আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিবন্ধী কারা???

কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।

আমার আজকের পোস্ট কে প্রতিবন্ধী? তা নিয়ে। আমার বড় ভাই, মানসিক প্রতিবন্ধী। আজ তার বয়স ৪২ বছর। আমার বাবা একজন ডাক্তার ছিলেন।

যার সারাটা জীবন তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন এই শিশুদের পিছনে। এই প্রতিবন্ধী একটি শিশুকে নিয়েই আমাদের পরিবারটি আস্থির হয়েছে বহুবার, বহুবার এলোমেলো হয়েছে। তারপর ও আমার ভাইকে তার যগ্যোতা আনুযায়ই সে যা করতে পারবে তা করার সুযোগ করে দিয়েছি। পাগল আর প্রতিবন্ধী এক নয়। আমি তাদের মানসিক প্রতিবন্ধী বলি।

মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর বাবা, মা আমি কখনই হব না এই গর্ব করা হাস্যকর। আপনি আমি যে কেউ এদের বাবা মা ভাই বোন হতে পারি। আজ আমার পরিবারের কেউ প্রতিবন্ধী নয়, কিন্তু কালতো হতে পারে। আমরা এত নিষ্ঠুর আচরন এদের সাথে করি, যা দেখলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কে প্রতিবন্ধী? আমার ভাইকে স্বাভাবিক বাচ্চাদের সাথে মিশতে দিয়েছে আমার বাবা মা। কি ভাবে একজন বাচ্চাকে প্রতিটি কাজ শেখাতে হয় তা আপনারা নুশেরার পোস্টে দেখেছেন।

আমাদের সৌভাগ্য, আমার ভাই অন্য অনেক বাচ্চার মত খুব বেশী প্রতিবন্ধী নয়। আমার ভাই সব কাজই পারে। সবই বুঝে, শুধু বুঝেনা সমাজের জটিল দিকগুলি। ও ব্যাংকের কাজ করতে পারে, বাজার করতে পারে, কিন্তু দরদাম করতে পারে না। ও বাজারে যেয়ে কি কি আনবে সেই চিন্তা করতে পারে না।

ওকে কেউ পরিচালিত করলে ও সব পারে। ও মিউনিসিপ্যল ট্যাক্স জমা দিতে পারে কিন্তু তার কাগজ বের করতে পারে না। সে সবই বুঝে কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না, তার মধ্যে দ্বায়িত্ববোধ আছে কিন্তু কিভাবে করবে তা সে বোঝে না। আমি বোধ হয় তার সীমাবদ্ধটুকু বুঝাতে পেরেছি। এবার তার সফলতার কথা বলি।

ভাইয়া বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি মহাদেশের ২৫টির ও বেশী দেশ ঘুরেছে নিজের যোগ্যতা বলে। ঐ যে বলেছি সে কিছুটা সুস্থ্য। এই কারনেই সে অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের চেয়ে বুদ্ধিমান। তাই সে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। Special Olympic খেলতে যেয়ে ভাইয়া ৪বার গোল্ড মেডেল ও একবার ব্রঞ্চ পদক নিয়ে এসেছে।

বিভিন্ন সেমিনারে তাদের বলা হয় বাংলাদেশের সোনার ছেলে। এই সোনার ছেলেদের বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে বিভিন্ন সার্টিফিকেট। তাদের জন্য বরাদ্দ টাকাটা কোথায় যে কোন খাতে হারিয়ে গেছে কেউ যানে না। আমি অনেক মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে বহু বহু ধর্ণাঢ ব্যাক্তির প্রতিবন্ধী ছেলেদের দেখেছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় দোকানে রাতে ঘুমায় ও প্রতিবন্ধী স্কুলে থাকে সেখানে কাজ করে যে দুই পয়সা পায় তাই দিয়ে ক্ষুধা নিবারন করে। বাবা-মা মারা যাবার পর ভাই বোনেরা তাদের এই প্রতিবন্ধী ভাইটিকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।

