আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
চতুর্থ পর্ব: রাঙ্গামাটি ভ্রমণ: সুবলং, পরে পেদা টিং টিং
তৃতীয় পর্ব: রাঙ্গামাটি ভ্রমণ: রং রাঙে দোচুয়ানি
দ্বিতীয় পর্ব: রাঙ্গামাটি ভ্রমণ: পথের কথা
প্রথম পর্ব: রাঙ্গামাটি ভ্রমণ: পূর্বাপরকথা
২১.
রাঙ্গামাটির সাজেকে ভয়াবহ ইঁদুর বন্যার কথা নিশ্চয়ই খেয়াল আছে- মাত্র মাস কয়েক আগের কথা। পালে পাল ইঁদুর এসে সাজেক এলাকার সব বাঁশের ফুল খেয়ে ফেলেছিলো। এই ফুল খেলে ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাহাড়ি মানুষরা মনে করেন। আর এরকম ঘটনা নাকি ২৫-৩০ বছরে একবার দেখা যায়।
বনরূপা বাজারে গিয়ে ছোট ছোট কচি বাঁশ দেখে ওই ঘটনার কথা মনে পড়লো।
অসীম দাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওই কারণেই এ বছর কচি বাঁশ খুব কম পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি যে বাঁশের গুচ্ছ একসময় মাত্র দশ টাকা করে বিক্রি হতো, এ বছর সেগুলোর দাম আশি টাকা পর্যন্ত উঠেছে। কথায় কথায় আরও অনেক কিছু জানা হলো- কীভাবে কচি বাঁশ রান্না করতে হয়, স্বাদ কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। সুবলং থেকে ফেরার পর হোটেলে মাত্র ঢুকেছি, এমন সময় অসীম দা জানালেন, রাতে তার বাসায় খেতে হবে। তার বাবা ইতোমধ্যে কচি বাঁশসহ আরো কী কী যেন যোগাড় করেছেন এবং মা রান্না করতে বসেছেন।
খাঁটি আদিবাসি কায়দায় রান্না করা হবে- বলেও অভয় দিলেন তিনি।
আমরা তো হতভম্ব! বলে কি! কখন এই ব্যবস্থা করলেন? আসলে আমরা যখন এসব বিষয় নিয়ে অসীম দার সাথে কথা বলছিলাম, তখনই আমাদের আগ্রহ দেখে তিনি মোবাইল ফোনে বাসায় আমাদের খাওয়ার কথা জানিয়ে দেন- আমাদের না জানিয়েই। তথ্যপ্রযুক্তির কী যে সুফল! আমরা অসীম আনন্দে রাজি হলাম! রাঙ্গামাটি শহরে এসেছি, আর কোনো আদিবাসি খাবার মুখে যাবে না- তা কি হয়?
২২.
রাতে সেজেগুজে অসীম দার বাড়ি গেলাম- একটু দেরি করেই। এর মধ্যে যে পর্যাপ্ত পরিমাণে দোচুয়ানি খেয়েছি, সেটার কথা কি বলব? না, থাক। সবকিছু বলা ভালো না।
তবে বাঁচোয়া যে মুখে তেমন গন্ধ নেই এবং অসীম দা জানালেন, এটা কোনো সমস্যা না। এলাকার সবাই দোচুয়ানি খায়, তাই মুখে গন্ধ থাকলেও তার পরিবারের কেউ কিছু মনে করবেন না। এমনকি অসীম দাও বাড়িতে থাকলে প্রায় প্রতিদিন খেয়ে যান।
অসীম দার বাবা একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। ভদ্রলোক বেশ আলাপী এবং মিশুক প্রকৃতির।
পনের মিনিটের মধ্যেই নানা বিষয়ে আলাপ জমে উঠলো। তিনিও ঘুরতে বেশ পছন্দ করেন; যদিও নানা কারণে খুব একটা ঘুরতে পারেন নি। তবে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির নানা দুর্গম এলাকায় গিয়েছেন। নানা ধরনের হুমকির মধ্যেও কয়েক ঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ে গিয়ে ভোট গ্রহণের দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব করতে গিয়ে কোথায় কোথায় কী সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন, সেগুলোও বর্ণনা করলেন।
মোটামুটি রোমহর্ষক ব্যাপার। তবে কাছের কক্সবাজারেও যাওয়া হয় নি কখনো। রিটায়ারমেন্টে যাবেন কিছুদিন পরই, তারপর পরিবারের সবাইকে নিয়ে কক্সবাজারে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁর।
এর মধ্যেই টেবিলে খাবার সাজানো শুরু হয়েছে। রাত হয়ে গেছে বলে কথা না বাড়িয়ে আমরা খেতে বসলাম।
