আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়া-মাটিয়ান হাওরের-কান্দা-জাঙ্গালকে বিশ্বব্যাপী আরো পরিচিত করবে গৌতম ঘোষের 'মনে মানুষ'

দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...

আকাশের কোলে কুয়াশা। মেঘের মতো খন্ড খন্ড। মেঘের কোলো কুয়াশাকে তাড়াতে প্রাণপণে লুটিপুটি খাচ্ছে সোনারোদ। বিশাল হাওরের বুক ছুঁয়ে আসা সীমান্তঘেঁষা ঠান্ডা বাতাস শিষ কাটছে কানে। এরকম নৈসর্গিক অতিপ্রাকৃতিক লোকেশানে ওপার বাংলার প্রখ্যাত নির্মাতা গৌতম ঘোষ মহান সাধক লালনের জীবনদর্শন নিয়ে নির্মিত ছবি ‘মনের মানুষ'র শুটিং করলেন সুনামগঞ্জে।

লালনের ভাবসুন্দর কবিতার মতো সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর ও মাটিয়ান হাওরের কান্দা-জাঙ্গাল ঝলকে উঠেছিল গৌতম ঘোষের ক্যামেরার ঝিলিকে। ৮ জানুয়ারি শুটিং শেষে তিনি ফিরে যান। গৌতম ঘোষ টাঙ্গুয়ার হাওর লাগোয়া ছায়াঘেরা, হাওর-নদীঘেরা ছোট্র গ্রাম ইকরামপুর, জয়পুর-গোলাবাড়ি, রৌয়াসহ বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন মনের মানুষ ছবির। টানা চার দিন তিনি শনির হাওরের বগিয়ানি স্লুইস গেইটসহ টাঙ্গুয়া, শনি মাটিয়ানের বিভিন্ন বিলঝিলে শুটিং করেন। হাসনের তরীতে লালনকে ভাসিয়ে দেন বৌলাই, হাসমারাসহ বিভিন্ন হাওরে।

৬ জানুয়ারি বুধবার। বৌলাই নদী। স্থানীয়ভাবে হাসমারা বলা হয়। নদীর পশ্চিমপাড় হলো আন্তর্জাতিক রামসার সাইট টাঙ্গুয়া আর পূর্ব পাড়ে মাটিয়ান হাওর। আকাবাঁকা নদী।

দুটি হাওরের মধ্যবর্তী জনবসতিবিহীন এই স্থান থেকে মাটিয়ান হাওরের গ্রুফ ফিশারী খলা বানিয়ে শাসন করেন ইজারাদাররা। এমন একটি সুন্দর স্থানেই ওই দিনের শুটিং শেষ করেন তিনি, বিষণœ লালনকে নৌকায় ভাসিয়ে...। জয়পুরে শুটিং শেষ করে বিকেল ৩.৪৫ মিনিটে পরিচালক গৌতম ঘোষ নামলেন স্পিড বোট থেকে। শুটিংয়ের পোশাক পড়ে তার সঙ্গে নামলেন প্রসেনজিত, পাউলি ধাম, বিবি রাসেল, রাইসুল ইসলাম আসাদ, হাবিবুর রহমান খান, শাহেদ আলী সুজনসহ অন্য সঙ্গীরা। পরে আরো তিনটি নৌকা করে অন্যরা এসে খাওয়াধাওয়া শেষ করে শুটিং উপকরণ জড়ো করে রাখেন।

তারপর খেয়ে আবার ছবিতে ডুবে যাওয়া। পড়ন্ত বিকেল। সুন্দর বৌলাই নদীর বুকে চুমু খাচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্য। খলাঘরে বসে টাঙ্গুয়া আর মাটিয়ানের ঝাক ঝাক অতিথি পাখির ডানার ওড়াল দেখছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, বিবি রাসেল, চঞ্চল চৌধুরী, পাউলি ধামসহ অন্যরা। ওদিকে হাসমারা নদীর বুকে আলোর তানে নৃত্য করছে ঢেউ।

চারিদিকের সারি সারি হিজলের গাছপাতা সারা দিচ্ছে এই তানে। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য পলকে চোখ ভরে দেখে নিলেন গৌতম ঘোষ। ক্যামেরা তাক করে ভাসিয়ে দিলেন লালন প্রসেনজিতকে। এর আগে একটি ছোট নৌকা ও দুটি মাঝারি নৌকা রশিতে বেঁধে ক্যামেরা বসিয়ে চালককে স্টার্ট দিতে বললেন। হাল্কা ভলিয়ুমে বাজছে লালনের গান।

সুনসান র্নিরবতা। গানের বাণী সুর সব মিলে গেছে হাওর-নদীর গুরু গম্ভীর আবহে। প্রসেনজিতকে ছোট হাত নৌকায় ছেড়ে দিয়ে নদীর পাড়ে এসে ক্রেনে বসে ক্যমেরায় নিতে থাকেন একের পর এক শর্ট। শেষ বিকেলের হলুদ লাল আলো। ডুবে যাচ্ছে।

