আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষার সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত- যত সরকার এসেছে তারা যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে- তা সবই ছিল মূলত বৈষম্যমূলক শিক্ষা সংকোচনের এবং দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ধারার। একমাত্র ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমী। প্রতিটি প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন লড়াই করেছে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল-তার নেতৃত্বে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন।

এই রিপোর্টে অত্যন্ত- নগ্নভাবে শিক্ষা সঙ্কোচনের কথা বলা হয়। সরকারি শিক্ষানীতি বাতিল ও সামরিক শাসন উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর আইয়ুব প্রদত্ত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে হরতাল ডাকা হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মোস-ফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ। তারপরও ছাত্র ইউনিয়ন এ দেশের ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়।

১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. আব্দুল মজিদ খান অত্যন- নগ্নভাবে সামপ্রদায়িক শিক্ষার প্রসার এবং সরকারি শিক্ষা সঙ্কোচন নীতি অবলম্বন করে শিক্ষানীতি ঘোষণা করে। প্রথম শ্রেণী থেকেই বাংলার সঙ্গে আরবি এবং দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজী অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনটি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এসএসসি কোর্স ১২ বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০% বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়। ছাত্র ইউনিয়ন এই গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ছাত্র সমাজকে আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী শিক্ষানীতি বাতিল ও সামরিক আইন প্রত্যাহার দাবিতে স্মরণকালের বৃহত্তম ছাত্র মিছিল হয়। সেদিন আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর ট্রাক উঠিয়ে দেয় এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী। শহীদ হয় দিপালী, কাঞ্চন সহ আরো অনেকে। শুধু শিক্ষানীতির আন্দোলন নয়, শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, ক্লাসরুম সংকট নিরসন, সেশন জ্যাম নিরসন, শিক্ষার্থিদের ইউনিফর্ম নিশ্চিতকরণ, ক্লাস শুরুর পূর্বে এসেম্বলি, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নতকরণ, স্বল্পমূল্যে শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিতকরণ, বিজ্ঞান গবেষণাগার- কম্পিউটার ল্যাব নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়াসহ শিক্ষা সংক্রান- বিভিন্ন স'ানীয় ও জাতীয় আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন নিরন-র সংগ্রাম করে চলেছে। শিক্ষার অধিকার আদায়ে যে সংগঠনের ভূমিকা অগ্রগণ্য সেই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নাম যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে থাকে।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন এ ভূ-খণ্ডে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের ইন্ধনে। তাদের শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্যই তারা সামপ্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ ভূ-খণ্ডের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের আন্দোলনকে বিভক্ত করা ও তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এক সময় এ ভূ-খণ্ড থেকে হাত গুটিয়ে চলে গেলেও তার সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আমাদের দেশসহ এ উপমহাদেশে এক ভয়ংকর মরণব্যাধি হিসেবে এখনো উপসি'ত। মৌলবাদ ফতোয়াবাজদের তান্ডবও সাম্প্রতিক কালে সাংঘাতিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এদেশের বিবেকবান, অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনের মানুষদেরকে দারুণ ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলগ্ন থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্ম-ব্যবসায়ী, উগ্র জঙ্গীবাদ ও ফতোয়াবাজদের রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করে আসছে। ষাটের দশকে সামপ্রাদায়িক দাঙ্গা বিরোধী কর্মকান্ডে ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো অগ্রগণ্য। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের অসামপ্রদায়িক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছিলো, সারা বাংলায় নিষিদ্ধ করেছিল রবীন্দ্র সংগীত, ছাত্র ইউনিয়নই তখন শাসক গোষ্ঠীর চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্ম-শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানমালা আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সামপ্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব ও উগ্র সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম এবং শত্রুকে চিরতরে উৎখাত করার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন' শাসক গোষ্টীর দূর্বলতা-ব্যর্থতা ও পরবর্তীতে ’৭৫-এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকারানে- এই প্রতিক্রিয়াশীল সামপ্রদায়িক ধারার প্রতিভূ শক্তিই রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে।

তারপর থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদদে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি এদেশে তাদের শক্তি সামর্থ আরো বৃদ্ধি করে চলছে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার করে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তারা ধর্মীয় আইন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন' এদের বাস্তব জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো স'ান নাই। কারণ এ সকল ধান্ধাবাজ সামপ্রদায়িক-মৌলবাদী রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থলিপ্সায় ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। তারা ভাষা আন্দোলনের বিরোধীতা করেছে।

‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে তারা লড়েছে। এসবই তারা করেছে ‘ইসলাম রক্ষার’ মিথ্যা দুরভিসন্ধিমূলক অজুহাত তুলে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী সহ সম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মের নামে বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাফের আখ্যা দিয়ে সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে জারজ হিসাবে চিহ্নিত করে মুক্তিকামী ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ভূমিকা রেখেছিল। ঐ বর্বর রাজনৈতিক শক্তি ৭১ এ বাঙ্গালী মা-বোনকে গণিমতের মাল আখ্যা দিয়ে নিজেরা ধর্ষণ করেছে এবং পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষণের জন্য তুলে দিয়েছে ।

জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির (৭১-এর আগে পর্যন- ইসলামী ছাত্র সংঘ) তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের কথা বলে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীকে একের পর এক হত্যা করছে এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতার মাধ্যমে এ পর্যন- শত শত ছাত্রের হাত, পায়ের রগ কেটে দিয়েছে, দিচ্ছে। ওরা আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধু শাহাদাৎকে রাতে ঘুমন- অবস্থায় জবাই করে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে ছাত্র ইউনিয়নের স্কুল ছাত্রনেতা নতুনকে, হত্যা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা তপনকে, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্জয় তলাপাত্রকে। এভাবেই ওরা ধর্মের নামে বহু প্রগতিশীল ছাত্রের জীবনকে অকালে কেড়ে নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এসকল ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের বর্বর শক্তিকে কিভাবে চিরতরে প্রতিহত করা যায়।

ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে, ব্যপক জনগণের বিশেষত শ্রমজীবী জনগণের সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ থেকে এসব অপশক্তিকে দূর করে দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল বাম শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এদের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও ক্ষমতা কাঠামোকে উৎপাটন করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে ছাত্র সমাজকে সচেতন ও জাগরিত করে ছাত্র-জনতার সমবেত সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র-ইউনিয়ন নিরলস ভাবে কাজ করে চলছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.