এডিট করুন
আমাদের তখন খুব খারাপ আর্থিক অবস্থা। ঘরে টাকা পয়সা নাই। ব্যাংক থেকে জমানো টাকা উঠিয়ে কোনমতে চলছে। ডাল আর ভাত প্রতিদিনকার খাবার। কিছুদিন পরে ডাল-ভাত খাওয়ার পয়সাও থাকবে না।
তাই বাবা ঠিক করলেন, যা টাকা আছে, তা দিয়ে কিছু দোকান ঘর উঠিয়ে ভাড়া দিবেন। বাবা একদিন কয়েক ট্রাক ইট কিনে নিয়ে আসলেন। ইটগুলো জমা হল আমাদের কারখানার সামনে। তারপর আনা হল এক ট্রাক বালি। এরপর যথারীতি আমাদের বান্ধা রাজমিস্ত্রি খালেক ভাই আর তার হেলপার এসে কাজে লেগে গেলেন।
উনার দুজন কাজ করেন। একটা একটা করে ইট গাঁথা হয়। আমি এক্সট্রা যোগালী হিসেবে লেগে গেলাম, লেবার খরচ বাচানোর জন্য। হেলপার ইট গাথার মশলা বানায়, আমি কড়াইতে করে সেই মশলা উপরে বাশের মাচায় বসা খালেক ভাইকে পৌছে দিই। আব্বা ভেবে দেখলেন কাজের গতি আরো বাড়ানো দরকার।
তাই খালেক ভাই আর তার হেলপার দুজনেই মাচার উপরে উঠে গেলেন দেওয়াল গাথার জন্য। আমি এক কড়াই সিমেন্ট আর পাচ কড়াই বালু মিশিয়ে একটা স্তুপ বানাই। তারপর সেখানে একটা গর্ত করি। তারপর সেখানে পরিমানমত পানি ঢালি। এরপর মশলা বানাই।
পুরাই রাজমিস্ত্রীর যোগালী। দুজনের জন্য মশলা সাপ্লাই দিতে হয়। খুব দ্রূত কাজ করতে হয়। মাঝে মাঝে ইটের প্রয়োজন হয়। খালেক ভাইয়ের হেলপার তখন মাচা থেকে নেমে মাচায় ইট তোলে।
সাপ্লাই পানি ছিল না। টানা কল টেনে পানি উঠাতে হয়। টিনের বালতিতে করে টানা কল থেকে পানি এনে কাজের জায়গায় রাকাহা ড্রাম ভরি। সকালেই বাবা ঘুম থেকে উঠিয়ে ড্রাম ভরতে পাঠান। এতে কাজের সময় অযথা পানি ভরে সময় নষ্ট কম হয়।
বেশী মিস্ত্রী বা লেবার নেওয়ার মত অবস্থা বা টাকা নাই। তাই আমিই ভরসা। একজন লেবারের টাকা বাচলে একদিনের খাবার খরচ হয়ে যায়। আমার বাবা মা দুজনেই সমানভাবে কাজে তদারকি করেন। প্রায়ই তারা ঝগড়া করেন।
কারণ একটা কাজ বাবা বলেন এইভাবে করতে আর মা বলেন অন্যভাবে করতে। এটা আমাদের পরিবারের প্রাত্যহিক সমস্যা। মা সকালের নাস্তা বানানো বাদ দিয়ে লেবার তদারকি বেশী পছন্দ করেন। ঐদিকে বাবা আর ছোটবোনতা চিল্লাচিল্লি করতে থাকে, “সকালের নাস্তা বানাও”। বেলা বারটার সময় সকালের নাস্তা হয়।
অবশ্য এটা কোন ব্যাপার না। নির্মাণের আনন্দ বড়ই আনন্দ। তা সে যত বড় বা ছোট নির্মাণ কাজই হোক না কেন। একে একে তিনটা দোকান ঘরের দেওয়াল গাথা শেষ হয়। এখন কিছুদিন দেওয়ালগুলোতে পানি খাওয়াতে হবে, তারপরে আস্তর মারতে হবে।
রাজমিস্ত্রীর কাজ মোটামুটি শেষ। ঘরের চাল ছাওয়ার পর তাদের আবার ডাকা হবে আস্তর মারার জন্য। খালেক ভাই আপাতত বিদায় নিলেন। আমি আর বাবা প্রতিদিন সকালে বিকালে দুবেলা দোকান ঘরের দেওয়ালে পানি দিই। দেওয়ালগুলো সবটুকু পানি শুষে নেয়।
এরমধ্যে একদিন বাবা পাচ জোড়া শাটার কিনে আনলেন। খুব ওজন শাটারগুলোর। আমি আর শাটারের দোকান থেকে আসা একটা ছেলে মিলে শাটারগুলো কারখানায় ভরলাম। এরপর একদিন লোহার এঙ্গেল কিনে আনা হল। যে দোকান থেকে শাটার কিনে আনা হয়েছে সেই দোকানের মালিক আসল তার পরেরদিন।
উদ্দেশ্য এঙ্গেল দিয়ে চাল ছাওয়ার কাজে কত টাকা লাগতে পারে তা দেখা। তা সেই দোকান মালিকই হলেন নাসির ভাই। উনি আমার সাথে বেশ খাতির জমিয়ে কথা বলা আরম্ভ করলেন। এমনকি দোকানের পিছনে খালি জায়গাটা উনি উনার ওয়ার্কশপের জন্য ভাড়া নিয়ে নিলেন সেই দিনই। পরদিন থেকে উনার ওয়ার্কশপের জিনিসপত্র আসতে শুরু করল।