আর প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের অবস্থাতো আরও করুন। ভাইয়ার জীবনের অর্ধেক তো পার হয়ে গেছে। ভাইয়াকে নিয়ে আমাদের সমাজ আমাদের যত ভাবে পেরেছে আঘাত করেছে আর আমরা দুর্জয় মনবল ও অসীম সাহস নিয়ে তা মোকাবেলা করেছি। আমার ভাইএর বয়স ৪২ বছর। আমি অবাক হয়ে দেখি এই অর্ধশতক পার হয়ে যাবার পরও এই দেশের এই সমাজের মানুষের কোন পরিবর্তন হয়নি।

যদি কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে তো তা নিচের দিকেই ধাবমান। আমার ভাইএর দুইটি ফুটফুটে মেয়ে। বড়টা ক্লাশ সেভেনে পড়ে। ছোট্টটি পড়ে প্লেগ্রুপে। বড়টি ক্লাশ ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে।

ঢাকা শহরের স্বনামধন্য এক স্কুলের ছাত্রী সে। এবারে এই মেয়েটির কথা বলি। কোন ব্যাপারে বিতর্ক হলে ওকে ওর এক সহপাঠী বলে--- তোর বাপতো পাগল, তোর আবার এত সাহস কত্থেকে হয়? এই শুরু, প্রায়ই ঐ সহপাঠী তাকে তার বাবার কথা বলে উত্ত্যক্ত করে। এই আভিযোগ শিক্ষকের কাছে দিলে সেই শিক্ষক বলেছে “আসলে ও তো সচীবের মেয়ে একটু মন খারাপ হয়েছে তাই বলেছে। আমি নিষেধ করেছি।

“ ভাইয়ার মেয়েটা তার ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল। তার মার্ক্স সব সময় ২য় গার্লের চেয়ে ১০/১৫ মার্ক্স বেশী থাকে এটা তার অপরাধ, অনেক অভিভাবক ও তার এই সাফল্য মানতে পারে না। ওর চলার পথ রুদ্ধ করবার জন্য ব্যস্ত তারা। তাকে বলে ----এই তোমাকে কে পড়ায়, তোমার পাগল বাবা? ও নাচে ভালো, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ছাত্রী ছিল। এখন নাকি তাকে কোন কোন মেয়ে এবং তাদের অভিভাবকরা ডেকে জিজ্ঞাসা করে-- তুমি নাচ না কেন? তুমি না নাচলে তোমার পাগল বাবার কিভাবে চলবে? আমার মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ফোন করে বলে--“ আর কত কাল আমি এসব কথা শুনব।

আমি তো ছেলেটা জন্মের পর থেকেই যুদ্ধ করে যাচ্ছি। ভাবলাম নাতনিরা হয়েছে আমার যুদ্ধ শেষ। এখনতো দেখছি নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে হচ্ছে। “ ভাইয়ার মেয়েটা ফোন করে বলল “ফুমনি আমি তোমার কাছে থাকবো আমাকে নিয়ে যাও। ওখানে তো কেউ আমার বাবা কি করে তা জানবে না?” যেদিন ভাইয়া প্রথম স্বর্নপদক গলায় ঝুলিয়ে প্লেন থেকে নেমেছে -তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়া তাদের এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে গ্রহন করেছে, সেই দিন যেভাবে অসম্ভব আনন্দে কেঁদেছিলাম -- এতদিন পরে আবার ঠিক সে ভাবেই কাদঁছি ঠিক তার বিপরীত কারনে।

কোন আহ্‌ উহ্‌ শোনবার জন্য আজ আমার এই পোস্ট না। কোন সমবেদনা জানাতে পারলে বলবেন, প্লিজ করুনা করবেন না। কোন প্রতিবন্ধী করুনার পাত্র হতে পারেনা। আপনাদের নিষ্ঠুরতা অনেক দেখেছি, দেখছি আরও হয়ত দেখব যতই বলি আমাদের নিষ্ঠূরতা দেখাবেন না ততই আপনারা মজা পান। কি করব বলুন? সয়ং সৃষ্টিকর্তাই তো আমাদের চরম নিষ্ঠূরতা দেখাতে পিছপা হন নাই।

তবুও এই প্রতিবন্ধী শিশুদের সাথে গেয়ে যাই"" আমরা করব জয়, আমরা করব জয় একদিন। "

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.