আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাগল না হওয়া হের্তা মুলার নোবেল পেলেন  জিললুর রহমান

আমি যেন এক মেঘ হরকরা

রোমানিয়ায় জন্মগ্রহণকারী জার্মানভাষী লেখক কবি ঔপন্যাসিক হের্তা মুলার এবারের নোবেল বিজয়ী। কমিউনিস্ট রোমানিয়ার স্বৈরশাসনের দমনমূলক কর্মকাণ্ডের বিপে দাঁড়িয়ে সংগ্রামমুখর নিষ্পেষিত জীবন বর্ণনার এক অসাধারণ রূপকার এই মুলার। ইতোমধ্যেই বিশ্বের ২০টিরও বেশি ভাষাতে তাঁর লেখা অনুদিত হয়েছে। ১৯৫৩ সালের আগস্টে জন্মগ্রহণ করেন রোমানিয়ার জার্মানভাষী শহর নিশিডর্ফ-এর বানাত এলাকায়। নিঃসন্দেহে তিনি রোমানিয়ার সংখ্যালঘু জার্মান পরিবারের সদস্য।

যদিও ঠাকুরদা একজন সম্ভ্রান্ত সম্পদশালী কৃষক ছিলেন, মুলারের বাবা মা সোভিয়েত অধিগ্রহণের পর শ্রমশিবিরে ক্রীতদাসের জীবন কাটিয়েছেন। তবে মুলার তিমিসোয়ারা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ও রোমানিয় সাহিত্য পাঠ করেন। ভার্সিটিতে পড়ার সময়েই তিনি চসেস্কুর স্বৈরতন্ত্রে অতিষ্ঠ হয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কামনা করে ‘একশান গ্র“প বানাত’ এর সদস্য হোন। ১৯৭৬ এর দিকে দোভাষির কাজ দিয়ে পেশাগত জীবনের সূচনা করেন এক ইঞ্জিনিয়ারিং মেশিন ফ্যাক্টরিতে, কিন্তু ১৯৭৯ সালে সে কাজ হারাতে হয় কমিউনিস্ট গুপ্ত পুলিশের কাজে অস্বীকৃতি জানানোয়। এ সময় তিনি অনেক ছোট গল্প লিখেছেন, যা সংকলিত হয় ‘নিচু ভূমি (নেইডারুনগেন)’ নামে।

তবে তিনি খুব সমস্যা বোধ করতেন সেন্সরকে সন্তুষ্ট করতে। তাই ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তাঁকে অপো করতে হয়েছে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের জন্য। তাঁর প্রথম গ্রন্থ বের হয় ১৯৮২তে জার্মান সংস্কৃতিতে শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে, তবে অবশ্যই সেন্সর করা অবস্থায় - যেহেতু তা প্রকাশিত হয় কমিউনিস্ট রোমানিয়ায জার্মান ভাষায়। এতে শিশুর চেখে দেখা জার্মান বানাত অর্থাৎ মুলারের শৈশবের রোমনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়, যাতে কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় একনায়কতন্ত্র, যা ছাড়া মুলার আর কিছু জানতেন না, আর কিছু দেখেন নি সেই নিদারুণ শৈশবে। এদিকে মুলার জার্মানভাষী লেখকদের সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন, যারা সেন্সরশিপের বিপে বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন।

চসেস্কু সরকার সেন্সর করে ‘সবুজ প্লামের দেশ (দ্য ল্যান্ড অব দ্য গ্রিন প্লাম)’ গ্রন্থকেও, যাতে লেখক ও সরকারী সেন্সরশীপ এর মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েনকে তুলে ধরা হয়েছে। ‘নিচু ভূমি’ প্রকাশের ২ বছর পরে বের হয় ‘ড্রুকেনডার ট্যাঙ্গো। এই ২টি গ্রন্থেই মুলার ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রামীণ জীবনের ভণ্ডামি বা হিপোক্রেসি। তিনি চিত্রিত করেছেন জার্মান মাইনরিটির প্রতিহিংসাপরায়ন ফ্যাসিস্ট মানসিকতাকে, তার ধৈর্যহীনতা আর দুর্নীতিকে। তাই অবিশ্বাস্য নয় যে, তিনি ঘরেও সমালোচিত হয়েছেন - রোমানিয়ার জার্মান গ্রাম-জীবনের আদর্শিক ইমেজকে বিচূর্ণ করার অভিযোগে।

