আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুকুমার চৌধুরীর কবিতা : সরলতার মোড়কে কঠিনতার চিত্রকল্প

কবিতা ও যোগাযোগ

সুকুমার চৌধুরীর কবিতা : সরলতার মোড়কে কঠিনতার চিত্রকল্প তপন বাগচী সুকুমার চৌধুরী কেবল কবিতা লেখেন না, কবিতার কাগজ সম্পাদনা এবং কবিতা নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন করেন। কবির মূল কাজ যে কবিতা লেখা তা পালন করেও তিনি কবিতার আন্দোলনে দুঃসাহসী যোদ্ধার মতো সবেগ সক্রিয়। মহারাষ্ট্রের নাগপুরবাসী এই কবির সঙ্গে কলকাতায় দেখা হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাংলা কবিতা উৎসবে, বছর দুই আগে। বাংলাদেশের প্রথম সারির কবি সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মাহবুব সাদিক, রবিউল হুসাইন, বিমল গুহ, ফরিদ আহমদ দুলাল, মাহমুদ কামাল, আসলাম সানী, কমলেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে আমিও ছিলাম। ভারতের আশিস সান্ন্যাল, মৃণাল বসুচৌধুরী, ঈশিতা ভাদুড়ী, শ্যামলকান্তি দাশ, দীপিকা বিশ্বাসের সঙ্গে ছিলেন সুকুমার চৌধুরী।

বয়স এবং ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে আমরা অতিসহজেই বন্ধূ হয়ে উঠি। অন্তর্জালের সুবাদে সেই বন্ধুত্ব অটুট থাকছে। কথা দিয়েছিলাম সুকুমার চৌধুরী ও দীপিকা বিশ্বাসের কবিতার ওপর লিখব। সেই লেখা বানাতে এতটা সময় পেরিয়ে গেল! তাতে হয়তো সুকুমার চৌধুরীর কিচ্ছু যায় না। কিন্তু আমার যে অনেক লাভ হয়েছে! আমার চিন্তাগুলো কিছুটা দানা ঁেবধেছে বলে, দু-চার কথা লিখতে পারছি।

সুকুমার চৌধুরী স্বভাবকবির মতো চারহাতে লিখতে পারেন। কবিতাঅন্ত প্রাণ বলতে যা বোঝায় আর কী! কেবল লেখা নয়, প্রকাশের েেত্রও তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই সমগ্র বাংলা-অঞ্চলে তাঁর পরিচিতি গড়ে উঠেছে কবি ও সম্পাদক হিসেবে। বাংলার বাইরের বাঙালি কবিদের মধ্যে তাঁর আসন তো সামনের সারিতে। আমি বিচ্ছিন্নভাবে সুকুমারের বেশ কিছু কবিতা পড়েছি।

তবে পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা করার মতো পড়াশোনা আমার নেই। প্রথসিদ্ধ সমাল্চেকও আমি নই। আমিও কবিতা লিখি, মনে-মনে ‘খাননিক’ একজন। পত্রিকার পাদপূরণের জন্য সম্পাদক-বন্ধুদের আহ্বানে মাঝে-মাঝে কবিতা নিয়ে দু-চারটে গদ্য লিখেছি। কিন্তু এ শাস্ত্রে আমার অধিকার জন্মায়নি (কোন শাস্ত্রেই বা আছে!)।

তবু এ বৃথা চেষ্টা। সমালোচকের মূল্যায়ন নয়, পাঠকের অনুভূও বয়ান হিসেবে গ্রহণ করলেই এ লেখার প্রতি সুবিচার করা হবে। সুকুমার চৌধুরীর গুছিয়ে ছাপা কাব্য ‘মায়ের বাপের বাড়ি’ও পড়েছি। রিংকু শর্মার চিত্রকর্মও আমি দেখেছি। মামাবাড়ির পথে যেতে পায়ের পাতায় ধানতে লুটিয়ে পড়ার চিত্রকল্প এঁকে কবি সকল পাঠককেই স্মৃতিকাতর করে তোলে।

