কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
সাদা কালো ডোরাকাটা মাফলার গলাতে পেঁচিয়ে ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। কালো স্যুট, হয়ত দুই কি তিন বছর ধরে খুব রাফ ইউজ করা এই জিনিস, ছিঁড়ে যাবে যাবে এমন ভাব। উনি কাছে এগিয়ে আসলেন। আর কিছুই হলনা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
আমার মনে হচ্ছে নিজেই হেসে দিব, রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। উনি আমার বিপরীত দিকে আগাচ্ছেন। আমার মুখোমুখি উনার হতেই হত।
এরপরও কেন যেন লোকটার হেঁটে আসার ভঙ্গীটা চোখে লাগছিল। ভাবছিলাম, এই যে ভদ্রলোককে এখন দেখলাম, চোখে পড়ল এতে কীই বা আসে যায়।
সারাজীবনে হয়ত উনার সাথে আমার আর দেখা হবে না। কীংবা দেখা হলেও হয়ত উনাকে দেখে মনে করতে পারব না। আমি হাঁটছিলাম সামনের দিকে। সেভাবেই হাঁটতে থাকি। সন্ধ্যার এই সময়টা হাঁটতে আমার ভালই লাগে।
মাত্র সন্ধ্যা শুরু হল। যাচ্ছি এক দোস্তর সাথে দেখা করতে। সে থাকে অনেক দূরের এলাকায়। পল্টনে। কোন কারণে মহাখালীতে এসেছে সে।
আমার বাসাও এখানেই হওয়াতে আমাকে ডাক দিল। আসলে খুব একটা ক্লোজ না, তবে মোটামোটি ইদানীং খাতির হয়েছে ভালই। যেমনটা ভাবছিলাম আবার ভাবা শুরু করি। ওই লোকটার হয়ত হাজারটা কাহিনী থাকতে পারে, হয়ত এক সময় সে বিশেষ কিছু হয়েও উঠতে পারে। আবার হয়ত নিতান্তই ছাপোষা মানুষ।
ভদ্রলোককে আমি দেখলাম, ব্যাস এটুকুই। আর কিছু না। তার শত কাহিনীর কোন কিছুই আমি জানি না, আর জানব না। হয়ত একদিন উনার কোন কাহিনীর সাথে আমার কোন কাহিনীও জড়িয়ে যেতে পারে।
এমনি এমনি এলোমেলো ভাবনা ভেবে সময় কাটাই।
মাঝে মাঝে মনে হয় দারুণ একটা কণ্ঠ পেলে এসব ভাব নিয়ে ধুমধাম গান গাইতাম। আমি হাঁটতে থাকি সামনে। এর দিকে তাকাই তার দিকে তাকাই। ছোট্ট ছেলেটা, হলুদ মোজা পড়া। দুটো মেয়ে হেসে হেসে গড়াগড়ি খেতে বের হচ্ছে শপিং মল থেকে।
একটা ছেলে অনেকক্ষণ ধরে বাইকের উপর উঠে বসে ভাব নিচ্ছিল। একটু পরে তার দোস্ত আসল, আর সে চলে গেল। বাইকটা বোধহয় এই বন্ধুরই। আমি চারপাশ তাকাতে থাকি। মানুষের কোন কমতি নেই ঢাকা শহরে।
হাঁটি আর মনে মনে গান গাওয়ার পাঁয়তারা করি।
হঠাৎ করেই চোখে পড়ে একটা অভিমানে গাল ফুলানো মুখ। রাস্তার ওপাশে। ধ্বক করে একটা ধাক্কা খেলাম যেন। উফফ কেন আমি ছবি আঁকতে পারি না! পারলে হয়ত এই মেয়েটার একটা ছবি আঁকতাম আমি।
একেবারে সাধারণ একটা মেয়ে। ফর্সা, মিষ্টি চেহারা। সাধারণ উচ্চতা আর অভিমানে গাল ফুলানো ভ্রু কুঁচকে থাকা একটা মুখ। খুব সুন্দর কী না জানি না, শুধু এটুকু জানি আমার চোখে সব কিছু সাদাকালো আর এই মেয়েটাকেই শুধু রঙ্গীন লাগছে।
কখনও বোধহয় মানুষের এমন হয়, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা না, বরং ঠিক তার পেছনে বসে থাকা চুপচাপ টাইপের একটা সিম্পল মেয়েকে ভাল লেগে যায়।
আমি মোটামুটি একটা ধাক্কা খেয়েছি, এখন এর প্রতিক্রিয়া কী দেখানো উচিত বুঝছি না। মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে কিছু না করলে হয়ত আর কখনই কোন সুযগ পাব না। কেমন যেন একটা উত্তেজনা ভর করছে। টেনশন না, বরং অনেকটা কাহিনীর শেষমুহূর্তের উত্তেজনা। এখন কী হবে, এখন কী হবে — এই টাইপ।