‘নিচু ভূমি’ বইটি সেন্সরবিহীন অবস্থায় পশ্চিমে চোরাচালান ও প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তিনি শিকতা করেছেন। তারপর ফ্রাঁঙ্কফুর্ট বইমেলায় ঘুরে এসেই মুলার প্রকাশ্যে রোমানিয়ার স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে মুখ খোলেন। আর তার ফলে রোমানিয়াতে তাঁর প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়। অবশেষে ১৯৮৭ সালে স্বামী ঔপন্যাসিক রিচার্ড ওয়াগনার এর হাত ধরে পশ্চিম বার্লিনের পথে পা বাড়ান মুলার - অবশ্যই রোমানিয়া সরকারের চাপে। এখনো তিনি বার্লিনেরই অধিবাসী।

মুলারের অধিকাংশ লেখাই তাঁর আপন ইতিহাসকে বিম্বিত করে থাকে। ‘ডার মেন্শ ইস্ট এইন গ্রোবার ফাসান আউফ ডার ওয়েল্ট’ (১৯৮৬)-এ তুলে ধরা হয় রোমানিয় জার্মান কৃষক পরিবারের দেশত্যাগের জন্য পাসপোর্ট যোগাড়ের কসরৎ সম্পর্কে। তাঁর পূর্বের লেখার মতোই এই গল্প প্রকাশ করে গ্রামের বর্বর দুর্নীতি Ñ যাতে দেখা যায় কর্মকর্তারা, পোস্টমাস্টার থেকে পাদ্রী পর্যন্ত, কীভাবে আরও অধিক দ্রব্যাদি চায়, এমনকি যৌন আনুকুল্যও দাবি করছে দেশত্যাগেচ্ছু আবেদনকারীদের কাছে। এই অভিজ্ঞতা সংকলিত হয়েছে ‘বারফুবিগার ফেব্র“য়ার’ (১৯৮৭) গ্রন্থে যখন কিনা মুলারও পশ্চিমে হিযরতের জন্য অধীর আগ্রহে অপো করছিলেন। ‘রেইসেন্ডে আউফ এইন্ম বেইন (১৯৮৯) বইতে মুলার পশ্চিমে পুনর্বাসনের সমস্যাকে তুলে ধরেন - আর একই সাথে উঠে আসে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি, যা রাজনৈতিক নির্বাসনে মড়কের মতো জুড়ে বসে।

‘এইন ওয়ার্মা কার্তোফেল ইস্ট এইন ওয়ার্মেস বেট্’ (১৯৯২) এর অনেক লেখাই রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জের প্রতিফলন। এখানে এমনও দেখা যাচ্ছে যে, কোনো এক নারী ‘মাতৃভূমি’ শব্দটিকে পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারছে না। ‘ডার টিউফেল সিয্ট্ ইম স্পিয়েজেল’ (১৯৯১) নামে আরেকটি গ্রন্থ মুলারের ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ সালে পাডেরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ধারাবাহিক বক্তৃতামালাকে সংকলিত করেছে। এ যেন টেনশন ও দ্বন্দ্ব তাঁর কাজে কীভাবে কাব্যিক দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে তা বুুঝার এক অবিকল্প চাবিকাঠি। এতে তিনি ইমেজ ও টেক্স্ট এর অনেক কোলাজ এঁকেছেন।

১৯৯৩ সালে মুলার ৯৪টি কোলাজ এর একটি সেট ‘ডার ওয়াচার নিম্টসেইন কামম’ শিরোনামে প্রকাশ করেন। ‘ভম ওয়েগগেহেন আন্ড অসশেরেন’ (১৯৯৩) গ্রন্থে যদিও কাব্যিক ইমেজগুলো একক অসীম পৃষ্ঠাগুলোর দিকে বেশি দৃষ্টি রেখেছে, তবুও তারা যেন একটি উদ্দেশ্যগত নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা সার্বিকতাকে ঐক্য প্রদান করে। ‘ডার ফ্চ্সু ওয়ার ডামডালস স্কহ্ন ডার যাগের’ (১৯৯২) উপন্যাসটি ‘ডার ফ্চ্সু ডার যাগের’ চলচ্চিত্রটির স্ক্রিপ্টের একটি সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ। এতে তিনি হ্যারি মার্কেল-এর সহ-লেখক ছিলেন। এর মূল চরিত্র একজন শিক যিনি রোমানিয় গুপ্ত পুলিশ কর্তৃক অপদস্থ হয়েছিলেন।

