গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
নেপালের মাওবাদী আন্দোলন সারা বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক সময়ে বহুল পরিচিত। দীর্ঘকাল গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার পর দলটি রাজতন্ত্রকে হঠিয়ে জোটবদ্ধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দলের প্রধান নেতা প্রচণ্ড দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নেন। কিন্তু খুব বেশি দিন তার ক্ষমতায় থাকা হয়নি। ভারতের আধিপত্য এবং জোটভুক্ত দলসমূহের কর্মকাণ্ডের হেতুতে প্রচণ্ড ৮ মাস পরেই প্রধানমন্ত্রীত্ব ত্যাগে বাধ্য হন।
নেপালী মাওবাদী দলের মতে, দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এখনো অর্জিত হয়নি। চীনে যেভাবে মাও সেতুং আধা সামন্তবাদ এবং আধা ঔপনিবেশবাদী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তেমনি নেপালের পরিস্থিতিও একই। আন্দোলনের এ ধারাকে গ্রহণ করায় দলটি মাওবাদী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। দলের পুরো নাম হচ্ছে ইউসিপিএন বা ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী) মাওয়ের চিন্তাধারাকে ধারণ করে নেপালে ওই রাজনৈতিক দল সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করছে। দল প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে মাও অনুসৃত নীতি জনগণের কাছে দ্রুত আস্থা অর্জনে সফল হয়।
মাওবাদীদের মতে, নেপালে ভারতীয় আধিপত্যবাদ দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে। তাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে রাজতন্ত্র। ফলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের পাশাপাশি দেশিয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমানভাবে লড়াই করতে হবে। তবে নেপালে ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতি বাস্তবিকই ভয়াবহ। দেশের অনেক জায়গায় নেপালী মুদ্রার চেয়ে ভারতীয় মুদ্রার প্রচলন অধিক।
যা হোক, প্রচণ্ডের নেতৃত্বে যৌথভাবে ভারত এবং রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক মাত্রায় জনসাধারণ ইতিপূর্বে দলটির সাথে যুক্ত হয়।
দলের সৃষ্টি যেভাবে
প্রচণ্ডের নেতৃত্বাধীন ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল’র (মাওয়িস্ট) যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। এ দলের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে আরো একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল হচ্ছে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (ইউনিটি সেন্টার) একটি খণ্ডাংশ। ইউনিটি সেন্টারের যাত্রা শুরু হয় নভেম্বরের ১৯ এবং ২০ নভেম্বর ঐতিহাসিক এক বৈঠকের মাধ্যমে।
ভারতীয় আধিপত্য এবং নেপালী রাজতন্ত্র উৎখাতের লক্ষ নিয়ে ওই সময় একাধিক বামপন্থি দল যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে ইউনিটি সেন্টার গঠন করে। সে সময় যে সব দলগুলো এক মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিল, তারা হচ্ছে- কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মার্শাল), কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ফোর্থ কনভেনশন), প্রলেতারিয়ান ওয়ার্কাস ওর্গেনাইজেশন এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (জনমুখী)। দল গঠনের পরের বছরই ইউনিটি সেন্টার প্রথম কনভেনশন অনুষ্ঠিত করে। এখানে দলের নতুন নীতি গ্রহণ করা হয়। কনভেনশনের ঘোষণা থেকে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ মেয়াদি সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে বেছে নেয়া হয়।
এমতাবস্থায় ইউনিটি সেন্টার প্রকাশ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার স্বাধীনতা হারায়। দলটি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইউনিটি সেন্টারের সাথে রাজনৈতিক কর্মসূচির দ্বিমত পোষণ করেন পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচণ্ড এবং ড. বাবুরাম ভট্টরাই। এমতাবস্থায় ১৯৯৪ সালে তারা দলের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে আলাদা পার্টি গঠন করেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রচণ্ড নেতৃত্বাধীন এ দল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিটি সেন্টার) নামে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করে।
