এলোমেলো ভাবনা সারাক্ষণ মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে
বাড়ি হতে যেদিকে তাকাতাম সে'দিকেই সোনালী ধানের ছড়াছড়ি। কৃষকেরা ধান কাটতো আর গান গাইতো। বাড়ির আঙ্গিনা হতে শুনতাম পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া আরো কত গানের সুর। সেই গানে ছিল প্রাণ। আমাদের ছিল প্রচুর জমি।
বাবা তাই বিভিন্ন এলাকা হতে ধান কাটার জন্য রাখাল নিয়ে আসতো। তারা দিনের বেলায় ধান কাটতো আর বিকালে খাল হতে প্রচুর মাছ ধরে নিয়ে আসতো। যখন মাছগুলো নিয়ে আসতো তখন খুশীতে মনটাই ভরে যেত। আমার মা তাকে সহযোগিতার জন্য ১০/১২ জন নারী সহযোগী রাখতেন। মাঝে মাঝে মা'র হাঁক ডাক শোনা যেত।
তারাতারি তোমরা সকলে আইস্,,,,সব মাছগুল্যা কাইট্যা রান্না করন লাগবো। আমরা মাছগুলি দেখতাম আর বলতাম 'ঐ মাছটা আমি খামু'। আমরা গোল হয়ে বসে মাছ কাটা দেখতাম। কিন্তু বাধ সাধতো আমার মা---যাও পড়তে বস। বাবা আর ভাইও মার সাথে সুর মিলাতো।
ইস মনটাই তখন খারাপ হয়ে যেত।
কৃষকেরা ধান কেটে বাড়িতে এনে বড় বড় পালা করতো। এত বড় যে উপর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম---আর সাথীদের বলতাম 'দেখ কত্ত্ব বড় পালা'। পাকা ধানের গন্ধে বাড়ি মৌ মৌ করতো। সেই গন্ধ যেন এখনো পাই যখন মনে করি সেই সব দিনের কথা।
দুপুরএর পর হতেই কিছু রাখাল গরু দিয়ে ধান মাড়াই করতো। গরু একটু এদিক সেদিক করলেই বলতো 'এই হ্যাট হ্যাট, এদিকে যা যা'। বিভিন্ন অঞ্চলের রাখাল আসাতে বিভিন্ন ধরণের ভাষাও শুনতাম,ভীষণ ভাল লাগতো। দিনের বেলায় মারাই করা ধানগুলো হতে ময়লা উড়িয়ে ধানের ঘর বোঝাই করা হতো।
মা আর মা'র সহযোগিরা ব্যাস্ত থাকতো, ধান ভিজানো, ধান ভাপে দেওয়া, শুকানো আরো কত কি।
বিকালে শোনা যেত চিড়া কোটার শব্দ। ঢেঁকিতে চিরা কোটা হতো। মাঝে মাঝে মা লেবুর পাতা দিয়ে চিরা কুটতো। সেই চিড়া যে কি মজা তা আমি বোঝাতে পারবো না। মুড়ি ভাজা হতো ।
ওহ্ গরম গরম মুড়ি। ইস স্বাদটাই আলাদা। মা মুড়ি দিয়ে মুড়ির নাড়ু করতেন, চিড়া দিয়ে চিড়ার নাড়ু আর নারিকেল দিয়ে নাড়িকেলের নাড়ু তৈরি করতো। আর নতুন ধানের চাল দিয়ে ক্ষীর রান্না করা হতো। বাড়ি বাড়ি তা আবার বিতরণও করতো আর বলতো 'সবাইকে নিয়্যা খাইতে হয়'।
নতুন ধান দিয়ে খই তৈরি করতো। খই গুর দিয়ে পাক দিতো । আমি ভীষন পছন্দ করতাম। দোতলায় বসে পড়তাম আর সবার অগচোরে খই খেতাম।
নতুন ধানের প্রথম ধানের চাল দিয়ে মোল্লা খাওয়ানো হতো।
