সখা, নয়নে শুধু জানাবে প্রেম, নীরবে দিবে প্রাণ, রচিয়া ললিতমধুর বাণী আড়ালে গাবে গান। গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি। এই ব্লগের©শান্তির দেবদূত।
১.
এ এক অদ্ভূত সমস্যা আমার; ছুটির জন্য মন আকুলি-বিকুলি করে, আর ছুটি যতই নিকটবর্তী হয় ততই অস্থিরতা বাড়তে থাকে অবশেষে তা চরমে উঠে ছুটির একদিন আগে। আর ছুটির প্রথম দিন? আমাকে পায় কে? স্বর্গ! কিন্তু সপ্তাহ যেতে না যেতেই নাভিশ্বাস! এক সপ্তাহের বেশি ছুটিকে উপভোগ করতে পারিনি কোনদিন।
একটানা ছুটি কারইবা ভালো লাগে? তবে এইবার দেশে এসে স্বর্গপতনের এই সময়কাল এক সপ্তাহ থেকে টেনেটুনে দুই সপ্তাহে উত্তীর্ণ করতে পারার পিছনে আমার পূর্ণাঙ্গিনীর অবদান অনস্বীকার্য। ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই ধূমায়িত চা এর সাথে ভাঁজহীন খবরের কাগজ, ভূঁড়িভোজ নাস্তার সাথে শাশুড়ির ফ্রী মিষ্টিমধুর ধমক, “একদম না করবে না! আর একটা পরোটা খাও, এত বড় ছেলে! দুইটা পরোটাতে কি পেট ভরে?”
দুপর হতেই বৌ যখন স্নান সেরে ভেজা চুলে সদ্য ইস্তী করা নতুন কাপড় পরে সামনে আসতো, মনে হতো, আহঃ! জীবনের স্বার্থকতা কিসে? এটাই কি স্বার্থক জীবন নয়? মনে মনে ভাবতাম, আহা! এভাবেই যদি প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় স্নান করে ভেজা চুলে সামনে এসে বসে থাকতো সে, তাহলে ইহজনমে আর জ্যোৎস্না দেখতে চাইতাম না! আর রাত! সেটাতো দাওয়াতে দাওয়াতেই কেটে যেত। দুই দিকের আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে পনের ষোল তো হবেই। পনের দিনে পেন্টের বেল্টের ছিদ্র দুই ঘর এগিয়ে দিয়ে তবেই ওনারা খ্যান্ত হয়েছেন।
শুশুর বাড়িতেই উঠেছিলাম, সেই কারনে বউ এর সাথে খুব একটা ঝগড়াঝাটিও হচ্ছিলো না, আর যাই হোক জলে থেকে কুমিড়ের সাথে লড়াই! টারজানের কাজ স্বামীদের দিয়ে হয় না।
কি আর করা! পূর্ণিমাও পনের দিনে বিলীন হয়ে যায়, আর আমি তো সাধারন প্রেমিক মদন।
পনের ষোল দিন যেতেই হাঁপিয়ে উঠেছি, শেষে না পেরে তাকে বললাম, “আর তো ভালো লাগছে না, ডেটিং করতে ইচ্ছা করছে”
সে এমন কড়া দৃষ্টিতে তাকালো যে আমি ভষ্ম হয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচতে কালক্ষেপণ না করে বললাম, “আরে, এখন কি আর আমার আগের দিন আছে না কি যে শ’য়ে শ’য়ে লাইন পড়ে যাবে? আসলে বলতে চাচ্ছি যে তোমার সাথে অনেক দিন ডেটিং হয় না। চলো না একদিন?”
বুড়া বয়সে ডেটিং? তাও আমার বউ এর সাথে? মাথা ঠিক আছে তো? দেখি জ্বর টর আসলো না কী? বলেই কপালে হাত দিয়ে গায়ের উষ্ণতা মাপতে লেগে গেলো।
আমি শুধু মিনমিন করে বললাম, “আমি কিন্তু মজা করে বলছি না, সত্যি সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছি। চল না আগের সেই দিনগুলোর মত একদিন বাহিরে কোথাও দেখা করি, শুধু তুমি আর আমি আর আমাদের স্মৃতিগুলো নিয়ে?”