১৯৯৬ সালে দলটি ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওয়িস্ট) নাম গ্রহণ করে।
উপমহাদেশের মাওবাদী আন্দোলন এবং নেপাল পরিস্থিতি
উপমহাদেশে মাওবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে চারু মজুমদারের ভূমিকা লক্ষণীয়। তিনি প্রথম মাও অনুসৃত নীতি এ অঞ্চলে গণ আন্দোলনে প্রয়োগ করেন। মাওয়ের চিন্তাধারা বা মতবাদ গড়ে উঠার পটভূমিতে দেখা যায়, ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতা গ্রহণের পর স্ট্যালিন বিরোধী নানা অপপ্রচারে নামেন। ক্যাসিক্যাল বাম ঘরণার অর্থনৈতিক কর্মসূচি থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রবর্তনে অগ্রসর হলে দলের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাম আন্দোলন বিভক্ত হয়ে পড়ে।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালে রাশান কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে গণ অভ্যুত্থান বা বৈপ্লবিক নীতি বাতিল করে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছার কথা বলে। পাশাপাশি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা দিয়ে বলে, তাদের সংগঠন ধনী-গরিব সবার। যেহেতু রাশিয়ায় এখন ওইভাবে আর ধনীক শ্রেণী নাই। কিন্তু, তখনো রাশিয়ায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ধনীক শ্রেণীর উপস্থিতি বেশ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান ছিল।
তাছাড়া একই সময় শ্রমিকদের ওভার টাইম মজুরিসহ আরো বিভিন্ন ইস্যুতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলন দু’ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে ভারতসহ উপমহাদেশের দেশগুলোতে। ৬০-এর দশকের শেষ ভাগে ভারতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নকশালবাড়ি আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের শ্লোগানে চীনের চেয়ারম্যানকে তাদের চেয়ারম্যান হিসেবেও ঘোষণা দেয়া হয়।
ওই সময় ভারতবর্ষে হাজার হাজার তরুণ মাওয়ের দীক্ষা নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত হয়। আন্দোলনে নকশাল বাড়ি কর্মীরা ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত মনিষীদের ভাবধারাকে সামন্তবাদের অবশিষ্টাংশ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এর অংশ হিসেবে ইশ্বরচন্দ্র এবং অন্যান্য মনিষীদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার মত উদাহরণও তারা তৈরি হয়। তাদের গণ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রমের কারণে কয়েক বছর পরেই নকশাল বাড়ি আন্দোলনের মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি গড়ে উঠে।
১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান এবং ভারতীয় উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তরুণদের কাছে এ দল মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়। ’৭১ পরবর্তী সর্বহারা পার্টির দ্রুত বিকশিত রূপে চলে যায়। কিন্তু, গণ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেয়ায় সর্বহারা পার্টির জনপ্রিয়তা অকালেই নষ্ট হয়ে যায়। ’৭৫-এর শুরুতে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয়। ফলে দলের বিকাশের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের ধারণা ছিল, মাওবাদী আন্দোলনের গতিধারা চিরতরে উপমহাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক দশকের রাজনৈতিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাওবাদী আন্দোলন ব্যাপকভাবে এখানে ফিরে এসেছে। শুধু নেপালে নয়, ভারতের অনেক রাজ্যে এ দলের সশস্ত্র সংগ্রামের কারণে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। অন্ধ্র, পশ্চিমবঙ্গ, ব্যাঙ্গালুর, তামিলানাডু, উডিষ্যা, ছত্রিশগড়, কেরালাসহ আরো বিভিন্ন রাজ্যে ভারত সরকারের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে এ দল ইতিমধ্যে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকে মাওবাদী আন্দোলন ল্যাটিন আমেরিকা, উত্তর এবং মধ্য আমেরিকাসহ ইউরোপের দেশে দেশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
এমন এক অবস্থায় নেপালের মাওবাদীরা সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটারের সমর্থন নিয়ে জয়লাভ করে।
নেপালে ভারতীয় আধিপত্যের স্বরূপ
ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধিতা ইস্যু মাওবাদীদের জনপ্রিয়তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নেপালে ভারতীয় আধিপত্য ১৯৫০ থেকে চলে আসছে। এ আধিপত্যের নেপথ্যে রয়েছে ভারত-নেপাল মৈত্রী চুক্তি। ১৯৪৯ সালে চীন তিব্বত আক্রমণ করে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে।
ওই সময় ভারতের সাথে তিব্বতের সুসম্পর্ক বিরাজ করছিল। কিন্তু, চীনের তিব্বত দখলের মাধ্যমে ভারতীয় সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। তিব্বতে কমিউনিস্ট চীনের আধিপত্যের হেতুতে নেপালেও ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নেপালের শাসক শ্রেণী কমিউনিস্ট আন্দোলনের কবল থেকে নিজেদের রক্ষার্থে ভারতের সহযোগিতা কামনা করে। অন্যদিকে সীমান্ত প্রশ্নে চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক বৈরী প্রভাব সৃষ্টি হলে নেপাল-ভারতের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারই অংশ হিসেবে, ১৯৫০-এর ৩১ জুলাই নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহন শ্যামসের জং বাহাদুর রানা এবং নেপালস্থ ভারতীয় অ্যাম্বাসেডর চন্দ্রেশ্বর নারায়ন সিংয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি মোতাবেক নেপালে ঐতিহাসিকভাবে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। চুক্তির মূল প্রতীয়মান বিষয়বস্তু হচ্ছে, উভয় দেশের জনগণ এবং পণ্য দু’দেশের অভ্যন্তরে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারবে। পাশাপাশি বৈদেশিক নীতি এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপারে দু’ দেশের মধ্যে ঐক্যমত্য তৈরি হয়। এর মধ্যে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫২ সালে চীনের সমর্থনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে অভ্যুত্থান সংঘটনের চেষ্টা করে।
কিন্তু, তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ সময় নেপালের শাসক শ্রেণীকে রক্ষার্থে ভারতীয় সেনাবাহিনী নেপালে প্রবেশ করে। ওই সময়কার চুক্তিকে আরো একটু ভালভাবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, নেপালে যে কোন সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ভারতীয়দের প্রাধান্য দিতে হবে। এমনকি ভারতীয় অনুমতি ছাড়া নেপাল কোন দেশ থেকে অস্ত্র কিনতে পারবে না। ভারতীয়রা নেপালে গিয়ে জমিজমা বা স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে পারবে।
চুক্তিতে বলা হয়, একইভাবে নেপালীরাও ওই সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু, ভারতীয় অর্থনীতির আধিপত্য বৈশিষ্ট্যের কারণে নেপালীরা এ চুক্তির কোন রকম সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো তাদের সমস্ত ব্যবসা ভারতীয়রাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এমতাবস্থায়, মাওবাদীরা নির্বাচনে জয়লাভের পর তাদের নেতা প্রচণ্ড ২০০৮-এর ২৪ এপ্রিল ঘোষণা দেয়, ভারতের সাথে নেপালের মৈত্রী চুক্তি নতুন করে বিবেচনা করা হবে। চুক্তি থেকে বিভিন্ন ধারা পরিবর্তনের বিষয়েও প্রচণ্ড তার বক্তব্যে বলেন। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত হচ্ছে, প্রচণ্ডের প্রধানমন্ত্রীত্ব পদ থেকে পদত্যাগ পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যে ভারতীয় শাসক শ্রেণীর প্রধানতম ভূমিকা ছিল।
মাওবাদীদের অবয়ব
নেপালের সাবেক পুঁজিবাদী সরকারের ধারণা মতে, প্রাক্তন গোর্খা, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় সৈন্যদের একটা বড় অংশের বসবাস হচ্ছে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায়। শুধু তাই নয়, এসব অঞ্চলের যে সব সৈন্য নেপালের সেনাবাহিনীতে চাকরী করত তারাও ফোর্স ত্যাগ করে ওই এলাকায় চলে যায়। এরাই পরবর্তীতে মাওবাদী গেরিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণের কার্যাদি সম্পন্ন করে। ২০০৩-এ নেপালের তৎকালীন সরকারের ধারণা অনুসারে, ৩১ হাজার ৫ শ’ যোদ্ধা সক্রিয়ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত ছিল। পাশাপাশি ৪৮ হাজার মিলিশিয়া, দেড় লাখ সক্রিয় ক্যাডার আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।