আমি ভাবছি আর আরও এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তাটা পার হলাম। আরও এগুচ্ছি। হঠাৎ দেখি যেই দোস্তের সাথে দেখা করতে এসেছি, সে দাঁড়িয়ে। ভাবলাম, যাক একজন পাওয়া গেল, ও বরং সাথে থাকলে একদম অপরিচিত একটা মেয়র সাথে কথা শুরু করতে সহজ হবে।
ওকে দেখে আমি হাত নাড়লাম। জিসান এগিয়ে আসল। “দোস্ত অ অ অ”, মুখে একটা হাসি তার।
“ ঐ মকসুস, এতক্ষণ লাগে আসতে? ”
“ বুঝিস না, ব্যাচেলর মানুষ, চারিদিক দেখতে দেখতে আসি। তুই হঠাৎ এদিক আসলি কেন? ”
“ বের হইছিলাম এক কাজে।
আয়েশা মেমোরিয়ালে একজন রোগী ছিল, তাকেই দেখতে আসা। তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথা গরম হয়ে গেল ব্যাটা। ”
“ কাকে দেখতে আসছিস? তুই আবার মানুষের খোঁজ নেয়া শুরু করলি কবে থেকে? ”
“ দূর সম্পর্কের শালা লাগে। মানে আমার গার্লফ্রেন্ডের দোস্ত। দাঁড়া ব্যাটা, তোর জরিমানা করা উচিত।
রাস্তার মধ্যে তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুইজন এতক্ষণ ধরে। ৪৫ মিনিট হবে। আমার বউ আমার উপর তিতি বিরক্ত হয়ে গেছে ব্যাটা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে। ”
হঠাৎ করে বুঝে গেলাম গল্পের বাকি কাহিনী। মনে মনে বার বার না না বলছি।
বলাটাই সার। এমন হবে এটাই ত স্বাভাবিক। দুনিয়াতে যে শুধু আমার একারই চোখ আছে ব্যাপার টা তা না। আমার বন্ধুরও চোখ আছে। যাকে আমার এই মাত্র দেখে এত ভাল লাগল, তাকে আমার আগে আরও কয়েক হাজার ছেলে দেখেছে হয়ত।
আর তাদের মাঝে কমপক্ষে ৫০ টা ছেলের কাছে মেয়েটাকে আমার মত ভাল লেগেছে বা হয়ত তার চেয়েও বেশি। এদের মাঝে একজন আমার দোস্ত হতেই পারে। হয়ত তার আগেও কয়েকজন থাকতে পারে, কিংবা তার পরেও হয়ত কয়েকজন থাকবে। কিছুক্ষণ আগের দেখা সেই ভদ্রলোকের কথা খেয়াল হল। কারও জীবনে কত কাহিনীই হয়ত থাকতে পারে, জানি না আর জানতেও পারব না।
“ এইটা হইল তোর ভাবী, সোমা ” আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল জিসান। আর আমিও পরিচিত হলার ওর মাধ্যমেই, “ এইটা হল তোমার দেবর, পাগলা। ” আমি দাঁত খিঁচিয়ে বললাম, “ দেবর কী রে, ফাজিল? বল ভাসুর। ” আমরা তিনজনেই হেসে দিলাম কিন্তু মনের ভিতর আমার যেন পেন্সিল কম্পাস দিয়ে কেউ খোঁচাচ্ছে।
সোমাকে দেখলাম।
এবার কাছ থেকে। মেয়েটা আসলে খুব বেশি সুন্দর না হলেও মোটামুটি সুন্দর বলা যায়। নিজের প্রতিই হাসলাম, খুব সুন্দরী মেয়েকে চোখে না পড়লেও যাকে নিয়ে মনে মনে কবি কবি ডায়লগ দিলাম, সেও ভালই সুন্দর। আসলে খুব অসুন্দর মেয়েকে নিয়ে বোধহয় প্রেমের কবিতা হয় না। কবিতায় মাঝে মাঝে একটু কম সুন্দর মেয়েরাও নায়িকা হয়, কিন্তু সেও সুন্দরের কাছাকাছিই থাকে।
হায় রে মানব মন! একটা কথা ভেবে কেমন যেন ভাল লাগছে, আর কিছু না হোক, আমার অপেক্ষাতে থেকেই হয়ত মেয়েটা এমন নিজে নিজে রাগ করে গাল ফুলিয়েছিল। আমিই সেই কার্যকারণ। একটু আগে প্রথম যখন দেখলাম, তখন কী ভাবতে পেরেছিলাম !