“আচ্ছা, সে পরে দেখা যাবে নে।
এইগুলো নিয়ে ভেবে ভেবে এখনকার সময়টা আর একঘেয়েমিপূর্ণ করে ফেলো না”, বলেই মুখের কোনায় একচিলতে হাসি ফুটিয়ে ঝামটা মেরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
২.
ঘুম থেকে উঠেই আমি আমাদের বাসায় চলে যাবো, সেখানে তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবো। তুমি কখন যাবে? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-ক্লাস আছে, আম্মুকে একথা বলে সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমি বের হবো। গাড়ি আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে গেটের কাছে অপেক্ষা করতে থাকবে আগের মত।
আমি মেইন গেট দিয়ে ঢুকবো আর পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে রিক্সায় উঠেই তোমাকে ফোন দিবো। ড্রাইভার আর কেয়ারটেকার বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকবে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত।
ডেটিং এর পরিকল্পনা করছিলাম দুজনে বসে বসে। জায়গা ঠিক হলো আমাদের ডেটিং এর স্বর্ণযুগের মাইক্রো থেকে ম্যারাথন এমন নানান রকমের ডেটিং এর সাক্ষী, সুখে দুঃখের সাথী সেই ক্লাসিক হ্যালভেশিয়া; সময় এগারটা। রক্তের মধ্যে উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম, অনেকদিন পর বাসায় মিথ্যা কথা বলে, কলেজ ফাঁকি দিয়ে, ড্রাইভার আর কেয়ারটেকারের চোখে ধূলো দিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার মত ডেটিং এ বের হচ্ছি, তাও আবার বিয়ে করা বউ এর সাথে! ভাবতেই ভালো লাগার একটা আবেশ ছড়িয়ে পড়ছিলো দেহজুড়ে।
বাহঃ! আজ তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে!
-থাক! আর পাম দিতে হবে না! এমনিতে তো সারাদিনে একবার ভালো করে তাকিয়েও দেখ না, আর এখন ডেটিং এর কথা শুনে ওনার প্রেমের বান ডেকেছে মনে! আমি কি কিছু বুঝি না মনে করেছ?
আরে না না! তুমি বুঝ না কে বলেছে? কিন্তু তোমাকে আজ সত্যি সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে।
পরিকল্পনার শেষ ধাপে অবধারিতভাবে চলে আসলো কে কি পড়ে যাবো। খুব আস্তে আস্তে বললাম, “তোমাকে শাড়িতে অনেক দিন দেখি না”।
-আমি জানতাম তুমি এই অনুরোধটা করবে! তুমি ভালো করেই জান যে আমি শাড়িতে কমফোর্টেবল না, তার পরেও তুমি কেন যে এই আবদারটা কর? না, শাড়ি টাড়ি আমি পড়তে
পারবো না স্যরি।
আমার এমন অনেক আবদার মুখের উপর না করে দিলেও দেখতাম যতো কষ্টই হোক শেষপর্যন্ত আমাকেই সে খুশি করতো।
সেই ইতিবৃত্ত স্মরণ করে আমি আশার ভেলা ভাসিয়ে ছিলাম সেদিন।
-শুন, একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, “আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবো না। যদি হ্যালভেশিয়ার পৌছে দেখি তুমি নাই তাহলে আমি এক মিনিটও বসবো না, সোজা বাসায়া চলে আসবো। ‘রিক্সা পাই নি’, ‘রাস্তায় জ্যাম ছিলো’ বা ‘বাসা থেকে নামার সময় লিফটে আটকে গিয়েছিলাম’, এমন বাহান টাহানা আমি কিচ্ছু শুনবো না। সুতরাং সাবধান!
আরে ধুর! আমি কি আর আগের মত আছি না কী, কাল কোনভাবেই দেরি হবে না, তুমি দেখে নিও।
৩.
অস্থির অস্থির লাগছিলো, ফোনের জন্য অপেক্ষা না করে কিছু সময় হাতে নিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। লিফটে নামবো? নাহ থাক, দেখা যাবে আজকেই মাঝপথে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে, আর আমি আধা ঘন্টা লেইট! এতদিন পর ডেটিং এ যাচ্ছি, আর চারতলা থেকে হেটে নামতে পারবো না?