প্রতিরূপকের মাধ্যমে মুলার এতে এঁকেছেন নিজের বিভিন্ন খণ্ডাংশকে যা একটি শঙ্কাতাড়িত জাতির মধ্যে ঘটতে পারে। মুলারের সর্বশেষ উপন্যাস হার্র্জটিয়ার (১৯৯৪) এ পর্যন্ত রোমানিয় স্বৈরতন্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রচিত্রণ। এতে তিনি সম্পৃক্ত করেন বর্ণনাকারীর নিবর্তনমূলক শৈশব এর সাথে রাষ্ট্রের বর্বরোচিত অত্যাচারকে। তাঁর একেবারে সা¤প্রতিক কাজ ‘হাঙ্গার আন্ড সেইড’ (১৯৯৫) একটি প্রবন্ধ সংকলন Ñ যার অধিকাংশই প্রতিফলন ঘটায় নিশিডর্ফ ও তিমিসোয়ারাতে তাঁর অগতানুগতিক ও ভিন্নমতাবলম্বী অবস্থানকে। মুলারের কাজের চরিত্র লণগুলো হচ্ছে বিশুদ্ধতা, ভাষার কাব্যিকতা এবং রূপকাশ্রয়, যা ফিরে ফিরে আসে, আর তার সারাটা গল্প জুড়ে বিচরণ করতে থাকে।

বিষয়ের দুর্ভার ম্লান হয়ে পড়ে তাঁর কল্পনার পেছনে লুকানো গদ্যের সৌন্দর্য ও বহুবর্ণিল রসবোধে। শব্দ ও কাজের মধ্য দিয়ে মুলার প্রতিনিয়ত বিবৃত করেন চার্চ ও রাষ্ট্রের গোঁড়ামি থেকে মুক্তি কিংবা স্বাধীনতাকে। তিনি হয়ে ওঠেন সেসব পূর্ব-জার্মান লেখকদের সশব্দ সমালোচক, যারা আঁতাত করেছেন গুপ্ত পুলিশের সাথে। তিনি এরই মধ্যে ‘ম্যরিলুইস-ফেইবার পুরস্কার’ (১৯৯০), ‘ক্রানিচস্টেইনার সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৯১), ‘কেইস্ট পুরস্কার’ (১৯৯৪) এবং ইউরোপীয় সাহিত্য পুরস্কার ‘আরিস্টেইয়ন’ (১৯৯৫) সহ এক ডজন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে তাঁর উপন্যাস ‘এভরিথিং আই পসেস আই ক্যারি উইথ মি’ মনোনীত হয় ‘জার্মান পুস্তক পুরস্কার’-এর জন্য ।

এই গ্রন্থে তিনি বর্ণনা করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের গুলাগ শ্রমশিবিরে এক যুবকের পরিব্রাজনের কাহিনী - ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ট্রান্সসিলভানিয়ার জার্মান জনগোষ্ঠীর পরিণতির উদাহরণরূপে। কবি অস্কার পাসতিয়র এর অভিজ্ঞতাই এই গ্রন্থের মূল অনুপ্রেরণা, যার মৌখিক ম্মৃতিকথাকে তিনি লেখ্যরূপ দিয়েছেন - তবে তার সাথে যুক্ত হয়েছে তার মায়ের জীবনে যা ঘটেছে তা’ও। সমালোচক ডেনিস শিক এর ভাষ্যে, তিনি যখন মুলারের বাড়ি বেরাতে যান, এবং দেখেন যে, তাঁর কাজের টেবিলে একটি ড্রয়ার ভর্তি কেবল পেপার কাটিং এর ছড়াছড়ি, যা তিনি সবই ধ্বংস করে ফেলেছেন পরে। তিনি অনুধাবন করেন যে তিনি এক প্রকৃত কবির ওয়ার্কসপে প্রবেশ করেছেন যেন। সুইডিশ একাডেমি ২০০৯ সালে সাহিত্যে মুলারকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেন, যিনি কবিতায় নিমগ্ন থেকে গদ্যের সারল্যে নির্যাতিতদের ল্যান্ডস্কেপ চিত্রিত করেছেন।