অনেকগুলো আইটেম, কিন্তু আমরা কেবল অপরিচিত আইটেমগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখালাম। শুরু করতে হয় নাকি বিগল বিচি দিয়ে- অসীম দা জানালেন।
বিগল বিচি দেখতে ছোট ছোট দানার মতো- হালকা তেলে ভাজা হয়েছে। এমনিতে এর কোনো স্বাদ নেই। এটি মূলত খেতে হয় শুটকি মাছ ও কাঁচামরিচের ভর্তার সাথে।
তখনই আসল স্বাদ পাওয়া যায়। অসীম দার মা প্রচণ্ড ঝাল ভর্তা বানিয়েছেন- জানালেন এটি ঝালই খেতে হয়, না হলে পরের আইটেমটির স্বাদ ভালো পাওয়া যাবে না।
বিগল বিচির তরকারি, খেতে হয় ঝাল-শুটকির সাথে
পরের আইটেমটিই আসলে আমাদের আরাধ্য আইটেম। কচি বাঁশের তরকারি। এটি দু'ভাবে রান্না করা হয়েছে- একভাগে পুঁইশাকের সাথে সিদ্ধ করে তরকারি, আর আরেকভাগে ভাজি।
দুটির স্বাদই অপূর্ব! কিংবা জীবনে প্রথম খাচ্ছি বলে আমাদের কাছে অপূর্ব লাগছে। যাই হোক, বেশ উপভোগ করেই খেলাম আমরা। পুঁই শাক খাওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে একটা একটা করে বাঁশ ধরছি আর কচকচ করে খাচ্ছি। কচি বাঁশ খেতে খুবই নরম- মুখে দেওয়া মাত্র গলে যাচ্ছে। আসলে এগুলোর স্বাদ বলে বুঝানো যাবে না! বুঝতে হলে খেতে হবে!
কচি বাঁশের তরকারি- পুঁই শাকের সাথে
আর কচি বাঁশের ভাজি
এর পরের আইটেমটি ক্যাবাং।
এখানেও বাঁশের কারবার। তবে এই বাঁশ খাওয়ার না। শক্তসামর্থ বাঁশের খোলের ভেতর কাঁচকি মাছ ভরে সেখানে তেল-মশলা দিয়ে বাঁশটিকে পোড়ানো বা ঝলসানো হয়েছে। এই পদ্ধতিতে আদিবাসিরা শূকরের মাংস রান্না করলেও আমাদের জন্য কাঁচকি মাছ রান্না করেছেন অসীম দার মা- শূকরের মাংস খাই কিনা এই সন্দেহে। তবে এটিও খেতে দারুণ হয়েছে।
হাজার হলেও নতুন স্বাদ! বাঁশ যে শুধু দেওয়ার জিনিস না, এ দিয়ে আরও অনেক কিছু করা যায়- সেটি ভালোভাবে বুঝা গেলো।
ক্যাবাং- বাঁশের ভিতরে রান্না করা কাঁচকি মাছ
আরও অনেক পদের রান্না ছিলো। মুরগির মাংস, মাছের তরকারি ইত্যাদি ইত্যাদি। খাওয়ার আগে অসীম দার বাবা বলছিলেন- খেয়ে যেন পেদা টিং টিং বলতে পারি। আমরা এতোই খেলাম যে, পেদা টিং টিং বলার মতো সামর্থ্যও নাই।
২৩.
রাত ১২টায় হোটেলে ফিরে আবারও একটু বেরুলাম। ব্যক্তিগত কারণে একটু অস্থির লাগছিলো। ভাবলাম একটু ঘুরে আসি। রাঙ্গামাটির দিন আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করেছে- রাতগুলো কি এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে? শহরের উঁচুনিচু পথে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে নানা কিছু ভাবছিলাম- কেন যে এসব ভাবনা আসে- ভাবছিলাম, এই যে এতোগুলো টাকা খরচ করে আসলাম, এ দিয়ে গ্রামের একটা পরিবারের গোটা মাসের খরচ চলে যায়! আর আমরা কিনা ফুর্তি করতে করতে টাকাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছি। এটাই বোধহয় সভ্যতা, নগরায়ন কিংবা উন্নতির ফসল।
ঠিক তক্ষুণি মুসলধারে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো- প্রকৃতির কান্না, নাকি গরীবের কান্না বুঝতে পারলাম না। এগুলো হয়তো আদৌ কোনো কান্না না, কান্না ভেবে আমরা সুখ পাই।
লেখার সাথে এই ছবিগুলো ফ্রি
কী ফুল জানি না, পছন্দ হলো তাই তুলে ফেললাম
একই ছবি, এটি এডিট করা- দুটির মধ্যে কোনটি ভালো লাগছে জানাবেন কি?
(আগামীপর্বে শেষ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।