নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'নির্দলীয় সরকার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে সমঝোতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।' (২৩ আগস্ট, সংবাদপত্র দ্রঃ)
এই মতামত তিনি শুধু এখন দিয়েছেন তা নয়। হিলারি ক্লিনটন যখন সর্বশেষে বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন ড. ইউনূস ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদও একসঙ্গে মিডিয়ার সামনে এই মতামত দিয়েছিলেন। তারা দুজনই হিলারি ক্লিনটনকেও তাদের এই মতামত জানিয়েছিলেন। এগুলো মোটেও নতুন কথা নয়। প্রতিদিন অসংখ্য নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রায় একই মতামত দিচ্ছেন।
ড. ইউনূসের এই মতামত প্রকাশের পর কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হঠাৎ আবার নতুন করে ড. ইউনূসের সমালোচনায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। যেন ড. ইউনূস তার মতামত ব্যক্ত করে মহাঅপরাধ করে ফেলেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ড. ইউনূসের বক্তব্যের সমালোচনা অবশ্যই করতে পারেন। কিন্তু তারা বক্তব্যের সমালোচনা না করে ব্যক্তির সমালোচনায় লেগেছেন। এখানেই আমাদের আপত্তি ও প্রতিবাদ।
পাঠক জানেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বর্তমান সরকারের আপত্তি আছে। সরকারের মন্ত্রী বা নেতারা তাদের আপত্তির পয়েন্টগুলো তুলে ধরতে পারেন। অন্যদের বেলায় তা তারা করছেনও। এটাই তো গণতান্ত্রিক রীতি। অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত বলেছেন, 'ড. ইউনূস একজন কৌশলী রাজনীতিবিদ, তবে তিনি রাজনীতিকের পোশাকটা পরতে চান না। এখন তিনি যা করছেন তা একান্তই রাজনীতিবিদের কাজ।' এ কথার অর্থ কী? নির্বাচন বা দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হলে একটা বিশেষ পোশাক পরতে হয়? সেটা কী পোশাক? আমাদের ধারণা, দেশের সব নাগরিকের রাজনীতি নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা আছে। (কিছু পেশা ছাড়া) ড. ইউনূস একজন স্বাধীন মানুষ। তিনি সেই অধিকারেই কথা বলেছেন। মুহিত সাহেবের তাতে অসুবিধে হচ্ছে কেন? আমরা জানি রাজনৈতিক দল করতে হলে ওই দলের পোশাক পরতে হয়। রাজনৈতিক কথা বলার জন্য কোনো পোশাকের দরকার হয় না। কোনো কৌশলও অবলম্বন করতে হয় না।
আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম জানতে চেয়েছেন, 'ড. ইউনূস কার কথায় এই অযাচিত উপদেশ দিচ্ছেন'? ড. ইউনূস এর জবাব ভালো দিতে পারবেন, যদি তিনি জনাব নাসিমের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন। এখানেও জনাব নাসিম ভেবে বসেছেন, ড. ইউনূসের মাথায় কিছু নেই। তিনি এদেশের নির্বাচন বা রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করার মতো বুদ্ধি রাখেন না। তাই জনাব নাসিমের ধারণা, ড. ইউনূস নিশ্চয় কারও পরামর্শ বা বুদ্ধিতে এই মতামত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায় সব সময় তাদের নেত্রীকে খুশি করার জন্য কথা বলেন, বিধায় তারা ড. ইউনূসকেও তাদের মতো মানুষ ভেবে বসেছেন। আমি মনে করি ড. ইউনূস তার দেশপ্রেম ও বিবেচনা বোধ থেকেই এই মতামত দিয়েছেন। কারও কথায় মতামত দেন দলীয় নেতারা। কারণ দলের নেতাদের ক্যারিয়ার একজন নেত্রীর হাতে বন্দী। ড. ইউনূস তো সেরকম দলীয় ব্যক্তি নন। তাকে কেন অন্যের কথায় মতামত দিতে হবে? জনাব নাসিম আরও বলেছেন, 'আপনি অযাচিতভাবে নানা কথা বলছেন।' অযাচিতভাবে মানে কী? জনাব নাসিম ও তার দল হয়তো