স্বপ্নবাজ
মাসুদ সাহেবের সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম, ১০টা বাজে। খেয়ে দেয়ে বের হতে হতে ১০:৩০ হলেও ১১:৩০ এর মধ্যে পৌছে যাবো। তাড়াহুড়া করে বের হলাম, রাস্তায় বেরিয়ে খেয়াল করলাম ঘড়িটা ফেলে এসেছি। বারবার মোবাইল বের করে সময় দেখা বিরক্তিকর মনে হয় আমার কাছে।
সবসময় হাতে করে রাখাটাতো চরম বিরক্তিকর ব্যাপার। যাই হোক, যা হয়েছে তো হয়েছেই, আজ না হয় মোবাইল দিয়েই চলুক। আস্তে আস্তে বাসের কাউন্টারে দাড়ালাম, মানিব্যাগ থেকে খুচরো টাকা বের করে টিকেট নিলাম কাউন্টারম্যানের কাছ থেকে। টিকেট হাতে চাতক পাখি হয়ে তাকিয়ে রইলাম গাড়ি যেদিক থেকে আসবে, সেদিকে। ১০ মিনিট,১৫ মিনিট করে ২০ মিনিট পার হয়, গাড়ি আর আসে না।
অবশ্য সামনে গাড়ীর যে বিশাল লাইন, তাতে গাড়ীওয়ালাদের তো দোষ দিতে পারি না। রাগে, বিরক্তিতে আর অসহ্য গরমে শরীর জ্বলছে রীতিমত। না,আর হয়না। টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে হাটলাম ২৭ নম্বর থেকে শুক্রাবাদ। ওখানে গিয়ে কয়েকটি সিএনজি অটোরিক্সা পেলাম, মতিঝিল যাবে না কেউই; অথচ নিয়ম অনুযায়ী তারা যে কোন জায়গায় যেতে বাধ্য।
বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুজির পর একজন যেতে রাজি হলেন, ভাড়া ১৩০ টাকা। মেজাজ একেবারে শীর্ষে পৌছে গেছে ইতিমধ্যেই। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে সেটাকে বাগে এনে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে সিএনজি চালককে বললাম,
"তোমাদের তো মিটার আছে, মিটারে চলো"।
কথাটা বলতেই সে এমনভাবে তাকালো, যেন আমি কোন মহাঅন্যায় করে ফেলেছি। বললো
"অহন মিটারে কেউ যাইবো, জিগানতো"।
উপায় নেই দেখে উঠে বসলাম। কিছুদূর যেতেই জ্যাম, পান্থপথের মোড়েও নাকি জ্যাম থাকে। মাথার তারগুলো টাস টাস করে ছিড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষন পরে জ্যাম ছাড়লো। বসুন্ধরা সিটির সামনে গিয়ে পড়লাম মহা জ্যামে, টানা ১৭ মিানট পড়ে ছাড়লো।
মনে মনে গালি দিচ্ছি সমানে সার্জেন্টকে। সামনে এগিয়ে আবার সিগন্যালে পড়লাম একেবারে মোড়েই। কৌতুহলে নেমে সার্জেন্টের কাছে গিয়ে বললাম,
"এক্সকিউজ মি, একটু আগে ১৭ মিনিটের যে লাগাতার জ্যাম ছিল, সেটার কারণটা বলবেন?"
উনি চরম বিরক্তি নিয়ে বললেন, "ভিআইপি ছিলো"। আর কিছু না বলে উঠে বসলাম আমার ১৩০ টাকার সিএনজি অটোরিক্সাতে। এতোক্ষনে মনে হচ্ছে যে ওদের এই বেশী ভাড়া চাওয়ার যৌক্তিকতা আছে।
সময় দেখার জন্য মোবাইল বের করতেই মাথা নষ্ট। ১২টায় দেখা করার কথা মাসুদ সাহেবের সাথে, এখন বাজে ১২:২৪। মাথা কাজ করছেনা একেবারেই। ফোন দিলাম মাসুদ সাহেবকে, বললাম ব্যাপারটা। উনি একটু মনক্ষুন্ন বুঝতে পারছি।
বললাম, "আগামীকাল আসি"।
উনি বললেন বিকেলের ফ্লাইটে বাইরে যাবেন, ফিরতে ফিরতে ১মাস। ওখানেই নেমে গেলাম সিএনজি থেকে, অনেক কথা খরচের পরে ১০০ টাকায় মুক্তি পেলাম সিএনজি চালকের কাছ থেকে। বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ভাবলাম, কারা দায়ী ঢাকার এই অপরিকল্পিত অবস্থার জন্য, মানুষের এই সীমাহীন দূর্ভোগের জন্য, এতো এতো কর্মঘন্টা নষ্টের জন্য। মানুষের কাছে থাকতে চান তারা, এই তার নমুনা! জনগন এতো ভালবাসে আপনাদের তো বুলেটপ্রুফ গাড়ীতে চড়ে প্রটোকল নিয়ে ঘোরার কি দরকার।
আর প্রটোকল নিয়েই যখন চলছেন, তখন এতো মানুষকে প্রতিনিয়ত এইভাবে কষ্ট দেয়ার কারন কি। মাঝে একদিন এক চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি বনানী, ফেরার পথে মহাখালীর বিখ্যাত জ্যামে পড়লাম। দাড়িয়ে আছি তো আছিই, একবিন্দু নড়াচড়া নেই কিছুর, আমার পাশেই দাড়িয়ে এক এ্যাম্বুলেন্স সিগন্যাল বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত। হঠাৎ কান্নার রোল উঠলো এ্যাম্বুলেন্সে, ভাল করে দেখে বুঝলাম, নিভে গেলো কোন জীবনপ্রদীপ। আদিমযুগে চিকিৎসা এতো উন্নত ছিলোনা, এখন যতোই উন্নত হোক, হাসপাতালে পৌছানোই কঠিন।
খুব কি পার্থক্য আছে আদিমযুগের সাথে। আগে ছিলোনা বলে পেতাম না, এখন থাকলেও পাওয়া যায়না!
ওখান থেকে লোকাল বাসে চড়লাম বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে। দাড়িয়ে আছি চাপাচাপিতে, মাঝে মাঝেই কড়া ব্রেক করে চালক আরো মানুষের জায়গার ব্যবস্থা করছে। ভাড়ার জন্য এলো কন্ডাক্টর। পকেটে হাত দিতেই দেখি মানিব্যাগ গায়েব।
ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে রইলাম কন্ডাক্টরের দিকে। প্রায় ৭০০ টাকা ছিলো,এই মাসের বাকী দিনগুলো চলার সম্বল, সাথে কিছু জরুরী ভিজিটিং কার্ড, গেলো সব। কন্ডাক্টর আমার দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো, সেই জানে, একটা হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বাস থেকে নেমে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বসে ফ্যানের নিচে বসলাম, যথারীতি বিদ্যূৎ নেই!
বেকারদের কাছে (৭০০+১৩০) ৮০০ টাকা কি, একটা চাকরী কি, একজন মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে চিকিৎসা কি, সেটা বুলেটপ্রুফ এসি গাড়ীতে চড়া, প্রটোকল নিয়ে ঘোরা ভিআইপি'রা বুঝবেন না। প্রতিদিন আমার মতো হাজারো মানুষ এই শহরে চিড়ে-চ্যাপ্টা হচ্ছেন এমন সব ভিআইপিদের চাপে।
আমরা নতজানু হয়ে আর্তি জানাচ্ছি আপনাদের কাছে, "আমাদেরকে এইসব অযাচিত রোজনামচা থেকে দয়া করে মুক্তি দিন"।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।