একবার ভাবলাম এক তোড়া ফুল নিয়ে যাই, পরমুহূর্তেই তা বাতিল করে দিলাম, একটু বেশি বেশি হয়ে যাবে। দেখা যাবে সে খুশি হওয়ার পরিবর্তে রেগে বোম হয়ে গেছে। ইদানিং কিছুতেই তাকে উপলব্ধি করতে পারছি না পুরোপুরি। বিয়ের আগে কোন ভুলভাল করলে ধমক খেতাম, চিৎকার দিত, আর এখন চুপ মেরে যায়, কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোই এখন তার রেগে যাওয়ার লক্ষণ।
প্রেমিকাদের চেয়ে বউ এরা বেশি আনপ্রেডিক্টেবল।
কেমন যেন লাগছিলো! বারবার মনে পড়ছিলো বিয়ের আগের পাঁচ বছরের কথা! এভাবেই সপ্তাহে দুই তিন দিন দেখা করতে যেতাম, সময় আসলেই উড়ে উড়ে যায়। মনে হচ্ছিলো এই তো সেদিন, সে একেকদিন একেকটা জামা পড়ে আসতো, আর আগের দিনের জামা নিয়ে আমাকে পরীক্ষা দিতে হতো, আর আমি কেবলাকান্তের মত মুখ করে তাকিয়ে থাকতাম। এ এমন এক পরীক্ষা যেখানে কোন ফেল নেই।
রিকশাটাও যেন আজ বেশি ধীরে চলছে! ভাই, একটু জোরে চালান না! আহা, কি মিষ্টি মৃদু বাতাস! আজ ঢাকা শহর একটু অন্য রকম লাগছে না? কেমন পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছন্ন লাগছে! গাছগুলোও যেন একটু বেশি সবুজ লাগছে? আচ্ছা, সে আজ কোন শাড়িটা পড়ে আসবে?
হ্যালভেশিয়ার সামনে রিকশা থেকে নামতেই তার ফোন।
-এক্ষণি রেব হও, আমি কলেজ থেকে বের হয়ে গেছি; এখন রিকশায় উঠছি।
আমি তো হ্যালভেশিয়ায় বসে আছি, খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম আমি।
-বাব্বা! সুবোধ ছেলের মত তাড়াতাড়ি চলে এসেছ? খুব এক্সসাইটেট মনে হচ্ছে?
আরে নাহ, রাস্তায় জ্যাম থাকেত তাই আগে আগেই বের হয়ে গিয়েছিলাম, এই আর কি।
-আচ্ছা, তুমি থাক, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
এই সময়টাতে একদম ফাঁকা থাকে হ্যালভেশিয়ায়, হেঁটে একদম শেষের দিকে গিয়ে প্রিয় সেই চেয়ারটায় বসলাম।
আহ! কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই টেবিল চেয়ার ঘিরে! কাটায় কাটায় দশ মিনিট পর সে ঢুকলো। ছোট মত একটা ধাক্কা খেলাম। হালকা মেকাপ করেছে, ঠোঁটে লিপস্টিক, পরিপাটি করে চুল আচড়ানো, বেশ সজীব লাগছিলো তাকে, মনে হলো আসায় আগে স্নান করে এসেছে, সে এক অপার্থীব সৌন্দর্য। সবুজ রঙের একটা সালোয়ার-কামিজ পড়েছে, হ্যাঁ, সালোয়ার কামিজ, এটাই আমার ধাক্কা খাওয়ার মূল কারন। একেবারে শেষ মুহূর্তেও আমার মনে হচ্ছিলো সে শাড়িই পড়ে আসবে।
চরম একটা সত্য অনুধাবন করলাম, “বউরা শুধু আনপ্রেডিক্টেবলই না, মাঝে মাঝে চরম নিষ্ঠুরও হয়। ”
৪.