মজার ব্যাপার হলো, এই পুরস্কারটি কমিউনিজমের পতনের ২০তম বার্ষিকীতে প্রদান করা হলো। মুলারের প্রকাশক মিশেল ক্রুগার বলেছেন, হের্তা মুলারকে এই পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি রোমানিয়ার সংখ্যালঘু জার্মান জনগোষ্ঠীতে বেড়ে ওঠা লেখকের সেই সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা কমিউনিজমের ভুলে যাওয়া অমানবিক দিকটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। রোমানিয়ার সামগ্রিক স্মৃতিবিলোপ : হার্তা মুলারের উপর রোমানিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত গুপ্ত পুলিশের øায়বিক চাপ রোমানিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে প্রবেশের পূর্বশর্তগুলো মেটানোর চেষ্টা করেছে। অর্থনৈতিকভাবে কিছু কিছু েেত্র জনগণ বেশ ভালো করছে। এটা কেবলই দুর্নীতি আর বিচার এর ত্রে, ব্রাসেলস যাকে ক্রমাগত সতর্ক করে যাচ্ছে।

কিন্তু একটা ত্রে যা অন্য সকলের উপরই কাজ করবে, তার ব্যাপারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দুর্ভাগ্যবশত কিছুই দাবি করে নি এবং রোমানিয়াও কিছুই করে নি - তা হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের মধ্য দিয়ে কাজ করা। রোমানিয়া মনে করছে এটা যেন পাতলা বাতাসে মিশে গিয়েছে। পুরো দেশটিই যেন সামগ্রিক স্মৃতি বিলোপের স্বীকার। যদিও এ ছিলো সকল গূঢ় স্বৈরতন্ত্রের পূর্ব-ইউরোপীয় আশ্রয় এবং স্টালিন-পরবর্তী সময়ে শত্র“ উত্তর কোরিয়ার সাথে মর্যাদার দ্বন্দ্বে জড়িত সবচেয়ে শঠ-স্বৈরিক। চসেস্কু ছিলেন চতুর্থ শ্রেণী পাশ একজন বদমেজাজী , যিনি সর্বদা এক টাঙ্কি-ভরা øানের জল নিয়ে ঘুরতেন, যখন কোনো রাষ্ট্রীয় কাজে বেরোতেন; সাথে সোনার চামচও থাকতো - প্রাসাদের প্রতি প্রবল দুর্বলতার কারণে।

সকল কিছুই তার পারিবারিক চক্র ও গুপ্ত পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিলো, এমনকী চার্চ পর্যন্ত। বশংবদ পাদ্রীদের আট শতাংশ গুপ্ত পুলিশের নিকট থেকে সরাসরি নগদ অর্থ পেতো। আর সাংবাদিক, চিকিৎসক, অধ্যাপক কী আইনজ্ঞদের েেত্রও তেমন প্রভেদ নেই। এই গুপ্ত পুলিশ শেষ পর্যন্ত টিকে যায়। চসেস্কুর পতনের জন্যও গুপ্ত পুলিশ দায়ী।