ড. ইউনূসের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রত্যাশা করেন না। কিন্তু জনাব নাসিম কি জানেন, এদেশের লাখ লাখ মানুষ দেশ ও রাজনীতি নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্য শুনতে আগ্রহী। তবে আমাদের দুঃখ এবং ক্ষোভ ড. ইউনূস দেশের নানা সমস্যা ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে তেমন মতামত দেন না। এবার নির্বাচনী সরকার পদ্ধতি নিয়ে ড. ইউনূস তার মতামত দেওয়াতে অনেকে উৎসাহিত হয়েছেন। আমরা আশা করি তিনি এখন থেকে নিয়মিত দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্পর্কে তার মতামত দেবেন।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এ প্রসঙ্গে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'ড. ইউনূস দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন। তিনি মানিলন্ডারিং করেন। এই সুদখোরকে মানুষ বিশ্বাস করে না।'_ দারুণ! জনাব মতিয়া চৌধুরী কী সূত্রে এত বড় খবরটি পেয়েছেন তা আমাদের জানাননি। কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভার নির্দেশে এনবিআর ড. ইউনূসের দেশি-বিদেশি আয় ও আয়কর নিয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছিল তাতে তো এরকম অভিযোগ ছিল না। এবার মতিয়া চৌধুরী এটা কোথায় পেলেন? নিশ্চয় বিশ্বস্ত সূত্র থেকেই (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়?) পেয়েছেন। ড. ইউনূস সম্পর্কে এটা খুব গুরুতর অভিযোগ, সন্দেহ নেই। এ খবর তো অর্থমন্ত্রীর আগে জানার কথা। কৃষিমন্ত্রীর কাছে এই খবর আগে গেল কীভাবে, সেটা একটা প্রশ্ন। আমি প্রস্তাব করছি, সরকার যেন অতি দ্রুত ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা দেয়। এত বড় অন্যায়ের জন্য ড. ইউনূসের শাস্তি হওয়া উচিত, যদি আদালতে তা প্রমাণিত হয়। সরকার যদি এ ব্যাপারে মামলা না করে তা হলে ড. ইউনূসের উচিত মতিয়া চৌধুরীর নামে মানহানির মামলা করা। মানিলন্ডারিং ইস্যুটার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া উচিত। বেগম মতিয়া চৌধুরী আরও কয়েকটি অভিযোগ করেছেন। শুধু একটি তথ্য দিই। বেগম চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন, 'স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উনি (ইউনূস) কোথায় ছিলেন?' কৃষিমন্ত্রীকে এর উত্তর অর্থমন্ত্রী ভালো দিতে পারবেন। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর একটি বইতে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বেগম মতিয়া চৌধুরী ড. ইউনূসকে শেখ হাসিনার প্রতিধ্বনি করে আবার 'সুদখোর' বলেছেন। এটা খুব অন্যায়। ড. ইউনূস তো কোনো ব্যাংক ব্যবসার সঙ্গে এখন আর জড়িত নন। সুদ নিয়ে এখন তিনি কোনো কাজ করেন না। তা হলে 'সুদখোর' হবেন কীভাবে? বেগম মতিয়া চৌধুরী বাংলাদেশ ও বিদেশের সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে কি 'সুদখোর' বলেন?
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, 'ড. ইউনূস দীর্ঘদিন পরে ঘোমটা ছেড়ে রাজনীতির অঙ্গনে আসলেন।' কীভাবে? একটা রাজনৈতিক মতামত দিলেই কি রাজনীতিতে আসা বলে? ভারতের নোবেলজয়ী ড. অমর্ত্য সেন সম্প্রতি বলেছেন, 'তিনি বিজেপির নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান না।' জনাব ইনু কি বলবেন, এবার অমর্ত্য সেনও রাজনীতির অঙ্গনে আসলেন। হায়রে জনাব ইনুর কাণ্ডজ্ঞান। রাজনৈতিক ব্যাপারে মতামত দিলেই যদি রাজনীতিতে আসা হয় তাহলে যারা কলাম লেখেন ও টিভির টকশোতে প্রতিদিন রাজনৈতিক মতামত দেন তারা সবাই রাজনীতি করছেন? দল করছেন? এটাই কি জনাব ইনুর ধারণা?
