সীমানার প্রাচীর টপকাতে হবে
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কলংক। এই দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা, স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যাপক খুন, ধর্ষন ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত থাকা এই দলটি আজ মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তাই না, রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে তারা ক্ষমতা ভোগ করে, মন্ত্রীও হয়েছে। এই লজ্জা আমরা রাখি কোথায়? ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা ইসলামকে কলুষিত করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল ধর্মপ্রান মানুষের ব্রেন ওয়াশ করে তারা ভোট ব্যাংকও গড়ে তুলেছে।
পুরো দেশ জুড়ে মাদ্রাসাগুলো কেন্দ্র করে তারা যে নেটওয়ার্ক তৈরী করে রেখেছে, তা আজ দেশের জন্য বড় রকমের হুমকি। কিন্তু তার চেয়েও বড় হুমকি হল, এই দেশের বড় দুইটি রাজনৈতিক দলই রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার জন্য তাদের মিত্র হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মাটিতে রাজনীতি করলেও এই দলটি আজও পাকিস্তানপন্থী। তাদের মাধ্যমেই জন্ম হয়েছে জেএমবি-র। জামায়াত স্বীকার না করলেও জেএমবি-র গ্রেপ্তার হওয়া কর্মীদের অধিকাংশই জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত থাকবার প্রমান পাওয়া গেছে।
এই দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ দলটিকে কেন নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হবে না?
জামায়াতের পূর্বের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক
জামায়াতে ইসলামীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট পাকিস্তানের লাহোরে। প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী। মজার ব্যাপার হল পাকিস্তানপন্থী এই দলটি কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ছিল না। কিন্তু সত্যি সত্যি ভারত পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই দলটি পুরোমাত্রায় পাকিস্তানপন্থী বনে যায়। দেশ বিভাগের সময়ে রায়টে অনেক মানুষ মারা যায়।
ঐ রায়টের অন্যতম রূপকার ছিল এই মওদুদী। এই কারনে ১৯৫৩ সালে তাকে সামরিক আদালত মৃত্যুদন্ড দেয়। তারপর মৃত্যুদন্ড মাফ করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়, যা কিনা অত্যন্ত নেক্কারজনক কাজ ছিল। এভাবে জামায়াত কিন্তু তার জন্মের পর থেকেই সাম্প্রদায়িক নীতিতে চলেছে এবং খুন-খারাবি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত ছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা
এই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা কি ছিল তা এই দেশের মানুষ মাত্রই জানেন। সেটা এতই দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে খুব বেশী আলোচনা করার কিছু নেই। পাকিস্তানে জন্ম নেয়া এবং পাকিস্তানপন্থী নীতিতে চলা এই দলটির বাঙ্গালী নেতারাও আসলে কাজে-কর্মে ধ্যান-ধারনায় পাকিস্থানী ছিল এবং আজও আছে। তাই তো সব সমস্ত বাঙ্গালী জাতি যখন পাকিস্তানী আর্মির অন্যায় আক্রমনের জবাব দিচ্ছে, তখন তারা বাঙ্গালী হয়েও নির্লজ্জের মত পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে এক হয়ে কাজ করেছে।
নিজেদেরকে ইসলামিক দল হিসেবে পরিচয় দিলে কি হবে? গনহত্যা, ধর্ষন - হেন কোন অপরাধ নেই যা তারা করেনি।
তাদের ইসলাম আসলে কি সেটা ১৯৪৭ সালের দাঙ্গায় একবার প্রমান হলেও ১৯৭১ সালের মত এতটা নির্লজ্জভাবে প্রতীয়মান হয়নি। এসব অপকর্ম করার জন্য তারা প্রথমে শান্তি কমিটি গঠন করে। তারপর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। উদ্দেশ্য একটাই - হত্যা, ধর্ষন ও লুটতরাজ করা। ৯ মাসে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা, প্রায় ৪ লক্ষ ধর্ষন - এত অল্প সময়ে এত অল্প জায়গার ভিতরে এটা ইতিহাসের বৃহত্তম জেনোসাইড।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪ বছরে পুরো ইউরোপে ৪০ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬ বছরে তিন মহাদেশ মিলে ৬ কোটি মানুষ হত্যা করা হয়। সেই তুলনায় বাংলাদেশের মত এত ছোট ল্যান্ডে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা অনেক ভয়াবহ ও বর্বরতুল্য। ১৪ ডিসেম্বরে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় নিরস্ত্র বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়, ইতিহাসে এমন বর্বর হত্যাকান্ডের নজির পাওয়া যায় না।
স্বাধীনতার পর জামায়াত হল নিষিদ্ধ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসবার পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন।
গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতারা প্রানভয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। যারা পালাতে পারেনি তারা জেলখানায় অবরুদ্ধ হয়। সেই সময়ে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চাপের কারনে এইসব দেশদ্রোহীদের অপরাধের বিচার খুব বেশি দূর এগোতে পারে নি। বরং বঙ্গবন্ধু সাধারন অপরাধের অপরাধীদেরকে সাধারন ক্ষমা ঘোষনা দিতে বাধ্য হন। তবে মনে রাখতে হবে, সাধারন ক্ষমা কেবল সাধারন অপরাধের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
হত্যা-ধর্ষনের জন্য সেই সাধারন ক্ষমা প্রযোজ্য নয়। সেই সাধারন ক্ষমার সুযোগ নিয়ে আজ কিছু দল রাজনীতি করে, এটা সত্যি খুব দুঃখজনক ও জাতির জন্য বড় ধরনের লজ্জা।