জিনিসপত্র বলতে ছিল একটা ওয়েল্ডিং মেশিন, একটা বিশাল হাতুড়ী আরো সব যন্ত্রপাতি যা সাধারণত একটা ওয়ার্কশপে থেকে থাকে। তবে উনার কোন ড্রীল মেশিন ছিল না। আমি উনার সাথে জমে গেলাম। কারণ আগে কখনও কোন ষ্টীল ওয়ার্কশপের এত ভিতরে যাই নি বা যাওয়ার সুযোগ পাই নি। আর যন্ত্রপাতি বরাবরই আমাকে আকর্ষণ করে।
আমি আমার সময়ের একটা অংশ কাটাতে লাগলাম সেখানে। নাসির ভাইয়ের দু জন মিস্ত্রী ছিল। একজন বড় মিস্ত্রী আর একজন ছোট মিস্ত্রী। দুজনের জীবন কাহিনী আরো অনেক ষ্টীল মিস্ত্রীর মতই। তাদের একজন রাতে থাকেন।
ওয়ার্কশপ পাহারা দেন। একটা চৌকি এনে বসানো হয়েছে ওয়ার্কশপের ভিতরে। সেখানে বিছানা পাতা থাকে প্রায় সব সময়। আমি প্রায়ই সেখানে যেয়ে বসে থাকি আর কাজ দেখি। লোহা পিটিয়ে সোজা করার শব্দে কানের বারোটা বেজে যায়।
কিন্তু আমার শুনতে ভাল লাগে। কারণ ঐটার মধ্যেও একটা নির্মাণ বা তৈরী করার সৌন্দর্য্য আছে। কিছুদিন পর বাবার সাথে টাকার দফা রফা করে নাসির ভাই দোকানের চাল ছাওয়ার কাজে নেমে গেলেন। উনি নিজে কাজ পারেন কিন্তু করেন না। হাজার হলেও মালিক বলে কথা।
উনি শুধু নির্দেশ দিয়ে যান উনার মিস্ত্রীদের। কিন্তু প্রথম দিনই বুঝতে পারেন যে নির্দেশ দেওয়ার পরিশ্রমটাও উনার করতে হবে না। কারণ আমার বাবা মা দুইজনই উত্তম নির্দেশ প্রদানকারী। তাদের নির্দেশ পালন করেই মিস্ত্রীরা কুল পায় না তার উপরে আবার নাসির ভাইয়ের নির্দেশ পালন করার মত কোন অবস্থা তাদের নাই। নাসির ভাই ততদিনে আমাদের সাথে বেশ জমে গেছেন।
বাবাকে চাচা বলে ডাকেন, আমাকে বড় ভাই বলে ( যদিও আমি তার থেকে অনেক ছোট )। বাবা উনাকে তুই করে বলেন। উনিও ভাতিজাসুলভ স্নেহে বিগলিত হয়ে যান। আমার বাবা লেবারদের যেমন গালাগালি করেন তেমনই তাদের স্নেহ করেন। বাজান বলে সম্বোধন করেন তাদের।
তাই দিনের শেষে সবাই চাচা চাচা করে দশটা টাকা বেশী নিয়ে নেয়। এমনকি কারখানা সংলগ্ন চায়ের দোকান থেকে মাগনা চা পান আদায় করে নেয় লেবাররা পায়ই বাবার কাছ থেকে। তা নাসির ভাই আমার সাথে নানা গাল গল্প করেন। উনার বিভিন্ন কাহিনী বলেন। আসলে প্রত্যেকটা মানুষই তার কাহিনী বলার জন্য চেষ্টা করে।
হয়তো কাউকে খুজে পায় না বলার জন্য বা উপযুক্ত জায়গা পায়না বলার জন্য। আমি যেমন এই জায়গাটা বেছে নিয়েছি আমার কাহিনী বলার জন্য। আপনি যদি আমাদের সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের সাথে মেলামেশা করেন তাহলে দেখবেন কয়েকদিনের মাথায় আপনি তার বহু কাহিনী জেনে গিয়েছেন। এমনকি সে কয়টা খুন করেছে তাও হয়তো আপনাকে বলে দেবে অকপটে গল্পচ্ছলে। কারণ তাদের জীবনে আচার আচরণগত বা সামাজিক জটিলতা নাই।
একজন গার্মেন্টস কর্মী মেয়ে যত সহজে একটা ছেলের সাথে ভেগে যেতে পারবে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তা পারবে না। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এই নিম্নবিত্ত মানুষেরা অনেক সুখে আছে। জীবনের জটিলটা বলতে তাদের কাছে খাবারের টাকা উপার্জন আর থাকার জন্য একটুকরো জায়গা। তা যাই হোক নাসির ভাইয়ের কথা বলতে ছিলাম। দুজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক বা মনষ্ক ছেলে মানুষ একসাথে হলে যদি তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে তবে অবধারিতভাবে তারা তাদের জীবনে নারীদের আনাগোনা বা নারী ভাবনা সম্পর্কিত কথা বলবে।
নাসির ভাইও এর ব্যাতিক্রম নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।