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেছেন, 'পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করতে ড. ইউনূস পেছন থেকে ষড়যন্ত্র করছেন।' তাই নাকি? ড. ইউনূসের তাহলে অনেক ক্ষমতা!! পদ্মা সেতু প্রকল্প ছাড়া সরকারের আর কোন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দে বাধা এসেছে তা আমরা জানি না। এটা নতুন খবর। পদ্মা সেতু নিয়ে এত কমিটি, এত শুনানি, এত সাংবাদিকতা হয়েছে কোথাও তো ড. ইউনূস সম্পর্কে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কাদের সম্পর্কে অভিযোগ হয়েছে তা কামরুল ইসলাম ভালো জানেন। জনাব ইসলাম হয়তো ভুলে গেছেন, শেখ হাসিনা অনেক চেষ্টা করেও পদ্মা সেতু স্ক্যান্ডালে ড. ইউনূসকে জড়াতে পারেননি। বাংলাদেশের মানুষ অনুমান করতে পারে কানাডা ও ঢাকায় এই দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে কারা কারা জড়িত। এ নিয়ে বাজারে নানা গুজবও আছে। প্রধানমন্ত্রী ও দু-তিনজন মন্ত্রী ছাড়া ড. ইউনূস সম্পর্কে এরকম অভিযোগ আর কেউ করেননি। এমনকি অর্থমন্ত্রীও নন। একদিন নিশ্চয় মূল ষড়যন্ত্রকারীদের নাম-পরিচয় জানা যাবে।
সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, 'তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকলে ড. ইউনূস কারাগারে থাকতেন।' কারণ ড. ইউনূস সংবিধান অমান্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে মন্ত্রীর ভাষায় 'দেশদ্রোহিতা' করেছেন। বলিহারি! এ না হলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী। ভাগ্যিস তিনি প্রধানমন্ত্রী নন। নইলে টিভি টকশোর কত আলোচক, কত কলামিস্ট, কত বুদ্ধিজীবী এত দিনে কারাগারে থাকতেন কে জানে! শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করার জন্য মাননীয় মন্ত্রী দেশদ্রোহিতার অর্থও ভুলে গেছেন। এই মন্ত্রী হয়তো জানেন না জনগণ চাইলে সংবিধান প্রতিদিন পরিবর্তন করা যায়। সংবিধানের কয়েকটি মৌলিক ধারা ছাড়া প্রতিটি ধারা সম্পর্কে বাংলাদেশের নাগরিক সমালোচনা করার অধিকার রাখে। যে মন্ত্রী ড. ইউনূসকে দেশদ্রোহী বলেছেন তিনি কি সেই মন্ত্রী যিনি যারা হরতালের ডাক দেয় তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যা করার জন্য হুমকি দিয়েছিলেন? যে দেশে একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষ খুন করার ডাক দিতে পারে সেই দেশের শাসন পরিস্থিতি কেমন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরেকজন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, 'ড. ইউনূসের দূতিয়ালির প্রয়োজন নেই। তিনি যেন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়েই থাকেন।' ভালো কথা। ড. ইউনূস যদি দূতিয়ালির কথা না বলতেন তাহলে এই মন্ত্রীরাই বলতেন, 'ড. ইউনূস দেশের প্রয়োজনে কোনো কথা বলেন না।'
মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন কলামিস্ট বলেছেন, 'ড. ইউনূস ও বিএনপির বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা। তিনি যেন বিএনপিতেই যোগ দিয়েছেন।'
ড. ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সমর্থন করেছেন বলেই এ সমালোচনা হচ্ছে। ড. ইউনূস ছাড়াও নাগরিক সমাজের বহু বরেণ্য ব্যক্তি 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' সমর্থন করেছেন। বিএনপি ছাড়াও বহু বিরোধী দল, পেশাজীবী ফোরাম, নাগরিক ফোরাম, কলামিস্ট, টকশোর আলোচক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমর্থন করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা এদের বিএনপিপন্থি বলেন না, বলেন শুধু ড. ইউনূসকে। এর কারণ কী? বিএনপি যা সমর্থন করে অন্য কেউ তা সমর্থন করলে তিনি বিএনপি হয়ে যাবেন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করলে তিনি আওয়ামী লীগ হয়ে যাবেন? এত সরলীকরণ ভালো নয়। ড. ইউনূস রাজনৈতিক বিষয়ে নীরব থাকলে অনেকে খুশি। কারণ তারা জানেন ড. ইউনূসের কথার দাম অনেক বেশি। আমরা চাই ড. ইউনূস দূষিত রাজনীতি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হবেন।
আওয়ামী লীগের এসব মন্ত্রী ও নেতা দাবি করেছেন, 'তারা ড. ইউনূসকে নাকি শ্রদ্ধা করেন। সম্মান করেন। তিনি নাকি দেশের জন্য গৌরব এনেছেন।' তা বটে। তা বটে। দেশবাসী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিলক্ষণ জানেন, আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান সরকার ড. ইউনূসকে কিরকম শ্রদ্ধা করেন ও সম্মান করেন। এটা মুখ ফুটে বলার প্রয়োজন নেই।
ড. ইউনূস নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে শুধু একটি মন্তব্য করাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাথা গরম হয়ে গেছে। তিনি যদি সত্যি সত্যি রাজনীতি করতেন বা দল করতেন বা কোনো দলে যোগ দিতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নেতারা কী করতেন কে জানে। আমরা বুঝতে পারি না, ড. ইউনূসকে নিয়ে আওয়ামী লীগের এত ভয় কেন? তার এত সমালোচনা কেন? তিনি তো ব্যক্তি মাত্র। তার দল নেই, হাজার হাজার কর্মী নেই, তার সঙ্গে সন্ত্রাসী নেই, স্তাবক গোষ্ঠী নেই, টেন্ডারবাজরা নেই, টাকার কুমীররা নেই। যা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকে। একজন নিরীহ ব্যক্তি মাত্র ড. ইউনূস। আওয়ামী লীগ তবু তাকে এত ভয় করে কেন?
লেখক : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।