছবিতে একটি দৃশ্যে নায়িকা স্কারলেট আটলান্টা ছাড়ার সময় একটি ইলেকট্রিক লাইটপোস্ট দেখা যায়।
উল্লেখ্য ছবির গল্পটি ১৮৬৪ সালে, ইলেকট্রিক বাল্ব আবিষ্কার হয়েছে এরও ৫০ বছর পরে।
৭. এই ছবির ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে স্কারলেট নামে আরেকটি ছবি তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটি তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেনি।
৮. এ ছবির মুক্তিকালে সাংবাদিকরা প্রযোজক ডেভিডকে জিজ্ঞেস করে সে কেমন অনুভব করছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘‘দুপুরের দিকে আমি ভাবি এটা স্বর্গীয়, মাঝরাকে মনে হয় এটা ফালতু. কখনোবা আমি ভাবি এটা চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি।
তবে এটা যদি শুধু একটা মহৎ ছবি হয় তাতেই আমি সন্তুষ্ট আছি। ’ উল্লেখ্য, প্রযোজক ডেভিডকে সন্তুষ্ট করা যথার্থই কঠিন ছিলো। এ ছবির নায়িকা নির্বাচন, চিত্রনাট্যকারের বদল, চিত্রগ্রাহকের বদল, একাধিক পরিচালকের কাজ করা তাই প্রমান করে।
৯. ১৯৩৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রযোজক ডেভিড, তার স্ত্রী ইরেনে, নিয়োগকারী জক হুইটনে, সম্পাদক হল কার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইডে একটা প্রিভিওতে যান। ছবির মিউজিক তখনও শেষ হয়নি।
তারা ফক্স থিয়েটারে যান। সেখানে তখন হাওয়াইন নাইটস এবং বিউ গেস্টে ছবি দুটো চলছে। হলের ম্যানেজারকে ডেকে কার্ন বলেন, তার এই হলে গন উইথ দ্য উইন্ড প্রথমবারের মতো প্রচার করে দেখতে চায়। হাওয়াইন নাইটস শেষ হওয়ার পর একটা ঘোষণা দিয়ে ম্যানেজার ছবিটা চালাতে পারে। তবে ছবির নাম বলা যাবে না।
শর্ত অনুযায়ী তাই করা হয়। কিন্তু ছবির শুরুতেই মার্গারেট মিচেল আর ডেভিডের নাম দেখে দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা দুই বছর ধরে পত্র-পত্রিকায় এ ছবির কথাই তো পড়ছিলো। ছবি শেষে হাততালির বন্যা বয়ে যায়। প্রিভিউ জরিপ কার্ডে তিনভাগের দুইভাগ দর্শক এ ছবিকে অসাধারণ বলে রেট দেয়।
তারা প্রযোজক অনুরোধ করে কিছুতেই এ ছবিকে যেন কেটে ছোট করা না-হয়। আটলান্টাতে ফিল্ম মুক্তি দেয়ার পর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লেখেন, সহস্র লোক রাস্তায় লাইন ধরে অপেক্ষা করছে। আটলান্টার ইতিহাসে এতো উল্লাস, চিৎকার আর উত্তেজনা দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে দেখ উত্তরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা এটিই। ’’ লন্ডনে ১৯৪০ সালে মুক্তির পর টানা চার বছরর চলে এ ছবি।
১৯৭৬ সালে এর টেলিভিশন ভার্সন ছাড়া হয় ১৯৭৬ সালে। সে সময় এটি সবচেয়ে কাঙ্খিত আর মূল্যবান টিভি অনুষ্ঠান ছিলো। ১৯৮৯ সালে মার্কিন ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি এ ছবিকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়। তাদের মতে ‘সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক কিংবা নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ। ’ স্কারলেটের প্রতি রেথের সংলাপ, ছবির শেষ লাইন হলো, ‘ফ্রেঙ্কলি, মাই ডিয়ার, আই ডোন্ট গিভ আ ডেম’ সংলাপটি আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিট্যুটের ২০০৫ সালের এক জরিপে সিনেমা ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় লাইন বলে নির্বাচিত হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।