“ তোর জন্য আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি দাঁড়িয়ে আছি এতক্ষণ ধরে। এখন কোথায় চাইনীজ খাওয়াবি বল ! ”
“ নতুন খবর শুনছিস? চাইনিজরা বাদামও খায়। আয়, তোদের বাদাম খাওয়াই।
”
আমার হালকা রসিকতায় সোমা হেসে দিল। চিকন ফিগারে নীল সালোয়ার কামিজ আর সাদা ওড়না আর ফর্সা মুখে সোমার হাসি ওর চোখ পর্যন্ত ঝিকিয়ে উঠল। আমি হঠাৎ চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জিসান আর দেরী করতে রাজি নয়। আমার জন্য এমনিতেই ওরা অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।
“ পাগলা যাইগা বস, বেশি দেরী করলে সোমার বাসাতে ঝালাপালা টাইপ ঝালেমা করবে। পরে কল দিস। ”
“ ওর বাসায় জানে যে তোরা প্রেম করিস? ”
“ আরে নাহ। এইদিন আসে নাইরে ভাই। দোয়া করিস।
”
আমি রিকশা ডাকতে সামনে আসলাম। কল্যাণপুর যেতে হবে ওদের। প্রথমে সোমার বাসা হয়ে যাবে জিসান এরপর ওখান থেকেই বাস ধরবে। পাশে দাঁড়িয়ে জিসান আস্তে বলল, “একটু বুড়া টাইপের রিকশাওয়ালা দেখ ত! ছোঁড়া টাইপ হলে কাপল পাইলেই খালি একটু পর পর খালি পিছে তাকায়, ঠিকমত প্রেমও করা যায় না, কথাও বলা যায় না। “
আমি একটু গভীর শ্বাস ফেললাম।
“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল ভাইয়া। আবার দেখা হবে। এই জিসান, ভাইয়াকে নিয়ে একদিন কল্যাণপুর আসবা কিন্তু। ” আমি আবারও একটা হাসি দিলাম। সৌজন্যের হাসি।
সাথে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস। আর হয়ত দেখা হবে না, হলেও কিছু যায় আসে না। ওরা দুজন রিকশায় উঠল, মেয়েটা হুড উঠিয়ে দিল। আমি পেছন ফিরে আসলাম। একটু আগের মত রাস্তার সবার দিকে আবারও তাকাতে লাগলাম।
ব্যাগ কাঁধে ছোট্ট ছেলেটা, কয়েকটা ছেলে সিগারেট হাতে, গার্মেন্টসের কিছু মেয়ে দল বেঁধে হাঁটছে, হুঁশ করে যাওয়া সাদা গাড়িটার ভেতরে ইয়ারফোন কানে এক তরুণী, দুটো মেয়ে রিকশা খুঁজছে...............। সোমার কথা আবার খেয়াল হল। এমন কী হওয়া উচিত? কী যায় আসে এসবে !!
উড়ে যায় পাখিটা দূরে বহুদূরে
যেখানে নেই আমার ছায়া কোনখানে
পিছন সে ফেরে না, কীসের যে ভয়ে
হারিয়ে যাচ্ছে সে যে ঐ দূর নীল আকাশে।
বোকার মত আমিই যে শুধু বসে থাকি সারাজীবন ধরে
খালি খাঁচায় পড়ছে ধূলো, তবুও গাইছি গান একই সুরে।
© আকাশ_পাগলা
(গানের কিয়দাংশ অর্থহীনের।
পরিচিত গান,ফুটনোটস না দিলেও হয়, তাও দিলাম। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।