এছাড়া মাওবাদীদের সমর্থক হিসেবে এক লাখ নেপালী তখন সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করত বলে সরকারের অভিমত। নেপালের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী মাওবাদী আন্দোলনকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তন্মধ্যে মাগারস, থারাউস, তামানঙস, দালিতস, ব্রহমিনস এবং চ্যাহট্রিস উল্লেখযোগ্য। এ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী মাওবাদীদের প্রধান ভোট ব্যাংক হিসেবেও চিিহ্নত হয়ে আসছে। নেপালের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে মাওবাদী গেরিলাদের ৬০ শতাংশের অবস্থান।
১৯৯৬-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি নেপালী গেরিলারা সরকারের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে জনযুদ্ধ শুরু করে।
প্রচণ্ডের পথ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনে নতুন ধারা
নেপালের বিপ্লবকে কেন্দ্র করে যে বিষয়টি বিশ্ব জুড়ে অন্যতম আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে তা হচ্ছে প্রচণ্ডের ডকট্রিন। অর্থাৎ বিপ্লব প্রশ্নে নেপালের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে নতুন চিন্তাধারা সংযোজন করা। আর এ রণনীতিকে প্রচণ্ডের মতবাদ হিসেবে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি বড় অংশ স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০১-এ নেপালে মাওবাদীদের দ্বিতীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।
এখানে দলের ভবিষ্যত সংগ্রামের প্রশ্নে প্রচণ্ডের চিন্তাধারা গৃহীত হয়। দ্বিতীয় কনফারেন্সের আগ পর্যন্ত, দলের প্রধান হিসেবে সাধারণ সম্পাদক ভূমিকা পালন করতেন। কনফারেন্স থেকে নতুনভাবে চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা হয়। ওই দায়িত্বে সর্বসম্মতিক্রমে প্রচণ্ডকে অধিষ্ঠিত করা হয়। সম্মেলনে প্রচণ্ডের রাজনৈতিক প্রতিবেদন এবং আগামী দিনে দলের আন্দোলন কীভাবে পরিচালিত হবে সে সংক্রান্ত মতামত উপস্থাপিত হয়।
তার ওই রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে “The great leap forward: An inevitable need of history”। অর্থাৎ, প্রচণ্ডের এ শিরোনাম পড়ে যা অনুধাবন করা যায়, তা হলো এ মুহুর্তে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করতে বিশাল এক উলম্পন (উলম্পন বলতে এমন এক কর্মসূচিকে বুঝানো হয়, যেখানে অসংখ্য কর্মীর উপস্থিতিতে নিজেদের লক্ষমাত্রা স্পর্শে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা হয়) সম্পন্ন করতে হবে। সে মোতাবেক দল পরিচালনায় নেতা-কর্মীদের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। যা হোক, প্রচণ্ডের এ রিপোর্টের বিষয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যগণ সিরিয়াসলি আলোচনা শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রচণ্ডের প্রস্তাব ভবিষ্যত পার্টি কর্মসূচি পরিচালনায় গৃহীত হয়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ৫ বছর সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার মাধ্যমে প্রচণ্ডের উপস্থাপিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দলীয় নেতা-কর্মীরা বুঝতে সক্ষম হয়, নেপাল পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত সর্বহারা বিপ্লবের লাইন এখানে উপযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে বর্তমান বৈশ্বিক পরিবর্তনকে মাথায় রেখে বিপ্লবের রণনীতি-রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। মার্কস-লেনিন-মাওবাদের তত্ত্বাবলী নেপালি পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে প্রয়োগ করতে হবে। এসবের ভিত্তিতে নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের এ রণকৌশলকে প্রচণ্ডের পথ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রচণ্ড তার চিন্তাধারায় বিভিন্ন রকম গণঅভ্যুত্থানের আলোকপাত করেন।
তিনি একদিকে মাওয়ের জনযুদ্ধ অন্যদিকে লেনিনের সশস্ত্র বিপ্লবের সংমিশ্রণের কথা বলেন। অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেপালী মাওবাদী নেতার মতে, ৫ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের পর প্রচণ্ডের এ নীতি আগামী দিনের আন্দোলন পরিচালনায় সুস্পষ্ট আলোকবর্তিকা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। নেপালের সিনিয়র মাওবাদী নেতা মোহন বৈদ্য আলিস কীরণ এ প্রসঙ্গে বলেন, মার্কসীজমের জন্ম জার্মানীতে। লেনিনইজমের বিকাশ রাশিয়ায়। মাওইজমের উত্থান হয়েছে চীনের বিপ্লব প্রশ্নকে সামনে রেখে।