সরকারীভাবে যদিও এই গুপ্ত পুলিশ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তথাকথিত বিপ্লবের পরে, কিন্তু তার কর্মচারীরা নিয়মিত বরাদ্দ অর্থ পেয়েছে। তাদের একাংশ নতুন তৈরি গুপ্ত পুলিশ-এ কাজ করেছে এবং এক ুদ্রাংশ তার ব্ল্যাক মেইল পুঁজি বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কাজে লেগেছে। এই গুপ্ত পুলিশ এর আর্কাইভ থেকে অর্জিত জ্ঞানই প্রভূত সম্পদের বীজ যা অর্জিত হয়েছে ঘোর কৃষ্ণ আর অর্ধ-কৃষ্ণ উৎস থেকে। তার ফলেই দুর্নীতি সরকারের সুউচ্চতম মহলে পর্যন্ত বিস্তৃতি পেয়েছে। পুরো দেশ প্রতিদিন উত্তরোত্তর দুর্নীতিতে ডুবে যাচ্ছে, যাতে নতুন পদ্ধতিতে পুরণো মানসিকতা কাজ করছে।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক্, হাসপাতালে, এ অবস্থা পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়েও করুণ : প্রত্যেকটা জিনিষেরই অভাব, বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রধান সার্জন থেকে সুইপার পর্যন্ত ঘুষের লেনদেন চলছে। চসেস্কুর সতের বছর পরে সিকুট্যাট এর আর্কাইভ এখনও নতুন সিক্রেট সার্ভিসের মধ্যে পুরণো ব্যক্তিরাই ম্যানেজ করছে এবং নয়-ছয় করছে। বহু বছর আগে ফাইল দেখে দেখে আইনগুলো পাশ হতো। কিন্তু সব আইনই অকার্যকর থেকে যেতো এবং কর্তৃপ এই ব্যাপারগুলোকে ধামাচাপা দিতো এই বলে যে সিক্রেট সার্ভিসকে দৈনিক ভিত্তিতে পিটিশন দিতে হবে। কিন্তু সে নিজেই নিজের প্রভু থেকে গেলো এবং যা ইচ্ছা করলো।

এখনো বদ্ধ দুয়ারের ওপার থেকে কর্তৃপ বলে থাকেন যে খুব এক্সপ্লোসিভ ফাইলকে এখনো ‘গোপনীয়’ হিসেবে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়। স্বৈরশাসনামলে জনতা প্রতিদিন বর্ডার পেরিয়ে পালিয়েছে, যাদের অনেকেই পশ্চিমে না পৌঁছে শ্রেফ হারিয়ে গেছে - বোধ হয় তাদেরকে গুলি করা হয়েছে। বহু সীমানা মৃত্যু ঘটেছে পুরোটা শ্মশান জুড়ে এবং তাদের স্বজনেরা জানেই না তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, কে-ই বা দায়ী। রাষ্ট্রদ্রোহীদের হত্যা দেশে ও বিদেশে, এমনকী আত্মহত্যা ও খুন বর্ণিত হয়েছে গাড়ির দুর্ঘটনা হিসেবে; আর তা সেভাবেই ফাইলবন্দী থেকে গেছে। আর ষড়যন্ত্রকারীরা নিঃশঙ্ক হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর তাদের সাথে রয়েছে অসংখ্য ভাড়াটে কী স্বেচ্ছাসেবী সংবাদ-সরবরাহকারী।

এ কারণেই এটা ষড়যন্ত্রকারী ও শিকারের মধ্যে একটা পরাবাস্তব দৃশ্যের অবতারণা করে। সাবেক ভিন্নমতাবলম্বী সরকারি চাকুরি পাচ্ছে এবং শপথ করার জন্য সমনও পাচ্ছে। আর যখন সে দুয়ার খোলে, দেখে তারই প্রাক্তন সিকুরিট্যাট প্রশ্নকর্তা সেখানে দাঁড়িয়ে, গণতান্ত্রিক সংবিধানে তার শপথ বাক্য গ্রহণ করার জন্য। কিংবা একজন রাজনৈতিক বন্দী একটি শহরে কোনো ব্যাংকে অর্থ-ধারের আবেদন করলো, আর ব্যাংকের যে পরিচালক জানালো যে তার অর্থ-ধারের আবেদন মঞ্জুর হয় নি; দেখা গেলো সে পরিচালক আর কেউ নয়, তারই একদা জেল পরিচালক। ব্রাসেলস-এ সকলেই বলে সাবেক বন্দীরা অন্য ব্যাংকে যাবে।