ঐদিন সব ভাল ভাল রান্না করা হতো। আমার ভাই কিছুতেই তা মানতে পারতো না। কারণ ভাই ছিল কট্টর কমিউনিস্ট। মাকে বলত তুমি গরীবদের খাওয়াও, এই মোল্লা খাওয়ায়ে কোন লাভ হবে না। আমার মা আর দাদু কিছুতেই শুনতো না, তারা বলতো 'ও বাবু এ কতা কইতে হয় না, আগে মোল্লারে খাওয়াইতে হয়'।
ভাই রাগে গজ গজ করতে থাকতো।
আমাদের বাড়িতে তখন ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা হতে আত্মীয় আসার ধুম পড়ে যেত। আমার মার তখন কিযে ব্যস্ততা। একদিকে রান্না বান্নাসহ অন্যান্য কাজ আর অন্যদিকে আত্মীয় সামলানো। মাঝে মাঝে মা'র জন্য ভীষণ খারাপ লাগতো।
বিকালে মা তার সহযোগীদের নিয়ে পিঠা তৈরি করতে বসত। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, ভিজানো পিঠা, পুলিপিঠা, মুকশোলা, বিভিন্ন ধরণের তেলে ভাজা পিঠা, তেল চিতই, পাটিসাপটা, বড়া পিঠাসহ আরো কত ধরণের পিঠা তৈরি করতো মা! আমরা সব ভাই বোনেরাসহ আত্মীয় স্বজন চুলার চারপাশে বসে থাকতাম। কখন পিঠা খাব তবেই শান্তি। মা পিঠা সবাইকে সমান ভাবে ভাগ করে দিতেন। মার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল আগের পিঠাগুলো তার সহযোগীদের খাইয়ে নিতেন আর রাখালদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন।
কোন কোন আত্মীয় আবার এতে খুউব মাইন্ড করতো----কারণ তারা ঢাকাসহ অন্যান্য শহর হতে গিয়েছে। বলতো 'কেন, তারা তো পরেও খাবে'। মা বলতো, 'হ্ ওরা পরেও খাইবো কিন্তু ওরা কত কাজ করে তাই ওরা একটা একটা কইর্যা খাইয়্যা নিলে ওরা ভীষণ খুশী হইবো আর আমিও শান্তি পামু। পিঠা বানানো অবস্থাতেই মা আত্মীয়দের পিঠা দিত। সবাইকে সমান ভাগে ভাগ করে দিত।
সকলে পিঠা খেত আর বলতো আরো কয়টা দিন তারা থেকেই যাবে। প্রায় প্রতিদিনই এক এক ধরণের পিঠা তৈরি করতো আর পাড়ায় প্রতি বাড়িতে মা তা বিতরণ করতো। মা খিচুরী,পোলাও, পায়েস রান্না করতেন। বাড়ির মুরগী ধরে জবাই করা হতো। সকলকে চিড়া, মুড়ি, নারিকেল কোড়া, চিরা-মুড়ির নাড়ু, গুর নাস্তা হিসেবে খেতে দিতো।
মনে হতো আজই ঈদ। আমি এই সুযোগে ছড়া লিখতাম----
''নতুন ধান আসে
কৃষক তাই হাসে,
মা বানায় পিঠে পায়েস
মেহমান তাই আসে।
মোল্লা সাহেব খোস মেজাজে
খায় কত খাবার যে,
ভাই আমার গাল ফুলিয়ে
এটা সেটা ভান দেখিয়ে
বলে শোন দাদু
আবার যদি মোল্লা খাওয়াও
ডাকবো আমি যত গরীব
খাওয়াবো আমি তাদের,
দেখবে তখন কেমন আমি
জানি কত জাদু!''
