নেপালে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আসেন, দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনার আকর্ষণে। এই পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্বয়ম্ভূ স্তূপ। এমনকি নেপালের আকাশ থেকেও এটা দেখা যায়।
স্বয়ম্ভূ স্তূপ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে, বিষ্ণুমতী নদীর তীরে অবস্থিত। এটি নেপালের অন্যতম প্রাচীন ধর্মস্থান।
বিশেষ করে বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের কাছে স্বয়ম্ভূ স্তূপ অত্যন্ত পবিত্র। এই স্তূপ একটি পাহাড়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এখান থেকে একদিকে পুরো কাঠমান্ডু উপত্যকা, আর অন্যদিকে হিমালয় পর্বতমালার বিভিন্ন শৃঙ্গ দেখা যায়।
স্বয়ম্ভূ স্তূপের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনি। বলা হয়ে থাকে, পুরো স্থানটি এক সময় ছিল বিশাল হ্রদ।
বোধিস্বত্ব মঞ্জুশ্রী এখানে আসার পর, হ্রদের পানিতে একটি বিশাল পদ্মফুল ফোটে। পদ্মফুলটি হয়ে ওঠে স্তূপ, মৃণাল হয় পাহাড়, আর লেকের পানি অন্যদিকে প্রবাহিত হয়ে চলে যায়। সৃষ্টি হয় কাঠমান্ডু উপত্যকার। নিজে থেকে, মানে স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছে বলে, এই স্তূপের নাম স্বয়ম্ভূনাথ।
পুরাণ অনুযায়ী, পুরো স্তূপটি একসময় স্ফটিকের তৈরি ছিল।
এখনও এই স্তূপ ও মন্দিরের কারুকার্য দেখে অবাক হতে হয়। বজ্রযানপন্থী বৌদ্ধদের কাছে তো বটেই, অন্যপন্থী বৌদ্ধদের কাছেও পরম পবিত্র তীর্থ স্বয়ম্ভূ স্তূপ। প্রতিদিন শত শত বৌদ্ধ পুণ্যার্থী সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের পুবদিক থেকে স্তূপ প্রদক্ষিণ শুরু করেন।
স্তূপ এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন সুন্দর তেমনি সুন্দর স্তূপের স্থাপত্য। এখানে একটি স্তূপ, অসংখ্য গাছ, তিব্বতি উপাসনালয় এবং একটি মন্দির আছে।
মন্দিরটি ‘মাংকি টেম্পল’ বা বানর মন্দির নামে পরিচিত। স্বয়ম্ভূ স্তূপেও প্রচুর বানর রয়েছে। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বিশ্বাস, এখানকার বানরগুলো পবিত্র। অনেক পর্যটক ওদের খাবারও দেন খেতে। বানর মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি বিশাল বজ্র এবং স্তূপ চত্বরে প্রবেশের মুখেই রয়েছে বিশাল সিংহমূর্তি।
স্বয়ম্ভূ স্তূপে পৌঁছানোর দুটি পথ রয়েছে। পুরনো পথটি দিয়ে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। এই পথ দিয়ে প্রবেশদ্বার থেকে ৩৬৫ ধাপের সিঁড়ি ভেঙে মূল স্তূপে পৌঁছাতে হয়। এখন অবশ্য নতুন আরেকটি রাস্তা বানানো হয়েছে। সে রাস্তায় গাড়ি দিয়ে মূল স্তূপ চত্বরের একেবারে কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়।
এই পথটিও ভীষণ সুন্দর, পাহাড়ের চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে।
মূল স্তূপে রয়েছে একটি গম্বুজাকৃতির কাঠামো। এর উপর রয়েছে ঘনক আকৃতির আরেকটি কাঠামো, যার সবদিকেই আঁকা রয়েছে বিশাল চোখ। বলা হয়ে থাকে, এ চোখ জোড়া গৌতম বুদ্ধের। তিনি পরম শান্তি ও করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বিশ্বের দিকে।
স্তূপ চত্বরে বিশালকার বুদ্ধমূর্তিও রয়েছে।
মূল স্তূপে আরও রয়েছে পাঁচ কোণাকৃতির একটি তোরণ। এই তোরণে রয়েছে ১৩টি স্তর। কারণ বুদ্ধত্ব অর্জন করতে হলে ১৩টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আর চারদিকে পঞ্চবুদ্ধের ছবি খোদাই করা আছে।
এই পঞ্চবুদ্ধ তন্ত্রযানের প্রতীক। এই পঞ্চবুদ্ধের নাম হল-- বৈরোচন, অক্ষভয়, রত্নসম্ভব, অমিতাভ এবং অমোঘসিদ্ধি।
পঞ্চম শতাব্দীতে রাজা ব্রজদেব এই বৌদ্ধস্তূপ প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজা ব্রজদেব ছিলেন রাজা মাণ্ডবের পূর্বপুরুষ। আবার অনেকে বলে, সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এখানে এসেছিলেন।
তখন তিনি একটি উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন। সেটি পরে ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে এক সময় ‘লিচ্ছবি’ গণরাজ্য ছিল। শুধু বৌদ্ধ রাজাদের কাছেই যে এ স্থান পরম পবিত্র ছিল তাই নয়, হিন্দু রাজারাও স্বয়ম্ভূ স্তূপে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সপ্তদশ শতকে কাঠমান্ডুর রাজা প্রতাপমল্ল এই স্তূপে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তখন তিনি এই স্তূপের অনেক সংস্কারও করেন।
গত ১৫শ বছর ধরে স্বয়ম্ভূ স্তূপ এলাকায় প্রায় ১৫ বার সংস্কার কাজ করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার করা হয় ২০১০ সালে। তখন স্তূপের গম্বুজাকার কাঠামোটি ২০ কেজি সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও পর্যটকদের জন্য এখানে একটি জাদুঘর, একটি গ্রন্থাগার, খাওয়ার জায়গা এবং স্মারকচিহ্ন বিক্রির জন্য বেশ কিছু দোকানও রয়েছে।
স্বয়ম্ভূ স্তূপ শুধু পবিত্র স্থানই নয়। একে বলা হয় নেপালের ঐক্যের প্রতীক। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য ইউনেস্কো স্বয়ম্ভূ স্তূপকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলেও ঘোষণা করেছে।
আরেকটা কথা, সত্যজিৎ রায়ের ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ নামে যে বইটা আছে, তাতেও কিন্তু এই স্বয়ম্ভূ স্তূপের বর্ণনা আছে। চাইলে স্তূপে যাওয়ার সময় বইটা নিয়েও যাওয়া যেতে পারে।
তাহলে ফেলুদা আর তোপসে যে জায়গাগুলোতে গিয়েছিল, সেগুলোও দেখে আসা যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।