মার্কসবাদের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে তিনটি, প্রথমত দর্শন (দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ), দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। তিনি আরো বলেন, নেপালের বিপ্লব সংঘটন প্রশ্নে কমরেড প্রচণ্ড এ তিনটি বিষয়ের চমৎকাল প্রয়োগ করছেন নেপালে। এবং তা আমাদের আন্দোলনকে উত্তরোত্তর শক্তি যুগিয়েছে। রাজনৈতিক দর্শন প্রসঙ্গে পার্টির চেয়ারম্যান প্রচণ্ড নিজেই বলেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং মাওবাদকে সমৃদ্ধ করতে আমাদের দল প্রচণ্ডের পথকে গ্রহণ করেছে।
দলে নারী এবং শিশুদের ভূমিকা
নেপালের মাওবাদী সংগঠনে নারীদের ভূমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য।
দলের জনযুদ্ধ পরিচালনার সময় দেখা যায়, এক পঞ্চমাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা হচ্ছে নারী। ওই সময় গেরিলাদের দখলে থাকা প্রত্যেকটি গ্রামে মাওবাদীরা নারীদের গণ সংগঠন গড়ে তুলেছিল। নেপালের অন্যতম মাওবাদী নেতা, বাবুরাম ভট্টারাই ২০০৩-এর ১৮ এপ্রিল বলেন, দলের ৫০ শতাংশ ক্যাডার শ্রমজীবী শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে। এছাড়া সৈন্যদের ৩০ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ১০ শতাংশ হচ্ছে নারী।
নেপালের জনযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কিশোর যোদ্ধা ছিল।
যুদ্ধের শেষ দিকে দেখা যায়, প্রায় ১২ হাজার গেরিলার বয়স ১৮ বছরের নিচে। মাওবাদীরা শিশুদের যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগের পাশাপাশি মূলত অন্যান্য কাজে যুক্ত রাখত। এসব কাজগুলো হচ্ছে একস্থান থেকে অন্যস্থানে দলের গোপনীয় খবর পৌঁছানো, গেরিলাদের জন্য রান্নার কাজে সহায়তা করাসহ আরো নানাবিধ কার্যাদি। তবে প্রত্যেক কিশোরকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত করা হত। মূলত, এর মাধ্যমে তারা ল্যান্ড মাইনসহ অন্যান্য বিপদজ্জনক বস্তু পরিহার করতে সক্ষমতা অর্জন করত।
তবে কিশোরদের যুদ্ধে ব্যবহারের বিষয়ে মাওবাদী নেতারা বিরোধিতা করেছেন। তারা বলেন, যে সব যোদ্ধা জনযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তাদের সন্তানদের প্রতিপালনে দল কার্যকর ভূমিকা রাখতে তাদের মুক্তাঞ্চলে রাখা হয়েছে।
জনযুদ্ধ এবং অবসান
জনযুদ্ধের সময় সমস্ত নেপালে মাওবাদীরা ছড়িয়ে পড়ে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ওই সময় নেপালের ৭৫টি জেলার ৬৮টিতে গেরিলারা অপারেশন পরিচালনা করে। প্রথমে তিনটি জেলা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জনযুদ্ধ শুরু হয়।
জেলাগুলো হচ্ছে রোল্পা, রুকুম এবং জজরকাট। পরবর্তীতে যুদ্ধ সমগ্র নেপালে ছড়িয়ে পড়ে। তন্মধ্যে নেপালের পশ্চিম-মধ্য পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলে মাওবাদী গেরিলাদের আধিপত্য ছিল তীব্র। এসময় জনযুদ্ধ প্রতিরোধে নেপাল সরকার বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জেলাগুলোকে বিভক্ত করে। A, B, এবং C গ্রেডের মাধ্যমে এসব জেলার বিপদজ্জনকের মাত্রা নির্ধারণ করতে দেখা যায়।
যেমন A গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত ৯টি জেলা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তন্মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে দুলাখা, সিন্ধুলি, গোর্খা, ড্যাঙ ইত্যাদি। একইভাবে B ক্যাটাগরিতে ছিল ১৭টি জেলা। C ক্যাটাগরিতে অনুরূপ বেশ কিছু জেলা ছিল।
দীর্ঘ ১০ বছর যুদ্ধের পর ২০০৬ সালে সাতটি রাজনৈতিক দল এবং মাওবাদীরা ১২ দফা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তিটি ভারতের মধ্যাস্থতায় হয়। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, চুক্তিটি প্রথমে হিন্দী ভাষায় এবং পরে নেপালী ভাষায় অনুদিত হয়। নেপাল সরকার এবং মাওবাদীদের মধ্যে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ ১০ বছর ব্যাপী পরিচালিত জনযুদ্ধের অবসান হয়। চুক্তি অনুসারে রাজতন্ত্রের বিলোপ এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার শর্ত প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া অন্তবর্তীকালীন সংবিধানের আলোকে ১৯ হাজার মাওবাদী গেরিলা যোদ্ধাকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