তাই প্রতিটি চরণ হয়ে দাঁড়ায় অবশ্যপাঠ্য। সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার অতিবাহনের মধ্যেও যে সূক্ষ্ম শ্রেণিবৈষম্য রয়েছে কবির দৃষ্টিতে তা এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই কবি বলে ওঠেন-- আর আমি তো গরিব, গেঁয়োভূত, চাষাভূষো মানুষ আমার মনেই থাকে না আজ রবিবার, আজকে ছুটির দিন আনন্দেও দিন, উৎসবের দিন। [রবিবার] এই কবিতাটি পড়তে পড়তে বাংলাদেশের ষাটের দশকের খ্যাতিমান কবি মহাদেব সাহার ‘বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ’-এর কথা মনে পড়ে যায়। মা খবর পাঠায় পহেলা বৈশাখে বাড়ি আসতে।

কিন্তু জীবনের জটিল অংকে পহেলা বৈশাখে কবির আর মায়ের কাছে য়াওয়া হয় না। সকলের জীবনে পহেলা বৈশাখ আসে, কবির জীবনে আর তা আসে না। ‘রবিবার’ কবিতায় কবি তাদের পে অবস্থান নিয়েছেন, যাঁদের জীবনে রবিবারের মতো একটি সাপ্তাহিক ছুটির দিনও উদ্যাপনের সুযোগ নেই। অন্ত্যন্ত সরল ভাষায় বলা হলেও এর নিহিতার্থ বেশ দূরগামীÑ প্রতীকময়! ‘ফাঁকা বুথে’ নামের কবিতায় সমকালীন নির্বাচনকেন্দ্রিক ভারতীয় রাজনীতির খণ্ডচিত্র আঁকা হয়েছে। প্রচলিত অসুস্থ রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবি প্রত্যাশা করেন এমন পরিবেশের, যেখানে ভালোবাসাকে অবলম্বন করেই ভোটে জিতে জনপ্রতিনিধি হওয়া যাবে।

সুকুমারের কবিদৃষ্টি খুবই সূক্ষ্ম। কেঁচোর ঠোঁটে সেলাই করার দৃশ্যও তাঁর চোখে নতুন অর্থ বোনে। তাই তিনি লিখতে পারেনÑ ‘আর আমরাও আমাদের জীবনকে সুন্দর ও নিশ্চিন্ত কোরে তোলার জন্য নিরুত্তাপ ও সুখী কোরে তোলার জন্য অশীতিপর কেঁচোর ঠোঁটে সেলাই করে যাই (কেঁচো) খুবই সোজাসাপটা কথা বলেন সুকুমার চৌধুরী। ব্যক্তিজীবনে এবং কবিতায় এই সরলতার সুষ্ঠু প্রকাশ ঘটেছে। এই সরলতাই সুকুমারের কবিতার যুগপৎ দোষ ও গুণ।

দোষ এই কারণে যে, সরলতার কারণে কখনো-কখনো কথার চেয়ে বেশি গভীরে ঢুকতে পারে না। আর গুণ এই কারণে যে, অনেক কঠিন সত্যকে তিনি সরলতার মোড়কে পরিবেশন করার মতা রাখেন। যেমন ধরুন, ‘দিনলিপি’ কবিতার কথাই বলি। একদিনের দেখার বিবরণÑ অতি সরল বিবরণ। কিন্তু আপাত সরলরেখার কয়েকটি টানে কবি এঁকে ফেলেন কংগ্রেস-বামফ্রন্টের ভোটের আগুনের কথা।

যাঁরা এই গল্প জানে না তাদের কাছে যেমন উপাদেয়, যারা জানে তাদের কাছেও নতুন মাত্রার চিত্রকল্পা! এই হচ্ছে সুকুমার চৌধুরীর কবিতার সারল্য ও সাফল্য। সুকার চৌধুরীর কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রকীকময়তা। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত প্রতীকের হাত ধরে পাঠক নিজে নিজেই ভাবনার গহীন অরণ্যে চলে যেতে পারে। প্রতীকের সুবিধা এই যে, একটি বস্তুকে দিয়ে অন্য বস্তুকে বোঝানো যায়। এতে পাঠকের চিন্তার সুযোগ তৈরি হয়।

