www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
ঠাণ্ডা মাটির মেঝের উপর খড়ের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত এই স্থানটিতে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে পুরোনো এই চালাঘরটির আদিম ছাতখানির প্রাগৈতিহাসিক কাঠের তক্তার পাশে জমাট বাঁধা অন্ধকারের নিভৃতে খড়কুটোর পাখির বাসাটা আবছা দৃষ্টিগোচর হয়।
ছোট এই চালাঘর। আর পাখির বাসাটা শূন্য। পাখিটা বাইরে গেছে। একটু আগেই।
খড়ের উষ্ণতা। খড়ের শুষ্কতা। আর স্যাঁতসেঁতে শীতল ছনকাঠের এই ছোট্ট চালাঘর। ছাতখানি বেশ উঁচু। চারপাশে জমা হয়ে আছে কাঠের তুষ, কাঠের স্তূপ, খড়ের গাদা।
আছে মরচে-পরা টিনের দেয়াল, ছনের ছাউনি, বাঁশের স্তম্ভ, কাঠের পাটাতন। বড় চিলেকোঠার মতন বটে, কিন্তু ওটার মত আন্তরিক নয়। ঘরোয়া নয়। কাছে ডাকে না, দূরেও ঠেলে দেয় না, এমনই এক চালাঘর। পরিত্যক্ত এবং জরাজীর্ণ এক বাংলোর সাথেই সংযুক্ত এই চালাঘরটি।
একসময় গম্ভীর ঐ বাংলোখানির অংশ ছিলো বুঝি, এখন আর নয়। নিজেই খুঁজে নিয়েছে নিজের এক ভঙ্গুর স্বরূপ। আত্মগ্লানিতে ভোগা এই চালাঘর। তার শীতল গর্ভে এখন শুধু ঠাঁই পায় কিছু ভগ্ন আসবাবপত্র, বিদীর্ণ কাঠ-সামগ্রী, জীর্ণ অকেজো এক ধানের গোলা, আর কিছু বোবা প্রাণী – একটি বাইরে গেছে, আরেকটি খড়ের গাদার উষ্ণতায়।
চারদিকে ঘন-জঙ্গল।
পাহাড়ী জঙ্গল। পেছনে পাহাড়। সামনে পাহাড়। আর এই পাহাড়ের উপর এক পরিত্যক্ত বাংলোর পাশেই এক ছিন্ন চালাঘর। সময়টা মাঘ মাস।
খড়ের গাদার উষ্ণতা বড় প্রয়োজন।
মাটির কাছাকাছি শুয়ে আছো তুমি। মাটি থেকে পাওয়া মাটি-গন্ধ খুব কাছ থেকেই পাচ্ছো তাই। নিশ্চয়ই জানো কেমন সেই অনুভূতি। ফিস্ফিসানি কত কথা ঐ ঘ্রাণের মাঝে।
এ এক নেশাময় গন্ধ, এই মাটির গন্ধ। সেই গন্ধের সাথে আবার মিশে আছে তারই এক মহা-স্তুতিগান। তারই বীরত্ব-গাঁথা। সেই মাটির বিশালত্বের কাছে নিজের ভয়ানক সীমাবদ্ধতার প্রকাশে তোমার শরীর তাই শিরশির করতেই পারে। নাকি ঐ শিরশিরে ভাবখানি ছাতের উপরের ঐ কিঞ্চিত খোলা অংশ দিয়ে সুড়সুড়িয়ে ঢোকা রাতের ঐ হিমহিম বাতাসের শিরশিরানি? খড়ের গাদার ভেতর শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকা তুমি কিন্তু উষ্ণ।
উষ্ণতায় উপভোগ করছো শীতলতা।
নানান নান্দনিক গন্ধের মাঝে ডুবে থাকা তুমি এবার হাত বাড়িয়ে তুলে নিলে পশমের চাদরখানি। এক পলক ফেলে তাকিয়ে দেখলে ছাতের দিকে। না, পাখিটা ফিরে আসেনি। বাসাটা শূন্য।
পাখিটা বাইরে গেছে। একটু আগেই ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ পেয়েছো তুমি। সেও কাটিয়েছে এক নির্ঘুম রাত, তোমার মত। জেগে ছিলে দুজনেই। একসাথে।
ওর ডানা ঝাপ্টানোতেই ভেঙেছে এই চালাঘরে বিরাজমান সুনসান নীরবতা। মাটির কাছে খড়ের গাদার ভেতর আপাদমস্তক ডুবে থাকা তুমি রাতভর চুপচাপ দেখেছো পাখিটাকে। শুনেছো ওর নৈঃশব্দতা। অনুভব করেছো ওর সঙ্গ। তবে নিঃশব্দ ডানার প্রতিধ্বনি তুলে ভাঙা চালাঘরের ফুটো দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ও তো তুমি জানতেই পারলে না এ কোন পাখি! পাখিটা তোমার কাছে অচেনাই ছিলো।