এমতাবস্থায় দলের চেয়ারম্যান প্রচণ্ড বলেন, জনযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাধ্যমে সংগ্রাম এবং বিপ্লব শেষ হয়ে যায়নি। এটি সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্রেফ নতুন একটা কৌশল মাত্র।
সংকটের নতুন ধরন
দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উত্তরণের পর ২০০৮-এর ১০ এপ্রিল নেপালে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচনের আগে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহল ধারণা করেছিল, মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে ফিরে নিয়ে আসার মাধ্যমে বুর্জোয়া দল হিসেবে আবির্ভূত করা যাবে। তাছাড়া বেশ কিছু নির্বাচনী আসনে মাওবাদীদের জয়লাভের ব্যাপারে সবাই পূর্বানুমান করে।
কিন্তু, এতসব মিথ্যে প্রমাণিত করে মাওবাদীরা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা পায়। মোট ভোটারের ৩০ শতাংশ সমর্থন দলটি অর্জন করে। পাশাপাশি ৫৭৫টি আসনের মধ্যে ২২০টিতে জয়লাভ করে। যা, সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে অভ্যন্তরে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করে। পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের মাধ্যমে আরো ৯টি আসন মাওবাদীরা পায়।
ফলে সর্বমোট ৬০১ আসনের মধ্যে এ দল ২২৯টি আসনে জয়লাভ করে। কোন দলই এককভাবে সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। তন্মধ্যে মাওবাদীদের সংখ্যাগরিষ্ট অবস্থানের কারণে ২০০৮-এর ১৮ আগস্ট প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু, এর পরেও নেপালের সংকট নিরসন হয়নি। কেননা, ২০০৯-এর ৪ মে নেপালী প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড ক্ষমতা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।
ঘটনা শুরু হয় সেনা প্রধান রুকমানগাদ কাতওয়ালকে বরখাস্ত করা নিয়ে। সেনা প্রধানকে বরখাস্তের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রধান হিসেবে এসেছে তা হল মাওবাদী ১৯ হাজার গেরিলাকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রসঙ্গে। শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, গেরিলাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু, কাতাওয়াল তা প্রয়োগে বিরত ছিলেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড শান্তি চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে সেনা প্রধানকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
বিপরীতে, সেনাপ্রধান সরকারপ্রধানের এ সিদ্ধান্ত অমান্য করেন। পাশাপাশি ওই সময় কাতাওয়াল সরকারের সাথে কোন রকম আলোচনা ছাড়াই ২ হাজার ৮০০ নতুন সেনা সদস্য ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। এমতাবস্থায়, প্রচণ্ড মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে সেনাপ্রধানের বরখাস্তের প্রস্তাব আনেন। তাতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বহিষ্কারাদেশে স্বাক্ষর করেন। বিপরীতে প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদব প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে এসে ১০ ঘন্টা পর সেনাপ্রধানকে স্বপদে পুনর্বহাল করেন।
এ পরিস্থিতিতে সংকট তীব্র হয়ে উঠে। মাওবাদীসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ঘটনার নেপথ্যে ছিল নেপালস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রাকেশ সুদ। তিনি সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করার আদেশ প্রত্যাখ্যান করতে প্রেসিডেন্টকে উৎসাহ যোগান। অন্যদিকে সরকারের অন্যতম প্রধান শরিক, ভারতীয় সমর্থনপুষ্ট ইউএমএল সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরকার হতে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্টের অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপ, ইউএমএল’র সমর্থন প্রত্যাহারসহ সমস্ত বিষয় ভেবে প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করেন।
যার মাধ্যমে হিমালয়শোভিত এ দেশ পুনরায় সংকটে পতিত হয়ে যায়।
বর্তমান পরিস্থিতি