বৌলাইর শান্ত স্রোতও আরো শান্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় মাঝি শামীমের থির থির বৈঠার টানে লালনবাহী নৌকা ছুটে যাচ্ছে মহাকালের গর্ভে। এমনই একটি ভাবগম্ভীর দৃশ্য শুটিং করে ওইদিনের শুটিং শেষ করলেন গৌতম ঘোষ। সঙ্গীদের দিক নির্দেশনা দিলেন আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) ভোর চারটায় একই স্থানে শুটিং সম্পন্ন করার। শুটিং শেষে রাত সাড়ে ৮ টায় তাহিরপুর রেস্ট হাউসে কথা হয় গৌতম ঘোষের সঙ্গে।

জানতে চাই লালনের দেশ কুষ্টিয়া রেখে এমন বিড়ম্বিত স্থান বেছে নেওয়ার কী কারণ। তিনি জানান, ছবিটা লালনের জীবনী নয়। তার জীবনদর্শন নিয়ে। কুষ্টিয়া লালনের জন্মভিটা হলেও তার কোন দেশকাল নেই। তিনি বলেন, লালনের সেই সময়ের কুষ্টিয়া এখন আর আগের মত নেই।

আমি প্রায় ২ বছর ধরে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এই এমন কিছু স্থান নির্বাচন করেছি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর অন্যতম। গত বছরের অক্টোবর মাসে টাঙ্গুয়া ঘুরে যাই। এর জলমগ্ন উদার আকাশ আর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো অসাধারন। একবার দেখেই আমার ভীষণ পছন্দ হয়।

তাই একবার দেখেই আমি এখানে শুটিং করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। এরকম একটি যোগাযোগ বিড়ম্বিত লোকেশনের কথা শোনে আমার ঘনিষ্টনরা ভড়কে যান এবং অন্য কোন জায়গা চোজ করার জন্য বলেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নেই এখানেই করব। গৌতম ঘোষ বলেন এটি একটি বিশাল কাজ। লালনের মানবতাবাদী ভাবদর্শন আর হাওরের স্বপ্ন-কল্পদৃশ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এর মাধ্যমে।

এখানে শুটিং শেষ করার পর পদ্মার চর ও টাঙ্গাইলে যাবেন তিনি। তারপর ছবির বাকি ১০ ভাগ কাজ শিলিগুরির একটি জঙ্গলে করবেন। টাঙ্গুয়াসহ প্রতিটি লোকেশনই লালনের ভাবদর্শনের সঙ্গে কল্পদৃশ্য সদৃশ। গৌতম ঘোষ আরো জানান, ১৯৯২ সনে পদ্মানদীর মাঝি করে প্রায় ১১ বছর বিরতি দিয়ে ২০০৩ সনে আবার অরণ্যের কাজ শুরু করেন। তারপর দীর্ঘ ৬ বছর টানা বিরতি দিয়ে কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনের মানুষ’ অবলম্বনে লালনের জীবনদর্শন, তার সময়কাল ও সমাজ বাস্তবতার মানুষের নানা দিক নিয়ে লালন দার্শনিকতার আলোকে ‘মনের মানুষ’ ছবির কাজ শুরু করেন।

এই ছবিতে প্রখ্যাত অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ লালনের গুরু সিরাজসাঁই, জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিত লালন, চঞ্চল চৌধুরী কালোয়া মীর্জা, পাউলি ধাম কমলী চরিত্রে অভিনয় করেন। ছোট লালন চরিত্রে বাংলাদেশের জিসান ও ছোট কমলী চরিত্রে তাথৈ অভিনয় করেন। যৌথ প্রযোজনায় রয়েছেন বাংলাদেশের হাবিবুর রহমান খান ও ভারতের গৌতম কুন্ড। কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে রয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যতি সম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল। ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ, প্রধান চিত্র গ্রাহক, সঙ্গীত পরিচালনায় রয়েছেন গৌতম ঘোষ নিজেই।

এ ছবিতে লালনের গান গাইবেন ফরিদা পারভিন ও লতিফ শাহ। এ প্রসঙ্গে গৌতম ঘোষ বলেন, লালনের সময় খোদাবক্স খাঁ নামে এক বাউল ছিলেন। তার বংশধর হচ্ছেন এই লতিফ শাহ। অসাধারণ কণ্ঠ তার। এর আগে তিনি কখনো ছবিতে গান করেননি।

এই প্রথম তিনি গান করলেন। ছবির অন্যতম প্রধান অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, গৌতম ঘোষ কাজের প্রতি কমিটেড। তিনি দরদ দিয়ে কাজ করেন। তিনি কাহিনীর ভেতর ঢুকে গিয়ে পারিপার্শকতাকেও জীবন্ত করে তোলেন। তার বিচারে লালন ভাবনা-দর্শনের সঙ্গে এই এলাকারও দার্শনিক মিল রয়েছে।

উদার আকাশ বিস্তৃত দিগন্ত যে কাউকেই ভাবনায় ডুবিয়ে দেয়। তাই এমন ভাবনার সঙ্গে ছবির কলাকুশলিরাও মিশে গিয়ে কাজ করেছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.