শহরে ব্যাংক থাকলেই ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের শর্তসমূহ পূর্ণ হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরিচালকটা কে? রোমানিয়ার উপন্যাসে কাফকার প্রতিধ্বনি  দুঃস্বপ্নে গুপ্ত সংবাদ : যখন বারবার জিজ্ঞাসাবাদের সমন আসে ফ্রান্য কাফকার মতো এক ইহুদি যে প্রাগে বাস করতো, হের্তা মুলারও অভিবাসনের জার্মানে বসে লিখছেন। ১৯৮৮ তে জার্মান গদ্যে মুলারের স্বর ‘সবুজ প্লামের দেশ’ ইমপ্যাক ডুবলিন সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে দেড় ল ডলার অর্জন করেছিলো। তার তৃতীয় উপন্যাসে ভার্সিটি ছাত্রদের একটা গ্র“পকে চিত্রিত করেন, যারা মুলার ও তার জার্মানভাষী বন্ধুদের মতো রোমানিয় সিকুরিতাত কর্তৃক অপমানিত হয়েছিলো। মুলারের সর্বশেস গ্রন্থ ‘দ্য এপয়েন্টমেন্ট’ প্রতিধ্বনিত করে কাফকার ‘দ্য কাসল’ ও ‘দ্য ট্রায়াল’ এর, এইভাবে যে, কেউ একজন পুনঃ পুনঃ সমন পাচ্ছে অশুভ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

কোনো এক বিষ্যুদবার সকালে এক অজানা যুবতী গুপ্ত পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে ট্রামে চড়ে। অতি স¤প্রতি সে একটা সরকারি বস্ত্র কারখানাতে কাজ করে, কিন্তু সে সন্দেহের উদ্রেক করলো যখন রোমানিয়া থেকে পালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো - সে ইতালিতে রপ্তানির জন্য তৈরি লিনেন স্যুট-এ নোট লিখলো। ‘আমাকে বিয়ে করো’ পকেটের মধ্যে এই আর্জির বার্তা পাঠালো এবং বার্তা-লেখকের নাম ঠিকানাও দিলো। এমনতরো নোট পরবর্তীতে সুইডেনে পাঠানো জামায়ও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সে সন্দেহ করতো তার সুপারভাইজার নিলুকে, যে তাকে ছকে বাঁধতে চায়।

এ হচ্ছে বর্ণনাকারীর স্মৃতি, পর্যবেণ, স্বপ্ন, মিথ্যাচার ও আবিস্কার Ñ সকল কিছুর মিলিত সঙ্কর। ‘দ্য এপয়েন্টমেন্ট’ তৈরি হয়েছে তার সপ্তম তলার ফ্যাট ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, যেখানে সে তার মদ্যপ স্বামী পলের সাথে থাকতো। আর তার পথে নামার সাথে সাথেই মেজর আলবু শুরু করে জেরা। এই যাত্রায় আমরা জানতে পারি তার প্রিয় বান্ধবী সুন্দরী লিলি গুলিতে মারা পড়ে হাঙ্গেরিয়ান বর্ডার পার হওয়ার সময় - সাথে ছিলো তার প্রেমিক ৬৬ বছর বয়সী মিলিটারি অফিসার। মেজর আলবুর সাথে এপয়েন্টমেন্ট এর জন্য ট্রামে ভ্রমণকালে বর্ণনাকারী স্মৃতি রোমন্থন করে, কীভাবে একটা ফি মার্কেটে তার সাথে পলের দেখা, যখন সে বিক্রি করছিলো তার প্রথম বিয়ের আংটিখানি।

তার প্রাক্তন শ্বশুর এক হিংস্র অফিসার ছিলেন, তার ভাষায় ‘সুগন্ধী লাগানো কমিশার’, যিনি দখলচ্যূত করেছেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি একই সাদা ঘোড়ার পিঠ থেকে, যাতে তিনিও চড়েছিলেন, যখন সে বর্ণনাকারীর দাদাদাদীদের জোরপূর্বক শ্রমশিবিরে পাঠিয়েছিলো। সে একটা ব্যবসায়িক সফরে নিলুর সঙ্গ লাভের স্মৃতিকথা মনে করলো; যেখানে বস্-এর সাথে থাকাটাই ইনসমনিয়ার একমাত্র ঔষধ। অজানা বর্ণনাকারী ঘোষণা দেয় - ‘আমি নিজে কিছুই না, কেবল সমনপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া। ’ পুরো উপন্যাস জুড়ে কোনো নায়কবিহীন তার একক-কথন - কীভাবে সে সংগ্রাম করেছে নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য। গতবার সে যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এলো, সে তার পার্সে কর্তিত আঙ্গুল পেয়েছে।