বেশ জটিল এবং অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে নেপাল বর্তমানে অগ্রসর হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের পদত্যাগের মাধ্যমে ভারতীয় কুটচাল এবং ষড়যন্ত্র সফল হলেও মাওবাদীরা থেমে নেই। তাদের গণ আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নিম্নগামী হওয়া এবং ভারতীয় আধিপত্য ক্রমশ বৃদ্ধির কারণে জনগণের কাছে মাওবাদীদের সমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মাওবাদীদের স্থলে ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সমর্থনপুষ্ট কথিত বামপন্থি দল ইউএমএল’র (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট লেনিননিস্ট) নেতৃত্বে নেপাল কংগ্রেসের সহায়তায় এবং মাধেসিসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও ছোট ছোট দলের সমর্থনে নতুন সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইউএমএল’র মাধম কুমার নেপাল। কংগ্রেস ও মাধেসি পার্টির একজন করে উপ প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়ে এ সরকার যাত্রা শুরু করে। কিন্তু, এতকিছুর পরও মাওবাদীরা দ্রুত সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। ১০ বছরের গেরিলা যুদ্ধে নেপালে উভয় পক্ষের প্রায় ৬০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়।
তাদের সফল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের প্রাচীন রাজতন্ত্র বিলোপ হয়। বর্তমানে নেপালে ভারতীয় আধিপত্য আরো জোরদার হচ্ছে। ফলে জনগণের মধ্যে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল এখন তা অনেকটা ম্রিয়মান। সম্প্রতি, ভারত এবং নেপালের মধ্যে নতুন করে সামরিক বিষয়ক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। চুক্তি অনুসারে, ভারত নেপালে অস্ত্র সরবরাহ এবং নেপালী বাহিনীকে প্রশিক্ষণের কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।
অন্যদিকে মাওবাদী সংগঠন ইউসিপিএন (মাওবাদী) তাদের সিভিলিয়ান সুপ্রিমেসী বা নাগরিক প্রাধান্যের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে একের পর এক রাজ্যকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে চলছে। ইতিপূর্বে তারা ১০টি রাজ্যকে সায়ত্তশাসন দেয়। গত ১১ থেকে ১৮ ডিসেম্বর আরো ১৩টি রাজ্যে সায়ত্তশাসন দেয়ার ঘোষণা দেয়। ফলশ্রুতিতে দেশটিতে কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি মাওবাদীরা ভূস্বামীদের মালিকানাধীন হাজার হাজার একর আবাদী জমি জোরপূর্বক দখল করে কৃষকদের কাছে বন্টন করে দিচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব জমির অধিকাংশের মালিক হচ্ছে সরকারের শরিক দল নেপাল কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির নেতৃবৃন্দ। এসব জমিতে মাওবাদী কর্মীরা কাস্তে-হাতুড়ীর পতাকা উত্তোলন করে দিয়েছে। বর্তমানে মাওবাদীদের যা শক্তি তাতে যে কোন মুহুর্তে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে তারা সামর্থ রাখে। কিন্তু, দেশটির ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে তারা এ উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আছে। নেপালের চারদিকে ভূমি বেষ্টিত হওয়ার দিল্লীর উপর দেশটি প্রচণ্ড নির্ভরশীল।
ফলে মাওবাদীরা যদি ক্ষমতা দখল করে তাহলে ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক মাত্রায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাওবাদীরা চীনের সাথে সম্পর্ক নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া স¤প্রতিক সময়ে নেপালে চীনের অবস্থান সংহত করতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বেজিং অগ্রসর হচ্ছে। যা হোক, ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, মাওবাদীদের ঠেকানোর জন্য ভারতের মদদ এবং সমর্থনে বর্তমান সরকারে ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়েছে। কিন্তু, ভারতের সমর্থন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে যে সব পেশাজীবী সংগঠন অতীতে মাওবাদীদের সমর্থন করতো না, তারা এ দলের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার এ মুহুর্তে নেপাল সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন সমীকরণ টানা সম্ভব নয়। এ জন্য নেপালের সামগ্রিক পরিস্থিতির ব্যাপারে আরো সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ জরুরী। কেননা, জনযুদ্ধ বন্ধ হলেও নেপালের সংকট আদৌ কমেনি। বরং ভারতীয় আধিপত্য এবং সরকারের জনকল্যাণ বিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
ফলে ভবিষ্যতই বলে দিবে নেপাল এবং তাদের জনগণের ভাগ্যে কী ঘটবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।