মুখোমুখি বসে আছি দুজন, চুপচাপ; দুজনের মুখেই মৃদু মৃদু হাসি। সেও নিশ্চয়ই আমার মতই ভাবছে, “ধুর! কি টিনেজ প্রেমিক প্রেমিকাদের মত পাগলামি করছি! এভাবে বাসা থেকে না পালিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বাহিরে খেয়েদেয়ে বসায় ফিরলেই হতো”।
চোখে চোখ পড়তেই সাথে সাথে ফিরিয়ে নিলাম; দুজনেই। কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে! থুতনির নিচে তিলটা যেন আজ দ্যুতি ছড়াচ্ছে, কালো আলোর দ্যুতি।
আলতো করে তার হাতটা ধরলাম, ধরেই থাকলাম শুধু কিছুক্ষণ, তার চোখের পাতা আগের মত কেঁপে উঠনি, আমার হৃৎদকম্পনটাও দ্রুততর হয়ে যায়নি। কেমন যেন পানশে পানশে লাগছিলো, কি যেন নেই! কি যেন নেই মনে হচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন লাগছে বিবাহপরবর্তী ডেটিং?”
খারাপ লাগছে না, তবে ঠিক ডেটিং ডেটিং মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে তোমার সাথে বাইরে খেতে এসেছি।
কোন টেনশন নেই, নেই চকিত চাহন, প্রতি মুহূর্তে কেউ দেখে ফেলার ভয় নেই, যতক্ষণ ইচ্ছা তার হাত ধরে বসে থাকতে পারি; ইচ্ছে করলে গালের তিলটাও টুপ করে ছুঁয়ে দেখতে পারি, আমার বুকটা দুরু দুরু কেঁপে উঠবে না, তার নিঃশ্বাস মূহূর্তে দ্রুততত হয়ে উঠবে না; সবচেয়ে বড় কথা, কোন তাড়া নেই, যতক্ষণ ইচ্ছা একসাথে থাকতে পারি!
মনে পড়ে গেলো চার বছর আগের একদিনের কথা। এক সপ্তাহের মত হয়ে গেছে দেখা করতে পারিনি, শেষে তাকে বললাম, “আমি ফ্যামিলি-নিডসে থাকবো, তুমি মা কে গাড়িয়ে বসিয়ে রেখে আইস্ক্রিম কেনার কথা বলে ভিতরে ঢুকবে”।
সেদিন শুধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম কয়েক মিনিট দুজন দুদিকে তাকিয়ে টুকিটাকি কেনার অভিনয় করে। চোখে নয়, ঘ্রাণে তাকে অঙ্কিত করছিলাম হৃদয়ে আর পুলকিত হচ্ছিলাম, পাশদিয়ে হেটে চলে যাবার সময় যে দমকা হাওয়াটা গায়ে লেগেছিলো সেটার রেশ চোখ বুঝলে আজও অনুভব করি। ছুঁয়েও গিয়েছিলো তার ওড়নাটা আলতো করে আমার একটা হাত, কাঁপিয়ে দিয়েছিলো আমার প্রতিটি লোমকূপ।
৫.
গাড়িতে উঠেই শুরু হয়ে গেলো তার নিত্যনৈমত্তিক হাত পা নেড়ে চোখ বড়বড় করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বিরামহীন কথা বলা, আমি বরাবরই ভালো শ্রোতা; মনোযোগ দিয়ে অমৃতবানী শুনার ভান করছিলাম আর অবচেতন মনে দর্শন আওড়াচ্ছিলাম। স্মৃতি স্মৃতির পাতাতেই সুন্দর, কবি ঠিকই বলেছেন,“যায় দিন একেবারেই যায়”।
মুধুময় অতীতকে নবরূপে আবিষ্কারের চেষ্টা সেটাকে ধ্বংসেরই নামান্তর। ভাগ্যিস সে আজ শাড়ি পড়ে আসেনি। প্রথম যেদিন তাকে শাড়িতে দেখেছিলাম সেই স্মৃতি না হয় অমলিনই থাকলো। তার হাতটা আমার হাতে নিয়ে উলটো পিঠে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে মনে মনে বললাম “আমার জীবনের শুদ্ধতম, সুন্দরতম স্মৃতিটাকে এভাবে অক্ষত রাখার জন্য এই জীবন পুনরায় তোমার তরে সপিয়া দিলাম, দেবী”
---------------------------------------------------------------------------
বি:দ্র: - ভালবাসা দিবস ২০১০ উপলক্ষে পিডিএফ সঙ্কলন "ভালবাসা"য় পূর্বে প্রকাশিত
----------------------------------------------------------------------------
দেবদূতের বিবাহনামা ----- ৬
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।