রাজনীতিতে জামায়াতের প্রত্যাবর্তন
আমাদের রাজনীতির জন্য খুব লজ্জা ও কলংকজনক ব্যাপার হল, হত্যা-ধর্ষন এবং সর্বোপরি দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার কারনে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি মাত্র চার বছরের মাথায় আবার এই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করল। এই লজ্জা রাখি কোথায়? জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার হয়েও জামায়াতকে রাজনীতিতে ফিরবার সুযোগ করে দিলেন। শুধু তাই না, গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাইদী সহ বড় বড় অপরাধীদেরকে দেশে ফিরবার সুযোগ করে দিলেন এবং কারাগার থেকে মুক্ত করে দিলেন।
এই দেশের ইতিহাসে একজন মুক্তিযোদ্ধার সবচেয়ে বড় বেইমানীর উদাহরন এটি। জামায়াতে ইসলামী এবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামে আত্মপ্রকাশ করল। ছাত্র সংঘের আদলে তৈরী হল ছাত্র শিবির। ছাত্র শিবিরে পক্ষে অনেককে সাফাই গাইতে দেখি, তারা তো স্বাধীনতা যুদ্ধে অপকর্ম করেনি। তাদেরকে কেন ঘৃনা করা হবে।
হবে এই কারনে যে, তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন করে এবং তাদের ধ্যান-ধারনাকে বহন করে চলছে। এই হিসেবে তারা কিন্তু বর্তমানে একাত্তরের রাজাকারদের চেয়েও ভয়ংকর।
দায় এড়াতে পারবেনা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি
বর্তমানে জামায়াতের শক্ত অবস্থানে পৌছবার দায় এড়াতে পারবে না আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কেউই। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনে জামায়াতের সাথে এক হয়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ দিল রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার জন্য কি সুন্দর এক হয়ে গেল।
এই দিক থেকে বিএনপি আরো এক ডিগ্রী এগিয়ে আছে। জিয়াউর রহমান তো তাদেরকে ছাড়পত্র দিয়েই যান। এর কনসিকয়েন্সে একবার কোয়ালিশন সরকারে তারা পা দিল। আর পরের টার্মগুলোতে রীতিমত জোটবদ্ধ হয়ে মন্ত্রীত্ব পর্যন্ত ভোগ করে ফেলল। এখন ভাঙ্গাচুরা বিএনপিতে বলতে গেলে জামায়াতই রাজত্ব করছে।
বিএনপির ক্ষয় দুইভাবে এই দেশের রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এক. জামায়াত শক্তিশালী হচ্ছে। দুই. আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্য বেড়ে যাচ্ছে।
জামায়াতের কথা বাদ দিলেও ছাত্রশিবির অনেক ক্ষেত্রে সমর্থন লাভ করেছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অনাচারের কারনে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সীমাহীন সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজির কারনে ছাত্রশিবির অনেক সাফাই গাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
ইসলামের রাজনীতি আর ইসলামের নামে রাজনীতি এক নয় কিন্তু
ইসলামের নামে রাজনীতি করে জামায়াত ও ছাত্রশিবির আসলে ইসলামকে কলুষিত করেছে। অনেক জায়গায় দেখেছি, ধর্মপ্রান মানুষদেরকে জামায়াত কর্মী হিসেবে অনেকে সন্দেহ করে। ধর্মের সাথে জামায়াতের কি সম্পর্ক? ইসলাম কি হত্যা, ধর্ষনকে সমর্থন করে? জামায়াত সত্যিকারের ইসলামিক দল হলে একাত্তরে কি গনহত্যা ও ধর্ষন করতে পারত? জামায়াত ইসলামের নাম দিয়ে মানুষকে ধোকা দেয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, জামায়াতের সমর্থন প্রত্যন্ত ধর্মপ্রান এলাকাগুলোতেই বেশি। সহজসরল ধর্মপ্রান মানুষের ধর্ম নিয়ে তারা খেলা করে।
মাদ্রাসা জুড়ে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক। কারন মাদ্রাসায় অল্প বয়েস থেকে তারা ছাত্রদের ব্রেন ওয়াশ করে নিজেদের আদর্শে পাকাপোক্ত করে ফেলতে পারে। ঐসব ছাত্রদের তারা যেভাবে বোঝায় সেভাবেই চলে। তাই মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার করার বিরুদ্ধে তারাই সবচেয়ে সোচ্চার। মাদ্রাসা মাত্রই জামায়াতের নেটওয়ার্ক তা কিন্তু আমি বলছি না।
তবে অনেক মাদ্রাসা বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাদ্রাসা জুড়ে তারা নেটওয়ার্ক করে রেখেছে।
জঙ্গী তৎপরতা
জামায়াতের সাথে জেএমবি-র কোন সম্পর্ক নেই, এমন কথা অনেককেই বলতে শুনেছি। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? জেএমবি-র সদস্যরা জামায়াতের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় মাঠে নামে। জেএমবি-র গ্রেপ্তার হওয়া অনেক নেতা-কর্মীকে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। আপাতদৃষ্টিতে তাই বিচ্ছিন্ন সংগঠন মনে হলেও জেএমবি তাই জামায়াতের মাঠ পর্যায়ের একশন টিম।
আর এই দুই দলের আদর্শের অবস্থানও কিন্তু খুব দূরে নয়।
শেষ কথা
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যদি জামায়াত তার খুন-ধর্ষন-দেশবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে পারে, তাহলে আজ আবার নয় কেন? সেই সাথে তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ ঘোষনা করা উচিত। খুনী ধর্ষক ও দেশদ্রোহীরা এই দেশে শাসন করবে, মন্ত্রী হবে, বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, এটা কি মেনে নেয়া যায়? এই দেশের সকল বিবেকবান মানুষের কাছে আমার তাই প্রশ্ন, জামায়াতে ইসলামীকে কেন নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হবে না?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।