কিন্তু পাঠকগণ যখন এই উপন্যাসের মূল প্রসঙ্গ খুঁজতে যায়, তখন এটা খুবই অস্থির মনে হয় এবং গল্পের প্লটটিকে টুকরো টুকরো ও লম্বাটে মনে হয়। সোভিয়েত পরবর্তী যুগে প্রাত্যহিক বর্বরতাকেন্দ্রীয় ইউরোপে পট-পরিবর্তনের অমতাকে চিহ্ণিত করে। যাই হোক, মুলার তার গল্পের চড়াই বেয়ে চলে এক ভগ্ন স্বপ্নের ময়দান পেরুনো ইতস্তত বর্ণনার বোমার আকস্মিক আঘাতের মাধ্যমে। ‘দ্য এপয়েন্টমেন্ট’ সমাপ্তি টানে খুনের ঠিক আগ-মুহূর্তে উপন্যাসটির সেই আদি ও অজর বাক্য ‘আমি সমন প্রাপ্ত হয়েছি’ দিয়ে এবং এক অনাকাক্সিত বিস্ময়কর গুপ্ততথ্য ফাঁসের মধ্য দিয়ে। প্রকৃত গোপন তথ্য হচ্ছে কেন ভালোবাসা শুরু হয় বিড়ালের মতো থাবা দিয়ে, আর তারপর সময়ের সাথে ম্লান হয়ে পড়ে অর্ধভুক্ত ইঁদুরের মতো।

লিলি নির্ভর করে, কিন্তু মুলার তা অথবা অন্যের মারাত্মক গোপন তথ্য ফাঁস করে না। কিন্তু সে তার মিস্ট্রিগুলোকে বাণীতে রূপান্তর ঘটায় এমনকী জার্মান ভাষায়ও এবং পাঠককে সমন জারীর মতা ধারণ করে। বর্ণনাকারীর ভাষ্যে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ আকর্ষণীয় হয়ে উঠে: ‘তার মুখের তালুকে উপরে তুলতে থাকে, আর আরপর মস্তিষ্কের সাথে আঠা লাগিয়ে দেয়’। বর্ণনা সবচেয়ে কার্যকর হয় যখন তার বিধবা মায়ের অভিব্যক্তিহীনতাকে সে এ ভাবে ফুটিয়ে তোলে - ‘যখন সে নিজেকে শুষ্ক করে, সে তোয়ালের মতো হয়ে পড়ে। সে বাটিগুলো পরিস্কার করার পর টেবিলের মতো; আর যখন সে বসে পড়ে, সে একটা চেয়ারের মতো হয়ে যায়।

’ পল যখন তার কর্মস্থল ইঞ্জিন প্লান্টে গোসল করছিলো, সে নগ্ন বেরিয়ে এলো কেননা কেউ একজন তার জামাকাপড় চুরি করছিলো। পলের দৃশ্যমান শরীরের ইমেজ মনে করিয়ে দেয় কীভাবে আলবুর সাথে এপয়েন্টমেন্টের বর্ণনা দেয় - ‘এটা লজ্জাকর, আর কোনো শব্দে এটা বুঝানো যাবে না, যখন তোমর সর্ব শরীর তোমার নগ্ন পায়ের মতো অনুভূত হবে’। অসহ্য নিষ্ঠুরতা এবং অবুঝ ছিঁচকে চুরির এক জগতের প্রতি সাড়া দিতে গিয়ে ‘দ্য এপয়েন্টমেন্ট’ বিবর্ণ সত্যকে উলঙ্গ করার মতো শব্দ খুঁজতে উদ্যমী হয়। এ হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর থেকে এক দুর্বোধ্য বার্তা যা পাঠকের সাথে আর্জি করে ‘আমাকে বিয়ে করো’। বস্তুত চালাকিটা হচ্ছে ‘পাগল না হওয়া’ যা হের্তা মুলারের নায়িকা এই উপন্যাসে নিজেকে বলেছে।

কিন্তু এমন এক পাগল সমাজে নিজেকে কি ঠিক রাখা যায়? - এটাই লেখকের খোলা প্রশ্ন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.