অচেনাই থাকলো। রাতভর জেগেও তুমি জানতে পারলে না পাখিটা দেখতে কেমন ছিলো। ওর ডানায় কয়টা পালক ছিলো। ওর ঠোঁটের ভেতর কি আকাঙ্ক্ষা ছিলো। ওর চোখে কি রহস্য ছিলো।
তবে তুমি ঠিকই জানতে ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই তুমি শুধু শুনতে পাবে ওর ডানার প্রতিশব্দ। এতটুকুই। তুমি এতটুকুই জানবে। তুমি এতটুকুই শুনবে। পাখিটা তোমার কাছে অচেনাই থাকবে।
তুমি শুধু শুনবে ওটার চলে যাওয়ার প্রতিধ্বনি। তুমি শুধু দেখবে ওটার প্রতিচ্ছায়া। তুমি শুধু চুপচাপ উষ্ণতায় উপভোগ করবে একাকী শীতলতা।
তুমি এবার উঠে দাঁড়ালে। গায়ে জড়িয়ে নিলে আরেক উষ্ণতা।
পশম উষ্ণতা। তোমার চাদরের উষ্ণতা। তুমি এগিয়ে গেলে ভাঙা কাঠের দরজার দিকে, ভেজানো ছিলো সারারাত। তুমি দুয়ার বন্ধ করে রাখো না, ভেজানোই থাকে। তবুও বাইরের জগত মনে করে তোমার বদ্ধ-দুয়ার।
তুমি ওদের ঘৃণা করো। তুমি এটাও জানো, যে ওদের কাছে তুমিও অপ্রত্যাশিত। তুমি এবার খোলা-দুয়ার দিয়ে বের হয়ে আসলে। শৈত্য-প্রবাহ তোমাকে জাপ্টে ধরলো। তুমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলে তোমার চাদরখানি – তোমার একমাত্র উষ্ণতা।
তুমি এগিয়ে গেলে। এগিয়ে গেলে পাহাড়ের ঢালের দিকে। নামতে শুরু করলে সমতলে। তোমার শরীরে লেগে যাচ্ছে শেষরাতের চোরকাঁটা। তোমার পা দুটোকে পাহাড়ী লতাগুল্ম জড়িয়ে ধরছে পরম মমতায়।
তোমার পায়ের আঙুলগুলোকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশিরকণা। তুমি এগিয়ে যাচ্ছো। তুমি সূর্যোদয় দেখবে। তুমি এক পাহাড়ের বাসিন্দা। কিন্তু তুমি সমতলে থেকে পাহাড়ের ফাঁকে দৃশ্যমান সূর্যোদয়ের নেশায় নেশাগ্রস্ত।
তুমি জানো, পাহাড়ের ফাঁকের সূর্যোদয় দেখতে হলে পাহাড় থেকে নেমে আসতেই হয়। তুমি সবই জানো। তবু তুমি জানো না তোমার চালাঘরে রাতভর সঙ্গ দেয়া অচিন পাখিটি কোন পাখি।
এখনো আঁধার। এখনো সূর্যের দেখা নেই।
এখনো আঁধার পৃথিবী। এখনো আঁধার এই জগত। এখনো আলো আসেনি। এখনো আলো আসেনি তোমার হৃদয়ে। তোমার হৃদয় এখনো পায়নি আলোর ছোঁয়া।
তুমি অনেক সূর্যোদয় দেখেছো, কিন্তু তোমার হৃদয়-সূর্য সর্বদা অস্তমিতই থাকে। আজও তুমি ফিরে যাবে। ফিরে যাবে তোমার ঐ চালাঘরে। লাল টকটকে এক সূর্যকে তোমার চাদরের তলায় লুকিয়ে তুমি ফিরে যাবে তোমার ঐ ছোট্ট চালাঘরে। ফিরে যাবে খড়ের উষ্ণতায়।
খড়ের শুষ্কতায়। তোমার পাশেই লাল সূর্যকে বন্দী করে রাখা এক পশমের চাদরকে ফেলে রাখবে তুমি। তোমার হৃদয় এখনো পায়নি আলোর ছোঁয়া। তুমি শুধু উষ্ণতায় উপভোগ করবে শীতলতা। আর শুনবে এক নিঃশব্দ ডানা ঝাপ্টানোর প্রতিধ্বনি।
এক অতিপ্রাকৃতিক খড়ের গাদায় নিজেকে লুকিয়ে রেখে তুমি আবার অপেক্ষার প্রহর গুনবে। নির্বাক তুমি নীরবে অপেক্ষায় থাকবে এক অচিন পাখির।
ছোট এই চালাঘর। আর পাখির বাসাটা শূন্য। পাখিটা বাইরে গেছে।
আর তুমি অপেক্ষায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।