রাতে আমরা তারাতারি পড়া শেষ করতাম। কারণ রাতের খাবারের পরই রাখালেরা গান আর গল্পের আসর বসাবে। গ্রামের লোকজন ভিড় করতো তা শুনতে।
মার সহযোগিদের পান বানানোর ধুম পড়ে যেত। আমরা পড়া শেষ করে টপ বারান্দায় (কাঠের দোতলা ঘরের সামনের বারান্দা) গুটি শুটি মেরে বসতাম গান আর গল্প শোনার জন্য। আত্মীয়-স্বজনও বসতো। শুরু হতো গল্প গুজব আর তারপর গান আর বিভিন্ন সাস্তর/কিচ্ছা-কাহিনী। ''আরে প্ররথমেতে শুরু করি আল্লা নবীর নাম-----আই --আই-- আই-------'' কিযে ভালো লাগতো।
একটা গান হতো তারপর শুরু হতো রূপ কথার গল্প। তবে গল্পের মাঝে মাঝে চলতো গান। ''এক দেশে আছিল এক রাজা, রাজার আছিল এক ছাওয়াল। সে কইলো আমি বানিজ্যিতি যামু----------''। আমি তো রাজকুমারের পাথর হয়ে যাওয়া শুনে কিযে কান্না।
আমার বোন বোঝালো ''এটাতো রূপ কথা। কান্না করে নাকি। মন দিয়ে শোন। বাবা যদি শোনে তুই কান্না করছিস তাহলে গল্প বলা বন্ধ করে দিবে আর এখনই তোকে পড়তে বলবে''। আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম আর কান্না করবো না।
হেমন্তকালে কেবলমাত্র খেঁজুর গাছ কাটা শুরু হতো। এসময়ে কিছু খেঁজুর গাছের রস হতো। কিন্তু সেই প্রথম রস শীতকালের মত এত বেশি মিষ্টি হতো না। কিন্তু তাতে কি, রস তো! আত্মীয় স্বজন তাতেই খুশী। সকাল হলে আমরা খেঁজুরের রস আর মুড়ি খেতাম।
গ্রামের অনেক লোক আসতো আমাদের বাড়িতে খেঁজুরের রস খেতে। গ্রামের লোকজন আর রাখালদের জন্য বাংলা ঘরে ব্যবস্থা করা হতো। মা একটুও বিরক্ত হতো না। বাবাও একাজে মাকে উৎসাহ যোগাতেন। আত্মীয়-স্বজনগণ মজা করে রস খেতেন।
আত্মীয়-স্বজনগণ যখন ফিরে যেতেন তখন পিঠা, গুড়, মুড়ি, চিড়া, খই সাথে করে নিয়ে যেতেন। মা তার সহযোগীসহ গ্রামের দুঃস্থ মানুষদেরও বাবার অগচোরে ধান দিত। বলতো এটা দিয়ে মুড়ি চিরা আর খই খাবি। গ্রামের সকলে মার জন্য দোয়া করতো আর বলতো মাস্টারের বউ পারেও বটে!
ভাই সহ গ্রামের ছেলেরা একদিন উৎসবের উদ্যোগ নিতেন, মুরুব্বীগণ একাজে তাদের সহযোগিতা করতেন---- সকল বাড়ি হতে নতুন ধানের চাল, ডাল ইত্যাদি কালেকশন করা হতো, আমাদের বাড়ি হতে একটু বেশিই দেয়া হতো। আমাদের বাড়ির সামনের খোলা জমিতে ক্ষীর আর খিচুরী রান্না করা হতে।
বউ ঝি বাদ দিয়ে গ্রামের যত লোক আছেন, সবাই আসতো। শিশুরা সুন্দর করে সেজে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতো। রান্না শেষ হলে কলাপাতায় তা খেতে দেওয়া হতো। গ্রামের বউ-ঝিদের জন্য আলাদা ভাবে তা পাঠিয়ে দেয়া হতো। কি যে মজা হতো সেদিন।
এখন কত কথাই না মনে পড়ে। এখন আমার কাছে সেই সব দিনের কথাগুলোকে মাঝে মাঝে রূপ কথার মতো মনে হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।