পাঠক নিজের মতো করে নতুন অর্থ তৈরি করে নিতে পারে। এতে পাঠকসমাজের কাছে কবিতার গ্রহণযাগ্যতা বাড়ে। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন কবি লিখেছেনÑ এরকম পোড়া দিনে তুমি দিলে গুড়জল তালপাখা নেড়ে দিলে মিঠে হাওয়া তুমি কি প্রথম বৃষ্টি দারুণ খরার শেষে (রুমা) এর চেয়ে সহজ ও সরল বাক্য কি কবিতায় প্রয়োগ করা যায়? কিন্তু সেই সরলতার মধ্যেই কবি প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সৃষ্টি করেছেন বাংলার চিরায়ত প্রকৃতির স্বস্তির রূপ। পোড়া দিনে গুড়জলের আরাম যে কী মধুর বাঙালি ছাড়া আর কে বোঝে? তবে শহুরে বাঙালি নয়, গেঁয়ো বাঙালির কাছেই এটি প্রিয়।

তালপাখা তো বৈদ্যুতিক যুগেও গ্রামের মেঠোহাওয়া প্রবাহের মুখ্য মাধ্যম। এই দুই বাক্যে গুড়জল কি কেবলই গুড়জল, তালপাখা কি কেবলই তালপাখা? না, তা নয়। এখানেই কবিতার প্রতীকময়তা। গুড়জল ও তালপাখা এখানে গ্রামীণ বাংলার প্রতিকূল আবহাওয়ায় স্বস্তি ও শ্রান্তিমোচনের প্রতীক। আর কবি যখন বলে, ‘তুমি কি প্রথম বৃষ্টি দারুণ খরার শেষে’, তখন তা কেবল প্রকৃতির অনুষঙ্গ হয়ে থাকে না, মানিবক প্রেমের উৎসারণ হয়েও ধরা পড়ে।

প্রথম প্রেমের অনুভূতির মতো প্রগাঢ়তা নিয়ে উপস্থিত হয় পাঠকের মনে। সুকুমারের কবিতা এভাবেই বোধের গভীরে নাড়া দেয়। আপাত সরল চরণও চিরায়ত পথে হেঁটে যাওয়ার শক্তি ধারণ করে। সুকুমার চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথা আগেই বলেছি, ওই কবিতা উৎসবের চৌহদ্দিতে। তঁঅল ভ্যক্তিজীবন নিয়ে খুব বেশি জানার সুযোগ ঘটেনি।

এছাড়া তাঁর কবিতা সম্পর্কে অন্যদের ধারণাও আমার জানা নেই। তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনার কোনো সমস্যা হয় না। কারণ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত জানার সুযোগ যে, তাঁকে কাছ যেথকে জানার সুযোগের অভাব মনে জাগে না। ‘কবিকে খুঁজো না তাঁর জীবনচরিতে’- একথা সত্য মেনেও কবির সৃষ্টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর পরিপার্শ্ব, তাঁর সময়-মানুষদের সম্পর্কে কিছুটা জানার আগ্রহ তৈরি হয় বৈকি। হয়তো এটি আমার মতো পাঠকের ব্যক্তিগত কৌতূহল, তবু তা সত্য বলেই উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারিনি।

সুকুমার চৌধুরী সরল কবিতা লিখতে গিয়ে গদ্যের বাকভঙ্গিমাকেই অঙ্গীকার করেন। ছন্দ যে তিনি জানে, তার প্রমাণ রয়েছে তাঁর নিরীাধর্মী সনেট-রচনায়। তিনি যেখানে গদ্যে বলতে চেয়েছেন, সেখানে অযথা ছন্দের দোলাকে টেনে আনেননি। সকল কথা হয়তো ছন্দে বলা যায় না। কোথায় যায় আর কোথায় যায় না, কতটুকু যায় আর কতটুকু যায় না, সে ব্যাপারে সুকুমার চৌধুরী সচেতন।

আর ছন্দ জানেন বলেই তাঁর গদ্যকবিতাও পেলবতায় পূর্ণ হয়ে থাকে। কঠিনতার চিত্রকল্প অংকনে সুকুমার চৌধুরী যে সরলতার আশ্রয় নেন, তা অব্যাত থাকলে, হয়ে উঠতে পারে সা¤প্রতিক কবিতার এক নবধারা, যা একান্তই বহির্বঙ্গীয়, যা একান্তই সুকুমারীয়! --------------------------------------------- ড. তপন বাগচী : কবি সাংবাদিক লোকসংস্কৃতিবিদ। ঢাকা, বাংলাদেশ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।